সাকিনা কাইয়ূম একজন উদ্যোক্তা। নিজের স্বপ্ন, মেধা, ধৈর্য ও দক্ষতা দিয়ে ধীরে ধীরে তিনি গড়ে তুলেছেন কালারফুল আর্টিস্ট্রি নামের একটি প্রতিষ্ঠান যেটি পেইন্টিং, ক্র্যাফট এবং ঘর সাজানোর নানা সরঞ্জাম তৈরি করে। পাশাপাশি বিভিন্ন হোম মেইড নিত্য ব্যবহার্য জিনিস বানিয়ে সাপ্লাই দিয়ে থাকে। কালারফুল আর্টিস্ট্রি এর মালিক সাকিনা কাইয়ূম একাই অনেকের কাজ সামলিয়ে আজ এ পর্যন্ত এসেছেন। আজকে তার স্বপ্ন, কাজ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কিছু কথা পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো। শুনুন তার মুখ থেকেই।
প্রথমেই যুগল পথচলার শুরুর গল্প
বয়স তখন সতেরো , নিজে না বোঝার আগেই কাজী সাহেব বললেন, বলুন কবুল ।
তখন আমি কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ি। আমার স্বামী নিতান্তই ভদ্রলোক, তিনি আমার পরীক্ষা যেন ভালো হয় বাসায় টিচার রেখে দিলেন। এইচএসসি টেস্ট পরীক্ষার সময় আমার বিয়ে হয়। জামাই ঠিক করলো ফাইনাল পরীক্ষা না দেওয়া পর্যন্ত হানিমুনেও যাবে না। আর কি, দিলাম। পাস করে গ্রাজুয়েশন কোর্সে ভর্তি হলাম। এতোদিন আমি ছোট বয়স বলে ফ্যামিলি থেকে ছাড় পেয়েছিলাম অনেক কিছুতেই। কিন্তু ধীরে ধীরে সাংসারিক দায়িত্ব বাড়ল।
শ্বশুর বাড়ির অনেকই চাননি আমি লেখাপড়া করি, তারা চাইছিল আমি এবার সংসারে মন দেই। শুরু হল আমার নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়া। রান্নাবান্না করে ঘর সামলেই কলেজ যেতে লাগলাম. অনেক মান অভিমান চলত প্রতিনিয়ত, কারণ আমি যৌথ ফ্যামিলিতে ছিলাম । কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি ও আমার স্বামী লেখাপড়ার জন্য সব সময়ই আমাকে সাপোর্ট দিত।
রাঁধি, চুলও বাঁধি
ফাইনাল ইয়ার যখন তখন আমি আমার প্রথম সন্তানের মা হতে চলেছি। যখন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা আমি ফাইনাল দুইটা পরীক্ষা দিলাম, এর মাঝেই মেয়ের মা হলাম আমি। ওর জন্মের চার দিনের দিন ও সাত দিনের দিন আরও দুই টা পরীক্ষা দিলাম। তখন সকলেই না করেছিল আমাকে পরীক্ষা দিতে, কিন্তু আমার মনোবল ছিল অনেক। পরীক্ষা দিলাম এবং পাসও করলাম।
গ্রাজুয়েশনের পর তাই ইকোনমিক্সে মাস্টার্স এ ভর্তি হলাম। এ সময় মেয়ে সামলানো, সাংসারিক কাজ কর্ম করে পড়াশোনা করা খুব মুশকিল হচ্ছিল। কিন্তু রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকত, আমার পড়াশোনা তখন শুরু হতো। মাস্টার্স এর পাশাপাশি কম্পিউটার এর কিছু কোর্স করলাম।
একদিন এক আপুর কাছ থেকে খবর পেলাম একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে টিচার নিয়োগ করবে। তখন আমার মেয়ের বয়স দুই বছর। আমার স্বামী সিভি তৈরী করে দিল। চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার যেদিন দিলাম, পরের দিন চাকরিটা হয়ে গেলো।
এরপর চাকরি, সাংসার, বাচ্চা সব সামলে মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠতাম। তবুও আমি থেমে থাকিনি। কোচিংও করতাম আমি। এদিকে মাস্টার্স এর পাশাপাশি আমি বিএড করাও চলছিল। একসময় বিএড এবং মাস্টার্স শেষ হলো। পাস করলাম। রেজাল্টও ভালো হলো।
ঢাকায় জীবন শুরু
এভাবে তখন চলতে লাগলো দিন, আমার মেয়ের যখন বয়স সাড়ে তিন, ওকে স্কুলে ভর্তি করলাম। নারায়ণগঞ্জে, এবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। যেখানে আমিই ওর ক্লাস টিচার। এভাবেই স্কুলে সাত বছর শিক্ষকতা করলাম। এরপর স্বামীর অফিস গুলশান যাতায়াত করতে সমস্যা হয় বলে আমরা ঢাকা শিফট হয়ে গেলাম, আর চাকরিটি কন্টিনিউ করা সম্ভব হলো না।
এরপর আমার দ্বিতীয় মেয়ে হল । তখন ঢাকায় এক স্কুলে চাকরি হলো। কিন্তু যাতায়াতের সমস্যার কারণে করতে পারলাম না। আমি টিউশন শুরু করলাম তখন। আমার পাশের ফ্ল্যাট এর একটি মেয়ে আমার কাছে পড়তো।
হঠাৎ আমার বাবা মারা যান। তখন আমার মা সাংসার কিভাবে চলবে চিন্তায় পড়ে যান। আমি যেখানে টিউশন করতাম তার পাশের বাসার একই ক্লাস এর আরেকটা মেয়ে আমার কাছে পড়তে চায়। আমি ভাবলাম, ভালই হবে; এতে আমি আমার মা-কে সাপোর্ট দিতে পারবো।
প্রথমে ভাবলাম, এক মাস আগে পড়িয়ে দেখি। আমার শ্বাশুড়িকে বলেছিলাম আমার আরেকটা ছাত্রী পড়ানোর কথা। কিন্তু হঠাৎ একদিন আমার স্বামী জেনে গেলো আমি টিউশনি করি। সে খুব রাগ করল আমি টিউশন করি বলে। জানি এটা তার নিজের কথা না, কেউ তাকে বাংলায় যারে বলে কান পড়া দিল। যে তোর বউ টিউশন করতে যায় আর বাচ্চাদের খেয়াল রাখে না।
যাই হোক, এ ঘটনায় আমি খুব কষ্ট পেলাম। আমি ভাবলাম, আমার জীবনের দুটি ঘন্টা কি আমি নিজের জন্য পেতে পারি না? কষ্টে ছেড়ে দিলাম টিউশন। এর কিছুদিন পর তৃতীয় মেয়ে হল। জীবনটা আরো যান্ত্রিক হয়ে গেল। এভাবেই কেটে গেলো বেশ কিছু দিন।
সব সময়ই আমার মনে একটা ডিপ্রেসড হতো, কেনো আমি নিজের জন্য কিছু করতে পারবো না। আসলে ছোটবেলা থেকেই যেই সব স্বপ্ন গুলো বুনেছি তা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতো। অনেক রাত ভেবে কাঁদতাম। মাঝে মাঝে নিজের ইচ্ছে হলেই ছবি আকতাম আমি। আসলে ছোট বেলায় আমি গান, কবিতা আবৃত্তি, অভিনয় অনেক কিছুই করেছি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কিছু পুরষ্কার আছে আমার। বিয়ের পরও সুযোগ পেয়েছি। "সেরা কণ্ঠ" প্রতিযোগিতা এ অংশগ্রহণ করেও একটি রাউন্ড অতিক্রম করেছিলাম।
হাজব্যান্ড ও মেয়ের সাপোর্ট ছিল সব সময়
আমি গান গাইলে আমার স্বামী কখনো বাঁধা দেয়নি। মেয়েকে আমি নিজেই আবৃত্তি শেখাই। কিনতু আর্ট একাডেমিক ভাবে শেখা হয়নি। আমার বড় ভাই ছেলেবেলা আর্ট করত দারুণ। ওর কাছ থেকে দেখে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। তবে আমি যে আর্ট করতে পারি আমি নিজেও জানতাম না। তবে কলম হাতে গেলেই হল নিজের অজান্তেই আঁকিবুকি করতাম আমি। মেয়েকে আমি যখন পারতাম, কখনো নিজের অজান্তেই স্কুল কপিতে আঁকিবুকি করতাম, আর মেয়ের বকা খেতাম, এখনো তাই করি।
মেয়েকে আর্ট স্কুলে ভর্তি করলাম যখন, আমিও বসে থাকতাম ওখানে ওর ক্লাসে। আমি মাঝে মাঝেই এক কোণে বসে বাচ্চাদের সাথে আর্ট করতাম। এরপরই স্যার এর নজর পড়ল আমার এ আগ্রহের ওপর। স্যার কিছু আর্ট-এর ট্রিক শিখিয়ে দিলেন। আর আমাকে তিনি খুব উৎসাহ দিলেন। বললেন যে, আপা আপনি পারবেন।
আমি মেয়ের কাছ থেকেও কালারের বিভিন্ন বিষয় শিখলাম। মাঝে মাঝে ক্যানভাস নিয়ে বসে পড়তাম। আরবী Calligraphy এর উপর আমার আগ্রহ আগেই ছিল, সেটি দিন দিন বাড়ল অনেক। স্যার এর কাছ থেকে আর সোশাল মিডিয়া থেকে শিখলাম অনেক কিছু। আর ফেলে দেওয়া জিনিষ নিয়ে কাজ করা শুরু করলাম। এভাবেই কাজের শুরু।
আমি আমার স্বামীকে একদিন বললাম, আজকাল মহিলারা অনেকেই বিজনেস করে, ড্রেস কিনে এনে সেল করে, আমিও কিছু একটা করি। তিনি বললেন, এগুলো তো সবাই করে, তুমি আর তোমার মেয়ে যে আর্ট কারো তা নিয়ে কিছু কারো। পেইন্টিং ও তোমার বানানো শোপিস বানিয়ে সেল করো। আইডিয়াটা আমার খুব ভালো লাগলো। আমার ছোট্ট ভাইয়ের সাহায্য "Colorful Artistry" নামে খুলে ফেললাম ফেসবুক পেইজ। আর আমাদের arts and craft products সেল এর জন্য পোস্ট দিতে লাগলাম। ভালোই সারা পেলাম প্রথম প্রথম। তারপর আরও অনেকের।
মেলায় প্রথম স্টল
মেয়ের স্কুলের বৈশাখী মেলায় অংশগ্রহণ করলাম আমাদের মা ও মেয়ের আর্টস এন্ড ক্যাফট এর জিনিস নিয়ে। আমাদের স্টলটাই ছিল সবচেয়ে আলাদা। অদ্ভুত হলো ৯৫% জিনিস শেষ হয়ে গেল। গ্রাহকের আগ্রহ আমাকে অবাক করলো।
এরপর নারী উদ্যোক্তা সংগঠন এর মেলা, গাজী ইভেন্ট এর মেলা. আরো অন্যান্য জায়গায় মেলা করে পরিচিত বাড়ে দিনের পর দিন। এখন দেশের সব জায়গায় আমাদের গ্রাহক তৈরি হয়েছে এবং দিন দিন বাড়ছে।
আমার
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হল নিজের দেশে অনেক মহিলা
আছেন, যারা কিছু করার
সুযোগ পায় না। তাদের কাজ
শিখিয়ে আমি সাবলম্বী হিসেবে
গড়ে তোলার কাজ করতে চাই। আমার স্বপ্ন আমার
নিজের বানানো জিনিসগুলো দিয়ে
এই প্রতিষ্ঠান একদিন একটা
ব্র্যান্ড এ পরিনত হবে।
আমি paintings, crafts,
glass work এর পাশাপাশি হোম মেইড কিছু জিনিসও বানাচ্ছি
যেমন - নারিকেল তেল, নারিকেল নাড়ু,
নিম সাবান, রসুন এর আচার,
কালোজিরা গুড়া ভর্তা ইত্যাদি।
আমার স্বামী আমাকে অনেক সাহায্য করে।
ব্যস্ততা না থাকলে হোম
ডেলিভারীগুলো সে-ই পাঠানোর
ব্যবস্থা করে। অনেক উৎসাহ
দেয়। জানি না এমন কতদিন থাকবে,
মাঝে মাঝে ভয় হয়
কবে জানি আবার বলবে
এগুলো বন্ধ কর!
আর এই ভয়টাই আমাদের দেশের প্রতিটি নারীকে তাড়িয়ে বেড়ায়, কারণ বিয়ের পর
নারীর নিজের মতামত এর কোনো মূল্য
থাকে না।