সাইনোপসিসঃ
আমাদের মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত, বা নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষদের অনেকেরই সুন্দর, স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের স্বপ দেখার সাহসটুকুও অনেক সময় থাকে না। এরকম একটি পরিবারের ছেলে রিন্টু। উচ্চ শিক্ষিত। এ দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, বা নিম্নবিত্ত পরিবারের উচ্চ শিক্ষিত সন্তানের প্রথম স্বপ্ন-একটা চাকরি। রিন্টুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। প্রেমের স্বপ্নও জেগে উঠে হৃদয়ে, যেহেতু একটা হৃদয়ের অধিকারী সে। কখনো কখনো কারও স্বপ্ন সম্পূর্ণ না হলেও কিছু কিছু পুরণ হয়, কেউ কেউ আবার স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু পেয়ে যায়। রিন্টুর ক্ষেত্রে অনেক রকম কিছুই হতে পারতো। চাকরি, প্রেম, স্বচ্ছল জীবন। কিন্তু শেষ দেখার আগেই নিয়তির নির্মম পরিহাসে তাকে সব খেলা সাঙ্গ করে চলে যেতে হয়। পাঠকের জন্য রিন্টু রেখে যায় দু’ফোটা অশ্রু, অথবা একটা দীর্ঘশ্বাস। এ ছাড়া তার আর কিছুই করার ছিল না। তবে তার সাথে জড়িয়ে যাওয়া চরিত্রগুলোরও অনেকটা গুরুত্ব রয়ে গেছে।
এক
মাকে বললাম-‘মা, কিছু টাকা দাও।’
মা বলল-‘কত?’
-‘শ’ দু’য়েক হলেই চলবে।’
-‘কেন?’
মা এমনভাবে প্রশ্ন করল আমি যেন ছোট শিশু। টাকা নিয়ে চকলেট, ট্রফি খেয়ে দাঁত নষ্ট করবো। আইসক্রিম খেয়ে নিউমোনিয়া বাঁধাবো। বললাম-‘একটা ইন্টারভিউ দিতে যাব।’
-‘কী চাকরি?’
-‘সরকারের একটা মন্ত্রণালয়ে কো-অর্ডিনেটর পদে।’
-‘পদ কয়টি?’
-‘তিনটি।’
-‘যাবার দরকার নেই।’
-‘কেন?’
-‘ঐ তিনটি পদের কোনোটিই তোর জন্য শূন্য পড়ে রয়নি।’
-‘কী বলছো?’
-‘ঠিকই বলছি, ইন্টারভিউটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।’
আমি চাকরি পাচ্ছি না বলে সবসময় নিজেকেই দোষ দিয়ে এসেছি। দেখলাম মা সেভাবে আমাকে দোষ দেয় না। এদেশের চাকরিদাতাদের (বিশেষ করে সরকারি চাকরি দাতাদের) সম্পর্কে আমার মায়ের ইতিবাচক ধারণা নেই।
আর কোনো কথা না বলে আমি চলে এলাম নিজের ঘরে। দরজা ভিজিয়ে দিলাম। ফুল স্পীডে পাখা ছেড়ে খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। কী একটা গল্পে পড়েছিলাম, বেকার নায়ক শুয়ে শুয়ে ভাবে-বড় একটা তুলি পেলে সে ছাদে ছবি আঁকতে পারতো। সেরকম ইচ্ছে আমার হলো না, কারন ছবি আঁকার দক্ষতা আমার নেই। আমি ক্যাসেট প্লেয়ারে গান ছেড়ে দিলাম। আমার প্রিয় একটি গান। ওপারের শিল্পী অঞ্জন দত্তের-হ্যালো, এটা কি ২৪৪১১৩৯।
যুবকটি একটা চাকরির জন্য ভালবাসার মানুষটিকে নিয়ে লাল-নীল সংসার সাজাতে পারছিল না। যখন চাকরি হল তখন দেখে ভালবাসার মানুষটি নেই। সত্যিই দু:খজনক ব্যাপার। আমি বেকার তা ঠিক; কিন্তু আমার তো কোনো ভালবাসার মানুষ নেই। কাউকে নিয়ে লাল-নীল সংসার সাজানোর স্বপ্ন আমার বুকে বাসা বাঁধেনি কখনো। তাহলে গানটি আমার এত প্রিয় হয়ে উঠলো কেন?
গানের এই যুবক অনেক দেরিতে হলেও-প্রিয় প্রেমিকাকে হারানোর পরে হলেও, শেষ পর্যন্ত একটা চাকরি পেয়েছিল। আমার কপালে বোধহয় কোনোদিনই চাকরি জুটবে না। আমার এলোমেলো ভাবনার স্রোতে বাঁধা ফেলে আমার ছোট বোন ছয় বছরের নুপুর দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো। ওর হাতে সেলফোন। ওটা ওর নিত্য সঙ্গী। যেন ওর খেলার পুতুল। এই ডিজিটাল বাংলাদেশে বর্তমানে একেক জনের তিন/চারটি মোবাইল সেট এবং কুড়ি/পঁচিশটা সীমাকার্ড থাকলেও আমাদের বাসার সবার জন্য এই একটি মাত্র মোবাইল সেট এবং একটি মাত্র সীমকার্ড। ল্যান্ডফোন যেমন বাসার সবার জন্য একটি থাকে তেমন। এবং এই সেটটি থাকে নুপুরের কাছে। বাসায় যত ফোন আসে-বিশেষ করে নুপুরের জেগে থাকার মুহূর্তে তার সবগুলো ওর রিসিভ করা চাই। বলবে-হ্যালো, কাকে চাচ্ছেন? তারপর যাকে চাইবে মোবাইলটা নিয়ে ছুটে যাবে তার কাছে। কখনো আমার কাছে, কখনো মা’র কাছে, কখনো বাবার কাছে। ভালই লাগে ওর এই ছুটোছুটি। আবার কোনো নাম্বার পেলে নুপুর সে নাম্বারে ফোন করে বসে। এখনো সে মেমোরিতে সেভ করা নাম্বার বের করতে শেখেনি। একাজটা শিখলে কী হবে তা ভাবলে আমার শরীর দিয়ে ঘাম ছুটে যায়। তখন মেমোরির সব নাম্বার মুছে ফেলতে হবে নিশ্চয়।
নুপুর এসে বলল-‘দাদা, ফোন যাচ্ছে না কেন? মেয়েটা বলছে সরি, রঙ নাম্বার।’
আমি নাম্বারটা এক পলকে দেখে বললাম-‘এটা তো টিএন্ডটি নাম্বার সামনে ০২ দিতে হবে। নুপুর বলল-‘দিয়ে দাও।’ বললাম-‘কার কাছে ফোন করেছিস তুই?’
-‘বেলা বোসের কাছে।’
-‘বেলা বোস!’
বিস্ময়ের ঘোর কাটলে হেসে উঠলাম হো হো করে। বললাম-‘বেলা বোসের কাছে ফোন করে লাভ নেই। সে ধরবে না।’
-‘কেন ধরবে না?’
-‘কারণ সে বাসায় নেই।’
-‘কোথায় গেছে?’
-‘শ্বশুর বাড়ি।’
-‘কে বললো তোমাকে?’
-‘কেউ বলেনি।’
-‘তাহলে জানলে কেমন করে?’
-‘আমি বুঝে নিলাম।’
-‘বুঝে নিলে কেন?’
সমুদ্রের অগণিত ঢেউয়ের মতো একের পর এক প্রশ্ন। নুপুরের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে দিতে ওর কৌতুহলের নিবৃত্তি না ঘটানো পর্যন্ত প্রশ্নবাণ থেকে মুক্তি নেই। বললাম-‘সে যদি থাকতো তাহলে ঐ ছেলেটার ফোন ধরতো নিশ্চয়।’
-‘তবু তুমি একবার তাকে ফোন কর।’
-‘যে নেই তার কাছে ফোন করে কী লাভ?’
-‘না কর।’
নুপুর যখন বলেছে তখন আমাকে বেলা বোসের কাছে ফোন করতেই হবে। কী করে ওকে বোঝাব যে, এই সাবকন্টিনেন্টে বেলা বোস বলে হয়তো একাধিক মেয়ে আছে, কিন্তু তাদের কারোরই ২৪৪১১৩৯ ফোন নাম্বার নেই। অগত্যা নাম্বরটির সামনে ০২ দিয়ে কল করলাম।
অদ্ভূত কান্ড! কল ঢুকে গেছে। রিং হচ্ছে। কিন্তু তা কী কররে সম্ভব? আমি মোবাইলটি কান থেকে সরিয়ে মাথাটা ডানে-বামে ঝাঁকালাম। নিজের মধ্যে কোনো সমস্যা থাকলে চলে যাবে এই ভেবে। তারপর মোবাইলটা আবার কানের কাছে নিলাম। না, কোনো ভুল নয়। ঠিক ঠিক রিং হচ্ছে। একটু পর ওপার থেকে মিষ্টি একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এল-‘হ্যালো।’
আমি মোবাইলটা ছুড়ে ফেলতে যাচ্ছিলাম প্রায়। ভৌতিক কোনো ব্যাপার-স্যাপার হয়তো। কন্ঠটা আবার বলল-‘হ্যালো, কাকে চাচ্ছিলেন?’ আমি বললাম-‘আমি বেলা......।’
-‘হ্যাঁ, আমি বেলা বলছি। বলুন কী বলতে চান?’
আমি নিশ্চিত হলাম যে, আমার মাথায় কোনো গোলমাল বেঁধে গেছে। ২৪৪১১৩৯ নম্বরে ফোন ঢুকেছে তাও ধরেছে স্বয়ং বেলা বোস। মাথায় গোলমাল যখন বেঁধেছেই তখন এর শেষ দেখে নিতে চাইলাম। বললাম-‘আপনার সঙ্গে আমার বিশেষ আলাপ আছে, তার আগে আমার ছোট বোন ছয় বছরের নুপুরের সঙ্গে একটু কথা বলুন।’
নুপুর মোবাইলটা কানে নিয়ে বলল-‘হ্যালো, তুমি কে?’
পরক্ষণেই নুপুর উচ্ছসিত কন্ঠে চিৎকার করে বলল-‘দাদা, তুমি বলেছিলে বেলা বোস শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে। কই, এইতো বেলা বোস কথা বলছে।’
আমি ভীষণ ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। আমি বেকার মানুষ। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে না গিয়ে হতাশা নিয়ে শুয়েছি নিজের ঘরে। হতাশার গান ছেড়েছি। আমার মাথায় গোন্ডগোল হতেও পারে। কিন্তু নুপুর তো ছোট মানুষ। ওর মধ্যে তো কোনো হতাশা নেই। ওর তো কোনো হ্যালুসিনেশনের মতো ব্যাপার হবার কথা নয়। এরই মাঝে মা নুপুরকে খাওয়াতে নিয়ে গেল। আমি মোবাইলটা আবার আমার কানে নিয়ে খাটের ওপর শুয়ে পড়লাম। বললাম-‘আমি কিন্তু ২৪৪১১৩৯ এ ফোন করেছিলাম।’
-‘জ্বি না, আপনি ফোন করেছেন ২৪৪১১৩৮ এ।’
-‘বলেন কী! আমার ছোট বোন নুপুর বেলা বোসের কাছে ফোন করতে চেয়েছিল.........।’
-‘একটা নাম্বার ভুল টেপার কারণে ফোনটা চলে এসেছে বেলা মল্লিকের কাছে।’
আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। বললাম-‘দুঃখিত, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।’
-‘এতে দুঃখিত হবার কিছু নেই। মানুষ মাত্রই ভুল আছে-ম্যান ইজ মর্টাল।’
-‘কী ইংরেজি বললেন!’
-কেন, ভুল বলেছি?’
-‘হ্যাঁ......।’
-‘হি-হি-হি।’
তার আচানক হাসিতে আমি একটু নার্ভাস হলাম। বুঝলাম, ভুলটা তার ইচ্ছাকৃত। আমি বললাম-‘রাখি তাহলে।’
-‘রাখবেন কেন? একটু কথা বলি। আপনার হাতে কি এখন কোনো জরুরি কাজ আছে?’
-‘জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো জরুরি কাজ কেউ আমাকে দেয়নি। শুয়ে শুয়ে ছাদ দেখা আমার সবচেয়ে জরুরি কাজ।’
-‘তার মানে আপিন বেকার যুবক?’
বুঝলাম, সে বুদ্ধিমতি মেয়ে। অনুমান ক্ষমতা তীক্ষè। বললাম-‘ঠিক ধরেছেন।’
-‘তাহলে ভালই হল-গল্প-টল্প করা যাবে।’
-‘গল্প-টল্প যাবে! কী গল্প করবেন আমার সঙ্গে?’
-‘খুঁজে পাওয়া যাবে।’
-‘ফোনে বর্তমানে অনেক ধরনের ক্রাইম হচ্ছে। আমি কোনো বখাটে ছেলে কিনা.....।’
-‘না, আপনি তা হবেন না।’
-‘কেমন করে বুঝলেন?’
-‘বখাটেরা কোনো মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলে আহলাদে গদগদ হয়ে। আর আপনার মধ্যে যথেষ্ট নার্ভাসনেস কাজ করছে।’
-‘তাই? না না, তা হবে কেন? নার্ভাসনেসের কী আছে?’
-‘হ-হি-হি।’
আমি কন্ঠের নার্ভাসনেস দূর করতে চাইলাম। বেশ সাবলিলভাবে বললাম-‘আপনার বাসায় এখন কেউ নেই?’
-‘না, বাবা কলেজে-মা স্কুলে। আর মামা বেরিয়েছেন উত্তর মুগদায় ঢাকনা খোলা ম্যানহোল গুনতে।’
-‘ব্যাপারটা বুঝলাম না। ঢাকনা খোলা ম্যানহোল গুনবেন কেন? উনি কি সিটি কর্পেরেশনের কেউ?’
-‘না, সব বুঝিয়ে বলবো। এবার বলুন আপনার নামটা কী?’
-‘রিন্টু।’
-‘আপনি কি কোনো টিনএজ বয়?’
-‘টিনএজ বয়রা কি বেকার যুবক হয়? আমি চার বছর আগে মাস্টার্স শেষ করেছি।’
-‘মানে রিন্টু নামটা টিনএজদের ভাল মানায়। আমার বান্ধবীর ছোট ভাইয়ের নাম রিন্টু। ও ক্লাশ নাইনে পড়ে। ও খুব অদ্ভূত কেসিমের ছেলে। আজ পনেরো দিন হল একই টি-শার্ট পরে আছে। ঘামের গন্ধে ওর আশেপাশে যাওয়া যায় না।’
-‘একই টি-শার্ট পনেরো দিন ধরে পরে আছে কেন?’
-‘ওর টি-শার্টের পেছেনে দেশের একজন মধ্যম মানের কবি অটোগ্রাফ দিয়েছেন। আজিজ সুপার মার্কেটে তাঁর সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল।’
-‘ও, তবে ওই রিন্টুও তো একদিন আমার বয়সী হবে-একদিন বৃদ্ধ হবে। নাকি হবে না?’
-‘তা হবে। আচ্ছা, আপনি মূলত করেন কী?’
-‘আশ্চার্য! বেকার মানুষরা কী করে তা অনুমান করতে পারেন না?’
-‘না, বেকার মানুষদের কাজ অনুমান করা কঠিন। কারণ তাদের একেক জনের কাজের ধরণ একেক রকম। কেউ সন্ধ্যা বেলা ফুটপাথে হাঁটে, কেউ হাঁটে রাত দুপুরে, কেউবা সারা রাত ছাদে বসে থাকে আর দিনের বেলা ঘুমায়। কেউ হাতে নেয় একটার পর একটা প্রজেক্ট।’
-‘আমি বেশির ভাগ সময় ঘরে শুয়ে শুয়ে ছাদ দেখি-দেয়ালে নানা রকম ছায়া দেখি। আমি খাঁটে শোয়ামাত্র একটা টিকটিকি আমার সামনের দেয়ালে চলে আসে। আমার ধারণা ও আমাকে ভালবাসে। আমাকে সঙ্গ দিতে চায় অথবা আমার সঙ্গ পছন্দ করে।’
-‘আচ্ছা, আপনার চাকরি-বাকরি হচ্ছে না কেন?’
-‘এ কারণটা খুঁজে দেখিনি।’
-‘আপনি কি হাঁদা টাইপের মানুষ?’
-‘হাঁদা টাইপ মানে কী?’
-‘মানে ভেতরে কোনো প্যাঁচ নেই। সবাইকে বিশ্বাস করেন। কোনো ব্যাপারে কাউকে দোষ দেন না। ছল-চাতুরী করেনও না, বোঝেনও না।’
-‘নিজের কথা নিজে বলি কেমন করে?’
-‘অন্যেরা কী বলে?’
-‘অন্যেরা আমাকে এরকমই ভাবে।’
-‘এরকম কী রকম?’
-‘আপনি যেমন বললেন।’
-‘তাহলেই সেরেছে। আপনাকেও অদূর ভবিষ্যতে মামার মতো কোনো আয়হীন মানব কল্যানমুখী কাজে নামতে হবে।’
-‘বুঝলাম না কিছু।’
-‘সব বুঝিয়ে দেব। এবার আমার মোবাইল নাম্বারটা লিখে নিন, আর আপনার নাম্বারটা বলুন।’
-‘আবার নাম্বার বিনিময় কেন?’
-‘পরে যোগাযোগ করবো।’
-‘আবার যোগাযোগ কেন?’
-‘হাঁদা টাইপের মানুষের সাথে কথা বলতে আমার ভাল লাগে তাই।’
আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম। বুঝলাম, মেয়েটার মুখে কিছু আটকায় না। আবার মনে রাগও হলো মনে। সে আমাকে বোকা ভাবছে।
দুই
রাতে নুপুরকে ছোট হাতে ইংরেজি লেটার শিখাচ্ছিলাম। কিন্তু শেখাতে পারছিলাম না। সে ছোট হাতের বলতে ছোট করে লেখাকে বোঝে। তাই সে অ কে ছোট করে অ লিখতে চাচ্ছে। কিন্তু অ কে ধ লিখতে চাচ্ছে না। ওর কথা-‘এটা তো অন্য রকম হয়ে গেল!’
টানা পয়তাল্লিশ মিনিট চেষ্টার পরও যখন কিছু হল না, তখন আমি ক্ষান্ত দিলাম। পাখাটা বাড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। নুপুরকে বললাম-‘আমার চুল টেনে দে’।’ নুপুর একাজটা খুব মনোযোগে করে।
ঘুমের মতো এসে গিয়েছিল। নুপুর মাথায় হাত দিলে আমার ঘুম এসে যায়। এ অবস্থায় মোবাইল বেজে উঠল। ধরার ইচ্ছে ছিল না। মোবাইল বাজাটা বেশিরভাগ মানুষের কাছে আনন্দের। কিন্তু আমার কাছে তা নয়। মোবাইলে কেউ আমাকে কখনো বলবে না-‘তোমার একটা চাকরি হয়েছে। ভাল চাকরি। বেতন......।’ অথবা বলবে না কেউ কোনো ভালবাসার কথা। আতœীয়-স্বজনের ফোন তো ধরাই ছেড়ে দিয়েছি। সবারই প্রথম প্রশ্ন-কিরে, চাকরি-বাকরি কিছ হল?
