কালের দিক থেকে বাংলা-সাহিত্যকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। সমাজ ও রাজনীতিতেও এই বিভাজন আছে। কালের কিছু সরলীকরণ নিয়ে পণ্ডিতেরা এই বিভাজন করেছেন। বৈশিষ্ট্যগুলো কি তা সুনির্দিষ্ট নয়। একটি যুগের মধ্যে আরেকটি যুগের বৈশিষ্ট্য হর-হামেশা পাওয়া যাবে। যদিও কালের বৈশিষ্ট্যকে এই বিভাজনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে; তবু এটি একটি রাজনৈতিক বিভাজনও বটে। আগের দিনে রাজা পরিবর্তনের সঙ্গে রাজ-আচরণাদিতেও কিছু পরিবর্তন হয়ে যেতো। রাজার ধর্ম-সংস্কৃতি ও ভাষার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে নতুন বৈশিষ্ট্যের সূচনা হয়েছে।
সুতরাং, সাহিত্যের কাল বিভাজনকেও আমরা রাজনৈতিক সময় বিভাজন হিসাবে বিবেচনা করতে পারি। যেমন এদেশে মুসলমান শাসনের আগের কালটিকে আমরা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনযুগ হিসাবে উল্লেখ করে থাকি। এর বিস্তার কাল নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে নানা বিভাজন রয়েছে; তবে দ্বাদশ শতকের আগে রচিত বাংলা সাহিত্যের সকল নিদর্শনকে আমরা এই যুগের আওতাভুক্ত করেছি। এ যুগের সাহিত্যের প্রধান নিদর্শন চর্যপদ। চর্যাপদের রচয়িতারা মূলত ছিলেন বৌদ্ধভিক্ষু; নিজেদের যাগ-যজ্ঞের প্রয়োজনে সাহিত্য-সাধনা করেছিলেন; এ সময়ে সেন বংশের রাজারা সাহিত্যের পৃষ্টপোষকতা করলেও তা ছিল মূলত সংস্কৃতি-আশ্রিত। জয়দেব-বোধায়নের মতো কবিরা সেন দরবারকে মুখরিত করে তুলেছিল।
তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ারের আগমনের পর থেকে এ দেশে কমবেশি মুসলিম শাসনের সূত্রপাত। এই শাসন প্রায় ইংরেজ আসার আগ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল; ত্রয়োদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত প্রায় ছয় শত বছর এই সময়ের বিস্তার। যদিও মধ্যযুগের শুরুর প্রায় শ’দেড়েক বছরকে অনেকেই অন্ধকার যুগ বলে চালাতে চেয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে যে কেবল মুসলমানরা এ অঞ্চলে রাজত্ব করেছে তা নয়; কিন্তু তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যের ঘাটতি হয়নি কখনো। বিশেষ করে স্বাধীন সুলতানী আমলে বাংলা-সাহিত্য রচনার এক হিড়িক পড়ে যায়।
এ দেশে শাসন স্থায়ী করার জন্য স্থানীয় ভাষা-সাহিত্য ও ধর্মের কিছুটা পৃষ্টপোষকতা সুলতানরা করেছিল বলেই রামায়ন মহাভারতের অনুবাদসহ নানা উদ্ভাবনী কাব্য রচনা চলতে থাকে। তাছাড়া শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব, মানুষের ভাবরাজ্যে নতুন সুরের জন্ম দেয়; বহু মানুষ বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার দোলা বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়; বৈষ্ণব কবিতার পাশাপাশি হিন্দু কবিদের আরেকটি অংশ মঙ্গলকাব্য নামক এক ধরনের দেবতাশ্রয়ী কাহিনী-কাব্যের সূচনা করেন। মানুষের রোগ-শোক সীমাবদ্ধতা টিকে থাকার অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দেবতাকে তুষ্ট করার নিমিত্তে এই কাব্য লিখিত হলেও এর অন্তর্লোকে প্রবাহিত ছিল মানব সমাজ ও মনস্তত্বের নানা জটিল ও কূটিল দিক। তবে এই কাব্য যে শুধু হিন্দু কবিগণই রচনা করেছেন তেমন নয়; মুসলমান