রহস্য , গুজব আর কিংবদন্তির রাজ্য কামরূপ কামাখ্যা- মোঃ শফিকুর রহমান
কিশোর
বয়সে কামরূপ কামাখ্যার জাদুর দেশের গল্প শুনে শিহরিত হননি এমন লোক খোঁজে
পাওয়া সত্যিই বিরল । যেখানে কোন পুরুষ লোক গেলে সুন্দরি স্বল্প বসনা
নারীদের বশে পরে আর ফিরে আসতে পারে না । নারী শাসিত এ রাজ্যে সুন্দরী
নারীরা তাদের যাদুমন্ত্র,ছলাকলা,কামলীলায় এমনভাবে বশীভূত করে যে ইচ্ছা
করলেও কেউ ফিরে আসতে পারে না । তবে জাদুবিদ্যার পারদর্শিতায় যদি সেই নারীকে
ছাপিয়ে যাওয়া যায় তবেই কেবল মুক্তি মিলতে পারে । নারীরা এমন গভীর
ভালবাসায় পুরুষদের আবদ্ধ করে রাখে সে পুরুষ যদি তাকে ছেড়ে চলে আসে তবে সেই
নারী আর দ্বিতীয় কোন পুরুষের বাহুবন্ধি হয় না তবে কারও ফিরে আসার পরিকল্পনা
প্রকাশ হয়ে পরলে তাক যাদুশক্তিতে কুকুর, ভেড়া
ইত্যাদি গৃহপালিত পশুতে রূপান্তরিত করে সেই নারী, পরম মমতায় পুষতে থাকে
যুগের পর যুগ ।
যদি সেই পশু পোষ না মানে তবে জঙ্গলে ছেড়ে দেয়া হয় অথবা
বলি দেয়া হয় মা কামাখ্যার সন্তুষ্টির জন্য ।
এমনিসব রোমাঞ্চকর কাহিনী ও
গল্প শুনার জন্য স্কুল জীবনে কত ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে বেদেনীদের মজমায় চুপিসারে
বসে থেকেছি ঘন্টার পর ঘন্টা তার ইয়ত্তা নেই । এসব কাহিনী কী শুধুই গুজব না
অন্য কিছু তা কাছ থেকে দেখার বাসনা ছিলো সেই ছোটবেলা থেকে।গত মাসে
২৭/০৭/১৮ রহস্যময় কামরূপ কামাখ্যা ভ্রমণ করে পাঠকদের সাথে অভিজ্ঞতা
বিনিময়ের সখ থেকে এই লিখা।
কামরূপ ও কামাখ্যা
কামরূপ
হলো জায়গার নাম আর কামাখ্যাা হলো দেবী, কামের দেবী । কামাখ্যা বিশ্বাস
রীতিতে কাম হলো সম্ভাবনা, কাম হলো আগামী, কাম হলো শুরু, কাম হলো শক্তি ।
কাম থেকেই সবকিছুর সৃষ্টি আর এইm কামের দেবী হলেন কামাখ্যা । তাঁকে তুষ্ট
রাখতেই এই মন্দির তৈরি হয় অতি প্রাচীন কালে। এখানেই যোনি পুজা করা হয়।
আসামের রাজধানী গৌহাটি শহর থেকে অল্প দুরত্বে পশ্চিমদিকে দুর্গম পাহাড় ও
বনভূমি বেষ্টিত নীলাচল পাহাড়ে কামাখ্যা মন্দিরের অবস্থান । সুমুদ্রপৃষ্ট
থেকে এর উচ্চতা ৮০০ফুট । এটি ভারতবর্ষের প্রাচীনতম মন্দিরগুলোর মধ্যে
অন্যতম । পুজা-পার্বন, গঠন-শৈলি ,তন্ত্র-মন্র, যাদু-টোনা ইত্যাদির
বৈচিত্র্যের জন্য এই মন্দিরের খ্যাতি অন্যসব মন্দির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ।
সারা ভারতবর্ষে এই মন্দিরের খ্যতিতে এমনসব বিচিত্র বিশ্বাস,জনশ্রুতি ও
রহস্যময় কাহিনী প্রচলিত রয়েছে যা এই মন্দিরকে দিয়েছে অন্যরকম উচ্চতা ।
প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী ও ভক্তদের উপস্থিতিতে মুখর থাকে মন্দির
চত্তর ও আশপাশ ।
মন্দিরের নির্মাণকাল ও বর্তমান রূপ
এই
মন্দিরের সঠিক নির্মাণকাল নির্ধারণ বেশ কঠিন । মূল গেইটের ধ্বংসাবশেষ এর
স্থাপত্যশৈলি থেকে ধারণা করা হয় এটি গুপ্তযুগে চতুর্থ থেকে পঞ্চম শতকে