আমি সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি বোধ করি ছোট খালা ফোন করলে। সে আমার উত্তর-প্রতিউত্তরের ধার ধারে না। বলে যায় তার মতো-‘কিরে, আর কত দিন এভাবে থাকবি? তোর বয়সি ছেলেরা বিয়ে থা করে ছেলেপুলে নিয়ে সংসার করছে। আচ্ছা, তোর সমস্যা কি বলতো? তুই কি আন্টারভিউতে কোনো প্রশ্নের উত্তরই দিতে পারিস না? তোর খালু নাকি জীবনের প্রথম ইন্টারভিউতে গিয়ে ভীষণ পেচ্ছাবের চাপে পড়েছিল। তোর কি এরকম কিছু হয়? কাপড়-টাপড় ভিজিয়েছিস কখনো?’
নুপুর উঠে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো। এক দমে বলে চললো-‘হ্যালো, কে? ও বেলা বোস? কেমন আছো? আমি খুব ভাল আছি। আমি দাদার কাছে ছোট হাতের ইংরেজি লেখা শিখছি। দাদা শেখাতে পারছে না। দাদা যেটা বলে সেটা ছোট হাতের হয় না, অন্য রকম হয়। আমি এখন দাদার চুল টেনে দিচ্ছি। দাদাকে দেব? আচ্ছা দিচ্ছি।’
বেলা যে আবার ফোন করবে আমি তা ভাবিনি। আমার হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে নুপুর দৌড়ে চলে গেল। অনেকক্ষণ লেখাপড়া নিয়ে থেকে হাফিয়ে উঠেছিল কি-না। এখন বাবার সঙ্গে গল্প করবে। ডালিম কুমার আর কঙ্কাবতীর গল্প। ডালিম কুমার ভ্রমরাকে এক কোপে কেটে ফেলেছিল। এটা তার কাছে মহাবিস্ময়। তার ধারণা এরকম কাজ আর কেউ পারবে না। আমাকে সে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে-দাদা, তুমি কি এক কোপে ভ্রমরাকে কেটে ফেলতে পারবে? যদি বলি পারবো সে তা বিশ্বাস করে না।
আমি মোবাইল কানে ধরে বললাম-‘হ্যালো, এত রাতে......?’
-‘ডিসটার্ব করলাম বুঝি?’
-‘না না, ডিসটার্ব হবে কেন? আমি তো আর কিছু করছিলাম না।’
-‘বেকার মানুষের ব্যাপারে এই একটা সুবিধা যে, কোনো কিছুতে তাদের ডিসটার্ব হয় না। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, কোনো বেকার ছেলেকে বিয়ে করি। সব সময় কাছে কাছে থাকবে।’
-‘আর আপনি প্রতি মুহূর্তে বেকার বেকার বলে খোটা দিতে পারবেন।’
-‘হি-হি-হি।’
মনে হলো নিজের বেকারত্বের কথা বলে ভাল ধরা খেয়ে গেছি। বেলা বলল-‘নুপুরের ছোট হাতের এ বি সি শেখানো কতদূর?’
-‘মাটি থেকে আকাশ যতদূর।’
-‘হি-হি-হি। ছোট হাতের লেখা ছোট করে লিখবেন। অন্য রকম লিখলে হবে কেন? হি-হি-হি।’
আমি ইতোপূর্বে মোবাইলে কোনো মেয়ের হাসি শুনিনি। মেয়েদের হাসি শুনবো কিভাবে? ছোট খালা ছাড়া আর কোন মেয়ের সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছে?
বেলার হাসি আমার কাছে খুব মধুময় লাগলো। সব মেয়ের হাসিই কি এমন মধুময়, নাকি বেলার......? আমি বললাম-‘আপনার মামা উত্তর মুগদায় কতগুলো ঢাকনা খোলা ম্যানহোল পেলেন?’
-‘চৌদ্দটা। তারপমধ্যে নয়টার ঢাকনা একেবারেই নেই, পাঁচটার দূরে সরানো। দু’একদিনের মধ্যে সেগুলোও হাওয়া হয়ে যাবে। আচ্ছা, ঢাকানাগুলো চুরি হয় কেমন করে? এগুলো দিয়ে চোররা করেই বা কী?’
-‘সরি, এসব ব্যাপারে আমি কখনো ভাবিনি। কাল আবার আপনার মামা কোন দিকে যাবেন?’
-‘বোধহয় দক্ষিণ মুগদায়।’
-‘এই ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল গণনার রহস্যটা কিন্তু বলছেন না?’
-‘বলবো, সব বুঝিয়ে বলবো-একটু অপেক্ষা করুন।’
তিন
পরদিন সকাল নয়টা। কোনো ইন্টারভিউ নেই। চাকরিজীবীরা যেমন টাইম দেখে অফিসে যায়, আমি তেমন যাই ইন্টারভিউ দিতে। চাকরিজীবীদের অফিস বন্ধ থাকলে যেমন সময় কাটতে চায় না, ইন্টারভিউ না থাকলে আমারও তেমন। আমি নাস্তা সেরে আবার বিছানায় গেলাম। হাতে বুদ্ধদেব বসুর কালো গোলাপ। দু’পাতা পড়ার পর আর পড়তে ইচ্ছে হল না। অন্য কিছু করতে মন চাইল। অন্য কী করবো? আমি আর কী পারি? ছবি আঁকতে পারি না। গান গাইতে পারি না। বেকার থাকলে সবাই নিজের হতভাগ্য নিয়ে দু’একটি কবিতা লেখে। আমি সে কাজও পারি না। হঠাৎ ইচ্ছে হল বেলাকে ফোন করতে। ইচ্ছেটা মনে জেগে ওঠা মাত্র লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। মনের ভেতর থেকে কে যেন বলল-আশ্চার্য! তুমি তাকে ফোন করবে কেন? আবার আরেকজন উত্তর দিল-করলে ক্ষতি কি? সেও তো একবার এমনি এমনি ফোন করেছিল।
শেষে জয়ি হল মনের ভেতর বসত করা দ্বিতীয় জন। আমি মোবাইল নিয়ে বেলার নাম্বার টিপলাম। রিং বাজতেই আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। মনে হল ফোন কেটে দেই। কিন্তু কাটতে পারলাম না। বেলা ভাববে, আমি মিস কল দিচ্ছি। যে মুখ পাতলা মেয়ে। ফোন করে বলবে-ব্যাপার কি, টিনএজ ছেলের মতো মিস কল দিচ্ছেন কেন?
কল রিসিভ হল। ওপার থেকে খুব ভরাট, গম্ভীর ও ঘুম জরানো কন্ঠ ভেসে এল-‘হ্যালো, কে? কাকে চাই?’
আমি ঘাবড়ে গেলাম ভীষণভাবে। বেলার মোবাইলে এরকম কন্ঠ! বললাম-‘বেলা বোস কে চাই।’
-‘বেলা বোস!’
-‘সরি, বেলা মল্লিককে চাই।’
-ও তো বাসায় নেই, ইউনিভার্সিটিতে গেছে। ভুল করে মোবাইল ফেলে গেছে। খুব ভুলো মনের মেয়ে। ভাত খেতে বসে চা খেয়ে উঠে যায়।’
-‘ঠিক আছে, রাখি তাহলে।’
-‘আপনার পরিচয় তো দিলেন না?’
-‘আমি রিন্টু।’
-‘রিন্টু......! ওর এ নামের কোনো বন্ধু আছে বলে তো শুনিনি।’
-‘আমি ওর সেরকম কোনো বন্ধু নই। আমি মাস্টার্স শেষ করেছি চার বছর আগে।’
-‘ও তাই বলুন। কখনো কি ওর হাউজ টিউটর ছিলেন?’
-‘না না, আমি জীবনে কোনোদিন টিউশনি করিনি।’
-‘আপনি করেন কী?’
-‘আমি কিছু করি না।’
-‘করি না মানে?’
-‘করি না মানে করি না।’
-‘বেলার সাথে আপনার পরিচয় কেমন করে?’
-‘সেটা না হয় বেলার কাছ থেকেই জেনে নেবেন। আমি তবে রা.......।’
-‘এত রাখি রাখি করছেন কেন? বেলা হলে নিশ্চয় এক ঘন্টায় থামতেন না? এক ধরনের পাবলিক আছে মোবাইল ব্যবহারই করে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার জন্য।’
মনে হল, আমার মুখে কেউ চড় মারলো। কথা হারিয়ে ফেললাম। সেই গম্ভির কন্ঠ আবার বলল-‘চুপ করে আছেন যে? আমার কাছে আপনার পরিচয় দিলে কোনো সমস্যা আছে?’
-‘না, সমস্যা কিছু নেই। মানে আমি এখন খুব ঘামছি কিনা।’
-‘ঘামছেন কেন, আপনাদের ওখানে ওলাডশোডিং চলছে?’
-‘না বিদ্যুৎ আছে, মানে এত গম্ভীর ও ভরাট কন্ঠ আগে কখনো শুনিনি। বঙ্গোবন্ধুর কন্ঠের মতো ভরাট।’
-‘ও সেই কথা। এতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। কন্ঠ মোটা হলেও আমার মনটা খুবই চিকন।’
-‘মন চিকন!’
-‘মানে নরম মন। কাউকে ধমক দিতে পারি না। আপনি যদি বেলাকে অহেতুক বিরক্ত করেন এবং বেলা যদি সে ব্যাপারে আমার কাছে নালিশ করে, তবু আমি আপনাকে ধমক দিয়ে কিছু বলতে পারব না। দয়া করে আপনার পরিচয় বলুন।’
-‘আমার নাম রিন্টু। গতকালই বেলার সাথে প্রথম কথা।’
-‘ও মিস কলের মাধ্যমে.....।’
-‘না না সেরকম নয়, ল্যান্ডফোনে রং নাম্বার হয়েছিল।’
-‘ঠিক আছে, আমি বেলার কাছ থেকে সব শুনে নেব। আমি বেলার মামা।’
-‘আপনি তাহলে কাল উত্তর মুগদায়.........।’
-‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, বেলা তাহলে আপনাকে বলেছে? প্রথম পরিচয়েই আমার প্রজেক্ট নিয়ে কথা! আমি জানতাম, আমার কাজ ওর ভাল লাগে। আরে কি বলবো-ছোট্ট একটা এলাকা। গিজগিজে মানুষ। সেখানে চৌদ্দটা ম্যানহোলের ঢাকনা নেই। ব্যাপারটা বুঝুন। প্রতিদিন হাজারে যদি একজন করে এসব ম্যানহোলে পড়ে তাহলে মাসে কতগুলো হয়। এই ঢাকা শহরে ম্যানহোলে পড়ে আহতদের জন্য একটা বিশেষায়িত হাসপাতাল বানাতে হবে।’
-‘আপনি কি সিটি কর্পোরেশনের সাথে জড়িত....?’
-‘আরে না, পৃথিবীর কোনো কিছুর সাথেই আমি জড়িত নই। আমি শুধু আমার সাথেই জড়িত।’
-‘তাহলে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল জরিপ করছেন যে?’
-‘বেলার সঙ্গে যেহেতু আপনার আলাপ হয়েছে তখন সব জানতে পারবেন। অপেক্ষা করুন।’
ঢাকা শহরের ঢাকনা খোলা ম্যানহোল জরিপ করছেন, অথচ বলছেন পৃথিবীর কোনো কিছুর সাথে জড়িত নন। রহস্যজনক মানুষ। কোনো প্রয়োজনীয় রহস্য জানার জন্য মনটা এমন উতালা হয়নি কখনো। কিন্তু এই রহস্যটা জানার জন্য খুবই আগ্রহ জাগলো মনে। সে আগ্রহ দমিয়ে অপেক্ষায় রইলাম। কঠিন অপেক্ষা।
বেলার ফোন এল বিকেলে। বেলা বলল-‘আমি জানতাম আপনি ফোন করবেন।’
-‘কেমন করে জানলেন?’
-‘অনেক কিছুই আমি আগে থেকে জানতে পারি। কী করে যে পারি তা জানি না। মামার বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে, বিয়ে করার কথা তিনি ভাবতেও পারেন না, অথচ ক’দিন ধরে আমার মন বলছে, মামার খুব বড়লোকের এক মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হবে। মামার সঙ্গে আপনার কথা হয়েছিল? মামা আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে চাইল। যেমন-আপনি দেখতে কেমন, কোন সাবজেক্টে লেখাপড়া করেছেন, রেজাল্ট কেমন, হবি কী। আরও অনেক কিছু। আমি তো তেমন কিছু জানি না। শুধু বললাম-বেকার মানুষ। চাকরি-টাকরি বোধহয় কোনোদিন হবে-টবে না।’
-‘এভাবে বলাটা কি ঠিক হল? হতেও তো পারে।’
-‘আরে না, হলে এতদিনে হয়ে যেতো। নয় দিনে যা হয় না, নয় বছরেও তা হয় না। শুনুন, মামা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছেন।’
-‘আমার সঙ্গে! কেন?’
-‘শুনেছে আপনার কোনোদিন চাকরি-টাকরি হবে না। এরকম মানুষ পেলে মামার খুব সুবিধা হয়। হয়তো আপনাকে তার কোনো প্রজেক্টের কাজে লাগিয়ে দেবেন।’
-‘প্রজেক্ট!’
-হ্যাঁ, তার অনেক রকম প্রজেক্ট আছে। ঢাকনা বিহীন ম্যানহোল গোনার প্রজেক্ট, বেওয়ারিশ কুকুর গোণার প্রজেক্ট, ভ্রাম্যমান পাগল গণনার প্রজেক্ট, আরও...।’
-‘আমি কি তার সঙ্গে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল গুণবো?’
-‘গুণবেন। বাসায় শুয়ে থাকার চেয়ে একাজ ভাল নয় কি?’
-‘কি যে বলেন।’
-‘শুনুন, কাল বিকাল চারটার মধ্যে টিএসসিতে চলে আসুন। আমি আর মামা আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।’
আমি কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। কখনো যে বেলার সাথে দেখা করার আমন্ত্রণ পাবো তা ভাবতে পারিনি। সে ইচ্ছাও জাগেনি মনে। বুঝতে পারলাম অনেক কিছুই নিজের অজান্তেই হয়ে যাবে। আমি বললাম-‘আসবো, কিন্তু কেউ কাউকে দেখিনি কখনো। পরস্পরকে চিনবো কীভাবে?’
-‘না, সিনেমাটিক স্টাইলের কোনো সাইন আমি দিতে চাই না। যেমন আপনি পরে আসবেন হলুদ টি-শার্ট, আমি পড়ে আসবো নীল শাড়ি। আমরা এমনিই পরস্পরকে খুঁজে পাব। আর যদি না পাই তাহলে সম্পর্ক কাট। আর হ্যাঁ, আমার সঙ্গে কিন্তু মামা থাকবে। আমার মামা একটু মোটা-সোটা, নাদুস-নুদুস টাইপের।’
সারা রাত নানারকম ভাবনার মধ্যে আবিষ্ট হয়ে রইলাম। আমার মনে কিছুটা আনন্দ জাগছিল। একটা মেয়ে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। মেয়েটা নিশ্চয় খুব সুন্দর হবে। কি মধুময় কন্ঠ! কথাবার্তায় কেমন চটপটে! জীবনে কখনো প্রেমটেম আসেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুদের দেখেছি গভীর প্রেমে হাবুডুবু খেতে। কলাভবনের ঘাসে ঢাকা মাঠে, টিএসসির বারান্দায়, পাবলিক লাইব্রেরীর সিঁড়িতে জোড়ায় জোড়ায় বসে থাকতে দেখেছি। চোখে চোখ, হাতে হাত, কখনো বা ঠোঁটে ঠোঁট। আমারও যে কখনো ওসবের তৃষ্ণা জাগেনি তা নয়। কিন্তু তৃষ্ণা নিবারণের উপায় ছিল না। আমার ছিল শুধু ক্লাশ টু বাসা, বাসা টু ক্লাশ। এই বেকার জীবনে আর হয়তো প্রেমের ফুল ফুটবে না। ফোটানোর ইচ্ছেও নেই। তবু বেলার আমন্ত্রণ পেয়ে ভাল লাগছিল।
আবার মনের মধ্যে একটা ভয়ও কাজ করছিল। কেমন আশ্চার্য মেয়ে! কোনো সাইন-টাইন লাগবে না। সে এমনিই চিনে নেবে আমাকে। হয়তো সে ক্ষমতা তার মধ্যে আছে। কিন্তু আমি তাকে চিনবো কেমন করে? টিএসসিতে কি মেয়ের অভাব আছে? আমি কি জনে জনে জিজ্ঞেস করবো-‘এক্সউইজ মি, আপনি কি বেলা মল্লিক?’ তাহলে যে লোকে পাগল ভাববে। আবার আমার মধ্যে কিছুটা নার্ভাসনেসও কাজ করছিল। সে যেভাবে ডাইরেক্ট কথা বলে। শেষে কথায় কথায় আমাকে না বিবৃত করে ফেলে। চিন্তা করতে করতে হালে পানি পেলাম। বেলার মামা থাকবে ওর সাথে। ওর মামা যে মোটা-সোটা মানুষ তা জেনেছি। সুন্দর কোনো তন্বী মেয়ের সঙ্গে মোটা-সোটা কোনো মানুষ দেখলে বুঝবো সেটা বেলা। আর না হলে ফোন করে বলবো-আমি এখানে আছি, চলে আসুন। কিন্তু তা বলবো কেমন করে? আমি তো সাথে সেলফোন রাখি না। আমার পার্সোনাল কোনো সেলফোন নেই।
চার
বেলা বিকেল চারটার মধ্যে পৌছুতে বলেছে। নিশ্চিন্তভাবে চারটায় পৌছুতে হলে অবশ্যই আমাকে আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে বাসা থেকে বের হতে হবে। ঢাকার শহরের সুবিখ্যাত ট্রাফিক জ্যামের কথা সব সময়ই আমার মাথায় থাকে। অনেক চেষ্টা করেও আড়াইটার মধ্যে বের হতে পারলাম না। কোন জামাটা গায়ে দেব, কোন প্যান্টটা পড়বো এমন ভাবতে ভাবতে সময় গেল কিছুটা। অথচ আমার জামা মাত্র দুইটা, প্যান্টও দুইটা। চুল আঁচড়াতে সময় লাগলো পনেরো মিনিট। অথচ সাধারণত চুল না আঁচড়ালেও আমার চলে যায়। পারফিউম ব্যাবহার করতে গিয়ে একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। পারফিউমের ব্যাপারে সব আধুনিক মেয়েরই কিছু চয়েজ থাকে। বেলা কেমন পারফিউম পছন্দ করে? হালকা না তীব্র গন্ধের পারফিউম? শেষে যদি বলে বসে-‘কী পারফিউম মেখে এসেছেন? একেবারে বমি এসে যাচ্ছে। আপনার দেখছি এ ব্যাপারে কোনো রুচিই নেই। বেকার মানুষদের যা হয় আর কি।’
চারটা বাজার দশ মিনিট পরে পৌছুলাম টিএসসিতে। রিকশা থেকে নেমেই খুঁজতে লাগলাম একটি সুন্দর মেয়ের সঙ্গে একজন মোটা-সোটা লোক। একজন মোটা লোক পেলাম। তার সঙ্গে একটি অল্প বয়স্ক মেয়েও ছিল। তাদের দু’জনকে দেখে আমি খুবই হতাশ হলাম। লোকটাকে দেখে আমার মনে পড়লো বাংলা সিনেমার একজন এন্টি হিরোর কথা। লোকটি বোধহয় তার চেয়েও কিছুটা বেশি মোটা ও লম্বা। গায়ের রঙ তেলকুচে কালো। সে টিএসসি’র ক্যাফেটারিয়ার সামনে বসে গপাগপ ফুস্কা গিলছিল। সে এত বড় হাঁ করছিল যেন তার হাঁয়ের মধ্যে আমার মাথাটা অনায়াসে ঢুকে যাবে। আর তার পাশে বসা মেয়েটিও যথেষ্ট মোটা। নাকটা থ্যাবড়ানো। গায়ের রং কালো। মুখ ভর্তি চিকেন পক্সের দাগ। আমি তখন ভাবছিলাম পালিয়ে আসবো কিনা। আবার মনে মনে সান্ত¡না খুঁজলাম-রূপে নয়, গুণে পরিচয়। বেলার কি সুন্দর কন্ঠ! কথাবার্তায় কি স্মার্ট!
