কালজয়ী কবি মির্জা গালিব ও তাঁর কবিতা
কালজয়ী কবি মির্জা গালিব ও তাঁর কবিতা

ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার সময়কালে যখন মোগল যুগের পতন ঘটতে থাকে তখন উর্দু ও ফার্সি ভাষার প্রভাবশালী কবি মির্জা গালিবের খ্যাতি পৃথিবীব্যাপী ছড়াতে থাকে। তাঁর পুরো নাম মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ খান গালিব। 

এই অদম্য মেধাবী কবির জন্ম ২৭ ডিসেম্বর ১৭৯৭ খ্রি:-এ ভারতবর্ষের দারিয়াগঞ্জের আগবরাবাদে। (বর্তমান ভারতের আগ্রার কলা মহলে) ডাকনাম ছিল ‘আসাদ’। খ্যাতির স্পর্শে ডাকনাম হয়ে যায় ‘গালিব’। যার অর্থ- সর্বোচ্চ।
যদিও সাহিত্যে তাঁর বিপুল অবদানের জন্য তাঁকে পরে উপাধি দেয়া হয়েছিল- ‘দাবির-উল-মালিক’ ও ‘নাজিম-উদ-দৌলা’।
গালিবের পূর্বপুরুষরা আগ্রার আদি বাসিন্দা ছিলেন না। প্রথমত, তুরস্কের আইবাক থেকে সমরকন্দে (উজবেকিস্তান) এবং পরে ভারতবর্ষে অভিবাসী হন। বাবা মির্জা আবদুল্লাহ বেগ খান ছিলেন একজন সৈনিক।
গালিবের বালক বয়সেই বাবা যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যান। শেষে সৈনিক চাচা নাসরুল্লাহ্ খান ভাইয়ের পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
মির্জা গালিবের পিতা আগ্রার এক অভিজাত পরিবারে বিয়ে করেছিলেন। সৈনিক জীবনের অনিশ্চয়তার কারণে মা ও ছেলে নানার বাড়িতেই থাকতেন।
শৈশবে পিতা ও চাচার মৃত্যুতে তাঁর মধ্যে বঞ্চনার স্থায়ী প্রভাব পড়েনি। বংশের ঐতিহ্যের কারণে অহঙ্কারী বালকের মধ্যে তাঁর মায়ের পিতৃগৃহে অবস্থানের প্রভাব নেতিবাচক ছিল। কিন্তু তাঁর সৌভাগ্য এমনই ছিল যে শৈশবে তাঁর শিক্ষা, তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ব্যাহত হয়নি। বালক বয়সেই আগ্রার খ্যাতিমান পণ্ডিতদের তত্ত্বাবধানে ও সংস্পর্শে পরে এই বালকই যে হয়ে উঠবে কবিতার জাদুকর তা কে জানত!
মাত্র ৯ বছর বয়সেই গালিব কবিতা লিখতে শুরু করেন। পুরো জীবন ধরে তিনি ফার্সিকে তাঁর প্রথম প্রেম বলে বর্ণনা করেছেন। ওই বয়সেই তিনি উর্দুতেও মসনবি কবিতা লিখতে থাকেন।
জীবনের প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন আত্মাবশ্বাসী, তাই শুরুতেই তাঁর লেখায় তিনি নিজেকেই নিজে সতর্ক করেন এভাবে-
হে-গালিব কভু
ভাগ্য দেখো না
হাতের তালুর রেখায়!
চেয়ে দেখো বহু
হাতহীন সুখী
নিত্য তোমাকে শেখায়!
১৮১০ সালের ৮ আগস্ট মাত্র ১৩ বছর বয়সে গালিব নওয়াব ইলাহী বখশ্ খানের কন্যা ‘ওমরাও বেগম'কে বিয়ে করেন। তারপর আগ্রা থেকে দিল্লির চাঁদনি চকে বসবাস শুরু করেন।
পারিবারিক জীবনে গালিব অতটা সুখী ছিলেন না। স্ত্রী ‘উমরাও বেগম’ ছিলেন অসম্ভব রকমের খোদাভীরু ও ধার্মিক, অন্যদিকে গালিব ছিলেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মে উদাসীন, যদিও তাঁর লেখায় ধর্ম উঠে এসেছে প্রকটভাবে এবং কোথাও কোথাও তা অতিমাত্রায় জটিল ও প্রতীকী।
স্বার্থের জিব মেলা দুনিয়ার মানুষের লোক দেখানো ধর্মকে তিনি অতি কটাক্ষ করে লিখেছেনÑ
দুনিয়াতো আছে
স্বার্থের মেলে জিব,
কার কথা তুমি
বলবে-যে, হে গালিব!
জানাজায়-ও আসে
মানুষেরা- কিছু নেবে
আগামীর সুখ,
সওয়াবের কথা ভেবে!
মানুষের আচার আচরণ এবং জীবনযাপনের অসামঞ্জস্যতায় তিনি খুব ব্যথিত হয়েই মনুষকে এক অদ্ভুত প্রাণী বলে আখ্যায়িত করে লিখেছেন-
এমন ভাবে-যে জীবন যাপন
অদ্ভুত মানুষের,
যেনবা রেখেছে অমরতা দিয়ে
আপন মরণ ঘের!
যেনবা আদৌ-
মরবে না কোন দিন,
আবার- এমনভাবেই মরে
যেন বাঁচার ছিল না চিন্ !