নির্মিত। ব্যানার্জি (১৯২৫)এক গবেষণায় দেখিয়েছেন অষ্টম থেকে সপ্তদশ শতকের
মধ্যে কমপক্ষে তিনটি সাম্রাজ্য যুগে এটি নির্মিত হয়েছে। একটা মত এমন
প্রচলিত রয়েছে যে ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে মুসলিম শাসক সোলায়মান কারানির
সেনাপতি কালাপাহাড় এই মন্দির সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছিলেন আসাম বিজয়ের সময়
কিন্তু কোন ঐতিহাসিক তথ্য দ্ধারা এটা প্রমাণিত নয়। কোচ বিহারের রাজা নারা
নারায়ণান ১৫৬৫খ্রীঃ এই মন্দির পূনঃনির্মাণ করেন যা অদ্যাবধি টিকে আছে।
বর্তমান
মন্দিরটি তিনটি চেম্বারে বিভক্ত, পশ্চিম চেম্বার,মধ্য চেম্বার এবং
গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহ হলো সেই গুহা যেখানে কামাখ্যা. দেবির যোনি রয়েছে। এটি সব
শ্রেণীর দর্শনার্থীদের জন্য উম্মুক্ত নয়। প্রতি চেম্বারের দেয়ালে দেব
নারায়ণের ভাস্কর্য স্থাপন করা আছে।
পৌরানিক কাহিনীতে কামাখ্যা দেবী
সতী
ছিলেন দেবতা দক্ষার কন্যা । পিতার অমতে সতী শিবকে বিয়ে করেন । এতে সতীর
পিতা দক্ষা ভীষণ ক্ষেপে যান । রাগ ,দুঃখ ও ক্ষোভে ভগবান দক্ষা সতীকে বাড়ি
থেকে বিতাড়িত করে দেন । কিছুদিন পর দক্ষা আড়ম্বরপূর্ণ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন
করেন । যজ্ঞে সতী ও শিব ছাড়া স্বর্গের সব দেবদেবী নিমন্ত্রিত হন । সতী তার
স্বামীকে নিয়ে এই যজ্ঞে বিনা নিমন্ত্রণে হাজির হলে পিতা সতীর স্বামী শিবকে
চরম অপমান করেন । স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী যজ্ঞের আগুনে ঝাঁপ
দিয়ে আত্মহত্যা করে বসেন । ভগবান শিব তখন ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে সতীর মৃতদেহ
মাথার উপর নিয়ে চক্রাকারে ঘুরাতে থাকেন । এই ঘুর্ণনের ফলে পৃথিবীও
সমানতালেই ঘুরতে থাকে ফলে পৃথিবী ধ্বংসের উপক্রম হয় । সকল দেবতারা আতংকিত
হয়ে ভগবান বিষ্ণুর শরনাপন্ন হন । বিষ্ণু তার হাতে থাকা সুদর্শনচক্র ছুড়ে
দিয়ে মৃতদেহটিকে ৫২ টুকরায় বিভক্ত করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে
দেন । যে যে স্থানে টুকরাগুলো পড়েছে সে সে স্থানগলো শক্তিপীঠ নামে পরিচিত ।
সতীর যোনিটা পরে এই কামরূপের নীলাচল পাহাড়ে ।
পরবর্তীতে এখানে পাহাড়ের
গুহায় স্যাতস্যতে জায়গায় মেয়েদের যোনিসদৃশ একটা গর্ত পাওয়া যায় যা দিয়ে
সবসময়
জলের হাল্কা প্রবাহ নিসৃত হতে থাকে এবং প্রতি বর্ষায় তিনদিন এতে লালজল
নিসৃত হয়। তখন বিচিত্র কারণে নিকটস্থ ব্রম্মপুত্র নদের পানিও লাল বর্ণ ধারণ
করে। স্থাপিত হয় মন্দির ,ইহাই কামাখ্যা মন্দির নামে পুজিত হতে থাকে ।
জনশ্রুতি আছে সতীর যোনি এখানে রয়েছে এবং এটি এখনও ঋতুবতী আছে । যখন এতে
লালজল নিসৃত হয় তখন তিনদিন মন্দির বন্ধ থাকে । লালজলকে মনে করা হয় সতী