কাছে গিয়ে বললাম-‘স্লমালিকুম মামা।’
লোকটা চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে। চোখ নয়, যেন দু’টি আগুনের গোল্লা। সে ফুসকার প্লেটটি পাশে রেখে উঠে দাঁড়ালো। হাতির পায়ের মতো দু’টি পা থপথপ করে কয়েক ধাপ বাড়িয়ে এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। আমার তখন আত্মারাম খাঁচা ছাড়। দৌড় দেয়ার শক্তিও পায়ে নেই। সে পাঁতি হাঁসের মতো ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলল-‘মতলব কী তোর?’
-‘মতলব? কিসের মতলব?’
-‘আমি তোর কোন জনমের মামা?’
-‘আমি রি....!’
-‘চোপ...আজ তোর খবর আছে। আমার সাথে ইয়ার্কি?’
লোকটা খপ করে আমার জামা ধরে আমাকে শূন্যে তুলে ফেললো। আমার মুখের কাছে মুখ এনে বলল-‘মতলব কী বল? নইলে মারবো এত থাপ্পর।’
তার একটা থাপ্পর খেলে আমার ভবলিলা সাঙ্গ হবে তা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম।
ইতোমধ্যে অনেক লোক জমে গেছে। অস্বাভাবিক কিছু দেখলে এই ঢাকা শহরে লোক জমতে সময় লাগে না। এ শহরে লোক আগায় না শুধু কেউ দুর্ঘটনায় পড়লে অথবা ছিনতাইকারীর কবলে পড়লে। লোকগুলো বোধহয় আমাকে চোর-ছ্যাচ্চর ভাবছিল। একজন বলল-‘কী করছে ভাই, কী করছে? হালারে প্যাঁদানী দেন।’
ঠিক তখন ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকলো এক লোক। আগন্তুকও মোটা। তবে আমি যার হাতের মধ্যে ঝুলে ছিলাম তার মতো না। আগন্তুকের গায়ের রঙ সম্পূর্ণ ফর্সা। চেহারাটা মায়াময়। সে এসে বলল-‘কী হয়েছে ভাই? একে এমন বাদুর ঝোলা করে রেখেছেন কেন?’
-‘কী আর হবে? ঢাকা শহর চোর-ছ্যাচ্চরে ভরে গেছে।’
-‘ব্যাপারটা আমি জানি। এ নিয়ে আমার একটা প্রজেক্টও আছে। এবার বলুন সে কী করেছে?’
-‘ব্যাটা চরম মতলববাজ। আমাকে মফিজ পেয়েছে।’
-‘কী করেছে তাই বলুন না।’
-‘চেনা নেই জানা নেই আমাকে বলে, স্মালামালিকুম মামা। ওর মতলববাজি আমি ছুটিয়ে দেব।’
এ কথা শুনে আগন্তুক হেসে উঠলো উচ্চ কন্ঠে। তার হাসি দেখে দানবটা রেগে উঠল-‘এভাবে হাসছেন কেন?’
-‘ভাইরে, হাসছি মনের দুঃখে। আমি মনে করেছিলাম, ও না জানি কী করে ফেলেছে। এখন দেখছি কিছুই করেনি।’
-‘কিছুই করেনি মানে? স্লামালিকুম মামা.........।’
-‘ও আমার ভাগ্নে। বছর কয়েক আগে ওর মাথায় একটা সমস্যা বেঁধে যায়। এমনিতে সব ঠিক। শুধু মোটা মানুষ দেখলে কাছে গিয়ে বলে-স্লামালিকুম মামা।’
এ কথা শুনে দানবটা আমার জামার কলার ছেড়ে দিল। আমি ধপ করে মাটিতে পড়লাম। তারপর সে মুখ বিকৃতি করে বলল-‘দুনিয়ায় কত কিসিমের পাগল যে দেখলাম!’
-‘ভাই সাহেব, এটা নিয়েও আমার একটা প্রজেক্ট আছে।’
-‘রাখেন আপনার প্রজেক্ট। এদেশের প্রজেক্ট মানেই টাকা খাওয়ার মওকা। এনজিওগুলো......।’
-‘আমার প্রজেক্ট সেরকম কিছু না।’
-‘ফাও কথা বাদ দিয়ে রাস্তা মাপেন।’
আগন্তুক আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে বেরিয়ে এল ভীরের ভেতর থেকে। টিএসসির লবিতে এসে নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে খানিকটা জায়গা পরিস্কার করলো। তারপর বলল-‘বসুন।’
বলা মাত্র আমি ধপ করে বসে পড়লাম। আমি দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি পাচ্ছিলাম না যেন। চোখেও ঝাপসা দেখিছিলাম। লোকটি বলল-‘নাম কী আপনার?’
-‘রিন্টু।’
-‘ঐ মটু মিয়াকে বেলার মামা মনে করেছিলেন নিশ্চয়?’
-‘জি।’
-‘আর ঐ কালো মেয়েটাকে বেলা?’
-‘জি।’
-‘ভুল অনুমান করেছিলেন। এই এটা হলো বেলা, আর আমি অধম হলাম বেলার মামা।’
তার ডান পাশে ছায়া শরীরের ছিপছিপে একটি মেয়ে বসে আছে আমি তা খেয়ালই করিনি। আসলে আমি তখনো একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমি তাকালাম বেলার দিকে। বেলা মাথা নিচু করলো। এক কথায় সে সুন্দর-ভীষণ সুন্দর।
আমি বললাম-‘কেমন আছেন আপনি?’
সে এ প্রশ্নে উত্তর না দিয়ে বলল-‘ডেকে এনে আপনাকে কী বিপদেই না ফেলেছিলাম।’
-‘না না, বিপদ নয়-এ একটু অন্যরকম অভিজ্ঞতা।’
তারপরই আমার মাথা নিচু হলো। অবশ্যই লজ্জায়। বেলা নিশ্চয় আমাকে দানবটার হাতের মুঠোয় ঝুলে থাকতে দেখেছে। দেখতে অবশ্যই ভাল দেখায়নি। মামা বলল-‘আমি দেখে না ফেললে আজ আপনার খবর ছিল।’
আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম। মামা বলল-‘তারপর বলুন, আপনাদের পরিচয় কিভাবে?’
আমি আদ্য-প্রান্ত বললাম। মামা বলল-‘আপানি মাস্টার্স শেষ করেছেন চার বছর, আর আমি চৌদ্দ বছর। আমার মনে হয় আপনাকে আমার তুমি করে বলা উচিত।’
-‘সিওর সিওর।’
-‘আর বেলাকে তুমি অনায়াসে তুমি বলতে পার।’
-‘আমি বেলাকে.......।’
-‘চলো ফুসকা খাব।’
ফুসকার কথা মনে হতেই আমার মনে পড়লো সেই লোকটাকে। আমি শিউরে উঠলাম। বললাম-‘এখন আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।’
-‘কেন, খেতে ইচ্ছে করছে না কেন?’
আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম-‘আপনার ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল গোণনার খবর বলুন।’
-‘বলবো, সব বলবো।’
হঠাৎ মামা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো-‘সর্বনাশ! পাঁচটা বেজে গেছে। আমি আর থাকতে পারছি না।’
আমি বললাম -‘জরুরি কোনো কাজ আছে?’
-‘আমাকে এখনই বিমানবন্দর যেতে হবে।’
-‘বিমানবন্দর কেন?’
-‘আমার এক বন্ধু আসছে কিউবা থেকে, তাকে রিসিভ করতে।’
-‘তিনি কিউবা থাকেন?’
-‘না, বেড়াতে গিয়েছিল।’
-‘পৃথিবীতে এত দেশ থাকতে কিউবায়.......।’
-‘সে এক গোড়া সমাজতান্ত্রিক। বলা যায়, সে গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের শত্রু। গণতন্ত্রকে বলে ধোকাবাজ পদ্ধতি। জনগণের কথা বলে বলে জনগণকে শোষন করে। গুটিকতক ব্যাক্তি সম্পদ চুষে খায়। আমেরিকার নাকের ডগায় বসে কেষ্ট্ররা বহাল তবিয়তে সমাজতন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন এটা তার কাছে যেমন বিস্ময় তেমন অহংকার। তার মতে কিউবা হলো-সাম্রাজ্যে বাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আত্মমর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে বেঁচে থাকার ও এগিয়ে চলার অনন্য দৃষ্টান্ত-বলিভিয়া থেকে ইকুয়েডর পর্যন্ত সমগ্র লাটিন আমেরিকান জনগণের কাছে কিউবা মার্কিন আধিপত্যেবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর প্রতিরোধের এক মূর্ত প্রতীক। তাই স্বচক্ষে দেখতে গিয়েছিল কেষ্ট্রর কিউবাকে। এখন কতদিন ধরে যে আমাকে কিউবার গল্প শুনতে হবে কে জানে।’
-‘আপনি কি পুঁজিবাদের পক্ষে?’
-‘পুঁজি ছাড়া মেরুদন্ড থাকে? বর্তমানে আমেরিকার চাইতে শক্ত মেরুদন্ড কার আছে?’
-‘আমেরিকা যে শোষক রাষ্ট্র এটা সবাই মানে।’
-‘পুঁজি তাদের হাতে তারা তো মাতুব্বরিগিরি করবেই।’
-‘পুঁজির পক্ষে হয়ে আপনি আয়হীন কাজে সময় ব্যয় করছেন কেন?’
-‘হয়তো নিরুপায় হয়ে। এ বিষয়ে পরে কথা হবে। আমি চললাম-তোমরা থাক-গল্প কর। আর হ্যাঁ, তুমি একটু কষ্ট করে বেলাকে বাসায় পৌছে দিও।’
-‘তা দেব।’
মামা চলে গেল। এখন আমি আর বেলা। মুখোমখি বসে। তবু আমি বেলার মুখ দেখতে পারছিলাম না। আমার দৃষ্টি সামনের দিকে যেতেই পারছিল না। কিছু বলারও পাচ্ছিলাম না। তবু কিছু বলতে তো হবে। বললাম-‘আপনার মামাটা চমৎকার একজন মানুষ।’
-‘মামা না আমাকে ‘তুমি’ বলতে বললো।’
-‘ঠিক আছে বলবো। আপনার মামাটা না চমৎকার একজন মানুষ।’
-‘আবারও তো আপনি করেই বলছেন।’
-‘এত তাড়াতাড়ি আমার মুখে ‘তুমি’ আসবে না।’
-‘কখনোই আসবে না।’
-‘হয়তো তাই।’
-‘থাক, ‘তুমি’ লাগবে না। আমাকে ‘আপনি’ করেই বলবেন।’
-‘ধন্যবাদ। আপনার মামাটা না চমৎকার মানুষ।’
-‘বেকাররা চমৎকারই হয়।’
-‘কেন, বেকাররা চমৎকার হয় কেন?’
-‘বেকাররা যে বোকা থাকে। বোকারা সে সহজ-সরল-নির্ভেজাল হয় তাই।’
-‘আপনার কি মনে হয় আমি বোকা?’
-‘এখানে তো মনে হওয়ার কিছু নেই। যা সত্যি তাতে মনে হওয়ার কী আছে?’
আমার মুখ কিছুটা লাল হল। লজ্জায় নয়, রাগে। এতটা স্পষ্টভাষী হওয়া ঠিক নয়। কথায় আছে-অপ্রিয় সত্যও বলতে হয় না। আর সে.....। যে আমি চার বছর আগে মাস্টার্স শেষ করেছি, সেই আমাকে ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়ে যদি বোকা বলে রাগ হবে না মনে? বেকার হলেই মানুষ বোকা হয়। কি অদ্ভূত যুক্তি! দেশটা যেন আমার বাপ কিনে রেখেছে। চারদিকে কত চাকরি। আমি সে সব করতে পারছি না। ইচ্ছে হয়েছিল বলি-‘আছো তো ফার্স্ট ইয়ারে, চাকরির বাজার সম্পর্কে কী বুঝবে? লেখাপড়া শেষ কর-যাও চাকরির বাজারে তখন ঠিক ঠিক বুঝবে কত আটায় কত রুটি। চেহারার এই ঝিলিক আর থাকবে না। তামাটে হয়ে যাবে গায়ের রঙ।’
কিন্তু আমি তা বলতে পারি না। কারো কথার জড়ালো প্রতিবাদ করা আমার স্বভাবে নেই। তর্ক করে কাউকে হারাতেও আমার ভাল লাগে না। বেলা বলল-‘চলুন কিছু খাই।’
-‘কী খাবেন?’
-‘আইসক্রিম।’
-‘ঠিক আছে চলুন।’
ক্যাফেতে আমি টোকেন কিনতে গেলেই বেলা বলল-‘আপনি টোকেন কিনতে এসেছেন কেন?’
-‘তাতে সমস্যা কী?’
-‘আপনার কাছে কি টাকা আছে?’
-‘অবশ্যই আছে। এখন আমার কাছে পাঁচশ’ টাকা আছে। পাঁচশ’ ত্রিশ টাকা ছিল। ত্রিশ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়েছি।’
-‘আপনি টাকা কোথায় পেলেন?’
-‘মায়ের কাছ থেকে নিয়েছি। দরকার হলে আমি মা’র কাছ থেকে চেয়ে নেই।’
-‘আমার মামাও তাই। তার তো মা নেই। বোনই তার মা। তার টাকার দরকার হলেই বোনের কাছে হাত পাতে। বোনের আদর-আহলাদেই তো সে এমন কর্মবিমূখ হয়েছে। ছেলেরা বেশি আদর-আহলাদ পেলে অকর্মা হয়ে যায়। ভবিষ্যতে আমি যখন মা হনো, আমার ছেকে চরম টাইট দিয়ে রাখবো। আপনার মা বুঝি আপনাকে........?’
-‘সব মা-ই তার সন্তানকে আদর-আহলাদে রাখে। এবং বোনও তার ভাইকে......।’
হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলাম-এই মেয়ের সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখবো না। কথায় কথায় যে বেকারত্বের খোটা দেয় তার সাথে যোগাযোগ চলে না। আমাদের ক্লাশের মেহেদি। ওর এক পা খোড়া। তারপরও শাওন নামের ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটা তার প্রেমে মোজলো। সে কি প্রেম! মধুর ক্যান্টিনে বসে সবার সামনে সে মেহেদির মুখে খাবার তুলে খাওয়াতো। সে কি কখনো মেহেদিকে ল্যাংড়া বলে খোটা দিয়েছে?
পাঁচ
দু’দিন কোনো যোগাযোগ হয়নি। বেলাও ফোন করেনি, আমিও না। দু’দিন পরই মনে হতে লাগলো-না, এরকম অভিমানের কোনো মানে হয় না। তার বয়স কম। মুখ পাতলা মেয়ে। কখন কী বলে তা নিয়ে অভিমান করে থাকা ঠিক নয়। মনে হতে লাগলো, বেলাকে ফোন করি। কত সুন্দর করে কথা বলে! আবার ফোন করতে সাহস পাই না। সে যদি বলে-‘আবার ফোন করেছেন কেন? আপনার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল, একটু দেখা হল ব্যাস। তাই বলে জনম ভরে আপনার সাথে যোগাযোগ রাখব নাকি? আমার আর কোনো কাজ নেই? আপনার সাথে কি আমার প্রেম হয়েছে?’
কেটে গেল আরও কয়েকটা দিন। আমার ভেতরে খুব তোলপাড় শুরু হল। নিজেকে কিছুতেই বোঝাতে পারি না যে, সে আমার কেউ নয়। তার সাথে সারা জীবন যোগাযোগ রাখা যাবে না। নিজে থেকে তার সাথে যোগাযোগ করা নিতান্তই ছেলে মানুষি। আমার এখন সেই বয়স নেই।
ছয় দিন পর বেলার ফোন এল। মনটা মুহূর্তে আনন্দে ভরে উঠল। ভাল একটা চাকরি পেলেও বোধহয় আমি এতটা আনন্দিত হতাম না। আচ্ছা, এরকম আনন্দের কোনো মানে আছে কি? আমি কল রিসিভ করলাম। না, যা ভেবেছিলাম তা নয়। বেলা ফোন করেনি। ফোন করেছে মামা। বলল-‘রিন্টু, আজ বিকেলে একটু বাসায় এসো তো।’
-‘কেন মামা?’
-‘এলেই বলবো। ভুল করো না, ঠিক ঠিক চলে এসো।’
-‘মামা, বলেন না কী দরকার?’
-‘আহ! এসেই শুনবে।’
মামা-ভাগ্নী দু’জনই রহস্য রেখে কথা বলতে ভালবাসে। কোনো কথাই খোলসা করে বলতে চায় না। বেলা ফোন না করলেও বাসায় যাবার প্রস্তাব পেয়ে খুশি হলাম। বাসায় গেলে বেলার সাথে দেখা হবে নিশ্চয়, কথাও হবে। আমি বললাম-‘ঠিক আছে মামা, আমি চারটার মধ্যেই চলে আসবো।’
-‘ধন্যবাদ, বেলার সঙ্গে কথা বলবে?’
-‘ও এখন বাসায় আছে? ওর কোনো ক্লাশ নেই আজ?’
-‘ক্লাশ আছে কিন্তু যায়নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। তাই ...........।’
-‘ঠিক আছে, দিন ওকে।’
-‘একটু অপেক্ষা করো, গোসল করছে।’
-‘ম্যাজম্যাজে শরীর নিয়ে গোসল!’
-হ্যাঁ, হালকা গরম জলে গোসল দিলে শরীরের ম্যাজম্যাজে ভাব কেটে যায়।’
বেলা বলল-‘হ্যালো।’
বেলা একবার বলেছিল, সে অনেক কিছুই আগে থেকে জেনে ফেলে। সেই সূত্র ধরেই আমি বললাম-‘আমি জানতাম আপনি আজ ক্লাশে যাবেন না। আপনার শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে।’
-‘মামা বলেছে নিশ্চয়?’