শোনা যায়- গালিব সুরাপান করার সময় লিখতেন এবং তা সন্ধ্যাবেলা। তাঁর সৃজনশীলতা ও কল্পনার ক্ষেত্রে সুরা সহায়ক ছিল বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সুরার প্রতি আসক্তিকে গালিব মনে করতেন আশীর্বাদ।
অতি শক্তিমান ও বহুভাষী এই খ্যাতনামা কবির লেখার ধারা ছিলÑ গজল, কাসিদা, রুবাই ও অন্যান্য এবং লিখার বিষয় ছিল জীবনবোধ, দর্শন, প্রেম, ধর্ম এবং অতীন্দ্রিয়তা।
তাঁর গজলে উঠে এসেছে দর্শন, জীবনবোধ ও রহস্যময়তা আবার কোথাও কোথাও বাস্তববাদ, ভোগবাদ ও প্রেম।
তাঁর কবিতায় প্রেম এসেছে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় প্রতীকী হয়ে আবার কখনো কখনো প্রেম শুধুই মৃত্যুর দ্বার খুঁজে বেড়ায়-
তার সে চোখে ডুব দিয়ে তো
মরতে পারি বারংবার,
সে চোখ নামায়, মরতে থামায়,
দেয় না খুলে মৃত্যু দ্বার !
তাঁর ফার্সি লেখা গজলগুলো থেকে প্রথম ইংরেজিতে ‘Love sonnet of GhalbÕ Abyev` K‡ib- 'Sarfaraz Khan Niazi,' published by Rupa & Co. India. and 'Firoz Son's in Pakistan.
১৮৬৫-এ শুধু এই এক বছরেই তিনি উর্দুতে ১৭৯২টা শ্লোক এবং ফার্সিতে ১১৩৪০টা শ্লোক লিপিবদ্ধ করেন।
বলা হয়- ‘গালিবের ফার্সি শ্লোক যদি না পড়া হয় তবে তাঁর কবিতার কিছুই পড়া হলো না’ ! - (ডা: সৈয়দ তাকি আবেদি-ইরান)
আজকাল আমরা যাঁদের কণ্ঠে প্রসিদ্ধ যেসব গজল শুনি, বেশিরভাগই গালিবের-ই লিখা গজল। এবং যাঁরা গেয়ে বিখ্যাত হয়েছেন তাঁরা-জগজিৎ সিং, মেহেদি হাসান, মো: রফি, গোলাম আলী, আশা ভোঁসলে, লতা মঙ্গেশকর, আবিদা পারভিন, ফরিদা খাতুন, টিনা খান, বেগম আকতার, রাহাত ফাতেহ্ আলী খান প্রমুখ সবারই কণ্ঠে গালিবের গজল-ই জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে এসেছে। গালিবের পূর্বে ত্রয়োদশ শতাব্দীর খ্যাতিমান উর্দু কবি আমির খসরু, পঞ্চদশ শতাব্দীর উর্দু খ্যাতিমান কবি মিরা বাই, ১৬ শতাব্দীর মো: কুলি কুতুব শাহ্ এবং তাঁর সময়কার মো: ইব্রাহিম খান, খাজা হায়দার আলী, ইমাম বক্স প্রমুখ এবং তাঁর পরের কবিরা, কেউ আজও পর্যন্ত এই যশস্বী শক্তিধর কবির মতো পৃথিবীব্যাপী ঈর্ষণীয় খ্যাতি অর্জন করতে পারেনি!
গালিব ছিলেন একজন কোমল হৃদয়ের অতি দয়ালু প্রকৃতির মানুষ, তাঁর প্রমান, তাঁর রচনাÑ ‘দাশাম্ব দিনলিপিতে মোগলদের পতন কাহিনী ও সিপাহী বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে (১৮৫৭) অতি করুণ ও মর্মান্তিক ভাষায় বিদগ্ধ শ্লোকে ফুটে উঠেছে।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি অতিকষ্টে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। কারণ, ১৮৫৭-এর সিপাহি বিদ্রোহ তাঁর জীবনকেও তছনছ করে দিয়েছিল। গালিব তাঁর জীবদ্দশায় জীবনের জন্য কখনো জীবিকা অর্জন করেননি, ফল হিসেবে মৃত্যুর আগে তাই তাঁকে উপোস থেকেও দিনাতিপাত করতে হয়েছিল।
তিনি তাঁর নিজের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে, তিনি বেঁচে থাকতে তাঁর গুণকে কেউ স্বীকৃতি না দিলেও পরবর্তী প্রজন্ম তাঁকে স্মরণ করবে। সত্যিই পরে ইতিহাসের সত্যতা প্রমাণ করেছিল।
১৮৬৯ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি ৭১ বছর বয়সে এই অমর মহান কবি ভারতবর্ষে দিল্লির বালিমারান, চাঁদনি চকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
তাঁর সমাধির শ্বেতপাথরের গায়ে যেন আজো দেখতে পাই তাঁরই লেখা অভিমানের বাণীÑ
সাড়ে তিন হাত জমি-ই ছিল যে
গালিবের নজরানা,
মৃত্যুর শেষে পেলে অবশেষে
জমিটির মালিকানা!


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান