কবি বন্দে আলী মিয়ার জন্ম বার্ষিকী ১৭ জানুয়ারী উপলক্ষে
প্রবন্ধ
কবি বন্দে আলী মিয়া আজীবন দারিদ্রতার সাথে লড়াই করেছেন। কিন্তু সাহিত্যপ্রেম-চর্চা ত্যাগ করেননি। নিরলসভাবে নিজের সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। ‘ময়নামতির চর’ কাব্য গ্রন্থ প্রকাশ হলে তিনি কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তাঁর অসাধারণ কাব্য প্রতিভা কাব্যপ্রেমীরা জানতে পারেন। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী কবি বন্দে আলী মিয়ার জন্ম বাংলাদেশের ছোট জেলা শহর পাবনার রাধানগর (নারায়নপুর)মহল্লায় ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারী । ( ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন তিনি ইন্তেকাল করেন)
কবি বন্দে আলী মিয়া কবিতায় আকর্ষনীয় ছন্দে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের জীবন-আচরণ, গ্রামের দৃশ্যপট চিত্রিত করেছেন।
তিনি শুধু কবিতা এবং শিশুতোষ ছড়া রচনা করেননি। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় বিচরণ করেছেন। উপন্যাস, নাটক-কথিকা লিখেছেন। অনুবাদ কর্ম করেছেন। সাহিত্যের শাখাগুলোকে তিনি অনায়সে ছুঁয়ে গেছেন বাঙ্গলা ভাষার সহজ-সরল শব্দ গাঁথুনি দিয়ে। তিনি একজন চিত্র শিল্পীও ছিলেন। এক বাক্যে বলা যায় কবি বন্দে আলী মিয়া একজন সব্যসাচী লেখক। পাবনার আর.এম একাডেমী ( রাধানগর মজুমদার একাডেমী) তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
তাঁর সাহিত্যের সৃজনশীল কর্মের সূচনা হয় অষ্টম- নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালেই।কবি বন্দে আলীর কিশোর বয়সে লেখা তাঁর ‘ ছিন্নপত্র’ নামে প্রথম কবিতা নাটোরের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী গেজেটে ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়।
প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশের পর ১৯২৭ সালে কবি বন্দে আলী মিয়া কলকাতার বৌ বাজারের ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমী থেকে চিত্রকলায় প্রথম শ্রেণী পেয়ে উত্তীর্ণ হন।
তিনি ১৯৩১-১৯৩২ শিক্ষাবর্ষে কলকাতা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৩৪ সালে উত্তীর্ণ হন। কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯২৫ সালে ইসলাম দর্শন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন।
১৯৩২ সালে কবি বন্দে আলী মিয়ার প্রথম কাব্যগ্রহ্ন ‘ ময়নামতীর চর’ প্রকাশিত হয় । এই কাব্যগ্রন্থ বিষয়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতামত জানতে তাঁর প্রবল আগ্রহ হলো। তিনি স্মৃতি কথায় লিখেছেন ‘‘ প্রায় মাস দেড়েক পরে সংবাদপত্র পাঠে জানতে পারা গেল, রবীন্দ্রনাথ পারস্য থেকে ফিরেছেন। আমার ‘ময়নামতীর চর’ নামক কবিতার বইখানি সেই সময়ে ছাপা হচ্ছিলো। বইটা সম্পর্কে একটা অভিমত কবির নিকট থেকে গ্রহণ করবার দুরাশা মনে ছিল। সুতরাং শ্রাবণের এক দ্বিপ্রহরে জনৈক শিল্পীবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বোলপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
