একজন বয়স্ক দারোয়ান কাম কেয়ার-টেকার প্রয়োজন। পরিচিত পুরোনো দারোয়ান আকবরই সাহায্য করলো, সে খুবই বিশ্বস্ত, তার সুপারিশকৃত লোক হলে নিশ্চিন্তে কাজে রাখা যাবে...
টাকা দিলে বাঘের চোখ মেলে কিন্তু টাকায় বিশ্বস্ত মানুষ পাওয়া অসম্ভব, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে! প্রাক্তন দারওয়ান আকবরের দেশ কিশোরগঞ্জ, তার খুব গর্ব— সে বলে-
আমি হামিদ উকিলের দ্যাশের মানুষ, অষ্টগ্রাম বাড়ি'।
তাকে সংশোধন করে দেই, বলি 'প্রেসেডেন্ট আবদুল হামিদ', তার সরল উত্তর—
'তুমরা যা কওয়ার কও, আমরা কই আবদুল হামিদ উকিল, সেই ছুডুকাল ত্থেইকা দেখতাছি, হেতেইন আমিলিগ ভুট করে,তাঁইন কুনুদিন হারসে না'!
কিশোরগঞ্জের মানুষ সহজ সরল হয়। আকবরের লোক মানেই তার গ্রামের সরল মানুষই হবে। আকবর গল্প করতে ভালবাসে। সে তার দেশ দেখাতে নিতে চায় আমাকে। তার দেশের গল্প করে অবসরে— অষ্টগ্রাম পুরোই হাওড়াঞ্চল, চারিদিকে শুধু পানি থই-থই; তাদের প্রত্যেকটা বাড়ি একেকটা দ্বীপ। নৌকাই চলাচলের একমাত্র মাধ্যম। হাওড়াঞ্চল হওয়ার অধিকাংশ লোক-জনের আয়-উপার্জন করার মতো কাজ-কাম থাকে না। দরিদ্র সাধারণ মানুষ তখন কাজের সন্ধানে এদিক-সেদিক চলে যায়। শীতে হাওড়ে যখন পানি শুকিয়ে যায় তখন দেশে ফিরে আসে সবাই, চাষাবাদ করে সারা বছরের খোরাকীর জন্য একফসলা ধানীজমিতে। তখন তারা মাস তিনেক নিজ ঘরবাড়ি মেরামতেরর মত জরুরী কাজগুলোও সারে। হাওড়ে বর্ষা আসার আগেই সব সারতে হয় বলে বরঞ্চ তারাই 'বদলা-কামলা'রাখে।
অষ্টগ্রামের অনেক লোককে সে চট্টগ্রামে এনেছে, বিভিন্ন জায়গায় চাকরিতে ঢুকিয়েছে। যারা চাকরি পায় না তারা ধামায় করে সাগর কলা ফেরি করে, কেউ-কেউ চা-বিস্কিট, পান-বিড়ি বেচে। চট্টগ্রাম কিশোরগঞ্জ থেকে অনেকদূর! তার ভাষায়-
' হেই... হাইঞ্জালা রেল এসটেশন থুন পথদিলে সে...ই ভৈরবে আহে, সুরুজ তহন মাথায়!দিপহরে ইশটিমারে উঠলে হে....ই রাইতে অষ্টগ্রাম। কী সুন্দর হাওড়ের দেশ।'
আকবর হালকা-পাতলা গড়নের এক লোককে নিয়ে এল আমার কাছে। নাম সফরআলী। সে এই প্রথম চট্টগ্রামে। গ্রামের মানুষ, কোথাও কোনোদিন চাকরি করেনি।
'বুঝায়ে দিলে সমস্যা নাইগা, হক্কলতাই করতে পারবে, কুনু অসুবিধা করলে আমারে কইয়ন'।
আকবের ভাষ্য—
এক বছরে ছুটি নেবে না! বছরান্তে একসপ্তাহ বাড়িতে যেতে দিতে হবে। অবশ্য ওর বাড়িতে তেমন কেউ নেই, বউ নৌকায় করে চুড়ি-লেস-ফিতা, আলতা- সাবান বেচে। অনেকটা বাইদানীর মত। স্বামী-স্ত্রী দেখাই হয় না বলতে গেলে! সফরআলী দেশে ধান বেচা-কেনার 'দলালি' করতো, তার মাথায় অনেক বুদ্ধি।তবে মানুষ চালাক হয়ে যাওয়াতে এখন দলালি পেশায় আয় কম।
মাস মাহিনা সাব্যস্ত করে রেখে দিলাম সফর আলিকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম।
একদিন পরই বুঝলাম আমাকে অনেক অস্বস্তিতে ভুগতে হবে এবং খাটতে হবে একে নিয়ে কারণ প্রথমেই ভাষা সমস্যায় পড়লাম। কোনো কিছু বললেই 'ওয়য়োহ - অয়য়োহ' ঘাঁড়নেড়ে কাজ করে উল্টো। দোকান থেকে চিপস কিনতে পাঠালে নিয়ে আসে জিরার গুড়া! প্রত্যেক পদে-পদে বেহাল অবস্থা!
আকবর বলে-
কয়েকটা দিন গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে, একটু সময় দেন।
ও মাতৃভাষায় বুঝিয়ে দেয় । আমি ধৈর্যধারণ করি। ঠাণ্ডাভাবে বোঝাতে চেষ্টাকরি। মাঝে-মাঝে বকাও দেই, তাতে হয় বিপরীত ক্রিয়া, ভুল-ভ্রান্তি বেড়ে যায়। তাকে বারবার বোঝাতে নিজেরই বদ-অভ্যাস হয়ে গেল কোনো কিছু বলতে গেলেই তা রিপিট করা। ঘর চুন-কাম করার সময় সিলিং ফেন খুলে বললাম 'এগুলোকে ন্যাকড়া ভিজিয়ে খুব ভালোভাবে পরিস্কার করে রাখো' পরিস্কারের একটি মহড়া দিলাম নিজেও। সে বুঝল। কিন্তু হায় কপাল! বিকেলে দেখলাম চারটা ফেনকে সে বড় দুইটা বালতিতে ডুবিয়ে রেখেছে। মাথায় আগুন ধরে গেল।
সফরআলী নির্বিকার চিত্তে জানালো ভেজা ন্যাকড়ায় কম পরিস্কার হচ্ছিল তাই পাখাগুলোকে 'ভিজায়া রাখেছে'! এতে অধিক পরিস্কার হবে, সে নিশ্চিত; বরঞ্চ আমিই পরিস্কার কীভাবে করতে হয় তা জানি না! ভিতরের কয়েলে পানি ঢোকায় ফেনগুলো আর সচল হল না।
'ঘর ভাড়া দেয়া হবে' বোর্ডটা সফর আলিকে দিয়ে গেইটে লাগিয়ে, তাকে ঘরভাড়া কত-ভাড়াটিয়া কেমন চাই, বোঝালাম। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো 'অয়য়োহ'। চার-পাঁচদিন পর জানালো একজন ভালো ভাড়াটিয়া পেয়েছে, ভাড়াটিয়া একজন শিল্পপতি এবং অতিশয় নম্র-ভদ্র; কিন্তু ফ্যামেলি নাই!বউ না থাকলেও যেহেতু তিনি -'শিল্পপতি' সে কারণে তাকে বাসা ভাড়া দেওয়া যায়', সফরআলীর মন্তব্য।
ভিমড়ি খাবার দশা আমার! সেমি-পাক্কা বাসার ভাড়াটিয়া 'শিল্পপতি'! ব্যাপার কী? স্বদেশ শিল্পপতিদের কী হলো! কোনো কারণে কি শিল্পপতি আত্মগোপন করতে চায়! আমি সফরআলীর দিকে চোখ বড় করে চাইতে-ই সে তাড়াতাড়ি বললো-
'শিল্পপতি সরাসরি আফনার লগে দ্যাখা করবে, হাইঞ্জালায়'।
সন্ধ্যায় একজন লম্বামত লোককে নিয়ে এলো সে
'তিঁনাই--শিল্পপতি, ঘরডা লইতে চায়'
বলে পরিচয় দিলো । ভদ্রলোকের সংগে হাত মিলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
'আপনি কী করেন?
