আমি মানুষের ব্যাকরণ
জীবনের পুষ্পিত বিজ্ঞান
আমি সভ্যতার শুভ্রতার মৌল উপাদান
আমাকে চিনতেই হবে।
তাকালেই চিনবে আমাকে।
তার প্রকাশিত কবিতা সর্বসাকুল্যে একাত্তর। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ছয় শব্দের একটি গল্প লিখে অবাক করে দিয়েছিলেন। হেলালের এই একাত্তরটি কবিতার মধ্যে এক-দুলাইনের কবিতাও আছে। এত কম কবিতা লিখে একজন কবি শুধু একটি দেশে নয়, এই উপমহাদেশে, বিশ্বসাহিত্য প্রাঙ্গণে প্রথম সারির অবিশ্বাস্যভাবে এক জনপ্রিয় কবি হিসেবে স্বীকৃত ও সমাদৃত।
‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’......। এই নিষিদ্ধ ইস্তাহার নিয়ে ১৯৬৯ সালে যখন তিনি প্রথম এলেন তখন এই কবিতা পড়ে কুসুমিত ইস্পাতের কবি হুমায়ুন কবিরের মনে হয়েছিল আর যদি একটা কবিতাও না লেখেন তাহলেও হেলাল কবি হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন।
পরানের পাখি তুমি একবার সেই কথা কও,
আমার সূর্যের কথা, কাক্সিক্ষত দিনের কথা,
সুশোভন স্বপ্নের কথাটা বলো,- শুনুক মানুষ।
তিনি একমাত্র কবি যিনি উত্তর বঙ্গবন্ধু কালকে আকালের বাংলাদেশ বলে অভিযুক্ত করে সাহসী সাম্যবাদী কবিতা ‘একটি পতাকা পেলে’তে লিখেছেন
‘কথা ছিল একটি পতাকা পেলে
পতাকা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে
ওম নেবে জাতীয় সঙ্গীত শুনে পাতার মর্মরে’
পাতা কুড়োনির মেয়ের কথাও তিনি মনে রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু তো স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণার সময় এদের কথাও ভেবেছিলেন। ফিদেল কাস্ত্রোর বন্ধু সুহৃদ বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে
‘ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান
বাঁচবে যুদ্ধশিশু সসম্মানে সাদা দুধে ভাতে’
ক’জন কবি এমনভাবে রক্তচক্ষু শাসকের সামনে বঙ্গবন্ধুবিরোধী শক্তি যখন ক্ষমতায় তখন লোভ ভয় জয় করে বলতে পেরেছিলেন:
‘কথাছিল একটি পতাকা পেলে
আমাদের সব দুঃখ জমা দেবে যৌথ খামারে।
সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ
সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।’
এই কমিউন ভাবনার কথা কখন ঘোষণা করছেন হেলাল হাফিজ যখন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি প্রায় শেষ, বিপন্ন, অনেকে শাসকের ভয়ে, কখনও প্রলোভনে দয়া নেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে। হেলাল অকুতোভয়, কারণ তিনি সৎ। কিছু পাওয়ার ইচ্ছাকে তিনি ঘৃণা করে এসেছেন প্রথমাবধি। তিনি ভেবেছেন কবে আসবে দুখু মিয়াদের হাসির দিন, পতাকুড়ানি মেয়েটির মুখের ভাঁজে তরল সুখ থমকে থাকবে; গোলা ভরা শস্যের অধিকার রাষ্ট্র ভাগবাঁটোয়ারা করে দেবে প্রয়োজন মতো।
মনে পড়ছে কবি তার ‘যার যেখানে জায়গা’ কবিতায় কি শোনালেন:
‘ভোলায়া ভালায়া আর কথা দিয়া কতোদিন ঠগাইবেন মানুষ
ভাবছেন অহনো তাদের হয় না হুঁশ।
গোছায়া গোছায়া লন বেশি দিন পাইবেন না সময়
আলামত দেখতাছি মানুষের অইবোই জয়।’
কোন মানুষ?
‘কলিমুদ্দিনের পোলা চিডি দিয়া জানাইছে- ভাই
আইতেছি টাউন দেখতে একসাথে আমরা সবাই,
নগরের ধাপ্পাবাজ মানুষেরও কইও রেডি ওইতে
বেদম মাইরের মুখে কতোক্ষণ পারবো দাঁড়াইতে’
এত গ্রাম থেকে শহর ঘেরার মাওবাদী ভাবনা। কারা দেবে জনগণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব? কলিমুদ্দিনের পোলা- যুবক-যুবতী। কখন লিখছেন এ কবিতা? ১৯৮১-তে যখন বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার পর শাসন করছে দেশ তারাই যারা তার অস্তিত্ব মুছে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের নতুন ইতিহাস লিখছেন।
একজন কবি সেই রাজনীতিকদের সামনে দাঁড়িয়ে তখনি বলতে পারেন এ কথা সততাকে রক্ষা বর্ম করে যখন তিনি দেশ ও দেশের মেহনতি মানুষের কষ্টে অস্থির
‘কোনদিন খোঁজ লইছেন গ্রামের লোকের সোজা মন/
কী কী চায়, কতোখানি চায়
কয়দিন খায় আর কতোবেলা না খায়া কাটায়’
এখন তিনি বলেন শুনি যেন কার চরণধ্বনী রে- কোনো অভিযোগ অনুযোগ নেই এই কিছু না চাওয়া কিছু না পাওয়া মানুষটির। আগেও ছিল না। এখন যখন অসুখ ছোবল দিয়ে যাচ্ছে তখনও তিনি বলে যেতে পারেন মূক অভিব্যক্তিকে- বেদনাকে বলেছি কেঁদো না।
মনে পড়ছে ‘নেত্রকোনা’ কবিতায়। তিনি বলেছিলেন:
দোহাই লক্ষ্মী মেয়ে কোনদিন জিজ্ঞেস করো না
আমি কেন এমন হলাম, জানতে চেও না
কী এমন অভিমানে...।’
এই কবিতার এক জায়গায় বললেন
‘কিছু কথা অকথিত থেকে যায়’
এখনো তিনি মৃদু হেসে বলেন
‘আমার দুঃখ আছে কিন্তু আমি দুখী নই’
এমন একজন মহান কবি সম্বন্ধে কিছু বলার জন্য উদগ্রীব ছিলাম। বারবার পড়েছি তার সব কবিতা।
হেলাল হাফিজের সব কবিতার আলোচনা, ব্যক্তি ও কবি হেলালের জানা অজানা দিকের ওপর আলোকপাত করতে চেষ্টা করছি ‘রেটিনার লোনা জলে উত্তরাধিকার’ নামের বইটিতে।
আমি বিশ্বাস করি বাংলা কবিতার পৃথিবীতে তিনি এক অবিনস্বর, অজেয়, অমর নাম।