[হারুন পাশা ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার। জন্মগ্রহণ করেছেন রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার তালুক শাহবাজ গ্রামে। গল্প প্রকাশিত হচ্ছে ২০১২ সাল থেকে। পাশার গল্প-উপন্যাসে স্বাতন্ত্র্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, তিনি গল্প-উপন্যাসের বর্ণনায় লেখককে অনুপস্থিত রাখেন। আবার একজন চরিত্র শোনায় আরেকজনকে গল্প। এতে করে চরিত্রের কথনেই গল্প-উপন্যাসের কাহিনি এগিয়ে যায় শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। নতুন এ প্রকাশরীতি পাঠককে মুগ্ধ রাখে, আখ্যানে।
তিনি শৈশব-কৈশোরে ছিলেন বঞ্চিত মানুষ। এই বঞ্চনা এবং গল্প শুনতে না পারার অতৃপ্তি আর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তিনি গল্প বলেন চরিত্রের মধ্য দিয়ে। তাঁর লেখায় উঠে আসে সমাজ, দেশ, মানুষের সংকটাপন্ন জীবনকথা। গল্প-উপন্যাসে গুরুত্ব দেন আঞ্চলিক ভাষা। এবং তিনি লেখেন পিতার সম্মান বৃদ্ধির জন্য।
প্রকাশিত গ্রন্থ ৫টি। এর মধ্যে দুটি উপন্যাস, ‘ তিস্তা’ এবং ‘ চাকরিনামা’।
পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন শওকত ওসমান সাহিত্য পুরস্কার এবং কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার। ]
হারুন পাশা লিখছেন ৭ বছর ধরে সিরিয়াস ধারার লেখক হিসেবে। তাঁর লেখালেখির গল্প জানা যাক :
২০১২ সালে ‘ভোরের কাগজ’-এ প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ‘ বেকারদের আর্তনাদ’ নামে। তখন আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ২০০৯ সালে প্রথম যে গল্পটি লেখা শুরু করেছিলাম তা শেষ করতে সময় লেগেছে পাঁচ বছর। গল্পটির নাম ‘দিনভর প্রহসন’। ২০১৪ সালে ‘ দৈনিক সংবাদ’-এ প্রকাশিত হয়। প্রথম গল্পটি লিখতে গিয়ে দারুণ ছটফটানির ভেতর ছিলাম। চরিত্র দাঁড় করাতে পারছিলাম না। কতটুকু লিখব, গল্পটা কত বড় হবে স্থির করতে পারছিলাম না। গল্পের শেষ চিন্তা করে রেখেছি মনে মনে, কিন্তু লিখতে গিয়ে ওই শেষ অংশে পৌঁছতে পারছিলাম না। অথচ এই পাঁচ বছরের ভেতর লিখেছি অনেক গল্প। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা তেইশ। কিন্তু কোনো গল্পের বই প্রকাশিত হয়নি। কারণ আমি নতুন প্রকাশরীতি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পূর্বসূরীরা যেভাবে লিখেছেন আমি সেভাবে লিখতে চাচ্ছিলাম না। এজন্য আমি অপেক্ষা করেছি। যার শেষ আসে ২০১৭ সালে।
আমি এমন একটা প্রকাশরীতি চাচ্ছিলাম যেটা একেবারেই আমার। অন্যের নকল বা কার্বনকপি নয়। আজ যে উপন্যাসটি পুরস্কার পেয়েছে, এই ‘তিস্তা’ উপন্যাসেই আমি প্রয়োগ করি নতুন প্রকাশরীতি। এ রীতির বৈশিষ্ট্য হলো উপন্যাসে লেখকের উপস্থিতি থাকবে না। চরিত্ররাই সব। তারাই যাপিত জীবনের ব্যাখ্যাকারক। তারাই বলবে নিজেদের কথা এবং চরিত্রের কথনেই উপন্যাসটি এগিয়ে যাবে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত।
এবার ‘তিস্তা’ লেখার গল্প বলি। আমি তিস্তাপারের সন্তান। জন্মের পর থেকে যে তিস্তার সাথে আমার পরিচয়, সেই তিস্তা আমার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় না হয়ে ছোট হতে থাকল। হয়ে গেল নালার মতো। বর্ষার দুমাস বাদে বছরের অন্য সময়গুলোয় নদীতে থাকে বালু। যে নদীর গর্জন শুনে ভয় পেতাম, সেই নদীর বুকে হাঁটা যায়। একপাশ থেকে আরেক পাশে যাওয়া সম্ভব। স্কুলের টিফিনে কিংবা স্কুল ছুটি হলে বন্ধুরা মিলে নদী দেখতে যেতাম। দেখেছি ভরা তিস্তায় কেমন করে কচুরিপানা পাঁক খায়। মাছ ধরছে মাঝি। ধানের জমিতে পলি জমা হচ্ছে। বাড়ছে ফলন। নদীতে মাছ আছে, ঘরে ধান আছে, মানে ভাত আছে। ফলে সংসারে হাসি-খুশিও আছে। চরের মানুষেরা ভুট্টা, আখ, মরিচ, তরমুজ, বাদাম আবাদ করছে।
