আসাদ মান্নান । কবিতাগুচ্ছ
আষাঢ়ে চাষার গল্পঃ ডানাহীন কানাপাখি
ঋতুচক্রে ঘুরতে ঘুরতে সময়ের বিদেহী চাকায়
নিজেকে উজাড় করে আহা কী সুন্দর নগ্নতায়
শূন্যতার হাত ধরে প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে নাচে
জলের যুবতী কন্যা বিরহিণী উলঙ্গ আষাঢ়!
অভিজাত প্রেমে দগ্ধ অন্তরঙ্গ কালের চুলোয়
শ্রীমতি রাধার মনে অবিরাম ধিকিধিকি জ্বলে
বৃন্দাবনী কল্পলোক, মহাপ্রেমী কৃষ্ণ মহাজন।
জলে স্থলে অন্তরীক্ষ্যে তিনি প্রভু প্রেমের রক্ষক
স্বয়ং ঈশ্বর আজ খুব একা, বড়ো অসহায়:
রাধা কৃষ্ণ পরলোকে! -- অন্ধকার ভূতের গলিতে
কৃষ্ণহীন লীলাগানে মুখরিত নগরমন্দির,
দেবানলে পুড়ে ছাই প্রেমহীন মানুষের মাটি--
জীবের ললিত কামলীলা ছাড়া আর কিছু নেই!
২
এমন আষাঢ়ে আজ আশেপাশে কেউ কি আছেন
গরীব চাষার হাতে হাত রেখে প্রাণের গভীরে
শঙ্খ আর উলুধ্বনি দিতে দিতে অনাবাদী ক্ষেতে
নতুন শস্যের গন্ধে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দেবেন?
মেঘের ভেতরে শুয়ে অগ্নিবালা দীর্ঘ গিরিশৃঙ্গে
ছড়িয়ে দিয়েছে তার আজানুলম্বিত নগ্নতাকে,
শ্রী জ্ঞানদাসের মতো একজন কানে কানে বলে,
প্রতি অঙ্গ লাগি কেন বলো কবি,প্রতি অঙ্গ কাঁদে?
বড়ই কঠিন প্রশ্ন;পৃথিবীর সব নদীজল
সমুদ্রকে পান করে এ প্রশ্নের মেলেনি উত্তর!
যখন মুশলধারে বৃষ্টি ঝরে, নেশায় আচ্ছন্ন
তখন কেন যে টের পাই চৈতন্যগলির গোরে
এ বুকের অগ্নিকুঞ্জে ফুটে ওঠা অমৃত কুসুমে
একটা প্রেমের ডানাহীন কানাপাখি বসে আছে।
৩.
এমন আষাঢ় মাসে মনবন্ধী অস্থির খাঁচায়
স্বপ্নের জানালা খুলে ঢুকে পড়ে কবিতা সুন্দরী ;
সে আমাকে আঁকড়ে ধরে তার মতো, প্রথম পুরুষে
ক্রন্দনের পরিবর্তে যে কুমারী রক্তপাতে হাসে;
এমন হাসির শব্দে খুলে যায় হৃদয়ের তালা
এ তালার চাবি নেই, আছে শুধু অদৃশ্য জানালা--
অলীক নৈঃশব্দলোকে উৎসচ্যূত আলোর ছোঁয়ায়
মৌনতার মগ্নতায় শব্দ দিয়ে জানালাটা খোলে।
জীবন বিমুখ সাধু কার টানে সন্ন্যাসী হলেন?
তাবৎ নিখিলে ব্যাপ্ত স্বনির্মিত কারাগারে বন্দি
ঈশ্বরের শব্দ নিয়ে এ কেমন স্বমেহন খেলা!
তিনি প্রভু জলেশ্বর রতিপতি আত্মরতি কামে,
জীবনবিহারী সাধু তার প্রেমে আশ্রম বানায়--
এ আশ্রমে শব্দচাষা মাথা ঠুকে সাধুর চরণে।
সূর্যটাকে হাতে নিয়ে
সূর্যটাকে হাতে নিয়ে শিশুগাছ দাঁড়ায় উঠোনে;
নক্ষত্রের ছায়া তাকে তুলে নেবে মেঘের মিনারে --
এরকম স্বপ্ন নিয়ে কেউ হাঁটে রঙধনু পথে,
পেশাজীবী ব্যস্ত থাকে যথারীতি নিয়মমাফিক
কৃষকের মাঠ জুড়ে বইতে আছে আনন্দের হাওয়া,
শ্রমিকের ঘাম যেন রমণীর সুগন্ধী আতর;
মাঝি ও মাল্লার দল বৈঠা মারে গাজী গাজী বলে।
অথচ নির্মম সত্য: নিয়ত আড়ালে গায় গান
লালনের পোষা পাখি কায়াহীন খাঁচার ভেতর:
মানুষ মৃত্যুর কাছে অতি তুচ্ছ একটা রঙিন
বেলুন অথবা ঠুনকো খেলনা ছাড়া আর কিছু নয়;
তবুও নেশার ঘোরে দু'দিনের মায়াকুঞ্জে ঢুকে
প্রাচুর্যের মোহজালে ধরা খায় দস্যু বনহুর !
ভিসা
রাহুগ্রস্ত পৃথিবীতে এ কেমন নারকীয় যজ্ঞে
সারাক্ষণ মেতে আছে এক দুর্বিনীত পরাশক্তি!
মানব বিনাশী এই অ্যামোবিক মরণ খেলায়
দানবীর গর্ভজাত কতিপয় সহিংস দানব--
ওদের থাবার নিচে অসহায় সভ্যতার শিশু
কী করে জলের মধ্যে খুঁজে পাবে প্রাণের জীবাণু--
মায়ের আঁচলে বেঁধে সমুদ্রকে বাতাসে উড়াবে!
মহাশূন্যে নৈঃশব্দ্যের হাহাকার; মৃতদের গানে
নক্ষত্রের মর্মরিত সুর; তবুও মানুষ কেন
বাঁচে তার মৌলিক ক্ষুধায়? এ ক্ষুধায় দেশে দেশে
ক্ষমতার যিশু জন্মে অস্ত্রে কিংবা ব্যালট পেপারে,
নাবালক গণতন্ত্র পোক্ত হয় মার্কিন ভিসায়--
লায়েক শিশুর লিঙ্গে (আহা!) চুমু খাবে শ্রীমতি জীবন।
পরকিয়া গণতন্ত্র
অদৃশ্য মুখোশ পরে ষড়যন্ত্রী কুচক্রী চণ্ডাল
অভিনয় মঞ্চে ফের অভিনব পোশাকে দাঁড়ায় :
মিথ্যাচারে ডুবে ডুবে বিষ ঢালছে মধুর হাঁড়িতে;
পাতা ও পল্লবে ঘেরা গন্দমের কুঞ্জবনে নাচে,
গায়েবী ভবনে নবোদ্যমে কী আরামে মা জননী
বিবি হাওয়া নব্য বাবা আদমের পা দু'খানি টিপবে-
পরকিয়া গণতন্ত্রে পোক্ত হবে মার্কিন পিরিতি !
আঙুল বিহীন পায়ে ভর দিয়ে ইটের অরণ্যে
ময়ূর আসনে বসে কামোদ্দীপ্ত শিয়ালের গর্তে:
দিন যায় দিন আসবে! দুর্বৃত্তকে কে আর থামায়!
রঙিন খোয়াবে মগ্ন অর্বাচীন নির্বোধের হাতে
বিভ্রান্ত মানুষ যদি ভুল করে রাজদণ্ড দেয়!
তবে কি আগুনে পুড়ে ভষ্ম হবে বাংলার আকাশ?
বাংলার বুবুর বাঁশি
অন্ধকারে সহায় সম্বলহীন স্বজন হারানো
দুঃখিনীকে তাঁর মতো এত আলো এত ভালোবাসা
কে দিয়েছে আর? কই,তাঁর আগে কেউ তো দেয়নি!
সবাইকে জড়িয়ে বুকে তাঁর এই দীর্ঘ পথ চলা
কুসুমে আস্তীর্ণ নয়,বরাবরই কন্টকে আকীর্ণ;
মৃত্য ভয় জয় করে তিনি আজ জ্যান্ত ইতিহাস :
ঝড়াক্রান্ত স্বপ্নদ্বীপে কুয়াশায় তিনি বাতিঘর।
জঙ্গী আর জানোয়ার অশান্তির আগুন নাচাতে
বিষাক্ত সাপের মতো বিচিত্র বুলির ঝাঁপি খুলে
বসে আছে মহল্লায়, কখনো বা মিডিয়াপাড়ায় ;
ওদের থামাতে আজ প্রজন্মের হাতে হাতে বাজে
বাংলার বুবুর বাঁশি -- বেজে ওঠে শান্তির নূপুর,
দুরন্ত পদ্মার জলে ঢেউয়ে নাচে আলোর নর্তকী ।
চাবি
এটা তো কথার কথা কিংবা কোনো স্তাবকতা নয়,
চাঁদ ও সূর্যের মতো ধ্রুব সত্য: সঠিক পন্থায়
মায়ের মমতা দিয়ে তাঁর আগে এই জরাজীর্ণ
কেউ তো এমনভাবে তাঁর আগে সাহস করেনি
দেশকে এগিয়ে নিতে-- লুটেপুটে নিজের আখের
গুছিয়ে নিয়েছে বেশ ওরা; চোরের মায়ের নাকি
বড় গলা : মিথ্যার জাহাজে চড়ে মগের মৃল্লুকে
এক হয়ে যেতে চায় যত সব লুটেরা মাস্তান
খুনি আর আগুনসন্ত্রাসী-- আয়নাতে নিজেদের
দানবীয় রূপ না- দেখতে কী সুন্দর মুখোশ পরেছে;
মৃত্যুকে উপেক্ষা করে অন্ধকারে এদের মুখোশ
যে-হাতের স্পর্শে খোলে সে-হাতেই সিন্দুকের চাবি,
এ চাবিতে জ্বলে আজ ভাঙা ঘরে মঙ্গলচেরাগ।
যে তিনি পিতার মতো
সুবর্ণ নদীর ঘাটে বাঁধা আছে বীর বাঙালির
অবিনাশী গৌরবের বিজয়ের সেই নৌকাখানি,
নূহের কিস্তির মতো যে-নৌকায় ঝড়ে ও ঝঞ্ঝায়
আমার সোনার বাংলা চিরদিন নিরাপদ থাকে,
দুর্দিনে বা দুঃসময়ে তাঁর শুভ কল্যাণীয় হাতে
বৈঠাখানি তুলে দিয়ে নির্বিঘ্নে দুর্গম মরু-গিরি
অকূলদরিয়া পাড়ি দিয়ে যাত্রীগণ ঘরে ফিরে।
যে তিনি পিতার মতো দারিদ্র্যজড়িত দেশ আর
দেশবাসীকে শর্তহীন ভালোবেসে পরম নিষ্ঠায়
বহুবিধ কর্মযজ্ঞে নিরন্তর জাগ্রত আছেন,
ভোগে নয় ত্যাগে তিনি অনন্যে উজ্জ্বল ; তাঁর মতো
এমন কেউ তো আর কোথাও দেখি না; কেউ আছো?
যদি থাকো, কাগজ-কলম নিয়ে দাঁড়াও সম্মুখে।