লেখক : আবু সাঈদ তুলু
অনেক ব্যাকুলতার পর অবশেষে কাক্সিক্ষত ঈদের চাঁদ আকাশে দেখা গেল। নিজামের আত্মবায়ু আত্মাটি ঠিক তখনই বেরিয়ে গেল। নিজামের মনের স্বপ্নের পূরণ হলো বটে কিন্তু স্বপ্নের বর্ধিত অংশটুকু পূরণ হয়েছিল কিনা চারপাশের কেউ জানে না। চারপাশের লোকজন শুধু জানে কাঁদতে। মুহূর্তেই কান্নায় ডুকরে উঠলো চারপাশ। এমন স্বাভাবিক মৃত্যুই চেয়েছিল নিজাম। মৃত নিথর দেহটিকে ঘিরে সকলের কান্না নিজামের সদ্য দেহমুক্ত আত্মাকে থমকে দিল। তাহলে কী দেহত্যাগ করা অন্যায় হলো। এরা কাঁদছে। আবার কী ফিরে যাবে দেহে। যে লোকগুলো চারদিক ঘিরে কাঁদছে তারা প্রত্যেকেই তো মৃত্যু কামনা করতো নিজামের। আর আজ যখন সত্যি মৃত্যু হলো। দেহ ফেলে অপারলোকে গমনের জন্য সূক্ষ্ম হয়ে ওঠলো তখন আবার এরাই কান্নায় ভেঙে পড়ছে। মৃত্যু একটা আশ্চর্য প্রদীপ। জ্বলা আর নেভা দুটোতেই থাকে মানুষের হাসি-কান্না।
‘কাল ঈদ আজ রাতেই জানাজা করতে হবে।’ বলে উঠলো বাড়ির মেঝো কর্তা। বড় কর্তা তখন বাড়িতে ছিল না। বাজারে গিয়েছিল। যখন ফিরে এসে ঘটনাটি দেখলো তখন উল্টো ঘোষণা দিয়ে বসলো
‘কাল ঈদের জামাতের আগে জানাজা হবে, তারপর দাফন।’
শুরু হয়ে গেল গুঞ্জন। ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার সময় যদি কারো মৃত্যু হয় তার কী করতে হয়। চাঁদ রাতেই কী তাকে জানাজা করে দাফন করতে হয়? নাকি খুব ভোরে জানাজা করে দাফন করে তারপর ঈদের নামাজ আদায় করতে হয়। কোনটার সঠিক উত্তর খুঁজে পায় না। অনেক দূরে দূরে আত্মীয় স্বজন রয়েছে তাদের আসতে সময় লাগবে তাই বাড়ির বড় কর্তা ঘোষণা দিয়েছে কাল ভোরে জানাজা হবে। কিন্তু বড় কর্তাও চিন্তায় পড়ে কী করা সঠিক ছিল। পাশেরই ছিল হুজুরের বাড়ি বড় কর্তা হাঁটতে হাঁটতে হুজুরের বাড়ি গেল।
হুজুর সবকিছু শুনে বিষয়টাকে আরো জটিল করে তুললো। ত্রিশ দিন সিয়াম সাধনার পর আজ আনন্দের চাঁদ উঠলো আকাশে। কাল সকালে ঈদ। ঠিক এ সময় মৃত্যু। বিষয়টি আসলে খুব ভালো নয়। মৃতকে আল্লাহ ক্ষমা করুক। না জানি কত পাপ করেছিল এ দুনিয়ায়। তা না হলে এমন আনন্দঘন সময় মৃত্যু আসে। আজ রাতেই তার দাফন হওয়া উচিত ছিল। বড় কর্তা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বড় কর্তা যখন বাড়িতে ফিরে আসে যখন শোনে আরেক ঘটনা। লাশের দিকে নাকি পিপড়াঁ আসছে। সন্ধ্যায় দিব্যি সুস্থ মানুষটার মৃত্যু হলো দু’ঘণ্টা যেতে না যেতেই পিপড়াঁ ধরে যাবে লাশে সেটা কী হয়।
পিপড়াঁ ধেঁয়ে আসছে কিনা তা অবশ্য খেয়াল করেনি নিজাম। নিজাম শুধু ভাবছিল মৃত্যুর কথা। কতদিন কতসময় মনে মনে স্বপ্ন দেখেছে ঈদের চাঁদ ওঠার আনন্দের সাথে সাথে তার মৃত্যু হবে। গান বাজতে থাকবে- ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। আনন্দের ¯্রােতে তার জানাজা হবে আর হবে দাফন। সবার মধ্যে তখন শুধু আনন্দ আর আনন্দ। নিজাম পাপ-পূণ্য নিয়ে কখনো কিছু ভাবে নি। সৃষ্টার সৃষ্ট অস্তিত্ব সে। তাই সৃষ্টার জন্য ঈমান ও আমল তো সঙ্গে আছেই। ভয় কিসের তবে? কিন্তু ঈদে মৃত্যু এমনভাবে ব্যাখ্যার হতে পারে সেটা তো কখনো ভাবেনি নিজাম।
সারারাত নিজাম জীবনের পর্যালোচনা করে চললো। কোথায় কী ভুল হয়েছিল। জীবনে কী চেয়েছিল; কী করেছিলো আর কী পেয়েছে। কেনই বা জীবন তার। আজ দেহহীন পৃথিবীর শেষ রাতে সে জবাবই অনুসন্ধান করে। শৈশবের ঘুড়ি উড়ানোর দিনগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠতে থাকে। কখন কী আনন্দ। কখন কী বাস্তবহীনতা। এই পৃথিবীতে ঘুড়ি উঠানো আর প্রজাপতি ধরাই যেন জীবনের কাজ। কী অনুপম সুখমায়া ছোঁয়ে থাকতো সারাজীবন। কিন্তু নানা সময় পাশের বাড়ির দুষ্টগুলো বিরক্ত করতো। শৈশবে পিতা যখন সহযোগিতা চাইতো তখন সে কৌশলে পাশ কাটিয়ে যেতো। তাহলে এটা কী ভুল ছিল? আসলে শৈশবে সংসারের কাজে মনোযোগী হবার মতো কোনো সচেতনতা ছিল না।
নিজাম হঠাৎ করে খেয়াল করলো তার দুপাশের দু হাত পিপড়াঁয় খেয়ে ফেলছে। এই দু হাত গত কয়েক মাস ধরে অবশ্য হয়ে পড়ে ছিল। এই হাত দুটো কী এতই অন্যায় করেছিল। যে দাফন করার পূর্বেই পিঁপড়া খেয়ে ফেলবে। তবে কী পাশের বাড়ির সম্পত্তি দখল করেছিল যৌবনে। কিছুই মনে করতে পারে না। তবে মনে পড়ে নিজের জমির সীমানাটা ঠিক করতে সে ব্যাকুল হয়েছিল। মুরগি চুরির অপরাধে এক ছেলেকে পিটিয়ে ছিল মনে আবছা আবছা স্মৃতি ভাসে। কখনো বা বিস্মৃতির দোলায় স্মৃতিটি আবার হারিয়ে যায়। তবে পাপের কারণেই কী তার দুহাত পিপড়াঁয় খেয়ে যাচ্ছে। মানুষ কত বড় পাপ করে তাদের তো কিছু হয় না। ধীরে ধীরে বিস্ময়ের মাত্রা বাড়তেই থাকে নিজামের।
কোমরের নিচের অংশের দিকে তাকিয়ে নিজাম আঁতকে উঠে। একি! কোমর থেকে পা পর্যন্ত মাংসগুলো গলে গলে যাচ্ছে। নিথর নিস্তব্ধ দু পা তো কোনো অন্যায় পদক্ষেপে দৌঁড়ায় নি। কোমর থেকে শরীর পর্যন্ত কোনো অন্যায় তো তাকে ছোঁতে পারে নি। তবে কীসের কারণে তার আজ সম্মানহীনতা। গলে পঁচে অবসান। ঠিক একইভাবে চোখ ও মাথার অংশটাও স্থির নরম নরম হয়ে যাচ্ছে। মানুষ মরে গেলে পঁচে যায় সত্য। কিন্তু সেটা এখনই। নিজাম তো তা চাইনি। কবরে সাওয়াল-জবাব নানা আনুষ্ঠানিকতার পর অনেক কিছুই হতে পারে।
নিজামের বিশ্বাস ছিল তার আছে ঈমান ও আমল। সাধারণত কোনো বড় ধরনের পাপ থেকে সে সর্বদা নিজেকে মুক্ত রাখতো। অতএব সে স্বপ্ন দেখতো সে এক সময় তার দেহ থেকে বের হয়ে যাবে। অমলিন পড়ে থাকবে তার দেহ। হাজার হাজার জনতা তার দেহকে ঘিরে খুঁজবে তার চেতনা। কত আদর কত আপ্যায়ন কত যত্ম কত মমতায় তার শবকে কবরস্থ করা হবে। নিজের দেহ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে জগতের নতুন জাগরণ উন্মোচিত হবে। পৃথিবী জীবনের শেষ নতুন নতুন আরেক জীবনের আরম্ভ হবে। কিন্তু একি হচ্ছে সব। দেহ যাচ্ছে পঁচে।
নিজাম পুনর্বার জীবনের অন্যায়গুলোকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো অন্যায় খোঁজে পায় না। মুহূর্তে কাতর হয়ে উঠে। তাহলে জীবনটা কেন বিলাসীতার মধ্যে কাটালো না। কৃচ্ছতা ও অন্যায় থেকে অবদমিত কষ্টকর জীবন যাপন করলো। অতি বিলাস নয় কিন্তু অতি ত্যাগ নয়Ñ পরিমিতিবোধের জীবন তো যাপন করতে পারতো। ত্যাগ ও বৈরাগ্যের প্রাপ্তি বুঝি এই। তাই ঈদের চাঁদের সাথে বেরিয়ে যাওয়া নিজামের আত্মবায়ু আত্মাটি আবার ফেরত পেতে চায়। জীবনকে নতুন পেতে পায় তবে অন্যায় করবার জন্য নয়। পৃথিবী এক ক্ষণস্থায়ী আবাস। এ বসতজীবনে এমন কোনো ভুল সে তো করেনি। তবে মৃত্যুর পরও কেন তার প্রতি পৃথিবীর এমন দুঃশাসন। এমন বিরূপ নিয়ম শৃঙ্খল। পৃথিবীর নিয়মের প্রতিটি বিষয়ে সে অতীষ্ঠ হয়ে ওঠে। তাহলে জীবনের সমস্ত শিক্ষাই কী ভুল। যাপিত জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপই কী ছিল ভুল। আর মরতে চায় না নিজাম। নিজাম উঠে বসতে চায়। আবার জীবন পরিক্রমে নতুন করে আবর্তন করতে চায়। ঘাত-প্রতিঘাত, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, গ্রহণ-বর্জন, ঈমান-আমলের মধ্যদিয়ে জীবনকে পুর্নবার যাপন করে যেতে চায়। তাই দু হাতের উপর ভর দিয়ে উঠতে চেষ্টা করে নিজাম।