অপরাহ্ন সাড়ে পাঁচটার দিকে সুধাকান্ত বাবু খবর পাঠালেন-আমাদের আগমন সংবাদ শুনে কবি আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন।....কবির বাসগৃহ উত্তরায়ণে এসে হাজির হলাম। কবি ইজিচেয়ারে শুয়ে কি একখানা বই পড়ছিলেন। আমরা যেতেই উঠে বসলেন। আমরা অভিবাদন জানিয়ে সমুখে বসলাম। কাগজের মোড়ক খুলে ‘ ময়নামতীর চরে’র ছাপানো ফর্মাগুলি তাঁর হাতে দিলাম। কবিতাগুলো রবীন্দ্রনাথ একরে পর একটি মনোযোগ দিয়ে পড়লেন।
ময়নামতীর চর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অভিমত সেদিন দুপুরে আহারাদির পরেই পাওয়া গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
‘ তোমার ময়নামতীর চর কাব্যখানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং তার জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। তোমার রচনা সহজ এবং স্পষ্ট, কোথাও ফাঁকি নেই। সমস্ত মনের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছ এবং কলমের অনায়াস ভঙ্গিতে লিখেছ। তোমার সুপরিচিত প্রাদেশিক শব্দগুলি যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুন্ঠিত হওনি তাতে করে কবিতাগুলি আরো সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাতীরের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকট স্পর্শ বাংলাভাষায় আর কোন কবিতায় পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি।( ২৬ জুলাই ১৯৩২)’’
কবি বন্দে আলী মিয়ার ‘ময়নামতী চর’ কাব্য গ্রন্থের কবিতাগুলো পড়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে মন্তব্য করেছেন, তা একটি বিশেষ দিক নির্দেশ করেছে। তিনি বলেছেন, ‘তোমার রচনা সহজ এবং স্পষ্ট, কোথাও ফাঁকি নেই।’ আসলেও এটি যথার্থ মূল্যায়ন। ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রন্থ কয়েকটি কবিতা নিয়ে আলোকপাত করার সময় এই বিষয়ে আমরা আলোচনা করবো ।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কবি বন্দে আলী মিয়া কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বেতারে এবং পরে রাজাশাহী বেতারে যোগদান করেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এখানেই কর্মরত ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন : কবি বন্দে আলী মিয়ার পিতা মুন্সী উমেদ আলী পাবনা জজকোর্টে চাকুরী করতেন। তাঁর মাতা নেকজান নেসা। পিতা মাতার ইচ্ছা অনুসারে তিনি পাবনা শহরের জিলাপাড়া মহল্লার ফজলার রহমানের কন্যা রাবেয়া খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯২৬ সালে। কবির প্রথম স্ত্রীর অনেক সন্তান আঁতুর ঘরেই মারা যায়। প্রথমা স্ত্রীর এক কন্যা জীবিত । কবি পরে আরো তিনবার পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। রাবেয়া খাতুনের পরের সহধর্মিণীরা ছিলেন, হেনা, শামসুন্নাহার এবং পরীবানু। প্রথম স্ত্রী এক কন্যা সন্তানের জননী। কবির দ্বিতীয় স্ত্রী এক কন্যা সন্তানের জননী। তৃতীয় স্ত্রী ছয় পুত্র, দুই কন্যার এবং চতুর্থ স্ত্রী দুই পুত্রের জননী । কবির এক নাতী ‘ কথিত’ বন্দুক যুদ্ধে পাবনায় নিহত হন। তাকে পাবনায় সবাই নাতী বাবু বলে ডাকতেন।
কবি বন্দে আলী মিয়ার পুত্ররা হলেন, রকিবুল ইসলাম টুটু ( মরহুম),শহীদুল ইসলাম ছুটু(মরহুম),সিরাজুল ইসলাম বুলু, মহিদুল ইসলাম মজনু(মরহুম),ফরিদুল ইসলাম ফরাদ, রমিজুল ইসলাম রঞ্জু, জাহিদুল ইসলাম চাঁদ এবং ওমর ফারুক । কন্যারা হলেন, রোকেয়া বেগম, আফরোজা বেগম মিনতি, দিলরুবা বেগম সুমতি এবং জান্নাতুল ফেরদৌস মিলু।
কবি বন্দে আলী মিয়ার কোন কিছু দেখার যে গভীর দৃষ্টি ছিল তা অনস্বীকার্য। কবি বন্দে আলী মিয়া গভীর দৃষ্টি প্রক্ষেপণে এবং স্বীয় মেধার সমন্বয়ে গ্রামীণজীবন, মানুষের সুখ-দু:খ-বেদনা নিয়ে কাব্য রচনার এক অনবদ্য কৌশল কাঠামো তাঁকে কবি হিসেবে সবার মাঝে স্থান করে দিয়েছে। তাঁর ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতার নামকরণেই এই কাব্যগ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে। ‘ ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রন্থে কবি বন্দে আলী মিয়া লিখলেন,
ময়নামতীর চর
(ক)
বরষার জল সরিয়া গিয়াছে জাগিয়া উঠেছে চর
গাঙ-শালিকেরা গত খুড়িয়া বাঁধিতেছে সবে ঘর।
গহিন নদীর দুই পাড় দিয়া আঁখি যায় যত দূরে
আকাশের মেঘ অতিথি যেন গো তাহার আঙিনা জুড়ে!
মাছরাঙা পাখী একমনে চেয়ে কঞ্চিতে আছে বসি
ঝাড়িতেছে ডানা বন্য হংস-পালক যেতেছে খসি,
..
তট হতে দূরে হাঁটু জলে নামি এক পায়ে করি ভর
মৎস্যের ধ্যানে বক দু’টি চারি সাজিয়াছে ঋষিবর।
...........................................................।’
কবি বন্দে আলী মিয়া এই কবিতায় বরষার জল সরে গিয়ে জেগে উঠা চরের চারদিকের দৃশ্য কবিতায় তুলে এনেছেন বাংলা ভাষার সহজ-সরল শব্দে। । এই কবিতায় তাঁর কবি মনের গভীর অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়।
কচুরীপানার ফুল
বেগুনী রঙের কচুরী পানার ফুল-
পানিতে ভাসিয়া চলে হেথা হোথা হয় নাকো দিক ভুল,
সুরসুর করি বায়ু চুপিসারে কয় কথা কানে কানে
শিহরায় তার বোঁটা আর পাতা শিহরায় অভিমানে;
...
কচুরী পানার ফুল
কাজল বরণ লিকলিকে দেহ পিঠভরা এলোচুল।
মেঘের মতন মুখ দেখে তার পানির আয়না দিয়া
সবুজ বরণ শাড়ীখানি তার রহে তনু জড়াইয়া।
..।’ ( ময়নামতীর চর, বন্দে আলী মিয়া)
কচুরীপানা এবং এর ফুল দেখেননি এ রকম মানুষ খুব কমই আছেন। নদী-জলাশয়ে কচুরীপানার বাস।
কচুরীপানা কবিতার বিষয় হতে পারে ! এই ভাবনা আমরা কয়জন ভেবেছি। কবি বন্দে আলী মিয়া কচুরীপানা নিয়ে অনবদ্য এক কবিতা লিখেছেন। সুনিপুন নির্মাণ কৌশলে কচুরীপানার ফুলকে কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন । কবি বলছেন, ‘ বেগুনী রঙের কচুরীপানার ফুল-
পানিতে ভাসিয়া চলে হেথা হোথা হয় নাকো দিক ভুল।’
কুচরীপানার ফুলের সাথে বাতাস কথা বলে কানে কানে।
কবি বন্দে আলী মিয়া কচুরীপানার পাতাকে সবুজ বরণ শাড়ীর সাথে তুলনা করেছেন। এখানেই তাঁর দেখার এবং ছান্দিক কবিতা লেখার এক যাদুকরি দিক ।