দেবীর ঋতুস্রাব । তিনদিন পর বিরাট উৎসবের আয়োজন চলে এবং যোনি পুজা করা হয় ।
এই উৎসব আম্বুচি মেলা নামে পরিচিত। ভক্তরা এই লাল জল সংগ্রহ করে পুজা দেন
এবং অনেকেই সিধুঁরে ব্যবহার করেন । এই জল কালা জাদুতেও ব্যবহার হয়। আবার
কালা জাদু টোনার অভিশাপ থেকে রক্ষার জন্যও এই জল সংগ্রহ করেন কেউ কেউ ।
অন্য
আরেকটি কাহিনী এমন, মর্ত্যের মহাপরাক্রমশালী রাজা নারাকা স্বর্গের দেবির
কামাখ্যার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে প্রেম নিবেদন করেন। দেবি এতে বিপাকে পরে
যান। নারাকাকে বুঝাতে চেষ্টা করেন এই বলে যে দেবতাদের সাথে মানুষের মিলন
সম্ভব নয়। নাছোড়বান্দা নারাকাকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে এই বলে কঠিন শর্তারোপ
করেন যদি এক রাতের মধ্যে নীলাচল পাহাড়ের গোড়া থেকে চুড়া পর্যন্ত সিড়ি তৈরী
করে দিতে পারেন তবে তিনি বিয়ে করতে রাজি। এই সিড়ি বেয়ে নারাকার সাথে
মর্ত্যে নেমে আসবেন এবং তার মনোবাঞ্চা পূর্ণ করবেন। শর্তানুযায়ী নারাকা কাজ
শুরু করেন রাত শেষ হওয়ার আগেই প্রায় কাজ শেষ করে ফেলবেন এমন সময় সিড়ির
গোড়ায় একটা মোরগ কককোরক করে বাক দিয়ে বসে। আসলে মোরগটি কামাখ্যা দেবির
ইশারায় এমন করেছিল। তারপর ক্ষিপ্ত হয়ে সে মোরগটাকে তাড়া করে কুকরাকাটা নামক
স্থানে হত্যা করে। এখানেও একটি মন্দির রয়েছে। বর্তমানে এটি ডারাং জেলায়
অবস্থিত । নারাকা বুঝতে পারেন দেবির সাথে পাল্লা দিয়ে জেতা সম্ভব নয়। তিনি
সিড়ি তৈরি বন্ধ করে দেন। কামাখ্যা দেবিকে বিয়ে না করতে পারলেও এখানে তার
নামে মন্দির তৈরি হয়। অসমাপ্ত সিড়ি পথের নাম মেখ্যালোজ পথ। নীলাচল পাহাড়ে
কামাখ্যা মন্দিরের কাছাকাছি তারা,ভৈরবি,ভূবনেশ্বরি এবং গন্থকর্ণের মন্দির
রয়েছে।
তবে আধুনিক যুগে এ
যুক্তি তেমন বিশ্বাস করা হয় না যে ব্রম্মপুত্রের পানি লাল হওয়ার সাথে এই
মন্দিরের সংশ্রব আছে । পুজা উপলক্ষে হাজার হাজার ভক্তদের লাল সিধুঁর
পানিতে মিশে নদের পানি লাল হতে পারে তাছাড়া এখানকার ভ-ূত্বকে প্রচুর
মিনারেল ও আকরিক রয়েছে যা বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে পানির সাথে দ্রবীভূত হয়ে
পানির রং লাল বর্ণ ধারণ করে বলে বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ মনে করেন। আসাম ও
মেঘালয়ের পাথুরে পাহাড়ে অনবরত গাঁ চুইয়ে পানি পরে। কথিত কামাখ্যা দেবির
যোনির গর্তও সেইরূপ হওয়াই স্বাভাবিক। ভক্তরা এসব যুক্তির তোয়াক্কা কমই
করেন।
যোনি পুজা
কামাক্ষা
দেবীর ভক্ত কুলের বিশ্বাসমতে মা কামাখ্যা এখনও এই মন্দিরে ভগবান শিবের
সাথে কামলীলায় মত্ত আছেন । শিবকে যৌনকাজে সন্তুষ্ট রাখতে তিনি সদা তৎপর ।
যোনি সদৃশ প্রাকৃতিক প্রবাহের উপর স্থাপিত মুর্তির পাশে একজন প্রাপ্তবয়স্ক
নারীকে বসিয়ে একজন পুরোহিত একধরণের সম্মোহন কসরতে পুজো দেন। পরে এ নারীকে
