"তহনি তো তোমারে কইছিলাম, " ওই সব করনের কাম নাই, পরের যান নিয়া পরের মাল নিয়া সুখ পাওন যায় না।" আমার কথা অহন ঠিক অইছে নি নূর এন্তাজের বাপ ? কোন জায়গাটা ধরে রাহেলা বিবি টানটা দিলো তা স্মরণ হয়ে যায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নুর আলীর। অন্যদিন হলে তেলে বেগুনে জ্বলে তো উঠতই এমন কি এরও বেশী কিছু এই বিবির গা গতরে….। কিন্তু পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় নিজের ছবিটার প্রতি দৃকপাত করতেই এগার হাজার ভল্টে স্যাঁকা খাওয়ার মত আঁতকে ওঠে ভাতের থালায় হাত রাখা নুর আলী। শুধু কি তাই? ছবির ওপরের নাম সহ অপরাধের ধরনের বর্ননার একটি হরফও পড়তে পারলো না হাতপাসহ ভাল্লুকের জ্বরে ধরার মতো কাঁপন ওঠে।
কলেজ পড়ুয়া ছেলে নুর এন্তাজ প্রত্রিকাটা মায়ের প্রায় মুখের ওপর ছেড়ে দিয়ে কোন দিকে যাবে দিশাবিশা হারায়ে একদিকে নিখোঁজ হয়ে যায়। ছেলেকে পিছু পিছুই ডাকলো রাহেলা বিবি ছেলে কানেই তুললো না মায়ের ডাক। মার কেমন লাগছে অশুভ খবরটি দেখে নিশ্চয়ি ছেলেরেও খুব খারাপ লেগেছে। না হয় ছেলে কখনো এমন করেনি। রাখ ঢাকেরও উপায় নেই কারো থেকে, এই সমাজ থেকে। ওরও তো একটা সমাজ আছে নিজের, ওদের নজর কী দিয়ে ঢাকবে? রাহেলা বিবি ভাবে, কিছু মিথ্যা সিথ্যা হলেও শুধরান যেত তা তো নয়! নির্জলা সত্য। সবাই এখন উচ্চবাচ্যেই একাত্তরের ঘাতক দালাল নুর আলীর অপকীর্তির বর্ননা দিয়ে বেড়াবে। বাইরে ছেলের মুখ দেখানর আর কোন উপায়ই থাকল না। এতো দিন মানুষ নিশ্চুপ ছিল, একাত্তরের ধর্ষক, খুনি, অগ্নিসংযোগকারীদের বিচারের নাম গন্ধও ছিল না, কারণ পরিস্কার, এতোকাল ক্ষমতায় ছিল ওদেরই সমর্থক। কুর্দন করে করে বেড়িয়েছে দেশ জুড়ে। আরো ডাল কুত্তা তাল কুত্তা নাকি বাংলাভাই বানাইছে আর দম ফাটানো ধমকানো বাজি করছে" আজ থেকে স্বামীর হিসাব নিকাষের দুর্দিন শুরু তারপরও সত্য প্রকাশে কি ভাবতে এক পা ও পিছ'পা হয় না নুর আলীর স্ত্রী রাহেলা বিবি।
ভাতের থালায় আর হাত বসলো না নুর আলীর। ঘরের দেওয়ালে টাংগান বাবার সাদা কালো ছবিটার দিকে চোখ পড়লে চমকে ওঠে নুর আলী। ওর মনে হলো বাবাকে হাসতে দেখলো।ব্ সাহস হল না নুর আলীর, বাবার ছবির দিকে তাকাবার। ওর ইচ্ছা হচ্ছিল এখনি ওর একাত্তরের লুটের টাকার ঝলমলে প্রাসাদ থেকে বেড় হয়ে মানুষ জনের চোখের আবডালে চলে যায়, যেখানে রাহেলা বিবিরা, নূর এন্তাজরা বিশেষ করে সেই একাত্তরের প্রজন্মের জীবিত একজনও নূর আলীর চোখে পড়বে না। এই মুহুর্তে নুর আলী চোখে যেন ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে। বারকয়েক ইস ইস করে চোখ রগড়ে তাকাতেই মরহুম বাবার ছবিটার দিকে ফের চোখ পড়ে। এবার বুঝি থ খেয়ে বাবার ছবিটার প্রতি তাকিয়েই থাকে নুর আলী। কিছুতেই যেন চোখটা সরাতেই পারছে না। ঘাম আর ঘাম বাবার চোখ মুখ জুড়ে, দর দর করে দরিয়ার জোয়ারের মতো ছুটছে। এবার কাঁধের গামছার খুট দিয়ে বেশ করে চোখ মুখ মুছে নিয়ে নিজেদের গৃহের উন্মুক্ত দরোজার দিকে ফিরে তাকাতেই কি যেন দেখতে পেয়ে আবারও চোখ মুছে পরিষ্কার করতে যায়। চোখ দু'টো ঝকঝকে তকতকে মনে হলো এবার ঘাতক নুর আলীর। আবার দরোজার মুখের দিকে তাকায়, আবার মরহুম বাবাকেই দেখতে পাচ্ছে বুঝি। ওখানটা থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে দেওয়ালে টাংগান বাবার ছবিটা দেখতে চেয়ে ব্যর্থ হলো। ছবিটি যেন দেওয়ালে নেই। এবার ডান হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নেয় এবং উন্মুক্ত দরোজার দিকে তাকায়, যা দেখতে ছিল তা আবার দেখার চেষ্টা।