স্মৃতি কথায় পাওয়া যায়, কবি বন্দে আলী মিয়া ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রহ্ন বিষয়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত সংগ্রহ করে বিদায় নেবার আগে বলেছিলেন,তাঁর কলমিলতা বইটা প্রেসে আছে এবং সেখানা তিনি কবিকে উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, কলমিলতা বইটি পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন জাগে সেটি কী প্রকাশিত হয়নি? নাকি প্রেস থেকে এর ছাপালিপি রবীন্দ্র বিদ্বেষী কেউ সরিয়ে ফেলেছেন। নানা কর্মে ব্যস্ত কবি বন্দে আলী মিয়া জানতে পারেননি।তবে আশার কথা কলমিলতা কবিতাটি ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রন্থে আছে।
জানা যায়, ‘ময়নামতীর চর’র প্রথম সংষ্করণে মোট বিশটি কবিতা ছিল।পরবর্তীতে ঢাকা থেকে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রহ্নে আরো বিশটি কবিতা সন্নিবেশিত করে মোট চল্লিশটি কবিতা নিয়ে ‘ময়নামতীর চর’ বইটির সপ্তম সংষ্করণ বের হয় ১৯৬৩ সালে।
কবি বন্দে আলী মিয়া কলমিলতা বইটি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন, সেই কলমিলতা কবিতাটিতে কি আছে সেটা আলোচনার দাবি রাখে।
‘ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রহ্নে পাওয়া ‘কলমিলতা’ কবিতাটি কবি গুরুকে উৎসর্গ করা হয়েছে তাও দেখা যায় না। এর কারণ অজানা ।
‘বাতাস লাগিয়া দোলে নিরবধি কলমিলতা
পাতায় তাহার মাটির মনের গোপন কথা-
বিহানের রোদে টলমল করে বিলের পানি
বুকে ভাসে তার রূপে ডগমগ কলমিরাণী।
..।’
কলমির ফুল-কুমারীরা যেন খুশীতে ভরা
চোখে তার সোনালী স্বপন রূপ-পশরা;
বেগুনী রঙের কুচকুচে মুখে দু’খানি ঠোঁট
সব মধু যেন ওই ঠাঁয়ে আসি হয়েছে জোট।
..।’
পাতায় ফুলেতে গলাগলি করে কলমিলতা
ইলশেগুঁড়িতে বুকে জাগে তার চঞ্চলতা।’
কলমিলতা শাক-সবজী। শাক-সবজী নিয়ে কবিতা হতে পারে কবি বন্দে আলী মিয়া তাঁর কাব্য প্রতিভার সাথে প্রাণ- বোধের সংযোগ স্থাপন করে কবিতা রচনা করেছেন।
কবি বন্দে আলী মিয়ার কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস, শিশুতোষ গ্রন্থ মিলিয়ে ২০০শত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।এ ব্যতিরেকেও বেতারে তার অসংখ্য কথিকা প্রচারিত হয়। তাঁর অপ্রকাশিত অনেক লেখা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বলে জানা গেলেও এগুলোর কোনো সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি।
কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমী পুরষ্কার, ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট পুরষ্কার এবং ১৯৮৮ সালে একুশে পদক(মরণোত্তর) ভূষিত হন।
অযতেœ- অবহেলায় কবির পাবনা শহরের ‘কবিকুঞ্জ’ বাড়িটির পলেস্তারা খুলে পড়ে ইট ধ্বসে যাচ্ছে। এ ছাড়াও পাবনায় কবি বন্দে আলী মিয়ার জন্ম এবং মৃত্যু বার্ষিকী সরকারিভাবে পালন করা হয় না। কয়েকজন কবিভক্ত কোনমতে তাঁর স্মৃতি চারণ করেন। তাঁর প্রতি এই অবহেলা কেন? তা আমরা জানি না। কবি বন্দে আলী মিয়ার ১১৪তম জন্ম বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি । #
লেখক: ( সাহিত্যের সেবক এবং আইনজীবী , জজকোর্ট,পাবনা )
