তিনটি কবিতা । মোহাম্মদ রকিবুল হাসান
ধুতুরা ফুল
সব কথা কি আর বলা যায় ?
সব কথা বলার পরও
আরো খানিকটা বাকি থেকে যায় ;
যে কথা বৃষ্টির সাথে ছাদভেজা তরুণীর সাথে
কথোপকথন শেষ হয় বৃষ্টি শেষ হবা মাত্র
দূর থেকে দেখা এই দালানের শহরে
সেই আমার দৃষ্টিসুখ
যে সুখ ক্ষুধার্ত সন্তানের কাছে
মায়ের কাছে টেনে নেবার আকুতি
অথচ চোখ ছল ছল !
সব কথা কি বলে কিছু হয় ?
থেমে থাকে কথার স্বাধীনতা
যেনো মুখের ভেতর সশস্র প্রহরী বসা
পিতা এই স্বাধীনতা কি তুমিও চেয়ে ছিলে ?
পা চাটা কুকুরের মতো
যখন সব মুখগুলো বিক্রি হয়ে যায়
কেউ কোনো কথা বলে না তখন
ভাগাভাগি চলে — সতের কোটি মানুষের দেশ
স্বাধীনতার মোড়োকে পরাধীন থাকে
রাজায় রাজায় দ্বন্দ্ব চলে, চলে বসচা
রাজস্বের নামে চলে পান্তাভাতে কর
শেয়ার মার্কেট পকেটে পুরে বাবা দরবেশ
বলে কি কিছুই হয়নি তো !
আকাশটা কালো, বৃষ্টি হবে হয়তো
আধুলি পায় না, যে ছেলেটা উদোম বসে আছে
কোনো এক ভিখারি দালাল নির্দেশ দেয়
আজ একশোর ঘর না পেরুলে
তোর ভাত যাবে ভাগাড়ে
কাদের সাহেব হাসে —
দেশটা এখন
সিঙ্গাপুর, ইউরোপ, আমেরিকা হয়ে যাচ্ছে
পাইক, পেয়াদা, মোসাহেব বলে জ্বি হুজুর !
প্রয়াত জসিমের সিনেমার মতন যদি
দু খানি ডিসুম মেরে দিতে পারতাম
বেফাঁস মন্তব্যকারীদের
রাজনৈতিক ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রে পাঠানো দরকার
দরকার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা !
সব কথা কি আর বলা যায় ?
পাছে সাতান্ন ধারায় ধরে নিয়ে যায়
ওখানে কি সানি লিওন
স্বাধীনতার নামে কোমর দোলায় ?
কাপড় পড়ে ?
পরুক বা না পরুক এটা তার অধিকার
আব্রু আর বেআব্রু এক প্যারাডক্স
চিয়ার্স, এনজয় কর যা কিছু ভোগে রুচি হয়
জেলের ভেতরটায় অন্য এক জগৎ আছে
ভিআইপিদের মহল
নাজরানা আছে,
দেশি বিলেতি সব আছে, কি চাই ?
পিতা আমি তোমাকেই ভালোবাসি, আর বাসি
অচেনা সেই বেদম বৃষ্টিতে ভেজা তরুণীকে
যার নাম জানি না, ইচ্ছেও নেই
অথচ ওর জন্যে রেখেছি ধুতুরা ফুল,
কানে গুঁজে দেব বলে
আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়েছে
রায় হয়েছে
আজ আমার ফাঁসি ।
মেঘ ও বৃষ্টির গল্প
একটা মেঘ ভালোবেসেছিলো ছোট্ট এক নদীকে
মেঘ সারাটাক্ষন ভেসে বেড়াতো ছায়া হয়ে
নদীর জলে
নদীটাও বুক জুড়ে আগলে রাখতো মেঘকে
এভাবেই চলত তাদের খুনসুঁটি —
রোদের ঝিকিমিকি খেলা করতো
রুপোলি মাছেরা পুচ্ছ নাড়িয়ে স্বাগত জানাত
অথচ
কত দূরে তাদের বসবাস
দূরত্ব কাছে পাবার আকাংখাকে
হাহাকার করে তোলে
মেঘ বৃষ্টি হয়ে কাঁদতো
সেই জলে স্নাত হতো নদীর মন
আর বলতো —
এইতো কাছেই আছি, পাশেই আছি
শহরে পাশে বয়ে চলা নদী
মহাজনি ভূমিখোরদের নজরে পড়লো
বড়ো বড়ো যন্ত্রপাতির গাড়ি এলো
বালি, মাটি, ইট, পাথর এলো
কংক্রিটের ইমারত উঠে গেলো তরতর করে
মানুষের কোলাহল বাড়লো
পাখিরা নীড়হারা — সব গাছ কেটে সাফ
ভরাট নদীর উপর সারি সারি দালানকোঠা
মেঘ চিৎকার করে গর্জে উঠলো
বিদ্যুৎ চমকালো আকাশজুড়ে
মেঘ আর কোনোদিন খুঁজে পেলনা
ছোট্ট নদীটিকে
বৃষ্টির থৈ থৈ জলে নতুন শহরের ছাদে
আজও ভেসে বেড়ায় বাতাসের হুহু শব্দে
তুমি নেই, তুমি নেই !
একটা ফুল তোলা সাদা রুমাল
কি চাও আমার কাছে ?
কিছুই তো চাইনে
শুধু একটু শুতে দিও পাশে
বহুদিনের নির্ঘুম চোখ, একটুকু ঘুম চায়
যদি চুলে বিলি কেটে দাও
জন্মান্তর ঘুমিয়ে থাকব
কোমর অষ্টেপৃঠে জড়িয়ে
কোথাও যেতে দেবো না
এক সময় ঘুমিয়ে পড়বে তুমিও
জড়িয়ে বুকের পাশে
নিঃশ্বাসের শব্দ ঘন থেকে ঘণীভূত হবে
তোমাদের জঙ্গলের জোনাকিগুলো
সারা রাত জেগে আলো দেবে
বলবে, দেখো ওরা কত সুখী
মনে হবে এর থেকে বেশি ভালো
বাসেনি কেউ কোনদিন
বাসা যায়না
এক শালিখের চোখে জল পরবে
ওর জোড়াটা শিকারির ফাঁদে ধরা পড়েছে
সেদিন !
বহুদিন পর ঘুম ভেঙে
হাতড়ে বেড়াবো পাশের মানুষটিকে
খুঁজে বেড়াব শহরতলি, গাছে ফাঁকে,
চায়ের দোকানে, চেনা অচেনা রেস্তোরায়
রিক্সার যাত্রীদের ভেতরে
কারোরবা বোরখা উঁচিয়ে দেখবো
ভেতরে তুমি আছো কি না
এক্সিবিশন, পত্রিকার পাতা তন্ন তন্ন করে
খুঁজবো কোনো সংবাদ আছে কি না
যে হারিয়ে যেতে চায়
তাকে কি আর খুঁজে পাওয়া যায় ?
সবকিছু ভোলা যায়, শুধু
ভালোবাসা ভোলে না যে বেসেছিলো ভালো
হয়তো তোমার রুচি বদলেছে
হয়তো নতুন কিছু পেয়েছো খুঁজে
হয়তো আমাকে তোমার চাইনে
হয়তো সব পুরোনো হয়ে গেছে
হয়তো বটগাছটা মরে গেছে যেখানে দাঁড়িয়ে
কথা বলতে লুকিয়ে
হয়তো জীবন নামের জুয়া খেলায়
হেরে গেছি আমি সর্বস্ব বাজি রেখে
দেউলিয়া ঘোষণা দিয়েছে ব্যাঙ্ক
আমার কেউ নেই, কিছু নেই
থাকতে নেই আজীবন
চাইনে কিছু, আমার ফুরিয়েছে দিন
আমায় তুমি দিলে না কাছে থাকতে
দিলে না তোমার জন্যে উজাড় করে
সারাটা জীবন যাকে খুজেছি
তাকে ধরে রাখতে — এ আমার ব্যার্থতা
না কি ঈশ্বরের ষড়যন্ত্র !
ভেবেছিলাম আমার একটা ঘর থাকবে
যেখানে তোমার মুখচ্ছবি তুলে তুলে
ভরিয়ে রাখবো দেয়ালে দেয়াল জুড়ে
সেই তুমি শুধু আমার
একটিও ছবি তুলতে দিলে না
মন জুড়ে যে ছবি চির অম্লান
তা কেবলি আমার মুছে যায় না
দুর্ভিক্ষ লেগেছে ইয়েমেনে
যেতে হবে ভয়াবহতার স্বরূপ তুলে ধরতে
তুমি আমার নেই, অথচ আছো
পৃথিবীতে ভালোবাসা এক জটিল সমীকরণ
হেরে গিয়েও জিতে যায় কেউ কেউ
যুদ্ধে শুধু জিততে হয়
ক্যামেরা তাক করে বসে আছি
ওপাশে বিদ্রোহীরা গোলা ছুড়ছে
গুলি চলছে থেমে থেমে
এগিয়ে গেলাম, সাথে একজন সৈনিক
বাকিরা কাতঁরে কাতঁরে মরছে
ওদের প্রিয়জনেরা হয়তো জানতেও পারলো না
কে কাকে খুইয়ে ফেললো চির জীবনের জন্যে
একটা সাদা ফুলতোলা রুমাল ছিল
বুক পকেটে রেখেছি অনেক যতনে
তোমার দেয়া, প্রথম দেখার দিনে দিয়ে ছিলে
বলেছো, যখন মনে পড়বে তখন
ওটা মুখে জড়াতে
ওখানে তোমার ঘ্রাণ লেগে আছে
বসে পড়লাম বালিতে
সামনে অনেক গুলো ঘর, শিশুরা কাঁদছে
জানিনা ওরা সবাই আজ বাঁচবে কি না
আমরা এম্বুসে পড়েছি
বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটটা খুলে ফেললাম
ওর আর কোনো প্রয়োজন নেই
তোমার চেহারাটা চোখের সামনে
চক চক করে উঠলো
দেখলাম, একটা সাদা শাড়ি পরে
তুমি হেঁটে আসছো
লুটিয়ে পড়লো আমার শরীর
ছিটকে পড়লো ক্যামেরাটা
বুকে রাখা রুমালটা ফুটো করে দিলো রক্ত
তুমি জড়িয়ে ধরে বললে,
কিছু হবে না, সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন
আমি বললাম,
সেই দিন আর কোনোদিন ফিরে আসবে না !
তোমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু
বহু বছর পর, ওখানে জন্মালো একটা বট গাছ
হুবহু তোমার মতন কথা বলতো
কোনো এক যুবকের সাথে
ওর হাতে একটা ফুল তোলা সাদা রুমাল ।