আবু মকসুদ এর বাছাই পাঁচ কবিতা
উনচল্লিশে আটকা পড়েছিলাম;
এই বুঝি রাস্তার শেষ।
কোথাও কোন আলো ছিল না,
পাশে ছিল না কোনো খড়কুটো;
সব সম্ভাবনা তিরোহিত হওয়ার পরে;
যখন চিরকালের ডুব দেওয়ার
প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন ভেতর থেকে
শেষবারের মতো ভেসে উঠার
আওয়াজ আসছিল। মৃত্যু প্রবল
বিক্রমে টানছে জীবন তবু শেষ চেষ্টার
গান শোনাচ্ছে, হাল না ছাড়ার
প্রণোদনা দিচ্ছে।
এখন একান্ন'র রাস্তায়।
উনচল্লিশে জয়ী হয়ে
রাস্তার পরিধি বাড়িয়েছি।
জীবনের গানে আস্থা
আরো মজবুত হয়েছে।
পরাজয় সহজ, সহজ
আত্মসমর্পণ। জীবন আপোষের
মৃত্যুর চেয়ে অনেকগুণ মূল্যবান,
জীবনের মূল্য জ্ঞাত হতে হবে।
হাল ছেড়ে দিলে মানুষ
মরে যায়, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত
মানুষকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে
জীবনের পতাকা।
কার্পেটের নীচে যে পাপ
চাপা দিয়ে রেখেছি,
মাঝে মাঝে মাথা চাড়া দেয়।
ঝকঝকে জুতো; গলদ রয়ে
গেছে, একটা পিন
সবসময় অস্তিত্ব জানান দেয়।
আমি যতই সফেদ হতে
চাই না কেন
মলিন দাগ পিছু ছাড়ে না।
খরিদ্দার খাবারের অপেক্ষায়;
আমি মধ্যস্বত্বভোগী, দুই পক্ষের সংযোগ,
হোটেল এবং খরিদ্দারের মাঝে
আমার মুনাফা সাড়ে তেত্রিশ।
মুনাফার জন্য পদে পদে অপমানিত;
কেউ মুখের সামনে দরজা লাগিয়ে দেয়,
কেউ কুকুর লেলিয়ে দেয়,
কেউ ভিক্ষুকের মতো ছুঁড়ে দেয় ধাতব মুদ্রা।
সব অপমান হজম করি, মুনাফার সাড়ে
তেত্রিশ অপমানে উপশম হয়।
মাথার ঘাম পায়ের জুতো ভিজিয়ে দেয়,
কনকনে শীতে গায়ে ফোসকা পড়ে যায়,
বন্যা কিংবা মারি দমাতে পারে না,
বেড়াল ভেজা বৃষ্টি কাধ চুইয়ে
ঢুকে যায় বুকের খন্দকে, পেঁচা
চোখ তবু দরজায় সংখ্যা খোঁজে।
সবাই আমাকে দালাল বলে, কায়িক
শ্রম ছাড়া সিন্দুক ভরে ফেলেছি
আমার বুকের উঠান কেউ ছুঁয়ে দেখে না,
চোখে দেখেনা সাড়ে তেত্রিশ কান্না।
জগৎসংসার একপেশে লাগছে;
যে সবুজ বৃক্ষ একসময়
সুখ নিদ্রায় ছায়া হয়ে থাকতো;
বিবর্ণ হয়ে গেছে;
পাশে গেলে আগের সজীবতা
অনুভূত হয় না। প্রবাহিত নদী
গেছে শুকিয়ে, দুর্বার যৌবন
ভাটা পড়েছে। প্রতিটি দিন ছিল
সম্ভাবনার, প্রতিটি ভোরে দিগন্তের
ডাকে উড়াল দিতাম।
দিগন্ত এখন ধূসর। উড়ালপুরের ডাক
আগের মত আলোড়ন তুলে না।
মরে গেছে জীবনের রঙ; ফ্যাকাসে
দিনের পরে আসে নির্জীব রাত।
থেমে গেছে কোলাহল, থমকে
গেছে চলার ইচ্ছা। জীবনকে আর
গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে পারছি না।
জলের কাছাকাছি থাকবো বলে
একদিন পরিখা খুঁড়েছিলাম।
জলমগ্ন সময় শেষে
অসংখ্যবার পায়রা উড়িয়েছি।
স্বাধীন সত্ত্বার কাছে ভিড়তে
দেইনি অন্য কিছুকে। জীবনকে
জীবনের মত উপভোগ করতে
রঙের বাজারে দোকান খুলেছিলাম।
দোকান ঠিকই আছে; মরে গেছে
ভিতরের রঙ। পুনরায় রাঙাবো
উৎসাহ জাগে না। বিধ্বংসী চিন্তা
মাথায় ভর করে। আত্মবিনাশে
উপশম হতে পারে।
যখন নিভে গেছে রঙ, রাত্রি ছেয়ে
আসছে, পাণ্ডুলিপির প্রয়োজনীয়তা
ফুরিয়ে। যখন স্থবির সময়কে বর্ধিত করার
ইচ্ছা জাগছে না; তুমি এসে দাঁড়ালে।
বর্ধিত চুমু জীবন চাগিয়ে দিল
আত্মহননের চিন্তা পুনঃ বিবেচনায় বাধ্য করল।
এই যাত্রা বেঁচে গেলাম, একটি চুম্বন
মৃত্যুর চেয়ে শক্তিশালী হয়ে দেখা দিল।
আমার নাম দুঃখমতি
জন্মের পর দুঃখ লেপ্টে আছে।
মাথা, কোমর, হাটু, গোড়ালি
দুঃখে ভরপুর! শুধু মধ্যাংশ কিছু পরিমাণ
সুখদ, পেট দেখে যেকেউ
সুখী ভেবে নেয়। পেটের জন্য
দুঃখবাদী জীবন পাত্তা পায় না।
শরীরের গাঁটে গাঁটে ব্যথা
বসে পড়লে উঠতে পারিনা
কোনরকম দাঁড়ালে পুনরায় বসতে
কষ্ট হয়। কষ্ট সহ্য করে বসে গেলেই
সুখ। আমার সমস্ত সুখ খাবারে,
দাঁড়িয়ে খাবারে যুথ পাই না
পেটের ভারে শ্বাস কষ্ট হয়;
বসে গেলেই আরাম, প্রচুর খাবার।
দুঃখ কাউকে বুঝাতে পারিনা
'ঘরের কর্তী রুদ্র মূর্তি'; ছেলেমেয়েরা
হেসে মরে। বন্ধুদের কাছেও
আজকাল দুঃখ বিকায় না।
দুঃখের আলাপে মুখ বন্ধ করে
দিতে আসে, অথবা পাত্তা দেয় না।
জানতাম খাবারে অনিহা
থাকলে দুঃখ জেঁকে বসে কিন্তু
আমার ক্ষেত্রে বিপরীত,
প্রচুর খাই; তবু দুঃখ তাড়াতে পারিনা।
দুঃখ কে কেউ দুঃখ ভাবে না,
অথচ আমি প্রচণ্ড পরিমাণ দুঃখী;
কারো কাছে মন খুলে দুঃখের
গল্প করতে পারি না, ঠেকায় পড়ে
আপনাদের জানালাম একটু সমব্যথী হবেন!