শৈশব-কৈশরের সমৃদ্ধ স্মৃতি নিয়ে বড়বেলায় নদীতে যাই, দেখার চেষ্টা করি নদীকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকা মানুষের জীবন। দেখি আর যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন হই। মিলাতে পারি না শৈশবের তিস্তার সঙ্গে যৌবনে দেখা তিস্তা। এ তিস্তার বুকে রস নেই। কষ্ট তীব্র হয় নিজের ভেতর। দেখতে পাই নদীতে পানি নেই বলে তিস্তাকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকা মানুষ ঠিক মতো আবাদ করতে পারছে না, মাছ ধরতে পারছে না। দেখি তাদের ক্ষয়, হতাশা, না খেয়ে থাকা, পেশা বদলের মিছিল। তাদের ভাগ্যবদল তো আমি করতে পারব না, কারণ সেই ক্ষমতা আমার নেই। তাদের বর্তমান জীবন নিয়ে লেখার চেষ্টায় নিজেকে যুক্ত করতে থাকি।
ঢাকা থেকে রাতে গ্রামে ফিরলে পরেরদিন সকালেই চলে যেতাম তিস্তায়। আলাপ করতাম নদীর মানুষদের সঙ্গে। দেখতাম এবং জানতাম তাদের সুখ-দুঃখের গল্প। তারা গলগল করে বলে যেত নিজেদের যন্ত্রণার কথা। অনুধাবন করতে পেতাম তাদের কথাগুলো শত ক্ষতে আক্রান্ত। ক্ষত সংক্রামিত হয় আমার মনেও। পর্যবেক্ষণ শেষে লিখতে বসি ‘তিস্তা’। লিখি তাদের পরিবর্তিত জীবনের আখ্যান।
এ উপন্যাস লিখতে লিখতে নদী সম্পর্কে আমার ধারণা বদলে গেল। নদী মানে পানিতে কানায় কানায় ভরা থাকবে, মাঝিরা মাছ ধরবে। না, তিস্তায় এসব নেই। মানিকের পদ্মা, অদ্বৈতের তিতাস, সমরেশ বসুর গঙ্গায় পানি থাকলেও ‘ তিস্তা’য় পানি নেই। পানিহীন মানুষের আর্তনাদ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। নদী ও মানুষের সমৃদ্ধ অতীত হয় দরিদ্র। দারিদ্র্যের আখ্যানে পূর্ণ হয় জীবন। তিস্তাবাসী দেশের নানাপ্রান্তে, বিশেষত শহরে রিকশা চালাতে যায়, ব্লকের কাজ করতে যায়, ঘর-বাড়ি মেরামত এবং ধান কাটার কাজ করে, বেছে নেয় হকারির জীবন।
পানি না থাকায় মানুষ, প্রকৃতি, পশু-পাখি আক্রান্ত হয় নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে। তিস্তা ব্যারেজ হয়েছিল মানুষের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে। কিন্তু পানিহীন ব্যারেজ হয় অশুভের অংশ। তিস্তা ব্যারেজ ও তিস্তা ক্যানেলে থাকে পানির বদলে বালুর প্রবাহ। মিছিল-মিটিং, মানববন্ধনে কাজ না হলে তিস্তাবাসী স্ব উদ্যোগে পানির জন্য আন্দোলনে নামে। উন্নয়নের এ যুগে যেখানে সব কিছু সহজলভ্য, সেখানে মানুষ পানির জন্য আন্দোলন করে। ঘটনা কতটাই না বেদনার। তবুও তারা পানি পায় না, অপেক্ষা করে তিস্তাচুক্তির। চুক্তি তো একদিকে হচ্ছেই না, অন্যদিকে চুক্তি হলেও তারা কি নিশ্চিতভাবে পানি পাবে, এ নিয়েও সংশয় কাটে না।
তিস্তা নদী, তিস্তা ব্যারেজ ও সংশ্লিষ্ট মানুষের দুর্বিষহ জীবন আমাকে ভেতর থেকে তাগাদা দেয় তাদের নিয়ে লিখতে। দীর্ঘ স্মৃতি এবং বাস্তবতা আমাকে কঠিন ভাবে আঘাত করতে থাকে বাক্য লিখতে। লিখতে থাকি একের পর এক বাক্য। দুঃখক্রান্ত হই, কিন্তু ক্লান্তি আসে না। লিখি তিস্তাবাসীর ব্যবহৃত ভাষায়। ব্যবহার করি রংপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা। প্রশ্ন আসতে পারে রংপুরের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাসে ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভাষা কেন? হ্যাঁ, এর কারণও আছে। চরে যারা বসবাস করে তাদের অধিকাংশই ময়মনসিংহের ভাষায় কথা বলে। ফলে চরিত্রের মুখে সে ভাষাই ব্যবহার করেছি।