-‘না, মামার সাথে আপনার ব্যাপারে কোনো কথা হয়নি।’
-‘তাহলে আপনি কেমন করে জানলেন যে, আমার শরীর ম্যাজম্যাজ করছে?’
-‘কেমন করে জানলাম জানি না। আমি মাঝে মাঝে কেমন করে যেন বিশেষ কোনো ব্যাপার বুঝে ফেলি। আমি গত পরশু বললাম-মা, নুপুরকে একটু সাবধানে রেখ, ওর কোনো অসুখ বাঁধতে পারে। আজ সকালে দেখি নুপুরের চোখ উঠেছে।’
বেলা বলল-‘আপনি কি মেডিটেশন করেন? মেডিটেশন যারা করে তারা নাকি মনছবিতে অনেক কিছু দেখতে পায়।’
-‘না, সেভাবে কখনো বসিনি।’
-‘বসে যান, বড় কিছু অর্জন করতে পারেন।’
-‘অহী-টহী পাওয়ার সম্ভাবনা আছে?’
-‘ধর্মান্ধরা শুনলে আপনাকে কোপাবে। চাপাতি চেনেন?’
-‘আর বলবেন না। ভয় পাচ্ছি খুব।’
আমি সাধারণত মিথ্যা কথা বলি না, এমনকি বলতেও পারি না। অথচ বেলার সঙ্গে কত সহজভাবে একটা মিথ্যে কথা বলে ফেললাম। এ মিথ্যাটা ধরা পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। বেলা মামাকে জিজ্ঞেস করলেই সব বের হয়ে আসবে। তবু আমার মধ্যে কোনো চিন্তার উদ্বেগ হল না। আসলে কখনো কখনো কোনো কোনো মানুষের সাথে বোধহয় রসিকতাচ্ছলে মিথ্যা সবাই বলে। এসব মিথ্যায় ধরা পড়লে ক্ষতি হয় না, বরং বিশেষ সহানুভূতি পাওয়া যায়।
ঠিক চারটায়ই বেলাদের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। বেল টিপতেই বেলা দরজা খুললো। চমকে উঠে বলল-‘আপনি!’
বুঝলাম, মামা যে আমাকে আসতে বলেছেন বেলা তা জানে না। আমি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম-‘মামা কোথায়?’
-‘আপনি কি মামার কাছে এসেছেন?’
-‘না, তা আসবো কেন?’
-‘তাহলে এসেই মামার খোঁজ করছেন?’
-‘দু’জনই বেকার মানুষ। আলাদা একটা টান আছে না?’
-‘হয়তো নিচে গেছে-এসে পরবে এখনই।’
আমি সোফায় বসলাম। প্রথমবারের মতো কারো ড্রইংরুমে ঢুকলে আমি রুমের চারিপাশে তাকাতে থাকি। এটা আমার অভ্যাস বলা যায়। ব্যাপারটা ভাল কি মন্দ তা বুঝি না। তাকিয়ে তাকিয়ে রুমের খুঁটিনাটি দেখি। সব ড্রইং রুমেরই একটা বিশেষত থাকে। পুরোপুরি মেলে না কোনোটাই। কোনো ড্রইংরুমে আসবাবপত্রের আধিক্য, কোনোটায় আবার ফাঁকা। কোনো কোনো ড্রইং রুমে ফুলের ছড়াছড়ি, কোনোটায় আবার সো-পিচ বেশি। আমাদের বাসায় দু’টি মাত্র রুম। একটা আমার, একটা বাবা-মা’র। আলাদা করে ড্রইংরুম নেই। বাইরের কেউ এলে আমার রুমে বসে। আমার রুমটাই ড্রইং রুম হিসাবে চালিয়ে দেই। সাজানো-গোছানো একটা ড্রইং রুমের খুব সখ আমার। একটা চাকরি না হলে এ সখ পূরণ হবার নয়।
আমি যখন দেয়ালে বেলার একটা ছবির দিকে তাকিয়ে আছি তখন বেলা বলল-‘নুপুরকে নিয়ে আসলে তো পারতেন।’
-‘আরেকদিন আনা যাবে।’
-‘ফোনে এত সুন্দর করে কথা বলে! আচ্ছা, চা খাবেন না কফি?’
-‘এ দু’টোর মধ্যে আমি বিশেষ প্রার্থক্য বুঝি না। দু’টোই আমার কাছে গরম লাগে। প্রথম বার মুখের কাছে নেবার পর একটা ছ্যাঁকা খাই।’
-‘হি হি হি।’
-‘হাসছেন! সত্যি বলছি।’
-‘ছ্যাঁকা শব্দটার কারণে হাসছি। প্রেমে ব্যর্থ হওয়াকে টিনএজরা ছ্যঁকা বলে।’
-‘হা হা হা।’
-‘হি-হি-হি। আপনি বোধহয় প্রেমে পড়েছেন?’
-‘মানে? হঠাৎ......?’
-‘প্রেমে পড়লে ছেলেরা অহেতুক রসিকতা করে। রসিকতার জন্য ছোটখাট মিথ্যা বলতেও দ্বিধা করে না।’
-‘আমি কোনোদিন ঐ সাগরে ডুবিনি-ডোবার কোনো সম্ভাবনাও নেই।’
-‘আবারও রস করে কথা বললেন। আমি নিশ্চিত......।’
তার মানে, আমি বেলার কাছে মিথ্যা কথা বলেছিলাম সেটা বেলা ধরে ফেলেছে। বুদ্ধিমতি মেয়ে।
কিছুক্ষণ পর চা এল। লাল চা। চায়ে একটা লেবুর টুকরো ভাসছে। রঙটা খুব সুন্দর হয়েছে। দেখে খুব ভাল লাগল। সত্যিই বেলা গুণবতী। চায়ের সঙ্গে অনেক রকমের টা। আমি শুধু চা-টাই তুলে নিলাম। চুমুক দিতেই আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। গিলতে পারলাম না এক ফোটাও। ফেলার জায়গাও পাচ্ছিলাম না।
বেলা বলল-‘কোনোদিন ভেবেছিলেন যে, বেলা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে আপনার পরিচয় হবে-তার বাসায় যাবেন-সে আপনাকে লেবুর টুকরো ভাসিয়ে লাল চা খাওয়াবে?’
আমি মাথা নেড়ে না বোঁধক উত্তর করলাম। সে বলল-‘একটা ভুল নাম্বারে চাপ পরে এমনটি হল। এর জন্য ধন্যবাদ নুপুরকে। টেলিফোন নিয়ে এরকম ব্যাপার নাটক-সিনেমায় দেখা যায়।’
-‘হু।’
-‘আমাদের ব্যাপারটা সিনেমা-নাটকের মতো হবে কিনা কে জানে। মানে ট্র্যাজিক অথবা হাস্যাকর কিছু। আমার মতো একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হতে পেরে আপনি কি খুশি?’
-‘হু।’
-‘আমি মেয়েটা খুব ভাল এবং বুদ্ধিমতি। সমস্যা একটু বেশি কথা বলি। নিজের তারিফ নিজে করলাম বলে মনে কিছু করলেন?’
-‘উ-হু।’
-‘কখন থেকে হু-হা করছেন, সমস্যা কী? মুখের ভেতর কী আটকে রেখেছেন?’
আমি আঙুল দিয়ে চায়ের কাপ দেখালাম। সে বলল-‘চা না গিলে মুখের মধ্যে আটকে রেখেছেন কেন?’ এ কথার জবাব হু-হা করে দেয়া সম্ভব ছিল না। বেলা প্রায় চিৎকার করে বলল-‘সমস্যাটা কী বলবেন তো?’
এমন সময় মামা ঘরে ঢুকলো। বলল-‘এভাবে চিৎকার করছিস কেন?’ বেলা বলল-‘দেখতো মামা, উনি কখন থেকে চা মুখের ভেতর রেখে বসে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে হু-হা করে জবাব দিচ্ছে।’
মামা ঝট করে চায়ে একটা আঙুল ঢুকিয়ে চা-টা টেস্ট করল। তারপর আমাকে বলল-‘ঐ জানালা দিয়ে কুলি করে এসো।’
কুলি করে এসে আমি স্বস্তি নিয়ে বসলাম। তবে বেলার রাগ আরও বেড়ে গেল। বলল-‘এত যতœ করে চা বানালাম, সে চা আপনি কুলি করে ফেলে দিলেন কেন?’
আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। মামা বলল-‘চায়ে কয় চামচ চিনি দিয়েছিলি?’
-‘দেড় চামচ।’
-‘সেটা তো লবন ছিল। তারপর..?’
-‘আ! লবন দিয়েছি তাহলে?’
আমি মৃদু হাসলাম। মামা হাসল শব্দ করে। বেলা দুঃখিত হয়ে বলল-‘জীবনের প্রথম বাসায় এলেন আর আমি আপনাকে লবন দিয়ে চা করে খাওয়ালাম। ছিঃ!’
আমি বললাম-‘ভুল হতেই পারে।’
মামা বলল-‘এটা আর তেমন কী ভুল। আরেক দিন আমার জন্য চা করতে গিয়ে লিকারের পরিবর্তে চায়ে দিয়েছিল ইঁদুর মারার ওষুধ। আর তো চায়ে রঙ হয় না। আপা না দেখে ফেললে সেদিনই এই মায়াময়-ছায়াময় ধরনী থেকে আমাকে বিদায় নিতে হতো।’
বেলার মুখটা অতিশয় রক্তিম হয়ে গেল। আমি বুঝলাম প্রসঙ্গ পাল্টানো উচিত। বললাম-‘মামা, ডেকেছেন কেন?’
এ কথা বলা মাত্র বেলার কাছে ধরা খেয়ে গেলাম। বেলা ঝন্ করে উঠল-‘তখন যে বললেন মামার কাছে আসেননি? আমি নিশ্চিত আপনি প্রেমে পড়েছেন। প্রেমে না পড়লে আপনার মতো হাঁদা টাইপের মানুষ এরকম মিথ্যে বলতে পারে না।’
আমার বলার কিছুই ছিল না। ধরা খেয়ে গেলে কারো বলার কিছু থাকেও না। বেলা যেন অহেতুক ঝগড়া বাঁধাতে চাচ্ছে এরকম একটা ভাব দেখিয়ে মামা বলল-‘তুই থামতো। যা, চিনি দিয়ে আরেক কাপ চা করে আন। এই ফাঁকে আমি রিন্টুর সাথে জরুরি কথাটা সেরে নেই।’
বেলা চা করতে গেল। আমি বললাম-‘কী প্রয়োজনে ডেকেছেন মামা?’
-‘আজ রাতে তোমাকে নিয়ে একটু বেরুবো।’
-‘কোথায়?’
-‘তেজগাঁও ইন্ড্রাসট্রিয়াল এরিয়ার ম্যানহোল গোণনার কাজটা শেষ হলেই আমার এই প্রজেক্টের কাজ প্রায় শেষ হয়ে যায়। তারপর আমি প্রতিবেদন লিখতে বসতে পারি।’
-‘ম্যানহোল গুণবেন রাতের বেলা!’
-‘তাতে সমস্যা আছে কোনো?’
-‘অবশ্যই আছে?’
-‘কী সমস্যা?’
-‘অনেক সমস্যা।’
-‘কী অনেক সমস্যা?’
-‘রাত দুপুরে ঢাকানাবিহীন ম্যানহোল খুঁজতে গিয়ে নিজেরাই যে ম্যানহোলে তলিয়ে যেতে পারি।’
-‘কেন, রাস্তায় লাইট পোষ্টের আলো আছে না?’
-‘এ দেশের লাইটপোষ্ট সম্পর্কে দেখি আপনার কিছু ধারণা নেই। সব লাইট জ্বলে? তার ওপর আছে লোডশোডিং-এর ব্যাপার।’
-‘আজ তো পূর্ণিমার রাত।’
-‘ঢাকা শহরের সব গলি-ঘিঞ্জিতে বুঝি পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঢোকে? সূর্যের আলোই তো পৌছায় না অনেক গলিতে।’
-‘তাতেও কোনো সমস্য নেই। দু’জন দু’টো তিন ব্যাটারীর টর্চ লাইট নেব।’
-‘তাতেও সমস্যা আছে।’
-‘এরপর আবার সমস্যা কী?’
-‘রাত দুপুরে জবরদস্ত দু’জন লোককে টর্চলাইট হাতে অলি-গলি ঘুরতে দেখলে টহল পুলিশ কি ছেড়ে কথা বলবে? ধরে ইয়াবা ব্যবসায়ী সাজিয়ে মাল আদায় করে ছাড়ছে। পুলিশ চেনেন?
-‘থানায় জানিয়ে রেখেছি সব।’
-‘কী জানিয়েছেন?’
-‘তারা জানে যে, ঢাকা শহরের সমস্যাগুলোর ওপর আমি রিসার্স করছি। এ কথা শুনে তারা খুব খুশি হয়েছে। পুলিশের বড়কর্তা আমার খুব প্রশংসা করলো। বললো-ম্যানহোল রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের অথচ.....। খুব খুশি হলাম। তবে পত্রিকায় রিপোর্ট করে পলিশকে ফাঁসিয়ে দিয়েন না আবার।’
-‘আপনি কি রিপোর্টে পুলিশকে বাঁচিয়ে কথা বলবেন? তাহলে তো বলবো আপনার উদ্দেশ্য ফেয়ার নয়।’
-‘হানড্রেট পার্সেন্ট ফেয়ার। আমি পুলিশের বাপকেও ছাড়বো না।’
-‘অলি-গলিতে ঢোকার পর চোর-টোর ভেবে যদি গণপিটুনি........।’
-‘আরে ধ্যৎ! তুমি দেখছি নেগেটিভ চিন্তার মানুষ। কোনো বড় কাজ করতে গেলে এত নেগেটিভ চিন্তা করলে চলে? অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদও তো জানতেন যে, প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে লিখতে গেলে আঘাত আসতে পারে, তাই বলে তিনি কি লেখা বন্ধ করে বসে ছিলেন?’
ছয়
পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনটা আনন্দে ভরে উঠল। জন্মাবধি পড়ে আছি এই ঢাকা শহরে। চাঁদের আলো কী জিনিস তেমন করে বোঝা হয়নি। এই ছল-চাতুরীর জটিল-কুটিল শহরে চাঁদ যে এমনভাবে পবিত্র আলো ঢালে তা জানাই ছিল না যেন। মামা তা জানার সুযোগ করে দিল বলে মনে মনে মামাকে ধন্যবাদ দিলাম। একটু ফাঁকা জায়গায় বের হলেই আমি তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে। মামা বলল-‘তুমি বোধহয় জীবনের প্রথম চাঁদ দেখলে?’
আমি মামার প্রশ্নটাকে গুরুত্ব না দিয়ে বললাম-‘মামা, দেখুন হালকা মেঘগুলো একের পর এক চাঁদটাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে, অথচ মনে হচ্ছে চাঁদটাই পিছু ফেলে যাচ্ছে ওদের, আর ওরা স্থির।’
-‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি-কথাটা যেন কে বলেছে?’
-‘সুকান্ত ভট্টাচার্য।’
-‘এত অল্প বয়সে ব্যাটা এমন এক উপমা পেল কেমন করে? অসময়ে না মরলে রবীন্দ্র-নজরুলের খবর ছিল।’
-‘মামা, সাহিত্যটা এমন জিনিস যে, কেউ কারও খবর করে না। যে যার জায়গায় থেকে কাজ করে যায়। সুকান্ত এক হাজার বছর বেঁচে থাকলে রবীন্দ্র-নজরুল যেগুলো লিখেছেন সেগুলো লিখতেন না। তিনি তারটাই লিখতেন।’
-‘সুন্দর বলেছো। সাহিত্য সম্পর্কে তোমার ভালো ধারণা বোঝা গেল।’
-‘মামা, চলুন একটা খোলা জায়গায় কিছুক্ষণ বসি। বসে বসে চাঁদ দেখি।’
-‘ঠিক আছে তাই হবে।’
ঘাসে ঢাকা একটা মাঠ পেলাম। চারিদিকে প্রাচীর দেয়া। একটা মাত্র গেট। বোধহয় কোনো ক্লাব অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খেলার মাঠ। আশেপাশে কোনো বিদ্যুতের বাতি নেই। সেখানে অকৃত্রিম চাঁদের আলো লুটিয়ে আছে। আগ-পাছ না ভেবে সেই গেট দিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম। মাঠের মাঝখানে সবুজ ঘাসের ওপর বসে পড়লাম। বলা যায় পূর্ণিমার চাঁদ দেখার মতো সবুজ ঘাসের মাদুরে বসার অভিজ্ঞতাও আমার সেই প্রথম। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি সবুজ ঘাসের মাঠ পেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে বসা হয়নি বা তেমন করে যাওয়া হয়নি। কেননা, আমি ছাত্র জীবনে কখনো কোনোরকম খেলাধুলা করিনি। খেলাধুলা না করলে বিশেষভাবে স্কুল ও কলেজে মাঠে নামা হয় না। তবে খেলাধুলা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সবুজ ঘাসে হাঁটা হয়, বসা হয়। সে হল প্রেম অথবা আড্ডা দিতে গিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এ দু’টোর একটাও আমার হয়নি। তাই সেভাবে সবুজ ঘাসে ঢাকা খোলা মাঠকে জানা হয়নি।
একটু পর আমি একেবার শুয়েই পড়লাম। শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখতে লাগলাম। মামা আমার পাশে বসে বোতল থেকে পানি পান করল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে কয়েকটা টান দিয়ে বলল-‘রিন্টু, তুমি কি চাঁদ বিষয়ক কোনো গান জানো?’
-‘চাঁদ বিষয়ক তো একটা গানই বিখ্যাত-চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে উথলে ওঠে আলো....।’
-‘গানটা কে লিখেছে?’
-‘রবি ঠাকুর।’
-‘আর কোনোটা জানো না?’
-‘আরেকটা আছে-আজ জ্যোস্না রাতে সবাই গেছে বনে।’
-‘এটা কে লিখেছে?’
-‘ঐ একজনই।’
-‘আচ্ছা, এমন কোনো বিষয় আছে যা নিয়ে ঐ গ্রান্ডফা-টা কিছু লেখেন নি?’
-‘এটা আপনার গবেষণার বিষয় হতে পারে। এ বিষয়ে একটা প্রজেক্ট হাতে হাতে নিন।’
-‘না, তা পারে না। আমি শুধু এই ঢাকা শহরের সমস্যাগুলো নিয়েই মাথা ঘামাতে চাই। যাকগে, তুমি প্রথম গানটাই গাও।’
-‘কোনটা?’
-‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে....।’
-‘আমি যে কোনোদিন গান গাইনি। সুর ঠিক হবে কিনা জানি না।’
-‘এখানে তো আর কেউ নেই। আর সুর ঠিক হল কি বেঠিক হল তা ধরার ক্ষমতাও আমার নেই। বেলা থাকলে সেটা ধরতে পারতো। ভুল সুরে গাইলে হাসিতে লুটিয়ে পড়তো। গাওতো...ওয়েট, আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে নেই।’
গানটা আমি অনেকবার শুনেছি। কথা মুখস্থ ছিল। গাইলাম। গেয়ে আত্মতৃপ্তি পেলাম। মনে হল, সুরটা মোটমোটি হয়েছে। কাউকে গান শোনানো-এটাও আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। মনে হল, মামার সাথে বেরিয়ে অজস্র নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘরে ফিরবো।
তারপর আবার আমি জ্যোস্নার সুধা পান করতে লাগলাম আর মামা সিগারেটের সুধা। আমি তো আর কবি না যে, সুধা পান করতে করতে কবিতার লাইন বানাবো মনে মনে। চুপচাপ সুধা পান করতে ভাল লাগছিল না। মামার সঙ্গে টুকটাক গল্প করতে লাগলাম। বললাম-‘মামা, আপনার প্রজেক্টের আওতায় কোন কোন বিষয় আছে?’
