পাঁচটি কবিতা ।। মাসুদ খান
পরমা কথা বলে ওঠে প্রকৃতির ভাষায়
তোমাকেই নিগড়িত করবার সমস্ত কৌশল
ভানুমতি ভোজবাজি সব রপ্ত করেছে মানুষ।
আর নারী, নিগড়কে তুমিও নূপুর ভেবে
বলো মেয়ে, মন খুলে আজ বলে যাও সব,
চুপচাপ শুনে যাব, প্রতিবাক্য করব না কোনো।
আমি কথা বলব বহু মুদ্রণপ্রমাদে-ভরা খরখরে গদ্যভাষ্যে
প্রত্যুত্তরে তুমি বলে যাবে অনর্গল
বরফ-গলানো স্নিগ্ধ পরিস্রুত প্রকৃতিভাষায়,
সে-এক সরলসার সুললিত চারুপদ্যে—
“নারীরূপে আসতে যদি ভবে
বুঝতে তুমি দুঃখজ্বালা তবে।
পেতে যদি ভূমিকা নারীর,
বুঝতে কী দায় কাঁধে প্রকৃতির!
বলতে পারো কোথায় কে কার থেকে
পিছিয়ে ছিলাম কখন এবং কবে?
হাজার বছর ধরে
জঞ্জাল সাফ করে
গড়েছি এই মানবসমাজ তবে।
দিনে দিনে হয়েছে তা জটাজটিল কাঁটাবহুল
আগাছাসংকুল।
তাই তো দিতে হচ্ছে এখন নিত্যনতুন ভুলের মাশুল
আরো অধিক ভুল।
উজিয়ে এলাম হাজার বাধা, হাজার দমন দলন
আবার বাধা, আবার দমন, আবার পদস্খলন
এমন করেই এগিয়ে গেছি, আজও আগুয়ান
ধারণ-সহন-প্রাণশক্তি প্রকৃতির সমান।
প্রকৃতি যা, এক অর্থে পরমাও তো তা-ই
বিভেদ ছেড়ে এই আমরাই অভেদটা শেখাই।
প্রাণকে ফোটাই। স্তন্য দিয়ে, অন্ন দিয়ে করি বিকশিত
তাপ ছায়া আর মায়া মেখে, জীবন ঘষে করি উজ্জীবিত।
একাধারে প্রজায়িনী, প্রাণপালিনী, এবং প্রশিক্ষক
অন্নদা ও স্তন্যদায়ী, প্রাণশক্তি-আয়ুর উদ্বোধক।
স্নেহশাসন, প্রীতিবাঁধন, পালনপোষণ...সবই অবিরত
সাধন করি। সর্বোপরি পালন করি ব্যবস্থাপন-ব্রত।
পরমাকুল আমর্মমূল নিজেই তো প্রকৃতি।
প্রকৃতিকেই শেখাচ্ছ আজ স্বভাব, সংস্কৃতি?
দায়িত্বজ্ঞান, রীতিনীতি, প্রেম-প্রজ্ঞা-প্রীতি?
কালে কালে ঘোর সংকট ঘুরে-ফিরে আসে
আজ ফের সেই দুঃসংকেত ভঙ্গুর সমাজে।
মর্দানি-ভাব দমে গিয়ে জাগুক নারীভাব
ভেতর-বাহির বোধন ঘটুক প্রকৃতি-স্বভাব।
দিনের শেষে, চিড়-ধরা এ সমাজ-সারাই কাজে
হন্যে হয়ে ফিরতে হবে নারী-ভাবের কাছে।”
এ-নিস্তারহীন ক্রূর কাঠ-ফাটা কঠোর রোদ্দুরে
এক মহাচ্ছায় গাছের গোড়ায় ঠেস দিয়ে
অনেকটা থতোমতো খেয়ে, হতভম্ব হয়ে
চুপচাপ অনুভব করে যাব প্রকৃতির এই কণ্ঠ, এই পরিস্রুত ভাষার আগুন।
সর্বনাম
তুমি যদি হও বিশেষ্য, আমি তোমার সর্বনাম
আমার জ্ঞানের, নিবিড় ধ্যানের, তুমিই তো পরিণাম।
সেই অপরের সঙ্গে সমান্তরাল সফর
জনম জনম, জন্মান্তর-- একটানা, অবিরাম।
তুমি যদি হও বিশেষ্য, আমি তোমার সর্বনাম।
যখনই লুকাও নামটি তোমার, তখন কী হয়--
তোমার লুকানো নাম-ভূমিকায় করি অভিনয়
পাই যদি খোঁজ লুপ্ত নামের, নামগান গাইতাম
তুমি যদি হও বিশেষ্য, আমি তোমার সর্বনাম।
বিশেষেও তুমি, নির্বিশেষেও, সেই একই তুমি
সকল কৃতির, সকল প্রীতির হে উৎসভূমি
সমস্ত পথ ঘুরে ফিরে শেষে তোমার ঠিকানাধাম
তুমি যদি হও বিশেষ্য, আমি তোমার সর্বনাম।
হর্ষ-বিষাদ
হারিয়ে ফেলবো অভয়নগরে
খুঁজে পাবো দূর মনোহরপুরে
এইভাবে এই জীবন কাটাবো
হারানো-পাওয়ার ইতিহাস লেখা আকাশের দূর শীর্ষে
কোথাও তো কিছু হারায় না এই সীমাহীন মহাবিশ্বে।
তুমি-আমি আজ কীভাবে কোথায়
মগ্ন রয়েছি কোন ভূমিকায়
বিশ্বছকের কোন এলাকায়, কোন হারানোর দৃশ্যে!
কোথাও তো কিছু হারায় না এই সীমাহীন মহাবিশ্বে।
কী কী হারিয়েছি কবে যে কোথায়
তুমিও জানো না, আমিও তো তা-ই
হারানো ও পাওয়া, হর্ষ-বিষাদ
কেই-বা শিকার কেই-বা নিষাদ--
এ কোন ভাবের ভুবনে ফেললে তোমার এ ভাবশিষ্যে!
কোথাও তো কিছু হারায় না এই সীমাহীন মহাবিশ্বে।
জৈবসন্ত্রাসী
এই তো কিছুদিন আগেও পৃথিবীটা ছিল তুমুল স্পন্দমান।সমগ্র জাহান জুড়ে এক অনারোগ্য অসুখ বাঁধিয়ে দিয়ে এইদিকে মারদাঙ্গা মড়কে, সংক্রামকের বুশফায়ারেদেখতে দেখতে নিঃস্ব, নিস্পন্দ হয়ে পড়ছে তামাম দুনিয়া। তারপর? দূর গ্রহে, দ্রাক্ষারস-কল্লোলিত নদীর কিনারে, হাইড্রোজেন পলিঅক্সাইডের মেঘের ছায়ায়, সুরেলা কস্তুরীগন্ধা হাওয়ার ভেতরে,জাফরানরঙা রিসোর্টের ডেকে বসে আছে ওরা, জৈবসন্ত্রাসীরা,দলবদ্ধ মিয়ারক্যাটের মতো গলা উঁচিয়ে এখন।তড়পাতে-থাকা ধরিত্রীর দিকে চেয়ে মেতে উঠেছে বেলেল্লা অট্টহাসিতে।
প্রস্থানের আগে
প্রীতি পেলে থেকে যাব আরো কিছুদিন, না পেলে এক মুহূর্ত নয়।
আবার যোগ দেব প্রকৃতির প্রতিটি আয়োজনে—
বৃষদের বপ্রকেলি আর সাতভাইচম্পা পাখিদের বেলাশেষের কলহকাণ্ডে,
হরিণ-হরিণীদের বিবাহপ্রস্তাবে,
নবীন পাহাড়ি ঝরনার অভিষেকে, উদ্বোধনে...।
জানি অবহেলা পাব, তবু
কখনো বেহাগ রাগে, কখনো তোটক ছন্দে ঘুরব
রঙচিত্র প্রজাপতিদের পিছু পিছু
বাজি ধরব শিকারসফল উদবিড়ালের অন্তরা থেকে সঞ্চারী অবধি
জলপলায়নরেখা বরাবর।
বহুকাল আগে ভুলে-যাওয়া সহপাঠীদের ঝিলিক-মাখানো
মর্নিং স্কুলের রোদ এসে পড়বে গায়ে
সেই রোদ দিয়ে সেরে নেব শান্ত প্রভাতি গোসল।
প্রীতি পেলে থেকে যাব, না হলে এক মুহূর্ত নয়।