সমসাময়িক বাংলা কবিতায় আল ইমরান সিদ্দিকী একটি উল্লেখযোগ্য নাম। দশকের কাল খন্ড বিবেচনায় চলমান শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের এই কবির কবিতায় আবহমানতার দায়কে খুব সুস্পষ্ট ভাবে মেনেই, অর্থাৎ বাংলা কবিতার আইনানুগ রীতি ও প্রকরণকে আরও ধারণ করে নিয়েই যেনো ছড়িয়ে যাচ্ছেন এক বিস্তারিত মনন ও নির্মাণ,কালের নিরিখে আসা যাবতীয় ভাবনা ও ভুবন,এদিক থেকে বিবেচনা করলে তার কবিতা সত্যিকার অর্থে আমাদের আতি নিজস্বতার বৈভবকেই যেনো চোখের সামনে এনে হাজির করে সত্য হয়ে উঠে, শত বিভ্রান্তির সময়ে।
আল ইমরান সিদ্দিকীর কবিতা এই দিক থেকে যথেষ্ট দায়িত্ব নেয়,এবং সমসাময়িক বাংলা কবিতায় আল ইমরানকে শব্দচয়ন, চিত্রকল্প,উপমা,উৎপ্রেক্ষা, ছন্দ থেকে শুরু করে ভাবের নির্মাণ সকল কিছুতেই যেন খুব বেশী আত্মমর্যাদাবোধে বলিয়ান একজন কবি হিসেবেই তার ভাষার নন্দনকে এগিয়ে নিচ্ছেন বলেই মনে হয়, বিশেষ করে যে সময়ে একটা প্রবল সঞ্চারি এক বিচ্ছিন্নতাবাদ,বা অনর্থবাদী এক প্রকার অতি আত্মকেন্দ্রিক চর্চায় অনেকটাই বাংলা কবিতা তার বিশুদ্ধ মর্যাদার যায়গাটিতে ক্রমশই ভিন্ন ভিন্ন হৈচৈ আর চকমকিতে ভরে উঠতে চাইছে,সেখানে আল ইমরান সিদ্দিকীর কবিতা যেন বাংলা কবিতারই গৌরবান্বিত একটা যাত্রার ভবিষ্যতের উজ্জীবিত উজ্জ্বল জায়গাটাকেই নির্দেশ করেন। - নীহার লিখন
কবিতাগুচ্ছ
দীনতা
হাওয়া হয়ে গেল বাতাসের কুর্নিশ
মরু-নকশায় সান্ধ্য আকাশ ভরা।
বিষণ্ন মুখ, কাঁপা কাঁপা গীম;
এগিয়ে নিতে পারি ঠোঁটজোড়া।
ক্ষীণতোয়া নদী, অচর্চিত এই নদীতীর,
কেন যে একে নাভিস্থানীয় মনে হলো!
মুছে যেতে চায় আমার দীনতা।
শীতের শেষ কয়েকটি দিন
শীত ভালো, খুব প্রিয় ঋতু;
সমস্যা শুধুই এতটুকু—
হুট করে মেজাজ খারাপ হলে
কোনো ছল-চাতুরী, কৌশলে
ভালো করা দায়।
রাতগুলি বড় আর দিনগুলি ছোট হয়ে যায়।
এ প্রকৃতি তুলে ধরে
কুয়াশায় থরে থরে
যে-বিশাল, যে-বিপুল বিবরণী,
স্বচ্ছতা তারই-বা কতখানি
হুট করে বোঝা দায়।
রাতগুলি বড় আর দিনগুলি ছোট হয়ে যায়।
সিক্ত চাঁদ—তার তলে
অন্ধকারে একা জ্বলে
দূর কফিশপ
আর সব নিস্তব্ধ, নীরব
দৃশ্যপট যেন বাঁধা স্থিরতায়।
রাতগুলি বড় আর দিনগুলি ছোট হয়ে যায়।
বিশীর্ণ লেকের পারে
একা একা ঘুরে-ফিরে
ঘরের ভিতর এসে
নিজেরই স্বভাবদোষে
বারবার ডুবি শূন্যতায়।
রাতগুলি বড় আর দিনগুলি ছোট হয়ে যায়।
২.
তাকে আমি দেখে দেখে রাখি—
ডানাজোড়া আকাশে হারিয়ে
সে মাটিতে নেমে আসা পাখি।
বিড়ালের বাঘতুল্য ছায়া
দেয়ালে পড়েছে—
তাই দেখে ভয়ে সে মরেছে।
কত আমি দেখেছি গোপনে,
রেখেছে সে পা দু’খানি ঘাসে;
সুয়িং মেশিনের সুঁই
যেভাবে সবুজ কটন কাপড়ে নেমে আসে।
ভাবি আজকাল বসে,
হুটহাট কত কিছু ঘটে;
দিকে দিকে সীমারেখা ঢেকে দিয়ে
নতুন নতুন কত ফুল ফোটে!
সাদা-কালো
তাকিয়ে থাকাকেই প্রার্থনার ভঙ্গি করে নিয়েছি। জানালার বাইরে চিরচেনা দিনগুলি; গোধূলি ঘনছাই-
বোবা ও বধির হতে হতে সহসা যার দেখা মিলেছিল, সে তো জলে, ধীর তমসায় মুছে যাওয়া
আমারই প্রতিবিম্ব। আঁধারে কালো কালো গাছ, প্রতিবিম্বহীন, উদ্বাহু – আমাকে টেনেছিল ঐকতানে!
এখন, মৃদু শীতে, আমি যা-কিছু ছেড়েছুড়ে আর যা-কিছুর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছি পা, উভয়ই দেখি
মোহময়-
বহুবর্ণিল বসন্ত চলেই আসছে- ফুল ও পাতার সম্মিলন দিয়ে নগ্ন ডালপালার অতুল বিন্যাসকে আড়াল করবে।
ক্রিমসন লেক
ফুলের ছায়ায় হাত চলে গেল
বাতাস, স্মৃতি, আলোকবাহী দিনে
জলে, জলজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে
স্থির আকাশ
আধোস্থির মেঘ
উড়ন্ত পাখি
যার যার প্রতিবিম্ব রাখছে।
কেউ বিম্বিত হওয়া থেকে দূরে
আমার দ্যুতিহীন চোখ খোলা আছে।
বীতশোক, বন্ধচোখ মানেই
মনে অপার কারমাইন, টলটলে-
বারংবার পতনে কান্নার ফোঁটা
বৃত্ত এঁকে চলে তাতে।
মধ্যযামে
একদিন তুমি ডিমের ওপর
এঁকেছো আমার মুখ
একদিন তুমি অদ্ভুত ওরে,
হয়েছিলে উন্মুখ—
যখন রাত্রে তুষারের ওই
ধবল আস্তরণে
তাবৎ দুনিয়া পড়ে গেল ঢাকা,
তুমি বলে দিলে কানে—
‘এবার আমরা প্রকাশিত হবো
অন্য নতুন নামে’
ফায়ারপ্লেসের মতো হলে তুমি
হঠাৎ মধ্যযামে।—
তুষারের ঝড় থেমেটেমে গেছে
তুষারে দুনিয়া ভরা
পাতাহীন গাছ তুষারের ঘায়ে
হয়েছিল আধমরা
আমি তো ছিলাম মনমরা খুব
স্বদেশ পিছনে ফেলে
বিদেশকে তুমি যতটা পারলে
সহনীয় করে দিলে।
মনে হয়েছিল টিকে থাকা যাবে
ত্রুটিহীন চেষ্টায়
দাঁড়ানো সহজ তুষার মোড়ানো
প্রকৃতির জানাজায়।
স্মরণে রাখার মতোই সেসব,
বলার মতো তো নয়
লিখে রাখি তবু খুঁটিনাটি আমি,
স্মৃতি নয় অক্ষয়।
শেষ পাতা
কী এক মহাজগৎ! তার দিকে হাত বাড়ানোর প্রতিটি ভঙ্গি নাচেরই ভঙ্গি। ‘প্রতিটি দিন আনন্দে ভরে
উঠুক’- সবার জন্য এই আমাদের সরল চাওয়া। তাও কান্না আছে। নিজের কান্না নিজেরই পায়ে এসে
ঝরে; বসে থাকা শুধু নিজের শরণ চেয়ে। পাতার উপর পোকার ধ্যান দেখেছি। প্রকৃতি ও শান্তি চিনেছি।
যে-ঘূর্ণি জীবনকে ঘোরায়, সেও তো চায় না বিচ্ছিন্ন থাকার শোকে আমরা কাঁটাতারে মুখ রাখি; শুধু যেন
আঙুল রেখে ডুকরে উঠি! শূন্যে বিরাট কমলা বেলুন ; টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে- আজকে আমরা
কতইনা হাসিখুশি; নিজেদের মেলে ধরলাম, মেলে ধরলাম হাজার শব্দে। আসলেও তাই!-
জীবন ডেকে নেয় থেকে থেকে লাফিয়ে ওঠার নাচে!
......................................................................................................
আল ইমরান সিদ্দিকী জন্ম: অক্টোবর, ১৯৮৩ ইং, নীলফামারি। বর্তমান নিবাস: নিউ জার্সি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর করছেন রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকাশিত কবিতার বই: কাঠঠোকরার ঘরদোর(২০১৫), ধুপছায়াকাল (২০১৮), গোধূলির প্যানোরামা (২০২০)। সম্পাদনা: ওয়েবম্যাগ ‘নকটার্ন’ (যৌথ)।