‘তিস্তা’ লিখেছি সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। তারপর দুপুর তিনটা থেকে বিশ্রাম নিতাম। পরেরদিন একই রুটিন পালন করেছি। উপন্যাসটি লেখা শুরু করেছিলাম ২০১৪ সালে এবং শেষ করি ২০১৭ সালে।
আমার এ উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর দেখতে পাই নানান জনের নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ‘ তিস্তা’ প্রকাশের পর অনেকেই তিস্তার বর্তমান জীবন নিয়ে কবিতা লিখেছেন। কেউ কেউ তিস্তাকে ঘিরে গল্পও লিখেছেন। সংকলনও প্রকাশ করেছেন। এমনকি তিস্তার জীবন নিয়ে উপন্যাসও লেখা হয়েছে। ‘ তিস্তা’য় যেহেতু বাংলা উপন্যাসে চালু থাকা প্রচলিত বর্ণনারীতি নেই, সেহেতু এ উপন্যাস বের হওয়ার পর কেউ কেউ তাদের উপন্যাসে বর্ণনা কমিয়ে সংলাপ বেশি ব্যবহার করেছেন। খুঁজলে এবং ভাবলে আরো বেরুবে।
যাইহোক, আমার লেখালেখিতে কিছু ব্যাপার-স্যাপার আছে। যেমন, বাংলা উপন্যাসের প্রচলিত বর্ণনারীতিতে লেখকই বর্ণনা করেন কাহিনি এবং মাঝে মাঝে চরিত্রের সংলাপ দেন। আমি গল্প-উপন্যাসে এ রীতি ব্যবহার করি না। আমার লেখায় চরিত্ররাই সব। দ্বিতীয়ত, গল্প-উপন্যাসে রয়েছে আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব। তৃতীয়ত, আমি লিখি পিতার সম্মান বৃদ্ধির জন্য।
লেখার মাধ্যম হিসেবে কেনই বা কথাসাহিত্য বেছে নিলাম। এ প্রসঙ্গে একটু বলি। আমি শৈশব-কৈশোরে একজন বঞ্চিত মানুষ। জন্মের আগেই দাদা-দাদী, নানা-নানীকে হারিয়েছি। পাইনি আপপাশের মানুষের কাক্সিক্ষত সঙ্গ। বাবা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। মা সামলিয়েছেন সংসার। কারো কাছ থেকে জীবনে নির্মম গল্পও শুনতে পাইনি। রূপকথার গল্প, ভূতের গল্প সহ অন্য গল্প আমাকে পড়ে পড়ে শিখতে হয়েছে। গল্প শুনতে না পারার অতৃপ্তি এবং যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আমি গল্প বলি। গল্প বলি চরিত্রের মধ্য দিয়ে। খেয়াল করলে দেখবেন, আমার গল্প-উপন্যাসে একজন চরিত্র আরেকজন চরিত্রকে গল্প শোনাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমি লিখতে গিয়ে সমাজ, দেশ, মানুষের সংকটাপন্ন জীবনের কথা বলি। গল্প-উপন্যাসে ডিটেইলে সেগুলো তুলে আনা সম্ভব। এমন কিছু কারণে লেখার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছি কথাসাহিত্য।
আমি কেবল সাহিত্য বিষয়টাকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। এজন্য অনেক পড়েছি এবং পড়ি। পড়া ছাড়া তাই কোনো বিকল্প ছিল না আমার সামনে। একটু পেছন দিকে যাই। আমি যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র, তখন ক্যাম্পাস ছুটি হলে দেখতাম বন্ধুরা বাড়িতে যেত বা এখানে সেখানে ঘুরতে যেত। কিন্তু আমি যেতাম না। আমি এই সময় পড়তাম এবং লিখতাম। নতুন কিছু জানার চেষ্টা করতাম। আমরা তো সেমিস্টার ব্যবস্থায় পড়েছি। এক সেমিস্টার থেকে আরেক সেমিস্টার শুরুর আগে পনেরো দিন বা এক মাস গ্যাপ থাকত। আমি ওই সময়েও পড়তাম। লিখতাম।
আমি পড়ে পড়েই জেনেছি কীভাবে লিখতে হবে এবং কী লিখতে হবে। এটুকু বুঝে উঠার পর নিজের অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে লিখছি উপন্যাস এবং গল্প।
[পুরস্কার প্রাপ্তির বক্তৃতার অংশবিশেষ]