ছবি আছে -১টি
বিষয় : ময়নামতী চর’ খ্যাত কবি বন্দে আলী মিয়া একজন সব্যসাচী লেখক
-মুরশাদ সুবহানী
কবি বন্দে আলী মিয়া । আজীবন দারিদ্রতার সাথে লড়াই করেছেন। কিন্তু সাহিত্যপ্রেম-চর্চা ত্যাগ করেননি। নিরলসভাবে নিজের সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। ‘ময়নামতির চর’ কাব্য গ্রন্থ প্রকাশ হলে তিনি কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তাঁর অসাধারণ কাব্য প্রতিভা কাব্যপ্রেমীরা জানতে পারেন। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী কবি বন্দে আলী মিয়ার জন্ম বাংলাদেশের ছোট জেলা শহর পাবনার রাধানগর (নারায়নপুর)মহল্লায় ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারী । ( ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন তিনি ইন্তেকাল করেন)
কবি বন্দে আলী মিয়া কবিতায় আকর্ষনীয় ছন্দে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের জীবন-আচরণ, গ্রামের দৃশ্যপট চিত্রিত করেছেন।
তিনি শুধু কবিতা এবং শিশুতোষ ছড়া রচনা করেননি। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় বিচরণ করেছেন। উপন্যাস, নাটক-কথিকা লিখেছেন। অনুবাদ কর্ম করেছেন। সাহিত্যের শাখাগুলোকে তিনি অনায়সে ছুঁয়ে গেছেন বাঙ্গলা ভাষার সহজ-সরল শব্দ গাঁথুনি দিয়ে। তিনি একজন চিত্র শিল্পীও ছিলেন। এক বাক্যে বলা যায় কবি বন্দে আলী মিয়া একজন সব্যসাচী লেখক। পাবনার আর.এম একাডেমী ( রাধানগর মজুমদার একাডেমী) তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
তাঁর সাহিত্যের সৃজনশীল কর্মের সূচনা হয় অষ্টম- নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালেই।কবি বন্দে আলীর কিশোর বয়সে লেখা তাঁর ‘ ছিন্নপত্র’ নামে প্রথম কবিতা নাটোরের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী গেজেটে ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়।
প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশের পর ১৯২৭ সালে কবি বন্দে আলী মিয়া কলকাতার বৌ বাজারের ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমী থেকে চিত্রকলায় প্রথম শ্রেণী পেয়ে উত্তীর্ণ হন।
তিনি ১৯৩১-১৯৩২ শিক্ষাবর্ষে কলকাতা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৩৪ সালে উত্তীর্ণ হন। কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯২৫ সালে ইসলাম দর্শন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন।
১৯৩২ সালে কবি বন্দে আলী মিয়ার প্রথম কাব্যগ্রহ্ন ‘ ময়নামতীর চর’ প্রকাশিত হয় । এই কাব্যগ্রন্থ বিষয়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতামত জানতে তাঁর প্রবল আগ্রহ হলো। তিনি স্মৃতি কথায় লিখেছেন ‘‘ প্রায় মাস দেড়েক পরে সংবাদপত্র পাঠে জানতে পারা গেল, রবীন্দ্রনাথ পারস্য থেকে ফিরেছেন। আমার ‘ময়নামতীর চর’ নামক কবিতার বইখানি সেই সময়ে ছাপা হচ্ছিলো। বইটা সম্পর্কে একটা অভিমত কবির নিকট থেকে গ্রহণ করবার দুরাশা মনে ছিল। সুতরাং শ্রাবণের এক দ্বিপ্রহরে জনৈক শিল্পীবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বোলপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
