পাঠ প্রতিক্রিয়া।। ছিঁড়ে যাওয়া নদীর টুকরোগুলো । রাজন্য রুহানি
পাঠ প্রতিক্রিয়া।।  ছিঁড়ে যাওয়া নদীর টুকরোগুলো । রাজন্য রুহানি
প্রথম কবিতাগ্রন্থ 'ঈশ্বরের ঘোড়া' নিয়ে ইথারের ময়দানে খেলেছেন তিনি টগবগে পৃথিবীর রেস; দৃষ্টিস্নিগ্ধ রোদে মেলে দিয়েছেন আত্মার বহুমাত্রিক রূপ। সে-থেকেই আঞ্চলিক সাহিত্যের ভাটাতেও প্রদীপ্ত মননে নিরলসভাবে বৈশ্বিক জোয়ারে জাগিয়েছেন অভিমানের মৃত নদী। অন্ধকারের নাভিতে এঁকে দিয়েছেন দক্ষ কারিগরি শিল্পউল্কিদীপ। কথাগুলো এইজন্য বলা— যখন আমার মোমগলা বয়সের শিল্পপ্রেম, শব্দের নৌকার এক টলোমলো যাত্রী; যখন বাক্যের স্পর্শে অনুরিত মন আকাশে-বাতাসে ওড়ে, তখন থেকেই তাঁর কবিতার প্রেমে পড়ি আমি। বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার সাহিত্য পাতায় তাঁর কবিতা আমার চোখ কিনে নিতো যেন। এছাড়া লিটিলম্যাগ তো ছিলোই। তাঁর প্রতি যথাযোগ্য বিশেষণ যুক্ত করা কিংবা তাঁর কবিতা বইয়ের আলোচনা করা আমার মতন ক্ষুদ্র শব্দশ্রমিকের কাছে অনাবাদী জমিতে ফসল ফলানোর স্বপ্ন। তিনি শিল্পসাহিত্যের রসদ নিয়েই এ পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করতে এসেছেন। তাঁর রক্তে বহমান পূর্বসূরির শিল্পের কাঁচামাল। বিশিষ্ট কবি, লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রয়াত শেখ আবদুল জলিলের বংশধর তিনি।
যাকে নিয়ে এত কথামালা তিনি বাংলাপিডিয়ার অন্যতম অনুবাদক, চিকিৎসক ও ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ পরিষদ কর্তৃক একুশে সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি, জামালপুরের সন্তান কবি (Mehedi Iqbal) মেহেদী ইকবাল। আশির দশকের এই কবির জন্ম ৩ জানুয়ারি, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ। কবিতার পাশাপাশি গদ্যতেও রয়েছে তাঁর নিপুণ পদচারণা। এবারের যায়যায়দিন ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম উপন্যাস 'তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে'। তাঁর স্নেহসিক্ত জলে আমি অবগাহন করেছি অনেক আগেই; কলেজে পা দেবার পরপরই তাঁর যথেষ্ট সঙ্গ পাইনি ঠিক, কিন্তু তাঁর কবিতার সান্নিধ্য আমাকে দেখিয়েছে ঋদ্ধতার পথ। আশির দশকের শুরুর দিকে তিনি 'বিবর্তন' নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন। তখন আমার ভূমিষ্ঠকাল।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় তাঁর আরেক কবিতার বই 'ছিঁড়ে যাওয়া নদীর টুকরোগুলো'। এ বইয়ে স্থান পেয়েছে ৪২টি কবিতা— মাছের স্বপ্ন পাখির পূর্ব পুরুষ, পাথরের ঢেউ, ভাগ্যরেখা, লালানডেমাগী বুভুক্ষু শিখার প্রতি, দৈনন্দিন, হ্যাঙার, ধাঁধা, বেড়ালের পা, উড়ন্ত শব্দেরা, পা, জীবনের গান, কুয়াশার শাল, স্পর্শ করতে চাই, প্রত্যাশিত অস্ত্রোপচার, বাঁক, নতুন ভোরের স্বপ্নে তবু আমরা বাঁচি, মুঠোভর্তি বালি এবং জল্লাদের চোখ, রক্তের দীর্ঘ ডানা, বিলীন হওয়ার পূর্বে, হাঙর স্বপ্ন, ক্লোন বিষয়ক, প্রতিশোধ, গ্লাস ভর্তি তরল ঠোঁট, প্রাকৃতিক, ময়দা বিষয়ক, বৃষ্টি, কী যে ভালো হতো, চাঁদের উরু, পাখি ভেবে, বনভোজন, নিষিদ্ধ গ্রাফে কয়েকটি খরগোশের পা, বেড়ালের চোখ, হেলুসিনেশন, স্রোত, ফিনিক্সের ডানা, ভোজ, বনসাই, ভ্যাকসিন, ঘড়ি, ঢেউ, প্লাসেন্টা, ছিঁড়ে যাওয়া নদীর টুকরোগুলো।
তাঁর সাথে কবিতা পরিষদের আড্ডায় মাঝেমধ্যে দেখা হয়, যদি ভাগ্যক্রমে সে আড্ডায় আমি উপস্থিত থাকি। গতকালের আড্ডায় স্নেহবৎসল কবি উপহার দেন তাঁর এই কবিতার বই।
পড়ছি তাঁর কবিতা। ইতোপূর্বে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত 'ময়দা বিষয়ক' কবিতা আমাকে টেনেছিল খুব। এছাড়া তাঁর কবিতাগুলো মূর্ত এবং বিমূর্ততা ছাপিয়ে একটা অনন্য জগতের দিকে নিয়ে যায়, যেখানে কালের গণ্ডি এমন এক সমৃদ্ধ বাগানের সন্ধান দেয় যার দৃশ্যসৌষ্ঠব মোহনরূপের প্রতিভূ। তাঁর কবিতা থেকে আমার কিছু ভালোলাগা পঙক্তি উদ্ধৃতি দিলাম।
'ঢেউ আসলে বহুরূপী। শুধু কি জলে?