-‘এই শহরের ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল, ভাসমান মানুষ, অবৈধ দোকানপাট, পাগল এসবের যথাযথ তালিকা প্রস্তুত করে এসব সমস্যা সমাধানের একটা সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরবো বলে আশা করছি।’
-‘আপনার কাজগুলো কিন্তু জটিল হবে।’
-‘জীবনে সহজ একটা চাকরি পেলাম না বলেই জটিল কাজ বেছে নিলাম।’
-‘বোনের ঘাড়ে বসে এসব করতে খারাপ লাগে না?’
-‘আমি আমার বোনকে সাফ জানিয়ে দিয়েছি, যদি কখনো সে আমার ওপর বিরক্ত হয়-আমাকে বোঝা মানে করে-ঝামেলা মনে করে, তাহলে যেন তা আমাকে জানিয়ে দেয়। তাতে আমি এতটুকু দুঃখিত হব না। আমি তাদেরকে মুক্তি দেব।’
-‘কীভাবে মক্তি দেবেন?’
-‘যেদিকে চোখ যায় চলে যাব।’
-‘তা শুনে আপনার বোন কী করলেন?’
-‘কাঁদতে লাগলো, আর আমার একমাত্র ভাগ্নি তিন দিন দানা-পানি কিছু স্পর্শই করলো না।’
-‘আমার তো কোনো বড় বোন নেই। আমার বোনটা আমার চেয়ে অনেক ছোট। একদিন আমিও কি তার ওপর এভাবে চেপে বসবো?’
-‘বোন বড় কি ছোট সেটা কোনো বিষয় না। তার যখন সামর্থ্য হবে তখন সে-ই তোমাকে মায়ের মতো আগলে রাখবে। ভাইয়ের ব্যাপারে সব বোনই এক। আমার বোনের কথাই বলি। সে ধরনীর মতোই সর্বসংহা। কিন্তু আমার ব্যাপারে ঠাট্টাচ্ছলেও দুলাভাই যদি একটা কথা বলেছেন তো আর রক্ষা নেই। রাত বেড়ে যাচ্ছে। চঁদের আলোয় এভাবে শুয়ে-বসে গল্প করলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। চলো, এক কাপ চা খেয়ে কাজে লেগে পড়ি।’
চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম। দোকানদার চা বানিয়ে বলল-দয়া করে একটু আগায়া নেন। মামা চাওয়ালার এ কথা সংগত মনে করল না। বলল-‘তুমি হলে চা বিক্রেতা, আমরা হলাম ভদ্র-শিক্ষিত (হতে পারি বেকার) কাস্টমার। তোমার উচিত আমাদের হাতে চা তুলে দেয়া।’
-‘এতদিন তো তাই দিছি এহন এক সমস্যার জন্যিই তো......।’
-‘সমস্যা কী?’
-‘আছে।’ লোকটা লাজুক হাসি হেসে মুখ ফেরালো। মামা বলল-‘ তোমার সমস্যাটা জানতে চাচ্ছি।’
-‘কোন সমস্যাটা জানতে চান? গরিব মাইনষের তো সমস্যার অন্ত নাই।’
-‘কথা এত পেঁচাও কেন? যে সমস্যাটার কারণে তুমি আমাদের হাতে চা তুলে দিতে পারছো না সেটা জানতে চাচ্ছি।’
-‘সেটা কইতে শরম লাগে?’
-‘পাছায় ফোঁড়া-টোড়া..?’
-‘সেরকম কিছু না।’
-‘তাহলে শরম লাগে কেন?’
লোকটা বুঝলো তার সমস্যা বলতেই হবে। সে ডান পা দেখিয়ে বলল-‘সমস্যা এইটা।’
-‘কী হয়েছে ওটার?’
-‘মচকে গেছে।’
-‘কেমনে?’
-‘ম্যানহোলে ঢুইকা গেছিল।’
মামা কথাটা শুনে খুব দুঃখিত হল। তারপর গর্বিত চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল-‘দেখলে রিন্টু, আমি মানুষকে কতবড় বিপদ থেকে মুক্ত করার মিশনে নেমেছি?’
আমরা হাঁটছিলাম আর ঢাকনা খোলা ম্যাহোলের সন্ধান করছিলাম। মামার এক হাতে ডায়েরি আরেক হাতে জলন্ত সিগারেট আর পকেটে কলম। কোনো ঢাকনা খোলা ম্যানহোল দেখলেই সিগারেটটা ঠোঁটে চেপে ধরে সেটার নম্বর দিচ্ছে এবং পজিশন লিখে নিচ্ছে। এ পর্যন্ত চারটা পেয়েছে।
আমাদের দু’জনের দৃষ্টিই নিচের দিকে। হঠাৎ সামনে কে যেন পথ আগলে আচানক বলল-‘ফায়ার!’
আমরা দু ’জন একযোগে চমকে উঠলাম। সরাসরি ফায়ার করে দিতে চাচ্ছে। তারপর যে ফায়ার বললো তার দিকে তাকিয়ে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ লংজাম্পটি দিলাম। চট পরিহিত মাথায় জটাওয়ালা এক লোক। তার হাতে একটা সিগারেট। পরে বুঝলাম, সে মামার কাছে আগুন চেয়েছে। মামা হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা তাকে দিয়ে দিল। সে বলল-‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
মামা বলল- ‘হোয়াই আর ইউ ইন সাস কন্ডিশন?’
মামা ইংরেজিতে প্রশ্ন করল বোধহয় এটা যাচাই করতে যে, সে আরও কোনো ইংরেজি জানে কিনা বা বোঝে কিনা। সে বলল-‘ওমেন-এ্যা ওমেন হ্যাভ বিট্রেট উইথ মি এ্যান্ড মেড মি ম্যাড।’
তার মানে লোকটা শিক্ষিত। কিছু কিছু পাগল ইংরেজি বলে। সেটা তাদের নিজের মতো। অন্যের ইংরেজি বুঝে তার নির্ভুল উত্তর কোনো পাগলকে আজ পর্যন্ত করতে দেখিনি। মামা বললেন-‘প্লিজ, টেল আস ব্রিফলি।’
-‘মাই ওয়াইফ ওয়েন্ট এ্যাওয়ে উইথ হার লাভ। সি হ্যাড টেকেন অল মাই প্রপাটিজ এ্যান্ড মাই লাভিং ডটার-মাই হার্ট। আই কুড লিভ উইদাউট অল মাই প্রপার্টিজ বাট ক্যান্ট মাই ডটার। হো ক্যান লিভ উইদাউট হিজ হার্ট?’
লোকটা তার পাগল হবার কারণ সংক্ষেপে বলে চলে গেল সিগারেট টানতে টানতে। আমরা দুঃখিত হলাম। স্ত্রী সব সম্পদ নিয়ে চলে গেছে আরেক জনের সাথে। সেটা তার পাগল হবার কারণ নয়। পাগল হয়েছে মেয়েটার জন্য। বাবা জিনিসটা সত্যিই অন্যরকম।
মামা বলল-‘ওর বেঁচে থাকার এখন আর কোনো স্বার্থকতা আছে?’
-‘না, ও বিধাতার সঙ্গে সাপলুডু খেলেই বাকী জীবন পাড় করবে।’
-‘তোমার কি বিধাতায় বিশ্বাস আছে?’
-‘আছে অথবা নাই এই দু’টোর মাঝামাঝি আছি।’
-‘তাহলে ওকে দিয়ে বিধাতার সাথে সাপলুডু খেলাতে যাচ্ছো কেন?’
-‘শিল্পী সুমন চট্টোপাধ্যায় বর্তমানে কবীর সুমন তার এক গানে এ কথা বলেছেন। গানটা আমার খুব প্রিয়।’
-‘ও, তুমি বোধহয় খুব গান শোনো?’
-‘কী করবো? আমার তো আপনার মতো কোনো প্রজেক্ট নেই। আচ্ছা মামা, ওর জীবনের স্বার্থকতার কথা বলছেন। আমাদের দু’জনের কথা একবার ভেবে দেখেছেন। আপনি আজ বড় বোনের ঘাড়ে বসে ঢাকনা খোলা ম্যানহোল গুণছেন, আর আমি ভবিষ্যতে ছোট বোনের ঘারে বসে হয়তো অন্য কিছু গুণবো। আমাদের জীবনের কী স্বার্থকতা?’
-‘তুমি কথাটা ঠিক বললে না। তাই বলে আমরা ওর পর্যায়ে পড়ি না। আমরা কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। ও তো সব চেষ্টা বাদ দিয়ে হাত-পা ধুয়ে আছে।’
আমি তর্ক করতে পারি না, ব্যাপারটা আমার ভালোও লাগে না। তাই মামার সঙ্গে তর্ক বাড়ালাম না। হাঁটতে লাগলাম আগের মতো। কিছুক্ষণ পর মামা ডাকল-‘রিন্টু।’
-‘জি মামা।’
-‘তোমার কি মনে হয় না, জীবনে বিয়ে না করে ভুল করেছি?’
-‘হু।’
-‘কেন?’
-‘সুন্দর ও স্বার্থক জীবনের সাথে বিয়ে, ঘর-সংসার ইত্যাদির সম্পর্ক আছে।’
-‘ভাব ঐ লোকটার কথা। মেয়েটার বিচ্ছেদ ব্যাথায় সে.....। অমনটি তো আমারও হতে পারতো। মেয়ে মানুষকে কি বিশ্বাস করা যায়?’
-‘একজনকে দিয়ে সবাইকে বিচার করা ঠিক না। অনেকেই তো সুখে-শান্তিতে সংসার করছে। আমার মায়ের কথা ভাবুন, আপনার বোনের কথা ভাবুন। তারা কি সেই রকমের মেয়ে? বেলাও তো সেই রকমের না। বেলাকে যে ছেলে বিয়ে করবে সে সুখের মহাসমুদ্রে ভাসবে আজীবন। তার জীবন ধন্য হবে।’
মামা কিছু বললো না। বোধহয় আমার যুক্তির কাছে কুপোকাত হল।
আমরা হাঁটতে লাগলাম চুপচাপ। হাঁটতে হাঁটতে টের পেলাম আমার মাথার পুরনো ব্যাথাটা সামান্য জেগে উঠেছে। রাত জাগলে সাধারণত হয়। আমি বাম হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে এগুতে লাগলাম। হঠাৎ একটি মেয়ে আমাদের গায়ে প্রায় ছোঁয়া দিয়ে চলে গেল। তার শাড়ীর আঁচল বোধহয় উড়ে এসে মামার মুখে পড়েছিল। মামা থমকে দাঁড়াল পেছন ফিরে। মেয়েটি সামান্য একটু দূরে গিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। হাত দিয়ে আমাদেরকে ইশারা করল। বাবা বলল-‘এর মাথায়ও কি কোনো.....?’
-‘না মামা, এর মাথায় কোনো সমস্যা নেই।’
-‘তাহলে এমন করছে কেন?’
-‘সে আমাদেরকে খদ্দের মনে করেছে।’
-‘খদ্দের! কিসের খদ্দের?’
দেখলাম মামা এ ব্যাপারে অজ্ঞ। আমি বললাম-‘মামা, এরা ভাসমান দেহপ্রসারিনী।’
-‘বলো কী! কি বাজে একটা ব্যাপার। এ ব্যাপারেও আমি একটা প্রজেক্ট হাতে নেব।’
-‘এদের ব্যাপারে কী কাজ করবেন?’
-‘এদের সংখ্যা কত, কী হারে বাড়ে, কেন এরা এ পথে আসে, কেমন এদের জীবন জীবিকা, কারা এদের খদ্দের সব বের করবো।’
-‘মামা, ভীষণ জটিল কাজ, পারবেন না।’
-‘কেন, পারবো না কেন?’
-‘ভাসমান পতিতাদের মোটামোটি একটা তালিকা করতে পারলেও তাদের খদ্দেরদের তালিকা করতে পারবেন না। আপনার চোখে যে নিস্পাপ কলেজ পড়–য়া কিশোর সেও এদের খদ্দের। ধনী ব্যাবসায়ী, জনদরদী রাজনীতিক তারাও এদের খদ্দের। সে সব দিনমজুরের কষ্ট দেখে আপনার চোখে জল নেমে আসে, তারাও তাদের কষ্টার্জিত উপার্যন দিয়ে জৈবিক ক্ষুধা মেটাতে এদের কাছে আসে। আপনি তাদের সবার পরিচয় কেমন করে বের করবেন? আপনি কি করে বুঝতে পারবেন নিশাচর রূপসীদের শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে কতটা বেদনা?’
চাঁদের আলোতেও টের পেলাম মামার মুখটা বিমর্ষ হল। সে কিছু না বলে হাঁটতে লাগলো তার মতো। আমার মাথার ব্যাথাটা বেড়ে গেল আরও। আমি ঠিক মামার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পা ফেলে হাঁটতে পারছিলাম না। পিছিয়ে পড়ছিলাম। মামার সেদিকে খেয়াল ছিল না। মামা হাঁটতে হাঁতে হয়তো কিছু একটা বলেছিল। আমি অনেকটা পিছিয়ে পড়ায় তা শুনতে পাইনি। সে পেছনে তাকিয়ে দেখে আমি অনেকটা পেছনে। আমি ততক্ষণে মাথাটা চেপে ধরে বসে পড়েছি। মামা ছুটে এল আমার কাছে। বলল-‘সমস্যা কী রিন্টু?’
-‘প্রচন্ড মাথা ব্যথা হচ্ছে।’
-‘হঠাৎ মাথা ব্যাথা কেন?’
-‘হঠাৎ নয়, বেশ পুরনো-যখন হয় তখন সহ্য করা কঠিন। বিশেষভাবে রাত জাগলে বেশি হয়।’
-‘সেটা তুমি আমাকে বলবে না? তাহলে কি আমি তোমাকে সঙ্গে আনতাম? এখন কী করবো? তোমাকে হাসপাতালে নেব?’
-‘না, আপাদতঃ বাসায় নিলেই চলবে। একটু শুয়ে থাকলে চলে যাবে।’
-‘যদি না যায়?’
-‘যাবে, সব সময় যায়।’
সাত
পরদিন সকালে মামা বাসায় এল। সাথে বেলা। মা পারে তো বেলাকে বুকের ভেতর লুকিয়ে ফেলে। এত সুন্দর মেয়ে সে না-কি সারা জীবনে দেখেনি। আসলে কি স্কুল, কি কলেজ, কি বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও আমার কোনো মেয়ে বন্ধু ছিল না। এ বয়সী কোনো মেয়ে কোনোদিন আমাদের বাসায় পা রাখেনি, তাই বোধহয় মা’র এই আবেগ। বেলা বলল-‘ব্যথাটা কত দিন ধরে?’
আমি জবাব দেবার আগেই মা বলল-‘অনেক দিন ধরে।’
-‘ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি?’
-‘কত করে বলছি, যাব যাব করে যাচ্ছে না। এত বড় ছেলে-আমি কি ধরে নিয়ে যেতে পারি?’
-‘রোগ নিয়ে অবহেলা করা ঠিক না।’
-‘তা কি ও বোঝে?’
মা নাস্তা আনতে চলে গেল। বেলা বলল-‘অমন চুপ করে আছেন যে? কিছুই তো বলছেন না?’
-‘আমি কিছু বলার সুযোগ পেলাম কোথায়? মা-ই তো সব বলে দিলেন।’
-‘অসুস্থ মানুষকে দেখতে এসেছি অথচ কিছুই নিয়ে আসিনি ব্যাপারটা অদ্ভূত না?’
-‘না, এটা আমার কাছে কোনো অদ্ভূত ব্যাপার না।’
-‘আসলে আপনি কী ফল পছন্দ করেন অনুমান করতে পারছিলাম না। আমি একটা ফলের দোকানের সাথে কথা বলে এসছি। আপনি কী কী ফল পছন্দ করেন বলুন, ওদের মোবাইলে ফোন করলেই পাঠিয়ে দেবে।’
-‘তার কোনো দরকার নেই।’
-‘দরকার নেই বললে তো হবে না। আমি দুই হাজার টাকা রেখে এসেছি।’
-‘যাবার সময় ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।’
-‘কী বলছেন? ফল কেনার জন্য টাকা দিয়ে সে টাকা ফেরত নিয়ে যাব? অদ্ভূত মানুষ আপনি।’
-‘আপনি আমার চেয়েও অদ্ভূত।’
বেলার সঙ্গে তর্ক করলে তর্কের শেষ পাওয়া যাবে না। মামা বসে ছিল চুপচাপ। আমি মামার সাথে কথা বললাম। বললাম-‘আমার কারণে কাল আপনার প্রজেক্টের কাজে ডিসটার্ব হল।
মামা বলল-‘সেটা আমার জন্য বিশেষ কোনো ক্ষতির কারণ নয়। আমার সময়ের অভাব নেই, বিশেষ কোনো তাড়াও নেই। আমার কাজ আজ না হলে কাল, কাল না হলে পরশু, পরশু না হলে দশ বছর পরে হবে।’
মা নাস্তা নিয়ে এল। বেলার মাথায় হাত রেখে বলল-‘খাও মা।’
আমি বললাম-‘এত বড় মেয়ের সাথে এমন আহলাদ দিয়ে কথা বলো না মা।’
বেলা ফস করে উঠল-‘আপনার হিংসা হচ্ছে?’
-‘কিছুটা তো হচ্ছেই।’
-‘হিংসুটে!’
আট
তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিন বেলার সঙ্গে দেখা। দেখা কোনোদিন না হলেও কথা প্রতিদিনই হয়। মামার সঙ্গে প্রায়ই তার বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজে বের হই। ওদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ভুলে যাই আমার একটা চাকরির প্রয়োজন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে বাবা-মা, ছোট একটা বোন।
মা-ই আমার ভেতর ব্যাপারটা জাগিয়ে দিল। একদিন মা বলল-‘এভাবে এলোমেলো চললে হয়? চাকরি-বাকরির একটা ব্যবস্থা করতে হবে না? বেলা মেয়েটা যেন ফুলের মতো। কি সুন্দর কথা-বার্তা! কি সুন্দর আচার-আচরণ! একটা চাকরি হলে........।’
আমি মাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে বললাম-‘আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখ না তো মা। চাকরি হলেই কত বড় চাকরি হবে? ওরা অনেক সচ্ছল পরিবার। অমন সুন্দর মেয়ের জন্য অনেক দামি দামি ছেলে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে।’
অথচ ক’দিনের মধ্যে আমিই আটকে গেলাম সেই আকাশ-কুসুম স্বপ্নের জালে। মনকে যতই বোঝাই-এ সম্ভব নয়। আমার অভুজ মন ততই বলে-কেন সম্ভব নয়? পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। তুমি মিছেমিছি ভয় পাচ্ছো। সাহস যোগাও দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। ছেলে হিসাবে তুমি কম কিসে?