গল্পকারের ভাবনা, মানুষ এমনি করে থাকে, কখনো কখনো ভয়কেও দেখবার তীব্র আগ্রহ দেখায়। হ্যা, নূর আলী এবার দেখতে পাচ্ছে বাবা পেছন ফিরে বাইরে তাকিয়ে আছে নূর আলীর মনে হচ্ছে ওর বাবা কার জন্য পথ চেয়ে আছে? অথবা কাউকে হাত ইশারায় ডাকছে। যে দিক থেকে কাউকে নূর আলীর বাবা ইশারায় ডাকছে বলে মনে হচ্ছে সেই দিকে মনযোগী হয় নূর আলী। নূর আলীর মনযোগের ভেতর এক প্রকার ভয় ঢুকে যায়, সে কি! এতো এতো মুখ ? ক্ষতবিক্ষত মুখ ? ও তো একটি কিশোরী মেয়ে! সেই মেয়েটি যে নাকি একাত্তরের দিনে দংগল নুর আলীর হাত থেকে ছাড়া পেতে ওর হাত কামড়ে ধরে ছিল, নুর আলীকে বুঝাতে চেয়েছিল, "কিছুতেই দুষ্মনের ক্যাম্পে যেতে চাই না। বরং তুমি আমারে মাইরা ফালাইয়া ছোট দোষ করো, তোমার আল্লাহর দোহাই ভাই গো! "
কিশোরী মেয়েটি সরতে না সরতেই দাঁতে ভেংচি কাটতে কাটতে গ্রামের শরৎ ঠাকুরের এয়াতিম নাত্নিটা দিবাদ্রি বুঝি এদ্দিন পর বেরহম নুর আলীর উপর রান্না ঘরের ভাঁজা কাঠি হাতে অসীম হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে। মুহুর্তের মধ্যে এমন একটি অবস্থার সৃস্টি হলো তা যেন লুটের টাকার আবাসনও ভয়ার্ত হয়ে গুড়িয়ে পড়তে থর থর করে কাঁপছে। নুর আলীকে ভেংচি কেটে কেটে বলছে, " খানদের তেলের চর্বি অলা অহন কুন্ঠে যাইবি? আইজ তরে ঠ্যাংগাইবাব আর তর কইলজা গুর্দ্দা খানকুত্তাগো দিয়া খাওয়াইবাব, এই আয় দেহিন !"
এরপর অনুভব করছে নুর আলী, তীব্র একটা ঠান্ডা সারা শরির জুড়ে! গ্রামের তুন্তলা দিদির ছনের ঘরে লাগিয়ে দেওয়া আগুনের হল্কার জিহবাগুলো ঘরের ভেতর দলে দলে ল্যা ল্যা করে ঢুকতে চাচ্ছে। সেগুলো চাবুকের মতো। তার সাথে কারো আর্তনাদ আর আর্তনাদ। এক প্রকারের গুংগানি উঠতে চাইল একাত্তরের ঘাতক দালাল নুর আলীর বোবা গুমট চিৎকারের ভিতর থেকে। অবশ্য তখনও জনশুন্য ঘর। একাত্তরের দোর্ডন্ড প্রতাপশালী ক্ষমতাশালী তথাকথিত জেনারেল নুর আলী ওরফে টিক্কা খান ওরফে রাওফরমান আলী ওরফে হালাকুখান কম্পিত থর থরে জবজবে ঘর্মাক্তকলেবরে অসহায় চোখে কাউকে খুঁজে ফিরছে। কিন্তু তাতে কি ? মিশমিশে অন্ধকারের মতো, অন্ধকারে তাকে কারা ঘিরে ধরেছে! কেউ সরছে না, কেউই যাচ্ছে না। হঠাৎই ঝকঝকে প্রাসাদের শরির জুড়ে বুঝি কম্পন জাগলো। " এ কি! ওই তো বাবা। নুর আলীর ইচ্ছা হলো বাবাকে ডাকতে। কিন্তু বাবা বিকৃতি মুখ ধারণ করে বিশাল এক বোঝা মাথায়। বোঝার চারদিক ছাপিয়ে লাল টকটকে রক্ত ঝরছে। বাবার শরির সেই রক্তে পায়ের স্পঞ্জ, লুংগি ও গেঞ্জি সমেত তলিয়ে যাচ্ছে বুঝি। আর বাবা মাথার বোঝার ষাড়্গরুর গস্তের রক্তের ভেতর পরে ভয়ার্ত কন্ঠে মেশিনগান কাঁধে কথিত জেনারেল নুর আলীকে বলছে, " বাবা নুর আলী! আমি আর হাঁটতে পারিনে বোঝার ভারে আমার গতর কাঁপছে, গোস্তের রক্তে ডোবা পা আর চলেন না বাবা! পিছলে পইড়ে যায়...।" বাবার অনুনয় কথা শুনে সেই দিনের জেনারেল নুর আলী অভ্যাশগত ভাবে চেচিয়ে উঠে বাবাকে হুকুম ছাড়ে, " বানচোত! পারবি না তো খাইবি কেমনে? চল- "বলেই একাত্তরের সেই দিনের মতো বৃদ্ধ পিতার মাজা বরাবর বুটের লাথিটা ছুঁড়ে মারে, বাবা "কোঁৎ!" মতো একটা শব্দ করে বড় একটা গাছের মতো চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। মাথায় থাকা ষাড়্গরুর কইলজা, আস্ত দুটো রানসহ বাঁশের ডালাটা কাঁত হয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ে।
নুর আলীর ঘোর কাটে, নিজের ডান পার্শের পা'টা ততখনে সামনের চেয়ারের তক্তপোশ গুঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে ফাঁসির রশির মধ্যে যেন শক্ত হয়ে আটকে আছে ঘাতক দালাল নুর আলীর।