স্বয়ং কামাখ্যা দেবীর প্রতিরূপ মনে করা হয় । এ সময় সন্যাসী, সাধু ,পুরোহিত
ও ভক্তরা উপস্থিত থাকেন । পূর্বে এখানে নরবলী বিশেষকরে কুমারি বলী দেয়া
হতো বলে জানা যায় । বর্তমানে এখানে মহিশ, ছাগল ও ভেড়া বলী দেয়া হয় ।
জাদু সাধনা
কামাখ্যাা
দেবীর সাধনায় জাদুবিদ্যার তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রায়োগিক কৌশল রপ্ত করে
বশ,বান, অশুভ শক্তির মোকাবেলা ইত্যাদি এমনসব শক্তির অধিকারি হওয়া সম্ভব
যা দিয়ে যে কোনও ক্ষমতাকে পরাস্ত করা যায় বলে মনে করা হয় । এমনকি অমরত্ব
লাভও। যাদুবিদ্যার যত কলা কৌশল আছে তার সবই এখান থেকে রপ্ত করা যায় ।
কামাখ্যার সাধনায় একবার কেউ নিয়োজিত হলে সে অনেক বড় যাদুকর হিসেবে নিজেকে
প্রতিষ্ঠিত করতে পারে অথবা বনবাদারে অভিশপ্ত পশু হিসেবে বিচরণ করতে হয় ,
এমন নানা কাহিনী বাংলাদেশসহ সারা ভারতবর্ষব্যাপি প্রচলিত রয়েছে ।
কামাখ্যা বশীকরণ মন্ত্র
কামাখ্যা
বশীকরণ মন্ত্র জাদু সাধনার চুড়ান্তরূপ । কঠিন সাধনার নির্দিষ্ট পর্যায়ে
নিজেকে নিয়ে যেতে পারলে যে কাউকে বশীভূত করা যায় । প্রেম ভালবাসায় বিশেষ
করে একতরফা ভালবাসায় ( one sighted love ) এই বশীকরণ মন্ত্র বেশী ব্যবহার
করা হয় । সাধনার বিভিন্ন পর্যায়ে লক্ষবারের প্রচেষ্টায় নাকি সিদ্দি
(সাফল্য) মিলে । এছাড়াও স্বামী/স্ত্রী , বস, পরকীয়া ,ব্যবসা ইত্যাদি নানা
ক্ষেত্রে এই বশীকরণ ব্যবহারে বিভিন্ন পেশার নারীপুরুষদের আকৃষ্ট করে । তবে
কামাখ্যা দেবীকে তুষ্ট করেই কেবল সিদ্দিলাভ সম্ভব । এর রয়েছে কিছু কঠোর
বিধি যা অনুশীলন বেশ সময়, ধৈর্য ও ব্যয় স্বাপেক্ষ । এই সাধনায় কেউ নিজেকে
নিয়োজিত করতে চাইলে তাকে একজন অগোরি সাধুর বা নাগা সাধুর শিষ্যত্ব গ্রহণ
করতে হবে । অগোরি সাধুদের সম্পর্কে বিচিত্রসব কাহিনী প্রচলিত আছে যে , সেসব
শুনলে গা শিউরে উঠে । তারা উলঙ্গ থাকে, শ্মশানে বসবাস করেন এবং বিচিত্র
খাদ্যভ্যাসে অভ্যস্ত থাকেন । এছাড়াও নানা ধরণের কালাযাদু,
টুনা,বাণ,বাণমুক্তি ইত্যাদির তন্ত্র ও মন্ত্র সাধনায় এই মন্দিরের তুলনা হয়
না ।
কামাখ্যা সিন্দুর
এখানে
একধরণের প্রাকৃতিক লাল পাথর পাওয়া যায় যা দিয়ে সিধুঁর তৈরী করা হয় ।
হিন্দু ধর্মের বিধানমতে এটি খুবই পবিত্র । প্রায় সকল তীর্থযাত্রী এই সিধুঁর
সংগ্রহ করে থাকেন ।
তন্ত্র
মন্ত্র জাদু টোনার অস্তিত্ব বিজ্ঞান স্বীকার করে না। এখানে যা রয়েছে তা
কেবল দীর্ঘদিনের সরল বিশ্বাস আর গুজব। মানুষের সরল বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে
একশ্রেণির অতি চালাক লোকের ফায়দা লোটার পায়তারা । তারপরও প্রতি দিন হাজার
হাজার মানুষ কেউ যাচ্ছে পূণ্যের জন্য, কেউ যাচ্ছে বিপদ মুক্তির জন্য, কেউ
যাচ্ছে জাদুমন্ত্র শিখবার জন্য, কেউ যাচ্ছে শুধুই পর্যটনের জন্যে,কাদের
উদ্দেশ্য কত টুকু পূর্ণ হচ্ছে সে হিসাব কেউ করছে বলে মনে হয় না।