শুরু হল আমার স্বপ্ন নিয়ে পথ চলা। বেলাকে জড়িয়ে স্বপ্ন। স্বপ্ন ঘরের-সংসারের। স্বপ্ন দেখতে দোষ নেই। কোনো মূল্য দিতে হয় না স্বপ্নের জন্য। কেউ বাঁধাও দেয় না এতে। হাজারটা বাঁধা এসে পথ আগলায় স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গেলে। খুব করে ভেবে দেখলাম স্বপ্নের বাস্তবায়ন তো অনেক দূরের কথা, আমি কোনোদিন বেলাকে আমার স্বপ্নের কথা জানাতে পারবো কি-না সেটাই সন্দেহ। কয়েকটি দিন, কয়েকটি রাত বিরতিহীনভাবে ভেবে দেখলাম যে, আমি কোনোদিনও বেলার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পরব না-আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমিই পারো আমার প্রশস্থ জীবনটাকে সুশৃঙ্খল নিয়মের সূতোয় বেঁধে দিতে।
নয়
এক সকালে বেলার ফোন এল। কন্ঠে বেশ উত্তেজনা-‘আপনি ঝটপট তৈরী হয়ে নিন, আমি আসছি।’
-‘কোথাও বেরুবেন না-কি?’
-‘হ্যাঁ, একটু বেরুবো।’
-‘কোথায়?’
-‘এসেই বলবো।’
সেই পুরণো রহস্য। কোথায় যাবে, কেন যাবে তা ফোনে বললে যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে।
সারে দশটায় বেলা এল। চঞ্চল হরিণীর মতো সে ছটফট করছে। মা এক গ্লাস লেবুর শরবত খাওয়াতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারল না। তার হাতে নাকি এতটুকু সময় নেই। বেলা বলল-‘আপনি রেডি?’
-‘রেডি।’
-‘বের হোন তাহলে।’
-‘শুধু সেভটা করবো।’
-‘তাহলে রেডি বলছেন কেন? বেকার মানুষরা যে ঢিলে হয় তা আমার জানা আছে। কখনো কোনো দায়িত্ব কাঁধে পড়ে না তো তাই.....।’
বেলার কথাগুলো মা শুনে ফেললো। আমি কোনো জবাব খুঁজে পাচ্ছিলাম না। খুব লজ্জা হল। মা কষ্ট পেল কি-না কে জানে। বেলা আমাকে সেভ করার সময় দিল না। বলল-‘এমনিই চলুন।’
-‘কিন্তু......।’
-‘আমরা এমন কোথাও যাচ্ছি না যে সেভ করতেই হবে।’
আমার রুমে বেলা বসে থাকায় আমি বাবা-মা’র রুমে পোশাক পড়তে গেলাম। ফিরে আসতেই বেলা লাফ দিয়ে উঠে বলল-‘এতক্ষণ পোশাক পড়তে লাগে? নাকি মা’র কাছে টাকা চেয়ে পীড়াপীড়ি করছিলেন? আমার সঙ্গে যাবেন তো আপনার টাকার দরকার কী?’
আমি বরাবর নির্বাক। কি অদ্ভূত মেয়ে! কোন কথায় মানুষ বিব্রত হতে পারে তাও বোঝে না। মুখে যা আসে বলে ফেলে। এটা মানুষের কোনো গুণ হতে পারে না। অবশ্যই এটা বড় রকমের একটা দোষ। অথচ বেলার চরিত্রের এই দোষটাই আমার কাছে গুণের চেয়েও ভাল লাগলো। মনে হল, এরকম একটা দোষ ওর মধ্যে না থাকলে ও এত সুন্দর হতো না। ও যদি সুন্দর ছবি আঁকতে পারতো, কবিতা লিখতে পারতো, আবৃত্তি করতে পারতো সে গুণগুলো ওর এই দোষটার চেয়ে ভাল লাগতো না আমার।
রাস্তায় নেমে বেলা বলল-‘কিসে উঠবেন ট্যাক্সিতে না অটোরিকশায়?’
আমি বললাম-‘কতদূরে যাবেন? কাছে হলে তো রিকশায়ও যাওয়া যায়।’
-‘আমি তো কোনো লক্ষ্য ঠিক করে বের হইনি।’
-‘মানে?’
-‘মানে লেখাপড়ায় মন বসছিল না। কোনো কিছু করতেও ইচ্ছে করছিল না। তাই মনে করলাম একটু বেরিয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে আমার এমন হয়। তখন বান্ধবী কাউকে ডেকে বেরিয়ে পড়ি। আজ কেন যেন মনে হল, কোনো বান্ধবী নয়, আপনাকে নিয়ে বের হবো।’
-‘ধ্যাত্তারি! আমি ভেবেছি, দরকারি কোনো কাজে কোথাও যাচ্ছেন। বসে বসে টিভি দেখলেই তো পারতেন।’
-‘বললামই তো কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না। যান একটা ট্যাক্সিই ডেকে আনুন।’
ট্যাক্সি ডেকে আনতে হলো না। একটা ট্যাক্সি আমাদের গা ঘেষে দাঁড়ালো। ড্রাইভার জানালা দিয়ে মুখ বের করে বলল-‘কই যাইবেন ছার?’
কোথায় যাব আমি তা বলতে পারছিলাম না। আমি তাকালাম বেলার মুখে। বেলা বলল-‘বুঝতে পারছি না কোথায় গেলে ভাল হয়।’
ড্রাইভার বলল-‘চন্দ্রিমায় যাইবেন? প্রেসিডেন্টের কব্বরের পাশে বইসা প্রেম করা মানে খানদানি প্রেম। আইচ্ছা, সেই প্রেসিডেন্টের শাসন নাকি অবৈধ হইয়া গেছে?’
বেলা ড্রাইভারের কথায় কোনো কান দিলো না। সে বোধহয় ভাবছিল কোথায় গেলে ভাল হয়। ড্রাইভার বলল-‘তায়লে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যান। সেখানে আবার ছিনতাইকারী আর বখাটেদের উৎপাত খুব বেশি। দুইদিন আগে একটা মার্ডার হইয়া গেছে। এক বখাটে নায়িকারে কটু কথা কইছিল। নায়ক তার প্রতিবাদ করায় তার পেটের মধ্যে ছুরি ঢুকায়া দিছে।’
আমি বুঝলাম, ড্রাইভার ব্যাটা বেশি কথা বলে। একে ছেড়ে দেয়া ভাল। বেলা বলল-‘সাভার চলুন।’
আমি বলালাম-‘সাভার কোথায়?’
-‘স্মৃতি সৌধে।’
সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার বলল-‘এইটা একটা ভাল কথা কইছেন। প্রেম করার জন্য খুবই ভাল জায়গা। ঝামেলা খুব একটা হয় না। দারুন একটা জিনিস বানাইছে। বছরে একবার দেশের গণ্যমান্যরা হুরোহুরি করে ফুল দেয়, আর সারা বছর সেখানে হয় প্রেমের মেলা।’
আমি ড্রাইভারকে ধমক না দিয়ে পারলাম না। বললাম-‘আপনি চুপ করেন তো। এত প্রেম প্রেম করছেন কেন? আমরা প্রেম করতে যাচ্ছি না।’
আমার ধমকে ড্রাইভার মোটেও বিচলিত হলো না। প্রেম করতে যাচ্ছি না-এ কথাটা বিশ্বাসও করলো না যেন। সে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। ব্যাদব। চরম ব্যাদব।
বেলার পাশে বসে আমার ড্রাইভারের কথাই বেশি করে মনে হতে লাগলো। সত্যিই যদি কোনোদিন এভাবে বেলার সাথে প্রেম করতে যেতে পারতাম। ব্যাপারটা মনে হতে আমি যেন লজ্জাও পেলাম একটু। মনে হল, বেলা যেন আমার মনের কথা বুঝে ফেলেছে। মেয়েদের না-কি পুরুষের মন বোঝার ক্ষমতা খুব বেশি। হঠাৎ বেলা ধমক দিয়ে উঠলো-‘অমন ফ্যাকাশে হয়ে বসে আছেন কেন?’
-‘কই, ঠিকই তো আছি।’
-‘কিসের ঠিক, আপনার মুখ কেমন সাদা, রক্ত-শূন্য। অমন জড়োসরো হয়ে বসেছেন যে? কোনোদিন কোনো মেয়ের পাশে বসেননি?’
-‘বসেছি, অনেকবার বসেছি।’
-‘কে সেই মেয়ে?’
-‘আমার মায়ের পাশে বসেছি। সেদিনও তো মায়ের পাশে বসে মামার বাসায় গেলাম।’
-‘আবুল!’
বেলা ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললো। ড্রাইভার গাড়ি থামালে আমাকে বলল-‘যান, ড্রাইভারের পাশে গিয়ে আরাম করে বসুন।’
আমি গিয়ে ড্রাইভারের পাশে বসলাম। ড্রাইভার মিটিমিটি হাসতে লাগলো। চরম ফাজিল।
আমি আর বেলা পাশাপাশি হেঁটে স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করছিলাম। না, ঠিক পাশাপাশি হেঁটে নয়। আমি বেলার চেয়ে একটু পিছিয়ে ছিলাম। বেলা দাঁড়িয়ে বলল-‘আমার পাশে হাঁটতে আপনার লজ্জা করে?’
খুবই স্পস্ট প্রশ্ন। এত স্পস্ট প্রশ্নের জবাব দেয়া যায় না। আমি বেলার পাশে চলে গেলাম। বেলা বলল-‘আচ্ছা, সবচেয়ে বড় স্তম্ভটার উচ্চতা কত?’ ভাগ্যিস উত্তরটা আমার জানা ছিল। বললাম-‘একশ’ পঞ্চাশ ফিট।’
-‘একেক জন শহীদের আত্মার উচ্চতা এর চেয়ে অনেক বেশি।’
আমি কোনো মন্তব্য করলাম না। সে এমন কোনো জ্ঞানগর্ভ কথা বলেনি যে, মন্তব্য করতেই হবে। এরকম কথা নাইন/টেন-এর ইংরেজি বইয়ের একটা প্যাসেজে আছে। সে হয়তো সেখান থেকেই কথাটা জেনেছে। আর যদি নিজে থেকেই কথাটা বলে তাহলে সেটা নাইন/টেন-এর বলিকা সুলভ কথা হয়েছে। বেলা বলল-‘এখানে মাঝে-মধ্যে আসেন?’
-‘আসি।’
-‘একা?’
-‘না, বাবার সাথে।’
-‘বাবার সাথে!’
-‘হ্যাঁ। বাবার মনটা যখন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়, কিংবা তাঁর কোনো সহযোদ্ধার কথা মনে পড়ে তখন তিনি এখানে আসেন। আমাকেও আসতে হয় তাঁর সঙ্গে।’
-‘কেন, আপনাকে আসতে হয় কেন?’
-‘বাবার হুইলচেয়ার ঠেলার জন্য।’
-‘বাবা হুইল চেয়ার ব্যবহার করেন?’
-‘হ্যাঁ, যুদ্ধে তাঁর দু’টি পা-ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি হাঁটতে পারেন না।’
-‘তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা! তিনি কি বেঁচে আছেন?’
-‘হু।’
-‘কই দেখলাম না যে?’
-‘হুইলচেয়ার ঠেলে সবার সামনে যেতে চান না, তাই....।’
-‘যুদ্ধের সময় আপনার বাবার বয়স কত ছিলো?’
-‘বলা যায় বাবা কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।’
-‘আপনার মা পঙ্গুত্ব দেখেই .......?’
-‘হ্যাঁ, মা বড়লোক বাবার মেয়ে। কি এক ঘটনাক্রমে বাবার সঙ্গে তার পরিচয়। প্রথম পরিচয়েই মা বাবাকে ভালবেসে ফেললেন। নানাভাই মা’র ভালবাসার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াননি। পয়ত্রিশ বছর ধরে মা বাবার হুইল চেয়ার ঠেলছেন। এই কাজটায় তাঁর সবচেয়ে বেশি সুখ। কাজটা আমিও করছি অনেকদিন ধরে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। এই দেখুন, আমার দুই হাতে কেমন দাগ বসে গেছে। এই দাগগুলো আমার খুব প্রিয়। যখন বাবা থাকবে না তখন এই দাগগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি বাবাকে দেখবো। আমার দেশপ্রেমিক বাবা। আমার প্রিয় মানুষ।’
তাকিয়ে দেখি বেলার চোখে পানি। কথাগুলো বলার সময় আমার কন্ঠে বোধহয় আবেগ চলে এসেছিল। সেই আবেগ যে বেলার চোখে পানি নিয়ে আসবে তা বুঝতে পারিনি। আর বেলার মতো চটপটে একটি মেয়ের চোখে যে এত সহজে পানি নেমে আসতে পারে তাও আমার কল্পনায় ছিল না। মনে তৃপ্তি পেলাম। স্মৃতি সৌধে আসাটাই ভাল হয়েছে, না হলে কখনোই বেলাকে জানানো হতো না যে, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। হয়তো এরপর থেকে বেলা আমার প্রতি বিশেষ সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাবে। কথায় কথায় ওভাবে অপমানও করবে না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এই সুযোগে বেলাকে আমার ভালবাসার কথা জানাবো। ডাইরেক্টলি কিছু বলতে পারবো না। বেলা যেরকম বুদ্ধিমতি তাতে ইনডাইরেক্টলি বললেই সে বুঝে ফেলবে। তারপর তার প্রতিক্রিয়া সে জানিয়ে দেবে।
একটা গাছের ছায়ায় সবুজ ঘাসের মাদুরে আমরা বসলাম মুখোমুখি। বেলা বলল-‘কিছু ভাবছেন?’
-‘হু।’
-‘কী ভাবছেন?’
-‘না, কিছু না।’
-‘কী অদ্ভূত! এই বললেন ভাবছেন আবার বলছেন কিছু না। বলেন কী ভাছিলেন।’
-‘আমি একটা মেয়েকে ভালবাসি।’
এ কথা শুনে বেলা হাসিতে লুটিয়ে পড়লো। এটা কি হাসিতে লুটিয়ে পড়ার মতো কোনো কথা? ভেবেছিলাম, বেলা জিজ্ঞেস করবে-মেয়েটি কে? কোথায় থাকে? কী করে? তখন আমি ইঙ্গিতে তাকে নির্দেশ করবো। অথচ সে কোনো প্রশ্নে না গিয়ে হাসতে লাগলো পাগলের মতো। হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি বের করে ফেলল। তার হাসি দেখে আমার মুখটা লাল হয়ে গেল। বললাম-‘ওভাবে হাসছেন কেন? কোনো হাসির কথা বলেছি কি?’
-‘না, তা বলেন নি। হি হি হি।’
-‘তাহলে?’
-‘মানে আপনার মতো........।’
-‘আমার মতো কী?’
-‘আপনার মতো ল্যাভেন্ডিস যে কি-না একটা মেয়ের পাশে বসতে........। আপনি কেমন করে কোনো মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলবেন-আমি তোমাকে ভাল........হি-হি-হি।’
বেলার হাসি থামেই না। আমার খুব রাগ হলো। শুরু থেকেই সে আমাকে নানারকম অবহেলামূলক কথা বলছে। এখন আবার বলছে ল্যাভেন্ডিস। সিদ্ধান্ত নিলাম তখনই বলবো তাকে ভালবাসার কথা। ইনডাইরেন্ট নয়, ডাইরেক্ট। এ্যাকশন এ্যাকশন ডাইরেক্ট এ্যাকশন।
ডাইরেক্ট এ্যাকশনে যাবার আগেই বেলা বলল-‘আমাকে ফুসকা খাওয়ান।’
ফুসকার কথা উঠলেই আমার চোখে ভেসে উঠে টিএসসিতে দেখা সেই লোকটার চেহারা। তখন আমি কিছু সময়ের জন্য ফ্যাকাশে হয়ে যাই। যাহোক, বেলার জন্য ফুসকা আনতে উঠে দাঁড়ালাম। বেলা বলল-‘টাকা নিয়ে যান।’
-‘টাকা আমার কাছে আছে।’
-‘মা’র কাছ থেকে কয়টা টাকা চেয়ে এনেছেন তা আমাকে ফুসকা খাইয়ে শেষ করবেন? ওটা রেখে দেন আপনার কাছে।’
-‘মা আমাকে টাকা দেয় খরচ করার জন্য। আমি বেকার বলে আমার কোনো দুঃখ নেই, আমার বাবা-মায়েরও না। এদেশে এমন ভাগ্য অনেক ছেলের।’
-‘বাহ! যুক্তি দিয়ে কথা বলতে শিখেছেন দেখছি। আপনার কিছু একটা হবে। আপনি আমার কাছ থেকেই টাকা নিয়ে যান। আপনার কাছ থেকে না হয় পরে একসময় খাব।’
-‘না, আজই আমার টাকায় ফুসকা খাওয়াবো। আমার কাছে পাঁচশ’ টাকার একটা নোট আছে।’
ফুসকার অর্ডার দিতেই ফুসকাওয়ালা বলল-‘ভাঙতি দিতে অইবো।’
-‘আমার কাছে ভাঙতি নেই। পাঁচশ’ টাকার নোট।’
-‘তায়লে ফুসকা দিতে পারতেছি না।’
-‘তোমার কাছে তো ভাঙতি আছে।’
-‘পাঁচশ’ টাকার ভাঙতি দিয়া এক পেলেট ফুসকা আমি বেচি না।’
-‘তাহলে দুই প্লেট দাও।’
-‘ছয় পেলেট নিলে দিতে পারি।’
-‘ছয় প্লেট ফুসকা কে খাবে? আমরা মানুষ দুই জন।’
-‘তাহলে অইবো না।’
-‘দিনে দিনে এদেশের মানুষ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। রিকশাওয়ালা, ট্যাক্সিওয়ালা, ফুসকাওয়ালা এই শ্রেণির মানুষ আগে এভাবে কথা বলতো না।’
-‘আরও খারাপ অইবো। সামান্য ব্যবসা করতে আইসা দিনে ট্যাক্স দিতে অয় হাজার ট্যাকা। মাথা ঠিক থাকে?’
-‘কাকে ট্যাক্স দিতে অয়?’
-‘তা আমারে জিগ্যান ক্যান? যারা দ্যাশ চালায় তাগো জিগ্যান।’
আমি ফুসকার দোকান থেকে ফিরে আসছিলাম। কে যেন পেছন থেকে আমার জামা টেনে ধরলো। তাকিয়ে দেখি মামা। খুবই বিস্মিত হলাম। বললাম-‘মামা, আপনি?’ মামা আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল-‘তুমি কোথায় যাচ্ছো?’
-‘যাচ্ছি না কোথাও, এখানেই এসেছি। আপনি কোথা থেকে?’
-‘সাভার ব্যাংক টাউনে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে এসেছিলাম। ফেরার পথে মনে করলাম মুক্তিযুদ্ধের শহীদের উদ্দেশ্যে একটা লাল সালাম জানিয়ে যাই। ও তোমার কাছে পাঁচশ’ টাকার ভাঙতি হবে?’
-‘আরে আমি-ই তো আছি সেই ঝামেলায়। চলুন বেলার কাছে আছে।’
-‘বেলা এসছে? আশ্চার্য! চলো তো।’
মামাকে দেখে বেলা অবাক হল আবার উৎফুল্লও হলো খুব। উৎফুল্ল হয়ে ভুলে গেল ফুসকার কথা। ভুলে যাওয়াটা আমার জন্য ভাল হল। না হলে আমাকে আবার কিছু কথা শুনতে হতো। মামা বলল-‘মা জননী, পাঁচশ’ টাকার ভাঙতি হবে?’
-‘ভাঙতি দিয়ে কী হবে?’
-‘একজন অভাবী মানুষকে বিশ/পঁচিশটা টাকা দিতে চাই। বেচারা সাতদিন ধরে না খেয়ে আছে।’
-‘সাতদিন ধরে না খেয়ে আছে! বেঁচে আছে এখনো?’
-‘আছে খুব কষ্টে। ওঠার ক্ষমতা নেই বোধহয়। শুয়ে আছে।’
-‘চলো তো দেখি।’
গিয়ে দেখি মাঝ বয়সী একজন শক্ত-সামর্থ্য লোক ঝাউগাছের ছায়ায় শুয়ে আছে টান টান হয়ে। আমাদের দিকে পিটপিট করে একটু তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করলো। আমি বললাম-‘সমস্যা কী আপনার?’
লোকটা বোধহয় একটু ঘাবড়ালো। জীবনে এই প্রধম আমার কথায় কেউ ঘাবড়ে গেল। আমি একটু বীরত্বের ভাব নিয়ে তাকালাম বেলার দিকে। লোকটা কিছু বললো না। আমি আবার বললাম-‘সমস্যা কী আপনার?’ সে বলল-‘কুনু সমস্যা নাই তো।’
-‘আপনি নাকি সাতদিন ধরে না খেয়ে আছেন?’
-‘হ, সাতদিন ধইরা এক ফোটা পানিও খাইনাই।’
-‘পানি খাননি কেন? পানি তো বিনা পয়সায় পাওয়া যায়।’
-‘ভাতই যহন খাইতে পাই না তহন পানি খাইয়া কী অইবো? পানিতে কি প্যাট ভরে?’
-‘সাত দিন পানি না খেয়ে কেউ বাঁচতে পারে না।’
-‘এইডা কী কন? এই কতা তো আগে জানতাম না।’
ততক্ষণে বেলা রেগে গেছে ভীষণ। তার মুখ লাল হয়ে গেছে। একেতো রোদের তাপে লাল, তার ওপর রাগে লাল। দুই লাল মিলে লালে লাল। মনে হচ্ছে মুখে একটু ছোঁয়া দিলেই রক্ত লেগে আসবে আঙুলে। আমার একটু ছোঁয়া দিতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। মাঝ থেকে এই ইচ্ছের কথা ভেবে আমি লজ্জা পেলাম। ভয়ও হলো একটু। বেলা আবার আমার ইচ্ছের কথা বুঝে ফেলে কি-না। যে বুদ্ধিমতি মেয়ে। আচানক ধমকে উঠতে পারে-‘আপনি মনে মনে আমার মুখ ছুঁইতে চাইছেন কেন?’
না, বেলা আমাকে তা বললো না। লোকটাকে বলল-‘করেন কি আপনি?’ প্রশ্নটা ঝাঁঝালো ছিল না। তবু লোকটা ঘাবড়ে গেল বেশ। মনে হল, তাকে কোনো পুলিশ প্রশ্ন করেছে। লোকটা বলল-‘কুলির কাম করি। রাইতে ট্রাক থিক্যা মাল নামাই।’
-‘আর দিনে ভিক্ষা করেন?’
-‘তওবা তওবা। ভিক্ষা করুম ক্যান? পত্যেক রাইতে আমার ইনকাম তিন/চাইরশ’ ট্যাহা।’
-‘তাহলে তাকে বলছেন কেন যে সাত দিন ধরে না খেয়ে আছেন?’
-‘মা জননী, মাপ কইরা দেন। আমি একটু আগে টাকি মাছের লাবড়া আর মাসকালাইর ডাইল দিয়া দুই পেলেট ভাত খাইছি। সত্যি কথা অইল ওনারে দেইখ্যা আমার মনে অইলো লোকটা সাদা-সিদা, ব্যাক্কল কিসিমের। যদি কিছু পাই তো মন্দ কী?’
-‘একজন এম.এ. পাস মানুষের সাথে আপনি চিটারি করেছেন। আপনাকে পুলিশে দেব।’
পুলিশকে এদেশের সবশ্রেণির মানুষই সব সময় ভয় পায়। ন্যায়-অন্যায় যাই হোক পুলিশের হাতে পড়লে মহাবিপদ এরকমটিই এদেশের বেশির ভাগ মানুষের ধারনা। প্রবাদ আছে-বাঘে ছুঁলে এক ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে দশ ঘা। পুলিশের কথা শুনে লোকটা কাহিল হয়ে গেল। বেলার সামনে হাত জোর করে বলল-‘মা জননী, এইবার মাফ কইরা দ্যান। আর কুনুদিন এম.এ পাসের সাথে টিচারী করুমা না।’ আমি বললাম-‘টিচারী না, চিটারী।’
মামা বেলাকে প্রায়ই মা জননী বলে। বোধহয় এই জন্যই বেলার মনটা একটু গললো। কিছুটা কোমল কন্ঠে বলল-‘না, ক্ষমা নেই। আপনাকে শাস্তি পেতেই হবে। আমি পুলিশ ডাকছি।’
আমিও একটু ঘাবড়ে গেলাম। বেলা সত্যিই কি পুলিশি ঝামেলায় যাবে? এসবের আদৌ দরকার আছে কি? মামা বলল-‘মা জননী, তুই পাগলামো করছিস। ও যা করেছে তাকে চিটারী না ভেবে পজিটিভভাবে নিতে পারিস। ওর অভিনয় ক্ষমতা......।’
-‘তুমি চুপ করো মামা। তুমি কোনো কথা বলবে না।’
-‘কেন, চুপ করবো কেন?’
-‘একটা অশিক্ষিত মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে তোমাকে বোকা ভাবে। তোমার জন্য আমার কষ্ট হয় মামা। তোমার বোনটা মরে গেলে তোমাকে কে আগলে রাখবে বলো?’
বেলার চোখে আবার পানি চলে এল। আমি বুঝতে পারলাম, মেয়েরা যত কঠিন আচরণই করুক না কেন তাদের সবার মনই একই রকম নরম। মামা বলল-‘কেন তুই আছিস না? মা থাকতে কোনো সন্তানের কষ্ট হয়?’
-‘মা কারো চিরকাল বেঁচে তাকে না।’
-‘তুই এমন কথা বলিস না। আমি শৈশবে একটা মাকে হারিয়েছি। এই মা না থাকলে আমার পৃথিবীতে আর কিছু যে থাকে না।’
পরিবেশটা ভারী হয়ে উঠলো। আমার চোখেও বোধহয় পানি এসে যাচ্ছিলো। তখন নাটের গুরু লোকটা একটা সুন্দর কথা বলে ভারাক্রান্ত পরিবেশটাকে অন্যদিকে নিয়ে গেল। লোকটা বলল-‘মা জননী, আপনি খামোখা কষ্ট পাইয়েন না। ওনার মতো দুই/চাইরজন ভাল মানুষ দুনিয়ায় আছে বইলাই দুনিয়াডা এহনো টিকা আছে। নইলে....।’
মামা বলল-‘চলো, আমরা সবাই মিলে ফুসকা খাব। এ্যাই তুমিও চলো আমাদের সাথে।’
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের ফুসকা খাওয়া হল না। কারণ আমার মাথার ব্যাথাটা ভীষণভাবে চাড়া দিয়ে উঠলো। এবং সেই প্রথম মাথার ব্যথায় আমি জ্ঞান হারালাম।
দশ
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলাম, আমি এক ডাক্তারের চেম্বারে শুয়ে আছি। চারিদিকে তাকিয়ে বুঝলাম, যে ডাক্তারের চেম্বারে শুয়ে আছি তিনি অবশ্যই খুব বড় ডাক্তার। আমার মাথার কাছে বসে আছে মামা। একটু দূরে একটা চেয়ারে বসে আছে বেলা। তার মুখটা বিষন্ন।
মামা বলল-‘ডাঃ সারোয়ারুল ইসলাম। খুব বড় নিউরো সার্জন। এতদিন ছিলো আমেরিকায়। সম্প্রতি দেশে ফিরেছে। ও আমার ক্লাশমেট ছিলো। স্কুল আর কলেজে আমরা এক সঙ্গে পড়েছি। অসাধারণ ব্রিলিয়ান্ট ছিলো স্টুডেন্ট হিসেবে। আমাদের স্কুলের অংকের স্যার ক্ষিতিশ বাবু কোনো জটিল অংকের প্যাঁচে পড়ে গেলে সারোয়ার প্যাঁচ খুলে দিতো। সবাই ওকে ডাকতো স্ক্রুডাইভার। প্যাঁচ খোলার স্ক্রুডাইভার। সবাই ওকে বলেছিলো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। কিন্তু ও এইচ.এস.সি শেষ করে ভর্তি হলো ঢাকা মেডিকেলে। তারপর গ্লাসকো। তারপর আরও অনেক কিছু। সে তোমাকে দেখেছে। খুব ভাল করে দেখেছে। নিজের প্যাসেন্ট হিসাবে নয়-দেখেছে বন্ধুর ভাগ্নে হিসেবে। সিটি স্ক্যানসহ অনেকগুলো টেস্ট দিয়েছে। টেস্টের রেজাল্ট হাতে পেলেই শুরু হবে ট্রিটমেন্ট। আশাকরি সুস্থ হয়ে যাবে। তবে সে এখন তোমার সাথে কথা বলবে।’
মামা হরবর করে অনেক কথা বলে গেল এক সঙ্গে। আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। মামার মুখে তাকিয়ে ছিলাম বোকার মতো। মামা বলল-তুমি কিছু খাও। তারপর ডা. সারওয়ার তোমার সাথে কথা বলবে।
-আমি কিছু খাবো না মামা।
-দূর্বল হয়ে গেছো তো।
-কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
-ফলের জুস খাও একটু। বেলা........।
বেলা ব্যাগ থেকে একটা জুসের বোতল বের করলো। বুঝলাম, খেতে হবে। তাই একটু খেলাম।
একটু পর এক যুবক এসে বলল-স্যার ডাকছেন।
পাশের কক্ষেই ডা. সারোয়ারুল ইসলাম বসেন। মামা বলল-চলো যাই।
আমরা তিনজনই এক সঙ্গে ডা. সারোয়ারুল ইসলামের কক্ষে প্রবেশ করলাম। ডা. সারোয়ারুল ইসলাম আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। ডাক্তাররা সাধারণত এরকমটি করে না। মামা তো আগেই বলেছেন, তিনি আমাকে আর সব রোগীর মতো দেখেননি, দেখেছেন বন্ধুর ভাগ্নে হিসেবে। ডাক্তার সারোয়াউল ইসলাম আমাকে বসতে বললেন।
তরপর বললেন-এখন কেমন বোধ করছেন?
-এখন খারাপ লাগছে না।
-আপনি কী করছেন?
-কিছু করছি না। করার চেষ্টা করছি।
-ও, পড়াশোনা?
-ইংরজি সাহিত্যে মাস্টার্স।
-ভালো তো।
আমার ভয় হচ্ছিল, বেলা আবার ফস করে বলে না বসে যে, তার কিছু হবে না। সে মামার মত আজীবন বেকার থাকবে। হাঁদা টাইপের মানুষ তো।
কিন্তু না। ডাক্তারের সামনে বেলা আমাকে বিব্রত করলো না। ডাক্তার বললেন-আচ্ছা, আপনার মাথা ব্যথার সমস্যাটা কতদিন ধরে?
-প্রায় ছয় মাস।
-অনেক দিন। এতদিনে কোনো ডাক্তারের কাছে যাননি?
-যাই যাই করে......।
-এখানেই তো অনেকে ভুল করে। আচ্ছা, মাথা ব্যথার সাথে কি কখনো বমি.....।
-জি, হয়েছে কয়েক বার। এমনকি বমির ভাব না হয়েই বমি হয়েছে।
আমি তাকালাম ডাক্তারের মুখে। দেখলাম, কপালটা যেন একটু কুঁচকে গেল। তিনি বললেন-আচ্ছা, কখনো খিচুনি....?
-জি, মাথা ব্যথার সাথে খিচুনিও হয়েছে অনেক বার।
ডাক্তারের কপালের ভাঁজ বেড়ে গেল। তিনি একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে মুখের চেয়ারা স্বাভাবিক করতে চাচ্ছিলেন হয়তো। তার তৃতীয় প্রশ্ন হলো-আপনার কি মনে হয় যে, আপনার ঘ্রাণশক্তি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে?
-জি সেরকমই মনে হয় মাঝে মাঝে।
প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক। সে হিসেবে ডাক্তারের রোগ নির্ণয় হয়ে যাবার কথা।
-চোখে ঝাপসা.....।
-হ্যাঁ, মাথা ব্যথা হলে চোখে ঝাপসা দেখি।
-ব্যথায় জ্ঞান হারালেন ক’বার?
-তিন/চার বার।
হয়তো তার আর কোনো প্রশ্ন নেই। তিনি গ্লাস থেকে একটু পানি খেলেন। দেয়ালে টাঙানো একটা ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন-ঠিক আছে, আসলে টেস্ট না করে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। টেস্টগুলো নিয়ে আসুন তারপর......।
ডাক্তার আমার দিকে হাত বাড়ালেন। বিদায়ী করমর্দন। আমি তার সাথে করমর্দন করে উঠে দাঁড়াতেই লক্ষ্য করলাম, তিনি চোখ ইশারায় মামাকে বসতে বললেন। আমি আর বেলা বাইরে এলাম। মামা বসে রইল।
মামা ডাক্তার সারোয়ারুল ইসলামের কক্ষ থেকে বের হয়ে এলেন প্রায় আধা ঘন্টা পর। তার মুখে হাসি। কিছু লুকানোর হাসি হয়তো। বেলা বলল-ডাক্তার বিশেষ কিছু বললেন?
মামা যেন এ প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। চমকে উঠে বলল-না না, বিশেষ কী বলবে? টেস্টের রেজাল্ট না দেখে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাবে না তো। আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ করলো। আমরা বন্ধু না?
আমি বললাম-তিনি কী অনুমান করছেন?
-অনুমান? এই যুগে অনুমান করে কোনো চিকিৎসা হয় না। টেস্ট করে নিশ্চিত হয়ে তারপর চিকিৎসা চলে। তাই সে কিছু অনুমান করছে না। চলো টেস্ট করাতে যাই।’
টেস্টগুলো করাতে যে অনেক টাকা লাগবে তা আমার জানা ছিলো। আমার কাছে তখন মাত্র পাঁচশ’ টাকা। তাই বললাম-‘আজই যে টেস্ট করাতে হবে তার কোনো মানে নেই। আগে বাসায় যাই।’
এ কথায় মামা রেগে গেল। বলল-‘চুপ করো। তোমাকে টাকার বিষয়ে কিছু ভাবতে হবে না। টেস্টের জন্য যে টাকা লাগবে আমার কাছে তা আছে। তোমার চিকিৎসার ব্যাপারেও বাবা-মাকে কিছু বলতে হবে না। তারা দুঃচিন্তা করবেন। চিকিৎসার জন্য যত টাকা লাগে তার ব্যবস্থা আমি করবো।’
-‘মামা, আমার চিকিৎসাটা ব্যয় বহুল হবে নিশ্চয়।’
-‘হোক, আমার স্থায়ী কোনো ইনকাম নেই তা ঠিক, তবে আমার স্থায়ী কিছু সম্পত্তি আছে। হ্যাঁ, গ্রামে একটা বাড়ি, কিছু জমি-জমা আছে যা আমি পৈত্রিকসুত্রে পেয়েছি। আমার একমাত্র বোন তার ভাগ নেয়নি। আমি গ্রামে কখনো যাই না। সেগুলো পড়ে আছে অহেতুক। তোমার জন্য আমি সে সব বিক্রি করে দেব। তারপরও যদি লাগে সেটাও যোগার হবে। আর বেলাও তো আছে। বেলা মা জননী আমার, তুই কি রিন্টুর জন্য কিছু করবি না?’
বেলা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলল-‘অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর এক মুহূর্তও নষ্ট করা ঠিক হবে না।’
আমার খুব খারাপ লাগছিল। মেয়েটা থেকে থেকে শুধু কাঁদছে। আবার ভালও লাগছিল। আমার জন্য কোনোদিন কোনো মেয়ে চোখের পানি ফেলবে তা ভাবনায় আসেনি কখনো।
এগারো
সবগুলো রিপোর্ট হাতে পেতে সপ্তাহ খানেকের মতো সময় লাগবে। মামা বলেছিল রিপোর্টগুলো নিয়ে সে আমার কাছে আসবে। তারপর আমাকে নিয়ে যাবে তার বন্ধু বিখ্যাত নিউরো সার্জন সারোয়ারুল ইসলামের কাছে। কিন্তু পনেরো দিন চলে গেলেও মামার কোনো দেখা মিললো না। এর মধ্যে মাথার ব্যাথাটা কন্টিনিউ হয়ে গেছে। শেষে আমি মামাকে ফোন করলাম। মামা জানালো আসছে খুব শীঘ্রই।
বেলাও কোনো খোঁজ করলো না। একবার মনে করেছিলাম, নিজেই রিপোর্টগুলো নিয়ে আসি এবং ডাক্তারের কাছে যাই। শেষ পর্যন্ত সেটাও পারলাম না।
শেষে মনকে সান্ত¡না দিলাম-এত উতালা হবার কিছু নেই। হয়তো রিপোর্টে সেরকম জটিল কিছু ধরা পরেনি তাই মামা আসছে না। আবার বিপরীতমুখি চিন্তাও মনে এল-হয়তো এমন কিছু ধরা পরেছে যার জন্য অনেক টাকার দরকার। মামা গ্রামে গেছে তার পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করতে। মনে প্রশ্ন ভেসে উঠল- কী হচ্ছে তা ফোনে জানালে ক্ষতি আছে কোনো? আর বেলাই বা এভাবে.......? নিজেই আবার উত্তর খুঁজে নিলাম-প্রথম থেকেই তো দেখছি এরা একটু রহস্য রাখতে পছন্দ করে।
বেলাকে ফোন করতে কেন জানি সঙ্কোচ হচ্ছিলো। শেষে বেলার মোবাইলে ফোন না করে ল্যান্ড ফোনে ফোন করলাম। সেই নাম্বার ২৪৪১১৩৮। রিং হয় কিন্তু কেউ ধরে না। ফোন কানে নিয়ে বসে থাকলাম। কিন্তু কেউ ধরলো না। আবার করলাম। একই অবস্থা। বাসায় কি কেউ নেই? তৃতীয় বারে কেন যেন বলল-‘হ্যালো।’
কন্ঠ শুনে চমকে উঠলাম। আবার রং নাম্বারে চলে গেল নাকি। তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিয়ে আবার ভাল করে দেখে ডায়াল করলাম। সেই মেয়েলি কন্ঠ। কেমন গেঁয়ো টান। বললাম-‘আমি বেলাকে চাচ্ছি।’
-‘কাউরে দেওন যাইবো না।’
-‘খুব জরুরি দরকার।’
-‘কইলাম তো দেওন যাইবো না।’
-‘প্লিজ।’
-‘পিলিজ কী এ্যা পিলিজ কী?’
খট করে ফোন না রেখে দিলো। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
মামার ফোন এল আঠাশ দিন পর। বলল-‘রিন্টু, কেমন আছো?’
-‘আছি কোনোরকম।’
-‘ব্যথাটা কি বেশি?’
-‘হ্যাঁ, পেইন কিলার খেতে খেতে গ্যাস্ট্রিকে ইফেক্ট করেছে।’
-‘তুমি একটা ক্যাব নিয়ে টিএসসি-তে চলে এসো।’
গেলাম টিএসসি-তে। মামাকে খুব বিপর্যস্ত লাগছিলো। খুব সংকুচিত লাগছিলো। মামা আমার কাঁধের উপর হাত রেখে অন্য দিকে চেয়ে রইলো। ঠোঁট কামড়াতে লাগলো। আমি বললাম-‘মামা, বুঝতে পেরেছি আপনি কোনো জরুরি কাজে আটকে গিয়েছিলেন।’
মামা এ কথার প্রসঙ্গে কিছু না বলে নিয়ে এল সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা প্রসঙ্গ। বলল-‘রিন্টু, আমার মাস্টার্স পরীক্ষার ঠিক আগে একটা মেয়েকে আমার ভাল লাগলো। খুব ভাল লাগলো। আমি কথাটা জানালাম তাকে। সে কিছু বললো না। আমি বারবার তাকে কথাটা বলতে লাগলাম। সে নির্বিকার। ক’দিন পর তার বিয়ে হয়ে গেল। সে আমাকে তার বিয়ের কার্ডও দিয়েছিল।’
এ কথার পরে আমি কিছু বলার জন্য পেলাম না। আর এরকম একটা প্রসঙ্গ হঠাৎ এল কেন তাও বুঝলাম না। বেলাকে যে আমার ভাল লাগে মামা কি তা বুঝে ফেলেছে? কিন্তু বোঝার তো কথা নয়। বেলা নিজেই তো বোঝেনি। আবার বুঝতেও পারে। মেয়েরা না-কি অনেক কিছুই বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে। তাদের বোঝার ক্ষমতাও না-কি অনেক বেশি। মামা ডাকলো-‘রিন্টু।’
-‘জি মামা।’
-‘তুমি কি বুঝতে পার ভালবাসার ব্যাপারে মেয়েদের মানসিকতা কেমন?’
-‘না, পারি না।’
-‘আমিও পারি না। ভেবেছিলাম, এ ব্যাপারে একটা প্রজেক্ট হাতে নেব। প্রজেক্টটার নামও ঠিক করে ফেলেছিলাম। নারী ও ভালবাসা অথবা ভালবাসা ও নারী। পরে বাদ করে দিয়েছি।’
-‘কেন?’
-‘বুঝেছি, এটা এমন কোনো বিষয় না যে, প্রজেক্ট হিসাবে এর পেছনে সময় ব্যায় করতে হবে। নিঃস্বার্থ ভালবাসা নারীরা বোঝে না। নিজেরাও নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে পারে না। নারীর ভালবাসার সাথে সুক্ষ্ম একটা স্বার্থ জড়িত থাকে। রিন্টু..।’
-‘জি মামা।’
-‘তুমি বেলাকে খুব ভালবাস, তাই না?’
আমি চমকে উঠলাম। কি আশ্চার্য ক্ষমতা এদের! ঠিক ঠিক বুঝে ফেলেছে। মামা বলল-‘হার্ট ইজ ফরম্ড ফর লাভ। আর এ কারনেই অনেকে অকারণে হৃদয়ে চোট খায়।’
-‘মামা......।’
-‘হঠাৎ বেলার বিয়ে হয়ে গেল। ওর স্বামী একজন ফ্লাইং ইঞ্জিনিয়ার। হাভার্টে লেখাপড়া করেছে। স্বামীর সঙ্গে ও এখন অষ্ট্রেলিয়ায় হানিমুন করছে।’
নিজের অজান্তের আমার ভেতর থেকে খুব বড় একটা প্রশ্বাস বের হয়ে গেল। কিছু বলতে পারলাম না। মামা বলল-‘একেবারে হঠাৎ করেই হয়ে গেল সব। মাকে নিয়ে ছেলেটা বেলাকে দেখতে এল। এক পলক দেখেই সে দিশেহারা। পারলে তখনই বিয়ে করে নিয়ে যায়।’
-‘সেটাই স্বাভাবিক। বেলা সত্যিই খুব সুন্দর। এরকম সুন্দর মেয়ে আমি আর একটাও দেখিনি।’
-‘বেলা অবশ্য তোমাকে জানাতে চেয়েছিল। আমিই জানাতে দেইনি।’
-‘কেন?’
-‘কী লাভ? এই অসুস্থ শরীরে তার সুখের খবর জেনে তোমার কী লাভ? রিন্টু...।’
-‘জি মামা।’
-‘তুমি কি কষ্ট পাচ্ছো?’
-‘না।’
-‘না বলো কেন? কষ্ট অন্যের কাছে প্রকাশ করলে হালকা হয়ে যায়। আর চেপে রাখলে কষ্টটা বাড়তে থাকে। হৃদয়ে কষ্টের নদী, নদী থেকে সাগর, সাগর থেকে মহাসাগর হয়ে যায়।’
-‘মামা, আমার রিপোর্টগুলো কি এনেছেন?’
-‘এনেছি।’
-‘ডাক্তারকে দেখানোর কথা না?’
-‘অবশ্যই দেখিয়েছি।’
-‘ডাক্তার কী বললেন, সে ব্যাপারে আমাকে জানাবেন না?’
-‘অবশ্যই জানাবো। জানাবার জন্যই তো এত ছুটোছুটি।’
-‘ছুটোছুটি! আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।’
-‘রিন্টু.....।’
-‘বলেন।’
-‘ব্রেন টিউমার দুই রকমের। এক হলো প্রাইমারি টিউমার, আরেক হলো সেকেন্ডারি টিউমার। প্রাইমারি ব্রেন ক্যান্সারের চিকিৎসা হলো, সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি। সব মিলিয়ে রোগি ১০-১২ মাস বাঁচতে পারে। আর সেকেন্ডারি ব্রেন ক্যান্সারে সঠিক চিকিৎসা চললে বাঁচার সম্ভাবনা ৬-১০ মাস। সেকেন্ডারি ব্রেন ক্যান্সারের চিকিৎসা সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও গামা নাইফ সার্জারি। ডাক্তারই ভালো বোঝেন, রোগিকে কোন ধরণের চিকিৎসা দিতে হবে। সারোয়ার আমাকে যেভাবে বুঝিয়েছে তোমাকে সেটা বললাম।’
আমি তাকিয়ে ছিলাম মামার মুখে। আমার দৃষ্টিতে কিছুটা অধৈর্য্য ভাব ছিল। আমি জানতে চাইছিলাম, আমার ক্যান্সারটা কী ধরণের। প্রাইমারি না সেকেন্ডোরি?
মামা আমার অধৈর্য্যভাব বুঝে নিয়ে বলল-তোমার সেকেন্ডোরি ব্রেন ক্যান্সার।
আমি মামার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে তাকালাম নিচের দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়েছিল কিনা তা জানি না। ভাবছিলাম, আমার তো তাহলে সময় একেবারেই নেই।
মামা বলল-তুমি ইতোমধ্যে ছয়/সাত মাস কাটিয়ে ফেলেছো একদম বিনা চিকিৎসায়। সেকেন্ডারি ব্রেন ক্যান্সারের বিনা চিকিৎসায় এতদিন বেঁচে থাকাটা বিস্ময়ের। যাহোক, আমার বন্ধু সারোয়ার তোমার সার্জারি করবে। ও এরই মধ্যে চাকির নিয়ে চলে গেছে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। যাবার সময় ও বলে গেছে, তোমাকে যেন আমি খুব তাড়াতাড়ি সেখানে নিয়ে যাই।
আমি বলার মত কিছু পাচ্ছিলাম না। মামা ডাকল-রিন্টু.....।
আমি চোখ তুলে তাকালাম মামার মুখে। তাকালাম মামার মুখে। দৃষ্টিতে শূন্যতা। মামা বলল-রিন্টু, আমি হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নই। আমি সব কিছুর শেষ দেখে নেবার মানুষ। আর তাইতো তোমাকে কোনো খবর না দিয়ে ছুটে গেলাম আমার গ্রামে। আমার স্থাবর-অস্থাবর সব বিক্রি করে সতেরো লাখ টাকা নিয়ে এসেছি। কালই আমরা ভিসার জন্য আবেদন করবো। ইমার্জেন্সি ভিসার ব্যবস্থা করবো। তোমার কি পাসপোর্ট করা আছে?
আমি কিছু বললাম না। মামা বলল-পাসপোর্ট করা না থাকলে সেটাও করে ফেলবো। পসপোর্ট করতে আর কত সময় লাগবে।
-‘বেলাকে কিছু বলেছেন?’
-‘তোমার কি মনে হয়, বলা উচিত ছিলো?’
-‘উচিত ছিল না?’
-‘কী হতো বলে? হয়তো একটু দুঃখিত হতো। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার স্বামীকে ফেলে তোমার জন্য কিছুটা সময় বের করার সময় সে পেতো না। রিন্টু......।’
-‘জি মামা।’
-‘তোমার কি মনে হয় না যে, বেলার সামনে দাঁড়িয়ে ভালবাসা না জানিয়ে তুমি ভাল করেছো?’
-‘কিছু বুঝি না মামা।’
-‘আমি বুঝি। বেলা, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি-বেলার সামনে দাঁড়িয়ে এই কথাটি না বলে তুমি খুব ভাল করেছো। হাত পেতে প্রত্যাখ্যাত নেয়ার কোনো মানে হয় না।’
-‘প্রত্যাখাত নাও হতে পারতাম। জ্ঞান ফিরে পাবার পর আমি বেলাকে কাঁদতে দেখেছিলাম।’
-‘আর তাতেই তুমি বুঝে গেলে, সে তোমাকে ফেরাতো না? অন্যের দুঃখে মেয়েরা যত সহজে চোখের পানি ফেলে, তত সহজে সে দুঃখের সহযাত্রী হয় না।’
-‘আপনি মেয়েদের ছোট করে কথা বলছেন।’
-‘হয়তো তাই।’
-‘এটা ঠিক না।’
-‘তুমি কি মনে কর, তোমার বুকের ভাষা সে বোঝেনি? সে না বুঝলে আমি পেলাম কোথা থেকে?’
-‘আপনাকে বেলা বলেছে যে, আমি তাকে....?’
-‘হ্যাঁ।’
আর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হয়তো মামার কথাও ফুরিয়ে গিয়েছিল। দু’জনে চুপ করে রইলাম। অনেকক্ষণ পর মামা ডাকলো-‘রিন্টু......।’
-‘জি মামা।’
-‘তোমার কি খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে?’
-‘হু।’
-‘মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছো বলে তোমার আজ বাঁচতে ইচ্ছে করছে, না হলে মনে হতো মরে যাওয়াই ভাল। ভালবাসার জন্য অনেকেই কি জীবনকে তুচ্ছ মনে করেনি? বেলার মতো অপরূপ সুন্দর একটি মেয়ে......! তবে যাই বলো, বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার। মৃত্যুর মতো অচেনা-অজানা একটা অন্ধকার পথ কারোরই কাম্য হতে পারে না।’
-‘ঠিক তাই।’
-‘এখন তোমার চোখে শুধু ভেসে উঠবে মা-বাবা, আর ছোট বোনটার মুখ। এই তো জীবন। প্রেম-বিরহ, হাসি-কান্না, ঘৃনা-ভালবাসা, উদারতা-স্বার্থপরতা। এই জন্যই বোধহয় জীবনের প্রতি আকর্ষণ এতটা।’
-‘হু।’
-‘রিন্টু, ডাক্তার যাই বলুক, তারপরও তুমি যে বাঁচবেই না এমন বলা যায় না। আমার এক দুঃসম্পর্কের খালুর কন্ঠে ক্যান্সার ধরা পড়লো। ভেতরে আর কোনো খাবার ঢোকে না। সিঙ্গাপুর থেকেও ফিরিয়ে দিল। দেশে এসে সে এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের কাছে গেল। এখনও সে বেঁচে আছে। চমৎকারভাবে বেঁচে আছে। সারোয়ার যেটা বলেছে সেটা জাস্ট ডাক্তারির থিওরির কথা বলেছে। থিওরির বাইরেও পৃথিবীতে অনেক কিছু হয়। রিন্টু.....।’
-‘জি মামা।’
-‘তুমি কি তোমার জীবনের জন্য, মানে পৃথিবীতে আর একটু সময় চেয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবে?’
-‘না।’
-‘কেন?’
-‘ঈম্বরের কাছে প্রার্থনা ব্যাপারটা আমার কাছে অহেতুক কিছু মনে হয়।’
-‘অহেতুক....!’
-‘আমি মনে করি, মানুষের প্রার্থনার কোনো উপযোগিতা ঈশ্বরের কাছে নেই। ঈশ্বর সেটা চায়ও না। সে চায় মানুষের কর্ম-ভালো কর্ম-সুন্দর কর্ম। তাই প্রার্থনার ইচ্ছা আমার কোনোদিন হয়নি, এখনো হচ্ছে না। আমি বেঁচে থাকতে চাই আরও কিছু সময়। আমার বেঁচে থাকাটা আমার পঙ্গু বাবা, অসহায় মা, শিশুবোন, সর্বোপরি আমার জন্য খুব দরকার। ঈশ্বর নিশ্বয় এটা জানে। জেনেও সে যদি আমার প্রতি সহানুভূতি না দেখায়, তো প্রার্থনা করলে সহানুভূতি দেখাবে এটা আমি মনে করি না।’
-‘একটা কবিতা শুনবে?’
-‘শুনতে পারি। প্রার্থনার চেয়ে কবিতা শোনা আমার কাছে অধিক ভালো লাগার।’
-‘তবে আমি কবিতার অর্থ আমি ভাল বুঝি না।’
-‘কবিতার অর্থ বোঝা খুব একটা জরুরি কিছু না। কবিতা মনের মধ্যে একটা ঢেউ সৃষ্টি করাটাই আসল।’
-‘এখন যে কবিতাটা শোনাবো সেটা আমার খুব প্রিয় একটা কবিতা। কবিতায়টায় মনে হয় পৃথিবীর প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া, আশা-নিরাশা এইসবের কথাই বলা হয়েছে। চলো, একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসি। আয়েশ করে দু’জনে দুই কাপ এলাচ-দারুচিনি দেয়া চা খাই। তারপর আমি তোমাকে কবিতাটা শোনাবো।’
-‘সে দোকানে যদি এলাচ-দারুচিনি দিয়ে চা না করে?’
-‘আমার পকেটে এলাচ-দারুচিনি আছে। আমাদের চায়ে আমরা দিয়ে নেব।’
আশ্চার্য মানুষ! পকেটে এলাচ-দারুচিনি নিয়ে ঘুরছে।
চা খেতে খেতে মামা বলল-‘রিন্টু চোখ বন্ধ কর।’
-‘কেন মামা?’
-‘কোনো প্রশ্ন করো না। যা বলি তাই কর।’
-‘চোখ বন্ধ করেছি।’
-‘এবার বলো-মৃত্যু তুমি এখনো আমার থেকে অনেক দূরে। আমার ভাল একটা চাকরি হবে। আমি একটা মেয়েকে বিয়ে করবো। মেয়েটা হবে চটপটে-অভিমানী-প্রতিবাদী। অল্পতে তার চোখে জল এসে যাবে। খুব সুন্দর একটা সংসার হবে আমার। আমার ছোট বোন নুপুর বড় হবে। ওকে শান্ত-সুবোধ একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব। রিন্টু, তুমি এরকম কল্পনার মধ্যে থাক আর আমি কবিতাটা আবৃত্তি করি-
বাঁশি থেমে যায় ঠিকই, কিন্তু বাজে রাধার অন্তর
এই যে দু’ফোটা অশ্রু এইখানে মানুষ অমর,
এইখানে ক্রিসমাস, এইখানে নতুন অঘ্রান
এখানে বিরহ শেষ, পুনরায় মাঠে পাকা ধান;
এখানে কৃষ্ণপক্ষে চাঁদ ওঠে অনন্ত পূর্ণিমা
এখানে নতুন কাব্য, এইখানে গানের মহিমা,
এইখানে পদাবলী এইখানে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন
রুমির মসনবি আর এইখানে মীরার ভজন।
সব বাঁশি থেমে যায়, কিন্তু বাজে রাধার অন্তর
এইখানে ভালোবেসে মানুষ বেঁধেছে তার ঘর
এইখানে মানুষের জন্য কাঁদে মানুষীর মন
এখানে প্রেমের সত্য, এইখানে যুগলমিলন;
সব বাঁশি থেমে যায় রাধার অন্তরে বাজে রাধা।
এইখানে অমরতা এইখানে সপ্ত সুর বাঁধা।।
উপসংহার
শেষ পর্যন্ত রিন্টু সিংগাপুর যেতে পারেনি। মামা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ভিসা পেতে দেরি হয়ে যায়। কেন দেরি হয় তা আপনারাও জানেন। শেষে মামা তার নীতির বিপক্ষে গিয়ে ঘুষ দিয়েছিলো। কিন্তু যেদিন ভিসা হাতে পেলো তার আগের রাতে রিন্টু মরে গেল। সেটা ছিলো ভরা পূর্নিমার রাত। বারান্দা থেকে চাঁদটাকে দেখা যাচ্ছিলো। অনেক রাত পর্যন্ত রিন্টু বারান্দায় বসেছিল চাঁদের দিকে তাকিয়ে। শেষ রাতের দিকে সে ঘুমোতে যায়। ভোরে নুপুর তাকে ডাকতে গিয়ে দেখে.........। থাক সে সব কথা।
আর ঘটেছে সুন্দর একটা ব্যাপার। বেলা যে একদিন বলেছিল-তার মনে হচ্ছে, মামার খুব বড় লোকের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হবে। বেলার সেই মনে হওয়াটা সত্যি হয়েছে। মামা রূপা কসমেটিক কোম্পানীর মালিক ফরহাদ খানের একমাত্র বিধবা মেয়ে রূপাকে বিয়ে করে এখন সেই কোম্পানীর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হয়েছে। তার এখন একজন প্রাইভেট সেক্রেটারী আছে। নীল রঙের একটা প্রাডো গাড়ি আছে। সে এখন সেই কর্মহীন বাউন্ডেলে মানুষ নয়। সে এখন সমাজে সু-প্রতিষ্ঠিত, সম্মানিত মানুষ।
মামা পূর্বের সব প্রজেক্ট বাদ করে দিয়েছে।
** গল্পে ব্যবহৃত কবিতাটির রচয়িতা মহাদেব সাহা।