অপরাহ্ন সাড়ে পাঁচটার দিকে সুধাকান্ত বাবু খবর পাঠালেন-আমাদের আগমন সংবাদ শুনে কবি আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন।....কবির বাসগৃহ উত্তরায়ণে এসে হাজির হলাম। কবি ইজিচেয়ারে শুয়ে কি একখানা বই পড়ছিলেন। আমরা যেতেই উঠে বসলেন। আমরা অভিবাদন জানিয়ে সমুখে বসলাম। কাগজের মোড়ক খুলে ‘ ময়নামতীর চরে’র ছাপানো ফর্মাগুলি তাঁর হাতে দিলাম। কবিতাগুলো রবীন্দ্রনাথ একরে পর একটি মনোযোগ দিয়ে পড়লেন।
ময়নামতীর চর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অভিমত সেদিন দুপুরে আহারাদির পরেই পাওয়া গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
‘ তোমার ময়নামতীর চর কাব্যখানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং তার জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। তোমার রচনা সহজ এবং স্পষ্ট, কোথাও ফাঁকি নেই। সমস্ত মনের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছ এবং কলমের অনায়াস ভঙ্গিতে লিখেছ। তোমার সুপরিচিত প্রাদেশিক শব্দগুলি যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুন্ঠিত হওনি তাতে করে কবিতাগুলি আরো সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাতীরের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকট স্পর্শ বাংলাভাষায় আর কোন কবিতায় পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি।( ২৬ জুলাই ১৯৩২)’’
কবি বন্দে আলী মিয়ার ‘ময়নামতী চর’ কাব্য গ্রন্থের কবিতাগুলো পড়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে মন্তব্য করেছেন, তা একটি বিশেষ দিক নির্দেশ করেছে। তিনি বলেছেন, ‘তোমার রচনা সহজ এবং স্পষ্ট, কোথাও ফাঁকি নেই।’ আসলেও এটি যথার্থ মূল্যায়ন। ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রন্থ কয়েকটি কবিতা নিয়ে আলোকপাত করার সময় এই বিষয়ে আমরা আলোচনা করবো ।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কবি বন্দে আলী মিয়া কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বেতারে এবং পরে রাজাশাহী বেতারে যোগদান করেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এখানেই কর্মরত ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন : কবি বন্দে আলী মিয়ার পিতা মুন্সী উমেদ আলী পাবনা জজকোর্টে চাকুরী করতেন। তাঁর মাতা নেকজান নেসা। পিতা মাতার ইচ্ছা অনুসারে তিনি পাবনা শহরের জিলাপাড়া মহল্লার ফজলার রহমানের কন্যা রাবেয়া খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯২৬ সালে। কবির প্রথম স্ত্রীর অনেক সন্তান আঁতুর ঘরেই মারা যায়। প্রথমা স্ত্রীর এক কন্যা জীবিত । কবি পরে আরো তিনবার পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। রাবেয়া খাতুনের পরের সহধর্মিণীরা ছিলেন, হেনা, শামসুন্নাহার এবং পরীবানু। প্রথম স্ত্রী এক কন্যা সন্তানের জননী। কবির দ্বিতীয় স্ত্রী এক কন্যা সন্তানের জননী। তৃতীয় স্ত্রী ছয় পুত্র, দুই কন্যার এবং চতুর্থ স্ত্রী দুই পুত্রের জননী । কবির এক নাতী ‘ কথিত’ বন্দুক যুদ্ধে পাবনায় নিহত হন। তাকে পাবনায় সবাই নাতী বাবু বলে ডাকতেন।