' সলজ্জ হাসি দিয়ে তিনি জানালেন: তিনি একজন শিল্পী, গান করেন। ব্যাচেলর ঘর-ভাড়া চান। আমি 'শিল্পপতি' থেকে আছড়ে পড়লাম সঙ্গীত-শিল্পে।
আলমিরা, ওয়ার্ডরোবের কাপড়-চোপড়ে ভ্যাপসা গন্ধের কারণে, ইফতারের ক্ষণিক আগেই মোড়ের দোকান থেকে কাপড়ে দেয়ার জন্য দশটা কাপুরের(কর্পুর) প্যাকেট আনতে বললাম সফরআলীকে।ভাল ভাবে বুঝিয়ে বললাম যে জিনিসটা কাপুর বা ন্যাপথলিন বলে। চট্ করে দশ প্যাকেট কিনে নিয়ে আস সামনের মনোহারী(স্টেশনারি) দোকান হ'তে, পঞ্চাশটা টাকা তার হাতে দিলাম। 'হয়য়ো' বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল সে, দোকান থেকে এসেই ইফতার করবে। ওর ইফতার নির্দিষ্ট স্থানে দেওয়া হলো। ঘরের সবাই ইফতারের জন্য বসে পড়লাম কিন্তু সফরআলী তো আর আসে না।দোকানে যাওয়া- আসায় বড়জোর পাঁচ মিনিট লাগার কথা। বেকুবটা গেলো কোথায়? ইফতারের সময় পার হওয়ার পরও তার দেখা নাই! প্রায় ঘণ্টাপার করে হাঁপাতে-হাঁপাতে এলো। তার হাতে ধরা শাড়ী কাপড়ের দোকানের চ্যাপ্টাকৃতির লম্বা দশটা প্যাকেট!চক্ষু ছানাবড়া সবার। কী এসব? তামাশা পাইছ? সারাদিন অভুক্ত রোযাদার সফরআলী দুর্বলকন্ঠে বললো-
'আফনেইতো কুইছন, কাপুরের দশটা প্যাকেট আনতে। এই খানে কুনু শারি-কাপুরের দোকান নাই, তয় আমি বাজারে শারির দোহান'ত্থন যাইয়া আনলাম। শারির দোকানঅলা খালি প্যাকেট ব্যাচতে চায় না, বুহুত কইয়া-বইল্লা তয় একটা বিশ ট্যাহাদরে দুইশ ট্যাহা দিয়া দশটা আনলাম। আফনে দিছুইন পঞ্চাইশ ট্যাহা বাকিডা আমার পকেটত্থন দিছি'
হতভম্ব-হতবাক আমি কী বললব, কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না!
সহজ-সরল ধার্মিক সফরআলী মোটামুটি ভাষা বিভ্রাট থেকে উৎরে উঠল,বকাঝকা খেয়ে নিজেকে অনেক শুধরে নিল।ভুল করলে তর্ক না করে, ভুল স্বীকার করে নেয়ার প্রবণতা আমার ভাল লগতো। সে আমাদের সংসারেরই অংশ হয়ে গেল। এরকমই চলছিল।হঠাৎ একদিন হাউমাউ করে সফরআলী বললো তাকে ছুটি দিতে হবে। তার পরিবারে এক মহা সংকট! বাড়িতে না গেলেই নয়। তার সংসার ভেঙ্গে গেছে।
সে প্রবাসে আসার কারণে তার বাইদানী বউ পর পুরুষের সংগে পরকীয়ায় জড়িয়ে তাকে ছেড়ে গেছে!
অগত্যা সংসার-পরিবারের ভাঙ্গা-গড়া পরিস্থিতিতে আমি তার ছুটি মঞ্জুর করতে বাধ্য হলাম। কাঁদতে-কাঁদতে সফরআলী বিদায় নিল।
আবার আসবে বলেছিলো সফরআলী, ফিরে এলো না; তার বাইদানি স্ত্রী পরকীয়া থেকে ফিরেছিলো কিনা; সংসার জোড়া লেগেছিলো কিনা— তা জানা হলো না!