বুড়ো হওয়া বড়ো কষ্টের।
তার চেয়েও বড়ো কষ্টের,বুড়ো হয়ে নিজের পরিবারের লোকদের কাছে করুণার পাত্র হয়ে যাওয়া।
ছইল মিয়া সে রকম অবস্থার মধ্যেই এখন আছেন।
পেনশনার হিসাবে তাঁর এখন সুখে শান্তিতে থাকার কথা।তা আর হলো কই?
সারাটা জীবনই তিনি অশান্তিতে কাটিয়েছেন।অন্যের নিয়ন্ত্রণে কাটিয়েছেন।ছোট বেলায় বাবার নিয়ন্ত্রণে।বাবার নির্দেশ মতো সব কিছু করেছেন।বাবার সঙ্গে জমি চাষের কাজ করেছেন।মাঠে গিয়ে গরু চরিয়েছেন।
তাঁরা হত দরিদ্র থাকায় জীবিকার তাগিদে স্কুলে না গিয়ে খেত খোলায়ই শরিরের ঘাম ঝরিয়েছেন।
আরেকটু বড়ো হলে,একটা সুযোগ আসায় বাবা অনেকখানি ফসলি জমি বিক্রি করে,পাশের গ্রামের এক আত্বীয়ের মাধ্যমে তাঁকে বিলেতে পাঠিয়ে দিলেন।
এখানেও ছইল মিয়ার কোন ইচ্ছা বা অনিচ্ছা ছিলোনা।
বাবার ইচ্ছাতেই হয়েছে।
বিলেতে এসে প্রথমে ফ্যাক্টুরিতে পরে রেস্টুরেন্টে কাজ করেছেন।রুজগারের পুরো টাকাটাই দেশে বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
তাঁর বাবাই সে টাকা দিয়ে অনেক গুলো ভাই বোন সহ,লোকজন ভরা
সংসার চালিয়েছেন।
বিলেতি টাকায় তাঁদের সংসারে সচ্ছলতা আসায়,চাচা,ফুফু সহ আরো অনেক আত্বীয় স্বজনকেও সাহায্য করতে পেরেছেন।এবং কয়েক বছরের মধ্যে বেশ কিছু ফসলি জমিও কিনতে পেরেছেন।
এরই মধ্যে বলা নেই কওয়া নেই,বিনা নোটিশে বাবা গেলেন মরে।ছইল মিয়া তখন বাবার নিয়ন্ত্রণ থেকে গিয়ে পড়লেন আরেক নিয়ন্ত্রণে।দায় দায়িত্বের নিয়ন্ত্রণে।
মা,চার ভাই,ছয় বোন,সবার ভালো মন্দের-বর্তমান আর ভবিষ্যতের সব দায়িত্ব এসে পড়লো তাঁর ঘাঢ়ে।
ছইল মিয়া সব দায়িত্ব পালন করেছেন নিখুঁতভাবে।একে একে ভাই বোনদের বিয়ে দিয়েছেন।
ভাইদের চাহিদা মতো ছোট খাটো ব্যবসা করে দিয়েছেন।
পাশাপাশি চাচা,ফুফু,মামা,খালাদেরও সাধ্য মত সাহায্য করেছেন।
এরই মাঝে মায়ের অনেক আকুতির পর নিজেও বিয়ে করেছেন।
বিয়ের পর ধীরে ধীরে ছইল মিয়া কখন যে স্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেলেন তা নিজেই বুঝতে পারলেননা।
কয়েক বছর পর স্ত্রী কে লন্ডন নিয়ে আসার পর যখন সেই নিয়ন্ত্রণ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেলো।তখন বুঝতে পারলেন।
আর বাচ্চাগুলো জন্ম নেয়ার পর ছইল মিয়া হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলেন নিয়ন্ত্রণ কাকে বলে!
তখন স্ত্রীর ইচ্ছাতেই সব কিছু হতে লাগলো।কাজ কর্ম থেকে শুরু করে,কার সঙ্গে মিশতে হবে,কার সঙ্গে কি কথা বলতে হবে,কখন খেতে হবে,কি খেতে হবে,কি কাপড় পড়তে হবে-সব,সব কিছু স্ত্রীর ইচ্ছার উপর,স্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেলো।
দেশে মা,ভাই,বোনকে টাকা দেয়া সম্পুর্ণ বন্ধ হয়ে গেলো।
ছইল মিয়া দিশাহারা হয়ে গেলেন।টাকা দিতে না দেয়ার কারণ হলো-বিয়ের পর যে ক'বছর স্ত্রী দেশে ছিলেন তখন নাকি মা,ভাই,বোন,সবাই মিলে তাকে জ্বালিয়েছেন।তাদের তিনি কোনদিন আর টাকা দিতে দিবেননা।
স্ত্রী তার কথা রেখেছেন।
তার ইচ্ছার বাইরে কারো জন্য কিছু করা সম্ভব হয়নি ছইল মিয়ার।
স্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে চলতে চলতে বুড়ো বয়সে এসে,পড়েছেন সন্তানদের নিয়ন্ত্রণে।সন্তানরা শুধু নিয়ন্ত্রণই করেনা-তারা যেনো করুণা করে।এরকম একটা ভাব সন্তানদের মাঝে প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করেন ছইল মিয়া।আর এটাই তাঁর জীবনের সব চেয়ে মর্মান্তিক বিষয়।
ছইল মিয়া সন্তানদের করুণায় দুঃখ পান।কষ্ট পান।
তাঁর বুকটা ভেঙ্গে যায়।