কবি বন্দে আলী মিয়ার পুত্ররা হলেন, রকিবুল ইসলাম টুটু ( মরহুম),শহীদুল ইসলাম ছুটু(মরহুম),সিরাজুল ইসলাম বুলু, মহিদুল ইসলাম মজনু(মরহুম),ফরিদুল ইসলাম ফরাদ, রমিজুল ইসলাম রঞ্জু, জাহিদুল ইসলাম চাঁদ এবং ওমর ফারুক । কন্যারা হলেন, রোকেয়া বেগম, আফরোজা বেগম মিনতি, দিলরুবা বেগম সুমতি এবং জান্নাতুল ফেরদৌস মিলু।
কবি বন্দে আলী মিয়ার কোন কিছু দেখার যে গভীর দৃষ্টি ছিল তা অনস্বীকার্য। কবি বন্দে আলী মিয়া গভীর দৃষ্টি প্রক্ষেপণে এবং স্বীয় মেধার সমন্বয়ে গ্রামীণজীবন, মানুষের সুখ-দু:খ-বেদনা নিয়ে কাব্য রচনার এক অনবদ্য কৌশল কাঠামো তাঁকে কবি হিসেবে সবার মাঝে স্থান করে দিয়েছে। তাঁর ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতার নামকরণেই এই কাব্যগ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে। ‘ ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রন্থে কবি বন্দে আলী মিয়া লিখলেন,
ময়নামতীর চর
(ক)
বরষার জল সরিয়া গিয়াছে জাগিয়া উঠেছে চর
গাঙ-শালিকেরা গত খুড়িয়া বাঁধিতেছে সবে ঘর।
গহিন নদীর দুই পাড় দিয়া আঁখি যায় যত দূরে
আকাশের মেঘ অতিথি যেন গো তাহার আঙিনা জুড়ে!
মাছরাঙা পাখী একমনে চেয়ে কঞ্চিতে আছে বসি
ঝাড়িতেছে ডানা বন্য হংস-পালক যেতেছে খসি,
..
তট হতে দূরে হাঁটু জলে নামি এক পায়ে করি ভর
মৎস্যের ধ্যানে বক দু’টি চারি সাজিয়াছে ঋষিবর।
...........................................................।’
কবি বন্দে আলী মিয়া এই কবিতায় বরষার জল সরে গিয়ে জেগে উঠা চরের চারদিকের দৃশ্য কবিতায় তুলে এনেছেন বাংলা ভাষার সহজ-সরল শব্দে। । এই কবিতায় তাঁর কবি মনের গভীর অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়।
কচুরীপানার ফুল
বেগুনী রঙের কচুরী পানার ফুল-
পানিতে ভাসিয়া চলে হেথা হোথা হয় নাকো দিক ভুল,
সুরসুর করি বায়ু চুপিসারে কয় কথা কানে কানে
শিহরায় তার বোঁটা আর পাতা শিহরায় অভিমানে;
...
কচুরী পানার ফুল
কাজল বরণ লিকলিকে দেহ পিঠভরা এলোচুল।
মেঘের মতন মুখ দেখে তার পানির আয়না দিয়া
সবুজ বরণ শাড়ীখানি তার রহে তনু জড়াইয়া।
..।’ ( ময়নামতীর চর, বন্দে আলী মিয়া)
কচুরীপানা এবং এর ফুল দেখেননি এ রকম মানুষ খুব কমই আছেন। নদী-জলাশয়ে কচুরীপানার বাস।
কচুরীপানা কবিতার বিষয় হতে পারে ! এই ভাবনা আমরা কয়জন ভেবেছি। কবি বন্দে আলী মিয়া কচুরীপানা নিয়ে অনবদ্য এক কবিতা লিখেছেন। সুনিপুন নির্মাণ কৌশলে কচুরীপানার ফুলকে কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন । কবি বলছেন, ‘ বেগুনী রঙের কচুরীপানার ফুল-
পানিতে ভাসিয়া চলে হেথা হোথা হয় নাকো দিক ভুল।’
কুচরীপানার ফুলের সাথে বাতাস কথা বলে কানে কানে।
কবি বন্দে আলী মিয়া কচুরীপানার পাতাকে সবুজ বরণ শাড়ীর সাথে তুলনা করেছেন। এখানেই তাঁর দেখার এবং ছান্দিক কবিতা লেখার এক যাদুকরি দিক ।