কবিদেরও কেউ কেউ এই ধারার কাব্যে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তবে মধ্য যুগে মুসলমান কবিদের বড় অবদান, দেবদেবী বর্জিত নর-নারীর প্রেমকাব্য রচনা; যেগুলোকে সাহিত্যে প্রণয়-উপাখ্যান বলে উল্লেখ করা হয়। মুসলমানদের দেব-দেবী না থাকায় তারা মানুষ নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন; তবে সেখানেও অতিলৌকিক অশীরি আত্মার উপস্থিতি একেবারে কম ছিল না। বিশেষ করে জ্বীন-পরী ও ফেরেশতাকুলের উপস্থিতি তো রয়েছেই। তবে যাই হোক, এই প্রধান দুই ধারার মিশ্রণের ফলে একটি নতুন ধরনের ভাষা ও সাংস্কৃতিক রূপ নিয়ে বাঙালি-চেতনা বিকশিত হচ্ছিল।
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ শুরু হয়েছে মূলত ইংরেজ শাসনের সূচনা পর্ব থেকে। যদিও ১৭৫৭ সালে নবাবের পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার ইংরেজ শাসনের সূচনা হয় তবু ইংরেজের বৈশিষ্ট্য ধারণে কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়েছিল। উনিশ শতকের একেবারে শুরুতে ফোর্টউইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার কাল থেকে আধুনিক কালের সূচনা হয়। ফোর্ট উইলিয়ম মূলত ইংরেজ সিভিলিয়নদের দেশী ভাষা শেখাবার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই কলেজের প্রধান অবদান বাংলা গদ্যের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। পণ্ডিত ও ছাত্ররা মিলে নতুন ধরনের সাহিত্য সূচনা করলেও ইংরেজ শিক্ষার অতীতের বাঙালি চেতনা থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দুশো বছর অতিক্রম করে গেলেও এখনো আমরা এই আধুনিক কালপর্বে বসবাস করছি। যদিও বাংলা-সাহিত্যের বিপুল বিশাল সম্ভার এই পর্বে গড়ে উঠেছে; জন্ম হয়েছে নতুন নতুন বিষয় ও আঙ্গিকের।
কিন্তু আমার কাছে এই কাল বিভাজনের যৌক্তিকতার ঘাটতি রয়েছে। প্রধানত এই
বিভাজনের ফলে যে কম্পার্টমেন্ট তৈরি হয়েছে, তাতে আমাদের মন সম্পূর্ণ বাংলা
সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ একই মাত্রায় ধরে রাখা সম্ভব হয় না। এর ফলে আমরা ধরেই
নিই, আমরা যে আধুনিক কালে বাস করছি সেটিই চেতনাগতভাবে সঠিক; আর আমাদের যে
পূর্ব-পুরুষ প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাস করতেন তারা ছিল পশ্চাদ্পদ অবিজ্ঞান
মনস্ক। ফলে তাদের রচনা আমাদের আধুনিক মনে সাহিত্যের তৃপ্তি দানে অক্ষম।
এ সব বাদ দিলেও বর্তমানে যে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে তা হলো, ইংরেজ শাসন অবসান
হওয়ার পরেও আমরা ইংরেজ-চেতনার আধুনিক কালে বাস করছি। ইংরেজ শাসন শুরুর
চল্লিশ বছরের মধ্যে তারা এ দেশে তাদের কাল নির্মাণে সক্ষম হলেও তাদের
অবসানের প্রায় সত্তর বছর পরেও আমরা এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি না। যদিও
উত্তরাধুনিক কাল কিংবা উত্তর ঔপনিবেশিক কাল বলে দীর্ঘদিন ধরে একটি ডিসকোর্স
চলছে; তবু সাহিত্যের মুখ্য কাল বিভাজনে এর কোনো ভূমিকা নাই। অন্তত
সাহিত্যের অধ্যাপকদের এ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। ইংরেজ আমলে সৃষ্ট
আধুনিককালের চেতনার মধ্যে কিভাবে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পর্বের চিন্তার
প্রকাশ ঘটাবো!