আশ্বিনে ফসলের মাঠে সবুজের ঢেউ
আকাশে বহু বর্ণিল বিচিত্র ঢেউ মেঘরাজির।'
(ঢেউ)
'পাখির পূর্বপুরুষেরা এক কালে ছিলো জলাশয়ে।'
(মাছের স্বপ্ন, পাখির পূর্বপুরুষ)
'জন্মের সময় গিলে ফেলেছিলাম
উনুনের এক টুকরো আগুন।'
(লালানডেমাগী বুভুক্ষু শিখার প্রতি)
'ভ্যান গগ বেঁচে নেই, এখন তোমাকেই টানতে হবে উজ্জ্বল কিছু রেখা।'
(হ্যাঙার)
'আসলে জন্ম থেকে কম্পমান
কখনো স্ফটিকের টুকরো, কখনো রোমশ কালো জন্তুর ভয়াবহ হা।'
(দৈনন্দিন)
'পা আছে বলেই প্যারাবোলা থাকে না থেমে
তোমার অনিন্দ্য হাঁটু, নগ্ন পা
কী দীপ্র এগিয়ে যায় সবুজ শস্যের আগুনে!'
(পা)
'একগুচ্ছ মাছি, না-কি মোমবাতি উড়ে যাচ্ছে
আমরা হাত বাড়িয়ে ধরতে যাই, নাকে আসে
মাছের আঁশটে গন্ধ।'
(কুয়াশার শাল)
'কোথায় সে দয়ালু সার্জন? যার হাতে নিষ্পাপ মানবিক ছুরি?'
(প্রত্যাশিত অস্ত্রোপচার)
'অসময়ে জাগে ভয়, অন্ধকার গিলে খায় চর্বি ও নুন
মুঠোভর্তি বালি শুধু, শূন্যতা, পুলকিত জল্লাদের চোখ।'
(মুঠোভর্তি বালি এবং জল্লাদের চোখ)
'ভালোবাসার বদলে তুমি দিতে চাইলে একটি মাত্র কোষ
বললে- ক্লোন করে নাও'
। (ক্লোন বিষয়ক)
'কোনো হাত এখন আর প্রসারিত নয়, বন্ধ সব করতল
করোটির ভেতরে যত জঞ্জাল আর প্যারানোইড বেড়ালের সতর্ক চলাফেরা।'
(কী যে ভালো হতো)
'ঈশ্বর ইঁদুরগুলোকে লেলিয়ে দিয়েছেন আমাদের উপর'
(চাঁদের উরু)
'জ্যোৎস্নার মাংস খুব সুস্বাদু, একদম হাঁসের মতো'
(বনভোজন)
'কত রকমের খাদ্য এখানে, কত বিচিত্র আয়োজন!
সব্জি জ্যোৎস্না থেকে কিশোরীর কাবাব।'
(ভোজ)
'...আমাদের একই মুখ
ঘুরে ফিরে একই ছবি, শরীরে শুকোয় শুধু
লবণাক্ত ঘাম।...'
(বনসাই)
'আকাশের কোনো ডালপালা নেই
নেই মৎস্যপূর্ণ জলাশয়
তবু তার দিকে ছুটে যায় রহস্যময় বেড়াল।'
(ভ্যাকসিন)
'আমরা সবাই তুলসী পাতা
ধুয়ে মুছে সাফসুতরো
যত দোষ ঐ ঘড়িটার।'
(ঘড়ি)
'এখানে আছি বান্ধবহীন। রোদ্দুরে প্রলম্বিত ছায়া
কোনো এক যুবতীর গর্ভাশয়ে বেড়ে উঠে অজ্ঞাত প্লাসেন্টা।'
(প্লাসেন্টা)
'সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে যাচ্ছে তারকারাজি
বেদনার্ত চোখে ঘুম নেই কালো হরিণের
ঘুমগুলো উড়ে যাচ্ছে ঠোঁটে দিয়ে ভ্যানগগের ব্রাশ।'
(ছিঁড়ে যাওয়া নদীর টুকরোগুলো)
বইটির প্রকাশক মাইবম সাধন। তিউরি প্রকাশন, মিউনিসিপ্যাল সুপার মার্কেট, পরিবাগ, ঢাকা। দূরালাপন: ০১৬৭৬১৪৭৮৪৪, ০১৯৫৩০০৬৫২৪

সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান