পাহাড় বা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প - মেঘ অদিতি
পাহাড় বা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প -  মেঘ অদিতি

ফিরে ফিরে আসা এক শীতের বারান্দা ছুঁয়ে ট্রেন চলছিল উত্তরের দিকে। স্থায়ী আবাসন প্রকল্প। চোখের জল তখনও শুকোয়নি। রাত বাড়ছিল। শীতও। ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসার মত এক দুর্মর অভিমানী কিশোরী অত রাতে ঘুম ঘুম চোখে পুড়িয়ে দিচ্ছিল পূর্বাপর স্মৃতি। কোথায় ছিলাম, কেন যাচ্ছি.. সেই যে আরো ছোটবেলায় ট্রেনে চাপলেই দুলে দুলে বলা, যাচ্ছি চলে.. ঝিকুর ঝিক...যাচ্ছি কোথায় জানি না.. কেবল জানি যেতে হবে.. যেতে হবে, যেতে হবে..
যেতে হবে। যেখানে যেতে হবে সেটা একটা পাহাড় হতে পারে। হতে পারে সেখানে কেবল খাদ আর মিস্টিক কুয়াশার জাল পাতা। তবে যেখানে যাওয়া তার নাম খুব বাহারী, স্থায়ী আবাসন প্রকল্প। অতএব তার আর পুরনো জনপদে ফিরে আসা নেই। তার কোনো ব্রহ্মপুত্রও নেই। যে থাকবে তার নাম আত্রাই। টলমল করে যার জল, আচ্ছা সে আত্রাই কি আত্রেয়ী নামের অপভ্রংশ?

টলমল টলমল, চোখে পড়ে টান
ভাসে মন খারাপের কাজল..

শুরুতে ছিল ট্রেন। যমুনায় এসে ট্রেন থেকে নেমে স্টিমার। যমুনার কালো জল, চোখের কাজল মিলেমিশ গেলে স্টিমার ঘাটে লাগে। জল ছেড়ে আবার ট্রেন। রাত বাড়ে। ধীরে ধীরে ভোর আসে। লাল শাড়িকে চমকে দিয়ে পুবাকাশ লাল হয়ে ওঠে। ট্রেন চলতে থাকে দু পাশের উপচে পড়া ফসলের মাঝখান দিয়ে। পুরুষটি গভীর ঘুমের অতল থেকে উঠে বসে এদিক ওদিক তাকায়। ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর সম্ভবত সে তার অবস্থানজনিত বিভ্রমে ভোগে।

ছায়া সরে নিভে যায় সম্পর্ককথন..
বাতাসে উড়ে আসে ছাই
ফুঁসে ওঠে আত্রাইয়ের জল

হয়ত পাহাড়ই। এখানটায় আসার পর একেবারে শুরুর কিছুদিন সে কেবল পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখেছিল দু’চোখ ভরে। তারপরই সে বুঝতে পারে পাহাড়ের আছে প্রবল এক কাঠিন্যও। তার মাঝে স্থায়ী আবাসন প্রকল্প তাকে কখন যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে সে বুঝতেই পারেনি। যখন বুঝল তখন আর উপায় কই। সেই কাঠিন্যের সাথে সহাবস্থানকে মাঝে মাঝে তার কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বসবাস বলে মনে হতে শুরু করে। সেই ছেড়ে আসা ব্রহ্মপুত্র যাকে আর সে কোনোদিন ছুঁতে পারেনি, দিনের মধ্যভাগে সে তার কাজকর্ম সেরে তাকেই ভাবতে শুরু করে চোখ বন্ধ করে। কখনও আত্রাইকেও তার আপন মনে হয়। বহমান নদী আসলে এক হিলিং প্রসেস যাতে সে তার কষ্টগুলো ভাসিয়ে দিয়ে জেগে উঠতে পারে পরবর্তী সময়ের জন্য।

তারপর বেলাও তো বাড়ে। দিনে দিনে ব্যারাকে তখন বন্দি সংখ্যাও একজন একজন করে যুক্ত হতে থাকে। আর বাড়ে জেনারেলের বুটের আওয়াজ।

ঘরে ঘরে সন্ধের আলো জ্বললে
মনে হয়, যেন এখুনি সবাই-
এক লক্ষ ফানুস উড়িয়ে দেবে

সারাদিন যেমন তেমন, বিকেল পেরিয়ে সন্ধে এলে হঠাৎ যেন হাওয়া বদলে যায়। পাহাড়ের যা রীতি। দিন একরকম যায়, রাত হলেই শীতের হাওয়া। বাড়ে কুয়াশা।

প্রথমদিকে তো সে ছিল একা। তারপর দুই এলো। আরো পরে তিন ও চার নাম্বার বন্দি এসে ব্যারাকে যোগ দিলো। সদস্যসংখ্যা বা যুদ্ধবন্দি যেদিক থেকেই ভাবো, তাদের উপস্থিতি বাড়ছে দিনে দিনে। প্রথমজন সময় বদলের আশায় বুক বাঁধছে কিন্তু বুটের আওয়াজ তো থামছে না। সে বরং প্রথমজন আরো সংযত হচ্ছে ভেতর ভেতর। পাঠ চালিয়ে যাবার চেষ্টা শুরু হয়েছে। ততদিনে লাইব্রেরির দরজা চেনা হয়েছে। একের পর এক বহির্বিশ্বের সাহিত্য পড়তে গিয়ে চোখ আটকে গেছে উদ্ধৃতিতে, ‘বিপ্লবের প্রথম শর্ত শিক্ষিত হও।‘ কথাটা মনে দাগ কেটে যায়। এক অর্থে সে বিপ্লবই চায় আর সেজন্য চেষ্টাটাই আসল। লড়াইয়ে নামতে গেলে নিজেকে প্রতিনিয়ত তৈরি করার নাম শেখা। শিখতে শিখতে সে এবার তৈরি হতে থাকে। বাকি তিনজনকেও সে সহযোদ্ধা হিসেবে তৈরি করার প্রয়াসে নামে।

দেয়ালে বাঁধাই করা সময়
মোম থেকে গলে পড়ে ছবি
সম্পর্কের এত কাছে ভরে ওঠে ঋতু
দূর থেকে ছবি বলে ভুল হয়ে যায়

সম্পর্ক জুড়ে থাকে দেয়াল আর দেয়াল জুড়ে শৈশব। ব্যারাকের প্রথম বন্দি, যার বৈবাহিক চিহ্ন হিসেবে একখানা ফ্রেম সামান্য বেঁকে আছে উত্তর দেয়ালে। দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ সদস্য, ওরাও সব দেয়াল জুড়েই জেনারেলের সাথে আছে আলাদা আলাদা ফ্রেমে। জেনারেল কোথাও হাসি হাসি মুখে। কোথাও আবার রাগি দাম্ভিকতায় ঋজু ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে সময়ের সাথে সাথে কিন্তু তার চিহ্ন কোথাও নেই। ব্যরাকের নিচের দিকের ঘরগুলো প্রকট অন্ধকার। সিঁড়ি বাঁক খেয়েছে যেখানে সেখান থেকেও তাকালে উর্দ্ধমুখী অন্ধকার।

পরিবর্তন বলতে দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ বন্দি, গায়ে গতরে যথেষ্ট বেড়েছে। দ্বিতীয়টি অতি বাচাল, তৃতীয়টি মুখ খুললে কথা জড়িয়ে যায় এবং চতুর্থজন একমুখ দাড়িগোঁফের জঙ্গল নিয়ে কেবল দুলে দুলে হাসে। তিনজনেরই আসলে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ছেড়ে এসাইলামে পাঠাবার সময় হয়েছে। আর জেনারেলের হয়েছে অবসর নেবার সময়।

এবং এতগুলো বছরে শেষ অবধি কোথাও বিপ্লব ঘটেনি কোনো।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান