নাজমীন মর্তুজা, বাংলাদেশের লোকায়ত দর্শন তাড়িত গবেষক, কবি ও কথাসাহিত্যিক, তিনি প্রজ্ঞার গভীরতম কন্দরে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে সৃজনশীল সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি ক্ষেত্র সমীক্ষাধর্মী মৌলিক গবেষণায় নিবেদিত। মূলত সাহিত্য ও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির গবেষণায় ইতোমধ্যে তিনি যথেষ্ঠ নিষ্ঠার স্বাক্ষর রেখেছেন। তেমনি রচনা করেছেন স্মৃতি কথা আকুতিমগ্ন অনুভূতি মালার আশ্লেষে, যৌথভাবে রচনা করেছেন- বাংলা সাহিত্যের অলিখিত ইতিহাস, ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্য : জারি গানের আসরে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ আত্তীকরণ ও পরিবেশন-পদ্ধতি এবং বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র। এছাড়া বাংলা পুথি সাহিত্য নামে একক ভূমিকা ও সম্পাদনায় সংকলন করেছেন
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ এনামুল হক প্রমূখ গবেষকের পুঁথি-সাহিত্য সম্পর্কিত প্রবন্ধমালা। তিনি ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্য : জারি গানের আসরে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ আত্তীকরণ ও পরিবেশন-পদ্ধতি শীর্ষক গ্রন্থের জন্য অর্জন করেছেন সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১২।
২০১১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলা একাডেমির যৌথ আয়োজনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা সম্মেলনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন আয়োজিত সেমিনারে ফোকলোর বিষয়ে প্রধান আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি ভাবনগর ফাউন্ডেশন এর নির্বাহী পরিচালক।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-
কাব্যগ্রন্থ : গুরুপরম্পরা, শ্রীরাধার উক্তি, মহামায়া কঙ্কাবতী, বাস্তবের লুকোচুরি, অপরূপার রূপকথা;
উপন্যাস : নোনাজলের চোরাবালি;
গবেষণাগ্রন্থ : ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্য : জারিগানের আসরে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ আত্তীকরণ ও পরিবেশন-পদ্ধতি, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র, বাংলাদেশের ফোকলোর, সাইদুর রহমান বয়াতি : সাধকের স্বদেশ ও সমগ্র, বাংলা পুথি সাহিত্য।
জন্ম : ১৫ মার্চ ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর জেলার সেতাবগঞ্জ। বর্তমানে তিনি স্বপরিবারে সাউথ অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করছেন এবং সেখানেও তিনি মগ্নচিত্তে (এ্যাবরজিনালদের) লোক সাহিত্য নিয়ে কাজ করছেন।
জলের মেয়ে
এই বুঝি আমারই ঘন কুন্তল মাড়িয়ে
নেমে এলে গোধূলী,
নীল কচুরীপানার ফনায় রামসাগরে -সুখসাগরে।
বাবা বলতো
আমি জলজ লক্ষ্মী,
যে বেলা প্রসব করেছিল মা
প্রচন্ড সুখার দিন দাবদাহের ।
আমার প্রথম কান্নার সয়লাব
ভাসিয়ে দিয়েছিল বাবার বুক
তার পর ঘর -উঠোন -পাড়া -গ্রাম ।
বাবা বলতো তোর চোখভরা জল
আমার ভাঙ্গা ভিক্ষাপাত্রের দান রে মা,
সেই যে বাবার চোখে জলের আনন্দটুকু
কত সম্মান লেখেছে ললাটে !
কোন রাজমুকুটের ফুল কেশে ফুটবে
সেই অলিক স্বপ্নে পার করে যাই
একে একে চল্লিশ শ্রাবণ ।
জলের ভেতরে ডুবে থাকি নি:সঙ্গতায়
আমাকে মিথের কন্যা না বানালে কি হতো ?
বস্তু জগতের ছলচাতুরী যাতনার দীর্ঘ সুতোর প্রান্তে বড়শি চিহ্ন হয়ে
চোখের জলে ডুবে থাকে তোমার জলজ লক্ষ্মী ।
সাত সাগরের জল ঘিরে রেখেছে তাকে
জলের তলের রাডার কি খোঁজো ?
এই খানে তীর্থ ধাম .........
এতটা সময় লাগলো সরল একটা পথ চিনে নিতে ।
হায় !
তোমাকে পথ চিনিয়ে আনবার ছলে জ্বালিয়ে রেখেছি জলবাতি ......
শুধু ইঙ্গিত দিতে পারি এর বেশী নয়
জলজ কানুনে বাঁধা হাত - পা ।
জলদেশে আজ নিলামে তোলা জলজলক্ষ্মীর চোখের জল ।
দেখবো এবার নিলামের ডাকে সাড়া দেবে
কোন সে সওদাগর ...?
জলের পুচ্ছ কেটে কুন্তলে সাজিয়ে দেবে
কচুরীপানার বর্ণীল মুকুট ।
আর ওকে দেখে জ্বলে যাবে চোখ
নিলামের জলসায় বসে আছে যারা ।
নির্মাণের মায়াজাল ছিঁড়ে
সদর দরজা অর্গল ভেবে
ফিরে যেওনা,
ঠেলা দিতেই খুলে যাবে,
ভেতরের আলো অন্ধকারে ঢুকে
নামোচ্চারণ কর,
ঠিক ঠিক শুনতে পাবে
কে ওখানে,
দুধাপ উঁচু, অতঃপর ডান দিকে
তিন ধাপ নীচে নেমে দেখা পাবে,
প্রথমে সামনের দুটো চাকা
তারপর নুপুর পরা পা দুটো,
সুখাসনে সমাসীন...
একটু সামনে এগিয়ে যেও,
মাথার পাশে খোলা জানালা,
দেখবে উন্মুক্ত পথ দিয়ে আসা
প্রভাতি আলোর আত্মনিবেদন ।
সেখানে রোজ সকালে গিয়ে বসে
নিজ রেওয়াজের আবহে,
মানসিক আদান প্রদানে আলোর নৈকট্য,
ভীষণ কাছের,
অনেক সময় লেগেছে
দুজন দুজনকে চিনে নিতে...
বসন্তের কোন ক্যালেন্ডার নেই
কিছু না করার ভয়াবহতায় আচ্ছন্ন আছি অনেকদিন
তবে তোমাকে নিয়ে ভাবতে পারার তৃপ্তি
শরীরের ছন্দে ছন্দে তোমার স্পর্শের দোলা
প্রতি মুহূর্তে বইতে পারার সুখ
সেটাই বা কম কি, মুহুর্মুহু মনে হয়
মাঝে মাঝে ভেবেছি তুমি ঈশ্বরের মত,
সাধারণ ভাবতে পারিনা,
মানুষ হিসেবে মনে হয়না অপকৃষ্ট
তোমার হাত, তোমার কণ্ঠ, তোমার
তাকানোতে মোৎসাট খেলা করে ।
মনে হয় তোমার মত সাগরে
ঝাঁপ দেয়া যায় সহজে,
তোমার মাঝে আনন্দ তৈরি করবার
আকর্ষণ আছে, স্বাধীনতার অপার
আনন্দ তুমি ।
যারা ভাবছে তোমাতে অতল
সর্বনাশ
এক প্রগাঢ় গ্লানির বোধ টেনে
বেড়াতে হবে জীবনভর
অবিবেচক তারা,
আমি তো তোমার মাঝে
সেইন্ট দস্তভয়েস্কিকে দেখি
যখন তোমার সঙ্গে সুখ সঙ্গমে যাই
পৌরাণিক যুগে পা রাখি,
গন্তব্যে ফিরি যখন পায়ে
পায়ে লুটিয়ে পড়ে
গেরুয়া জল,
পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে নেয়
একটা কালোর মখমল,
দৈগন্তিক একটা বৃষ্টি ভেজা সুখ হয় ।
তোমাতে মগ্ন হয়ে
বৈষ্ণব বিনয়েজাগতিক
মন্দিরে ঢুকে যাই
তোমার নাম ভজন করবো বলে !
ঘোর অপভ্রংশ
জানি জানি যে হৃদপিণ্ডটা জ্বলছে
সেটা তোমার রক্ত মাংসে।
ভয় পাচ্ছো মৃত ভেবে
সারারাত তো জেগেই থাকে
তোমার পিঠের উপরে বিছানা বালিশে ।
যে রাতে অর্কেষ্ট্রা ভুলে গেলে
সে রাতে বুকের বাম পাশটা কেটে
গুটিয়ে রেখেছিলো পাঁজরের ফাঁকে ।
তারপর থেকে সুর গুলো টুং টাং
শিউলি ঝরার মত ঝরে ভোরের বাতাসে,
ভয় পাচ্ছো ভয় পেয়ো না
খুন হয়ে পড়ে থাকা শরীরের রক্ত গুলো
লম্বা জিভ দিয়ে চেটে খায় তারপর রোজ রাতে মৃত দেহটাকে
খুন করে ঘুম পাড়ায় ।
কালো চোখের কালো মনি গুলো কটকট করে চিবোয়
আদর করে দাঁত বসায় বক্ষমূলে
জরায়ুতে
এভাবেই পুস্ট হচ্ছে সে
বাইশ বছরের গুম করা শরীর
খুন করে আর ঘুম পাড়ায় ।
কখনো কখনো স্নেহ চায় ,লীলালাস্য চায় ,
চায় অবুঝ আদর ,
হেলা করা ফেলা করা সময়ে
নিজেই যখন বন্দি হলো
নিজেই হলো খুন ।
বাইশটা বছর অন্ধকারের রক্ত মাংসে
গুম করেছে মৃত আত্মার খুন করেছে
এখন নাকি পোড়া মাংসে পোড়া ঘরে গন্ধমদির শবের পচন
এ সবই তার প্রাণ পরায়ণ।
দেখছো তুমি যাচ্ছে গলে মৃতের দেহ মোমের মত , যাচ্ছে ভেসে নদীর ঢেউয়ে
তোমার বামে তোমার ডানে তোমার ঘ্রানে
জানে জানে জানে তো সে
তুমিই তো সেই শিউলি সাদা
অস্থিমালায় শিব সুঠাম
বাঁচিয়ে দেবে আদর দেবে ,
দেবে স্পর্শ
দেবে সঠিক সম্মান।
আশ্বিন রমণীদের নয়
ট্যাক্সিতে আনমনা হবে নিগুঢ় রমনী,
নিজস্ব ভাবনার ছোঁয়ায়
শিখে নেবে তোমার আঙুল
মিঠে লুকোচুরি।
অনায়াস বলে যাবে আঁতেল
শব্দে অগোছালো কবিতার লাইন,
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রমণী
শব্দ ও কাঠামো নিয়ে অনুভুতির
গভীরে।
আনন্দঘন মুহূর্তের উচ্ছ্বাস
তখন দেহে নয়, মাথা জুড়ে
বাস করবে মিছিলের শ্লোগান,
আবেগে উচ্ছ্বসিত শোকে বিষণ্ণ।
ততক্ষণে রমণীর দেহ ছাড়া
তোমার কোন বায়না থাকবে না
আশ্রয় দেবে বলে রমণীয়
পাথর হয়ে যাবে ।
তোমার তখন চর জেগে উঠবে
মিশিগান লেকে
অভিমান ছায়া ফেলে যাবে
ট্যাক্সির আবহে,
নীল নদের নির্জন বাঁকে
খুঁজে নেবে
তুমি অন্য কোন
মরু যুবতীকে
হিরন্ময় রৌদ্রে বৃষ্টির ধারাপাতে।