স্মৃতি কথায় পাওয়া যায়, কবি বন্দে আলী মিয়া ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রহ্ন বিষয়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত সংগ্রহ করে বিদায় নেবার আগে বলেছিলেন,তাঁর কলমিলতা বইটা প্রেসে আছে এবং সেখানা তিনি কবিকে উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, কলমিলতা বইটি পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন জাগে সেটি কী প্রকাশিত হয়নি? নাকি প্রেস থেকে এর ছাপালিপি রবীন্দ্র বিদ্বেষী কেউ সরিয়ে ফেলেছেন। নানা কর্মে ব্যস্ত কবি বন্দে আলী মিয়া জানতে পারেননি।তবে আশার কথা কলমিলতা কবিতাটি ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রন্থে আছে।
জানা যায়, ‘ময়নামতীর চর’র প্রথম সংষ্করণে মোট বিশটি কবিতা ছিল।পরবর্তীতে ঢাকা থেকে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রহ্নে আরো বিশটি কবিতা সন্নিবেশিত করে মোট চল্লিশটি কবিতা নিয়ে ‘ময়নামতীর চর’ বইটির সপ্তম সংষ্করণ বের হয় ১৯৬৩ সালে।
কবি বন্দে আলী মিয়া কলমিলতা বইটি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন, সেই কলমিলতা কবিতাটিতে কি আছে সেটা আলোচনার দাবি রাখে।
‘ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রহ্নে পাওয়া ‘কলমিলতা’ কবিতাটি কবি গুরুকে উৎসর্গ করা হয়েছে তাও দেখা যায় না। এর কারণ অজানা ।
‘বাতাস লাগিয়া দোলে নিরবধি কলমিলতা
পাতায় তাহার মাটির মনের গোপন কথা-
বিহানের রোদে টলমল করে বিলের পানি
বুকে ভাসে তার রূপে ডগমগ কলমিরাণী।
..।’
কলমির ফুল-কুমারীরা যেন খুশীতে ভরা
চোখে তার সোনালী স্বপন রূপ-পশরা;
বেগুনী রঙের কুচকুচে মুখে দু’খানি ঠোঁট
সব মধু যেন ওই ঠাঁয়ে আসি হয়েছে জোট।
..।’
পাতায় ফুলেতে গলাগলি করে কলমিলতা
ইলশেগুঁড়িতে বুকে জাগে তার চঞ্চলতা।’
কলমিলতা শাক-সবজী। শাক-সবজী নিয়ে কবিতা হতে পারে কবি বন্দে আলী মিয়া তাঁর কাব্য প্রতিভার সাথে প্রাণ- বোধের সংযোগ স্থাপন করে কবিতা রচনা করেছেন।
কবি বন্দে আলী মিয়ার কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস, শিশুতোষ গ্রন্থ মিলিয়ে ২০০শত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।এ ব্যতিরেকেও বেতারে তার অসংখ্য কথিকা প্রচারিত হয়। তাঁর অপ্রকাশিত অনেক লেখা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বলে জানা গেলেও এগুলোর কোনো সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি।
কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমী পুরষ্কার, ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট পুরষ্কার এবং ১৯৮৮ সালে একুশে পদক(মরণোত্তর) ভূষিত হন।
অযতেœ- অবহেলায় কবির পাবনা শহরের ‘কবিকুঞ্জ’ বাড়িটির পলেস্তারা খুলে পড়ে ইট ধ্বসে যাচ্ছে। এ ছাড়াও পাবনায় কবি বন্দে আলী মিয়ার জন্ম এবং মৃত্যু বার্ষিকী সরকারিভাবে পালন করা হয় না। কয়েকজন কবিভক্ত কোনমতে তাঁর স্মৃতি চারণ করেন। তাঁর প্রতি এই অবহেলা কেন? তা আমরা জানি না। কবি বন্দে আলী মিয়ার ১১৪তম জন্ম বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি । #