একগুচ্ছ কবিতা ।। মাহবুব বারী
একগুচ্ছ কবিতা ।। মাহবুব বারী

নীরবতা
দূরত্বকে ভাগ করিনি
বরঞ্চ প্রলম্বিত করেছি আমার এই পৃথিবী
চলে গেছি আরও দূর আরও দূর
অশেষ এই চলার পথে কেউ নেই কিছু নেই
ধু ধু করে সারাক্ষণ শুধু নীরবতা
দূরত্বকে ভাগ করিনি
আসিনি ফিরে, যে গেছে আমাকে ছেড়ে
জানি আমি, জানি না তো কে আপন কে-বা পর
জ্ঞানের অগম্য আমার সবকিছু, জন্মান্ধের মতো চলেছি একা
ধু ধু করে সারাক্ষণ শুধু নীরবতা
দূরত্বকে ভাগ করিনি
বিভক্ত করেছি শুধু আমার এই হৃদয়
চলে গেছি আঁধার-আলো পার করে এক চিৎকারে
কে আছ কে আছ আমার পথের শেষে
ধু ধু করে সারাক্ষণ শুধু নীরবতা।


সাদা
প্রাতরাশে সাতজন মানুষের সঙ্গে
সাতজন রঙের গভীর সখ্য হলো। রেস্টুরেন্টে
টেবিলের ওপর গড়িয়ে যাওয়া চা
কাপের সাথে এই কথা বলাবলি করছে।
ধোঁয়া উড়ছে আর গান
ধোঁয়া উড়ছে আর গান
ধোঁয়া মিলিয়ে যাচ্ছে
সুর মিলিয়ে যাচ্ছে
তারপর সন্ধ্যায়
সাতজন মানুষ ও সাতজন রঙ
বেরিয়ে গেল
সাদা হতে হতে
সাদা হতে হতে

শূন্য

তোমার ভেতর দিয়েই যেতে হবে শূন্যে মাহাশূন্যে ঈশ্বরে
উপাস্য তিনি আমাদের, ঈশ্বর মানে একপ্রকার শূন্য,
শূন্য সেখানে আছেন শূন্যে ভাসমান।
তোমার ভেতর দিয়েই যেতে হবে সেই শূন্যে
শূন্য কোনো লক্ষ্য নয়
তবে অলক্ষ্যে শূন্যই লক্ষ্য
ইচ্ছা অনিচ্ছায় সেই শূন্যেই যেতে হয়
আমরা সেই শূন্যের যাত্রী
আমাদের পিতামাতা নেই ভাইবোন নেই বন্ধু-বান্ধব নেই
আমাদের অতীত নেই বর্তমান নেই ভবিষ্যৎ নেই
আমরা শূন্যের মহাযাত্রী, শূন্য মানে ঈশ্বর
আর তুমি ঈশ্বরের একপ্রকার ছায়া কিংবা প্রতিলিপি
আমরা সেই প্রতিলিপি সঙ্গে করে অগ্রসর হতে হতে
বুকের নিচে ঈশ্বরকে অনুভব করি, ঈশ্বর মানে শূন্য
আমার শূন্য অনুভব করি, আমাদের আর কিছু নেই
আমাদের গন্তব্যের প্রতি এক ধাবমানতা আছে
আমাদের এক শূন্য আছে।
তোমার ভেতর দিয়েই যেতে হবে সেই শূন্যে
তোমার ভেতর দিয়েই যেতে হবে সেই মহা শূন্যে
আর তুমি শূন্যতার এক প্রতিলিপি, ঈশ্বরের পথে এক
মাংসল পিচ্ছিল রাস্তা মরণশীল পচা শূন্য।

হ্যাঙ্গার
মধ্যরাতে স্বপ্নের টানাপোড়েনে ঘুম ভাঙে
চোখের উপর মাকড়সার জাল আটকে যায়
সমস্ত দেহের মধ্যে কালিঝুলি—
স্বপ্নের ভেতর থেকে কী উঠে এল ঘুমের ভেতর থেকে?
ঘুম এবং স্বপ্ন থেকে জেগে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখি
আমার হ্যাঙ্গার থেকে উঠে এসে
আমার পোশাকগুলো
ঘরের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে শুধু ঘুরে বেড়াচ্ছে
আর হাসছে— হাসতে হাসতে নাচছে, নাচতে নাচতে হাসছে।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকতে থাকতে
অবশেষে আমিও নাচতে শুরু করি— তমুল তাণ্ডব নৃত্য
অন্ধকারে উন্মাদের মতো, পোশাকের সাথে সাথে—
তারপর একসময় পোশাকের সাথে
আর এক পোশাক হয়ে ঝুলে থাকি হ্যাঙ্গারে।

ভ্রমণ
এ তো ভ্রমণ নয়
এ তো অবিস্মরণীয় এক ক্ষুধা আর এক তৃষ্ণার জলে সাঁতার —
এ তো শব্দে শব্দে শব্দকে ছাড়িয়ে যাওয়া
আর এক সংগীতের সুধা, সুরে সুরে সপ্তমী
এ তো নৃত্যছন্দে ঘূর্ণিপাক —
এ তো ভ্রমণ নয়
এ তো শুধু ঘুরে বেড়ানো সকাল- সন্ধ্যা
এ তো রাত্রির ঘুম, ঘুম নয় ঘুমের মতন
ঘুমের ভেতর থেকে জাগরণের দিকে দীর্ঘ এক যাত্রা;
আর এক আবর্তন ঘুরে ফিরে
সুতোর একদিক থেকে মাকুর সঙ্গে মিশে
অন্য পাড়ে যাওয়া; এ তো স্বপ্ন থেকে
অকস্মাৎ মাটিতে পদার্পণ, ভূমি থেকে ভূমিতে,
এক আকাশ থেকে আর এক আকাশে
আর ভেসে গিয়ে মেঘের মতো কিশোরীর মাথার বেণি গাঁথা
এ তো এক সমুদ্র থেকে অন্য এক সমুদ্রে বিহার—
এ তো ভ্রমণ নয়
দেশ থেকে দেশে শুধু পরিব্রাজকের মতো,
এ তো ইবনে বতুতার বিশ্বভ্রমণ
এ তো তীর্থযাত্রা তীর্থে তীর্থে—
এ তো ভ্রমণ নয়
এ তো গ্রীষ্ম থেকে শুধু বর্ষার দিকে যাওয়া
তারপর শরৎ তারপর হেমন্ত তারপর শীত
তারপর ঋতুর এক পরিক্রমা শেষে
বসন্তের দিকে অভিসার...
এ তো সেই দুরন্ত বসন্ত,ঝরা পাতার গানে,
এ তো বসন্তের ফুল, সুবর্ণা
এ তো সময়ের বুকে ফুটে থাকা মহাকাল—
এ তো ভ্রমণ নয়
ভ্রমণ তো শুধু অবিরত তোমার দিকের দিকেই যাওয়া।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান