“হয় ফেসবুক, না হয় আমি”- এ দু'টোর মধ্যে তোমাকে যে কোন একটা বেছে নিতে হবে। কথাটা সোহানার সাথে শেষবারের মত হয়েছিল শান্ত’র। এরপর আর একবারও কথা হয়নি শান্ত-সোহানার। মাঝে একবার সোহানা মোবাইলে কল দিয়েছিল, কিন্তু শান্ত রিসিভ করেনি। হঠাৎই শান্ত’র এ ধরনের সিদ্ধান্ত সোহানাকে বিন্দুমাত্রও বিচলিত করেনি। কিন্তু আজ ১৫দিন হলো শান্তর কোন খবর নেই, এমনকি তাদের একমাত্র ছেলে প্লাবনকে পর্যন্ত ফোন করে না। ও তো এমন ছিল না, কি হলো ওর! এ কথাগুলো শুয়ে শুয়ে ভাবছে সোহানা। শোবার ঘরেই ওয়ারড্রোবের উপর একটা বিড়াল দৌড়াতে গিয়ে ঔষধের ট্রেটা উল্টে ফেললো, সেদিক একবার তাকিয়েও উঠতে ইচ্ছে করলো না সোহানার। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল শান্ত’র সাথে আর একদিনের জন্যও আপোষ করবো না। ওর অবহেলার মাত্রা দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। আমি ঘরের বউ জন্য কি আমার স্বাধীনতা থাকতে নেই! আমি ফেসবুক নিয়েই থাকব দেখি ও কি করে, কতদূর করে। বলে আবারও নিজের মোবাইলটায় হাত দেয়। বিভিন্ন অপশন হাতড়ে গিয়ে দেখে ১৩০টি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টে অপেক্ষমান।
আনমনে ওগুলোর উপর চোখ বুলাতেই আবারও একটা রিকোয়েস্ট এসে হাজির। রিকোয়েস্ট নম্বর ১৩১। মোঃ পরাগ আহ্সান, একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে কর্মরত। দেখতে খুবই সাদামাটা। সোহানার দৃষ্টি থমকে গেল ছবিটার উপর। ছেলেটির প্রোফাইল পিকচারটা বেশ সুন্দর। ফুলের বাগানে সুনসান নিরবতায় দাঁড়িয়ে আছে, এ রকম একটা ছবি। কি ভেবে যেন সোহানা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টেটি এক্সেপ্ট করলো। সাথে সাথেই পরাগ তার ওয়ালে লিখলো "ঞযধহশং ধ ষড়ঃ" আমি কি আপনার সাথে কথা বলতে পারি?
সোহানা লিখলো- 'ঘড়'. বলে ছেলেটির প্রোফাইল ঘাটতে লাগলো। ছেলেটির প্রোফাইলে উল্লেখ করা তথ্য অনুযায়ী বয়স সোহানার থেকে ৫ বছরের ছোট। ওর ওয়ালে বিভিন্ন রকম মনিষীদের ছবি সম্বলিত বিভিন্ন বাণী। ছেলেটি দিনের অনেকটা সময়ই যে ফেসবুক নিয়েই থাকে এটা স্পষ্টই বোঝা যায়। পরিবার সম্পর্কে তেমন কিছুই নেই। ওর বিভিন্ন স্ট্যাটাসে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, ছেলেটি বেশ হতাশাগ্রস্ত। সোহানা ভাবে- পৃথিবীতে বোধহয় হতাশাগ্রস্তদের সংখ্যাই বেশি। আর এদেরই অন্যতম নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হচ্ছে ‘ফেসবুক’। তাই মনে মনে ধন্যবাদ জানায় ফেসবুক ফাউন্ডারকে। বর্তমান প্রযুক্তির অদ্ভুত সুন্দর একটা উপহার ‘ফেসবুক’। চেনা নেই, জানা নেই, হঠাৎই কত আপন হয়ে যায় ফেসবুকের বন্ধুগুলো। যাদের কাছে অবলীলায় মনের কথাগুলো শেয়ার করা যায়। এক ধরনের অন্য রকম একটা ভাল লাগা যেন ঘিরে থাকে চারপাশটা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বিকাল ৪:৩০ মিঃ। ছেলে প্লাবনকে স্কুলে আনতে যেতে হবে, তাই তড়িঘড়ি করে উঠে বাথরুমে যায়।
মোবাইলের টিংটিং শব্দে ঘুম ভাঙ্গে শান্তর। আজ শান্তর ৪০ তম জন্মদিন। এই চল্লিশ সংখ্যার একটা মাহাত্ত্ব আছে। ‘চল্লিশ’ সংখ্যাটি পৃথিবী নামক গ্রহটার অনেক কিছুরই দৃষ্টান্ত বহন করে। কাজেই চল্লিশ বছরের জন্মদিনটাকে ব্যতিক্রমভাবেই পালন করবে বলে স্থির করলো শান্ত। আজকের দিনটা সে ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে। আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা ছাড়লো। রাতে বিদুৎ বিভ্রাটে প্রচন্ড গরমে ঠিকমত ঘুম হয়নি তার, উঠতে উঠতে সকাল ১০:৩০ মিঃ। টেবিলে রাখা মোবাইলে দেখলো ১৩টা মেসেজ। একটু মুচ্কি হেসে মনে মনে বললো- “আনলাকি থার্টিন বাট লাকি ফর সাম” এই সংখ্যাগুলোকে কেন যে মানুষ ভাগ্যের সাথে মিশিয়েছে ভেবে পায় না। নিজে নিজেই বিরক্তি বোধ করে ব্রাশটা হাতে তুলে নিয়ে বাথরুমে চলল।
টুকটাক কবিতা/গল্প/নাটক ইত্যাদি লেখার অভ্যাস শান্তর অনেক দিনের। তার ধারনা- বাথরুমটা হচ্ছে তার আইডিয়া নাজিল হওয়ার একটা তীর্থস্থান। কারণ, সেখানে বসেই সে অনেক নাটকের প্লট তথা কবিতার প্রেক্ষাপটের সন্ধান পেয়েছে। মনে মনে ঠিক করল বাথরুমে বসেই ঠিক করা যাবে আজকের দিনটা কিভাবে উদযাপন করবে এবং তারপর আয়েশ করে এসে মেসেজগুলো দেখবে।
অনেকটা প্রশান্তি নিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে মোবাইলটা হাতে নিল। সবগুলো মেসেজই গতানুগতিক লেখা-
'Happy birthday to you'.
শুধুমাত্র একটিতে লেখা- “আজ পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুটবে তার সবগুলোর শুভেচ্ছা বাবা শুধু তোমাকে” তোমার জান প্লাবন।
মুহুর্তেই ছেলেটির মায়াবী মুখটি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। বুকের ভেতর একটা চাপা কষ্ট হু-হু করে উঠল।
নিকট অতীতে নাজিলকৃত প্ল্যানটা যেন মাথা থেকে হাওয়া হয়ে গেল। প্লাবনের দেয়া এই সুন্দর মেসেজ এর জন্য মনে মনে অনেকবার ধন্যবাদ দিল ওকে। ওই মায়াভরা মুখটির দিকে তাকিয়ে সে সোহানার অনেক কর্কশ আচরণ নিরবে হজম করে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। প্রতিবারই স্বামী-স্ত্রী দু’জনের বাক-বিতন্ডায় স্বেচ্ছায় পরাজিতের স্বাদ গ্রহণ করেছে। এবার ঝগড়ায় বাসা থেকে বের হওয়ার সময় প্লাবনকে ঘুমে রেখেই চলে এসেছে সে। একবার ভাবলো বাসায় চলে যাবো, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো- না, আর না। অনেক সেক্রিফাইস করেছি। এই ফেসবুক সোহানাকে অনেক পরিবর্তন করিয়েছে। ফেসবুকের নেশায় সে ছেলেটাকেও আর আগের মত সময় দেয় না। এই নিয়ে অনেকবার তর্কাতর্কি হয়েছে দু’জনের। শেষ সময়ের দেয়া শর্তের কথা মনে হওয়ায় বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্তটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। এবার একটা শিক্ষা সে সোহানাকে দেবেই। সংসারে স্বামীর অভাব ওকে বুঝিয়েই ছাড়বে। আমাদের সমাজে মেয়েরা যতই স্বাবলম্বী হোক না কেন, যতই অর্থনৈতিক মুক্তি আসুক না কেন, স্বামীহীনা নারীকে কেউ তেমনভাবে মূল্যায়ন করতে চায়না। আর সোহানা জাতীয় মেয়েরা মনে করে- পৃথিবীর সবচেয়ে গবেট জাতীয় প্রাণী হচ্ছে তাদের স্বামী। অথচ একবারও চিন্তা করে না- তারা যদি নিজেদেরকে চালাকই ভাবে, তাহলে ঐ স্বামীটা তাদের কব্জা করলো কিভাবে?
না, এবার শান্ত তার সিদ্ধান্তে অটল। তার মনে হলো- ভবিষ্যতে ভালো কিছু সময় কাটাতে কিছুটা খারাপ সময় অতিক্রম করতেই হবে- বলে মনে মনে নিজেকে শান্তনা দিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে কাপড়-চোপড় পরে বাইরে বের হয়।
“একবার ডেকে যাও তুমি,
বার বার ছুটে যাবো আমি তোমার দুষ্টুমিতে আজ,
আমার ইচ্ছে মেশাবো আমার হয়ে যাও তুমি,
আমি তোমার হয়ে যাবো”
পরাগের দেয়া এই মেসেজটি সোহানা বার বার পড়ছে। যতই পড়ছে ততই যেন তার এক ধরনের ভাল লাগা কাজ করছে। সোহানা ভাবছে- এত অল্প সময়ে ফেসবুকে কথা বলতে বলতে কখন যে একে অপরের এত কাছাকাছি চলে এসেছি বুঝতেও পারিনি। এখন প্রতিদিন অন্তত ২০ বার করে উভয়ের অনুভূতির আদান-প্রদান না হলে যেন কিছুই ভালো লাগে না।
সোহানা গভীরভাবে লক্ষ্য করে দেখেছে, পরাগের চেহারাটা খোকনের চেহারার সাথে অনেকটাই মিল পাওয়া যায়। সোহানা ভাবে- আচ্ছা, খোকনের মিষ্টি মুদ্রাদোষগুলো কি পরাগের মাঝেও আছে? হয়তোবা আছে, হয়তো নেই। কিছু কিছু মুদ্রাদোষও যে অন্যকে আকর্ষণ করতে পারে, খোকন ছিল তার বলিষ্ঠ প্রমাণ। প্রথম জীবনের ভালবাসা, খোকনের অনেক স্মৃতিই সোহানাকে কাতর করে মাঝে মাঝে। সমাজ-সংসারে মানুষের জীবনের সুর-তাল-লয় কখন যে ভেঙ্গে যায় কেউ তা বলতে পারে না। যেমনটি ভেঙ্গেছিল সোহানার জীবনেও। প্রত্যাশিত মানুষটির সাথে হু-বহু মিল এবং তাকে না পাওয়ার বেদনা থেকেই কি পরাগকে তার এতটা ভালো লাগে? হয়তোবা তাই। সোহানার এসব ভাবনায় ছন্দপতন হলো কলিংবেলের শব্দে।
দরজা খুলে দিতেই প্লাবনের এক ডজন অভিযোগ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘প্যারেন্টস্ ডে’-তে সোহানার অনুপস্থিতি। একমাত্র সন্তানের এই যৌক্তিক অভিমানের কাছে সোহানা সহসাই পরাজয় বরণ করে নিয়ে বিভিন্ন কথায় ছেলেকে বুঝিয়ে শান্ত করল। বিপত্তিটা ঘটল খাবার সময়ে প্লাবন হঠাৎ বলে উঠল- “আম্মু বাবা বোধহয় এবার সত্যি সত্যি রাগ করেছে। আর আসবে না। তুমি শুধু শুধু বাবার সাথে ঝগড়া কর।
কথাটা শুনে সোহানা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। কি! আমি শুধু শুধু ঝগড়া করি? তোর বাবা কি ধোয়া তুলশি পাতা? কেউটের ছেলে কেউটেই হয়েছিস। দুধ দিয়ে কালসাপ পুষছি আমি! এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলল। একবার সোহানার কথা আরম্ভ হলে তাকে থামানো যায় না। প্লাবন অনেকটা শান্তভাবেই বলল-
মা, রাগ থাকা ভালো, কিন্তু পরিমাণে বেশি হলে অনেক সময়ই বিপত্তি নেমে আসে। আমি ক্লাস নাইনে পড়ি, আমিও কিছু বুঝতে শিখেছি। আজ ‘প্যারেন্টস্ ডে’-তে প্রায় সবার বাবা উপস্থিত হয়েছেন। আমার কি ইচ্ছে হয়না মা, আমার বাবার হাতটি ধরে বাড়ি আসতে?
শান্ত’র রক্ত বয়ে বেড়াচ্ছিস না?
তুই তো তোর বাবার কথাই বলবি।
তুমি এত রাগারাগি করলে আমি কিন্তু গ্রামে বাবার কাছেই চলে যাব।
যাবিই তো, আজ হলেও যাবি, কাল হলেও যাবি।
আমি কি বুঝিনা, সবই বুঝি।
বলে নিজের রুমে চলে যায়। প্লাবন নিরবে খাওয়া শেষ করে।
ঘুন্টিমোড়ে শহীদের দোকানে চা খেতে খেতে শান্ত’র মনে হলো- আগামী সপ্তাহে প্লাবনের জন্মদিন। প্রত্যেকটা জন্মদিন পালন করার জন্য মা-ছেলে মিলে তিন বছর ধরে প্ল্যান করে থাকে। কারণ ওর জন্মদিন আসে চার বছর পর পর। কোথায় বেড়াতে যাবে, কি খাওয়া হবে, কাকে কাকে দাওয়াত দেয়া হবে ইত্যাদি। এবার নিশ্চয়ই ওর মন খারাপ, কারণ ওর সমস্ত পৃথিবী জুড়েই বাবা। খুব বাবা ভক্ত ছেলে। বাবা-ছেলের এমন বন্ধুত্ব খুব একটা দেখা যায় না। মুহুর্তেই প্লাবনের মুখটি মনে করে শান্ত বিরাট এক শূন্যতা অনুভব করে। সারাদিনের কর্মসূচি ভুলে যায়। চা খাওয়া শেষ না করেই বেরিয়ে পড়ে।
পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ প্রেমে পড়া, আর সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো- কাউকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবেসে যাওয়া। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো ভাবছে শান্ত। এই দীর্ঘ ২০টি বছর সে সোহানাকে ভালবেসে ঘর করছে। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমার হিসাব মেলাতে চেষ্টা করে মনে মনে। অপরদিকে প্লাবনের জন্মদিনে হঠাৎ করে উপস্থিত হয়ে প্লাবনকে চম্কে দিয়ে ওর অদ্ভুত সুন্দর চোখের কোণে আনন্দের জল চিক্চিক্ করে উঠাটাও দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কিচ্ছু ভেবে পায় না সে।
‘ধ্যাৎ, কি-যে করি, মাথায় কিছু কাজ করছে না।’
বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফেসবুকে ঢোকে। কিন্তু সেটা করতেও কেন জানি ভালো লাগছে না।
মানুষের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ক্ষতকে ভুলে থাকার যত চেষ্টাই করুক না কেন, আসলে ভুলে থাকাটা বড় কঠিন। কর্মব্যস্ততায় সামান্যতম অবসরেও ভেসে ওঠে সেই পুষিয়ে রাখা কষ্টগুলো। শান্ত’ও এর ব্যতিক্রম নয়। এমনিতেই সে একটু খেয়ালী। খেয়ালী মানুষরা আবেগী হয়। বাসায় আসতে আসতে প্লাবনের জন্মদিনে ওকে একটা সারপ্রাইজ দেয়ার সিদ্ধান্ত সে মোটামুটিভাবে নিয়েই ফেলল।
বাঃ! খুব ইন্টারেস্টিং তো!
ইন্টারেস্টিং তো বটেই।
তাহলে আমি কি আমার একটা ইচ্ছের কথা বলতে পারি?
হু, মনে হয় পারো।
আমি নিজ হাতে প্লাবনের জন্য একটা গিফট তোমার হাতে দিতে চাই, প্লিজ
কিন্ত ---
নো, কোন কিন্তু নেই। বন্ধু হিসেবে আমি কি এইটুকু অধিকার রাখি না?
কথাগুলো দুপুরে শুয়ে শুয়ে মোবাইলে চ্যাট করছিল সোহানা-পরাগ। প্লাবন স্কুলে। এ সময়টা সোহানার অফুরন্ত অবসর। ইতোমধ্যে সোহানা-পরাগের বন্ধুত্বটাও বেশ পাকাপোক্ত হয়েছে। তাই পরাগের প্রত্যাশিত অধিকার ও ইচ্ছে কোনটাই উপেক্ষা করতে পারেনি সোহানা।
পরদিন দুপুর ১২টা।
বাসা থেকে বের হয় সোহানা। পরনে নীল শাড়ী, কপালে হালকা নীল টিপ পরেছে। রিক্সায় বসা, চুলগুলো এলোমেলো বাতাসে উড়ছে। আজ দেখতে অনেকটাই সুন্দর লাগছে ওকে। কিছু কিছু মেয়ে আছে, যাদেরকে হালকা সাজেই অপ্সরী-অপ্সরী মনে হয়। সোহানা এক ধরনের ভাললাগা, সংকোচ, উচ্ছাস নিয়ে যাচ্ছে পরাগের কাছে।
“যমুনা ফিউচার পার্কে” আজ ওদের দেখা হবে। কাল প্লাবনের জন্মদিন। ভাবছে যেভাবেই হোক পরাগকে আগামীকাল বাসায় আসতে বলবে। পরক্ষণে মনে হলো- প্লাবন বিষয়টাকে কিভাবে দেখবে। ও এখন অনেক কিছুই বুঝতে শিখেছে। এ সময় মায়ের বন্ধুত্বকে কিভাবে নেবে, এই ভাবনাটা যেন কিছুতেই সোহানার পিছু ছাড়ছে না। এমনিতেই কাল জন্মদিনে বাবার জন্য ওর মনটা খুবই খারাপ থাকবে। তার বন্ধুরা হয়তো হৈ-চৈ করে তার মেঘকালো মুখটায় হাসি ফুটাতে ব্যস্ত থাকবে, এ অবস্থায় অপরিচিত একজনকে সে স্বাভাবিকভাবে নেবেই বা কেন। মানুষ খুব সহজে অনেক সময় সবকিছুকে মেনে নেয় না। এটা এক ধরনের স্বার্থপরতা। উন্নত মস্তিষ্কের প্রাণীদের মধ্যে মানুষের মত স্বার্থপর প্রাণী খুব কমই দেখা যায়। যদিও অন্যান্য অনেক প্রাণীর চেয়ে মানুষের আয়ু খুবই কম। সোহানা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল- যা ভাবে ভাবুক। জীবন তো একটাই, আমি থেমে থাকবো কেন? রিক্সা ততক্ষণে যমুনা ফিউচার পার্কের কাছে এসে পড়েছে। সোহানা রিক্সা থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকিয়ে শপিংমলের দিকে পা বাড়ায়। কাঠফাঁটা দুপুরের তপ্ত হাওয়ায় ঘেমে যাচ্ছে ক্রমশঃ। তার উপর সাইড ব্যাগে ছাতাটা উঠাতে ভুলে যাওয়ায় মনে মনে নিজেকে খুব ধিক্কার দেয়। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় পরাগকে দেয়া কথামত যথাসময়ে ‘সপ্তডিঙ্গা’ নামের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এর সামনে দাঁড়ায়। আজ শপিংমলে চারপাশটা বেশ সরগরম। এই মলে অনেকগুলো সিনেপ্লেক্স। বিভিন্ন বয়সী মানুষজন প্রতিদিন এই অত্যাধুনিক শপিংমল দেখতে আসে। প্রায় ১০ মিনিট হয়ে গেল পরাগের দেখা নেই। সোহানার মধ্যে এক ধরনের মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে। বার বার টিসু পেপারে চিবুকের ঘাম মুছছে। এই এক্সাইটমেন্টটা অনেকটাই অম্ল-মধুর। সময়গুলো যেন সহজে ফুরোতে চায় না। সোহানার দৃষ্টি অনেকগুলো অচেনা মানুষের ভীড়ে ফেসবুকের পরিচিত মুখটাকে আবিষ্কারের চেষ্টায় ব্যস্ত। এর মধ্যে কোন ফাকে যে শান্ত তার পাশ ঘেষে দাঁড়িয়েছে বুঝতেও পারেনি। এক সময় শান্ত সামনে এসে দাঁড়ায়। সোহানা হতচকিত হয়ে যায়।
শান্ত বলে-
কখন এসেছো?
সোহানা এর কোন উত্তর না দিয়ে বলে-
তুমি!
হ্যাঁ,
আমি পরাগ আহসান, সোহানা নামের একটি মেয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি। মানে!
মানেটা হচ্ছে, একই ছাদের নীচে আবদ্ধ ঘরে দীর্ঘ সময় ধরে ভালবাসার আবাদ করলে অনেক সময়ই অক্সিজেনের অভাবে ‘ভালবাসা’ নামক বৃক্ষটি বিবর্ণ হয়ে পড়ে। তাইতো মাঝখানে একটা বিরতির পর্দা টেনে জানালা খুলে দিলে সেই ভালবাসা আবারও সতেজ হয়ে ওঠে, ফিরে পায় নতুন প্রাণ। অনেক কষ্ট করে তোমাকে জয় করেছিলাম, বাসায় যখন তোমার-আমার ভালবাসার আকাল পড়লো, তখনই ভাবলাম; তোমার ভালবাসা পাওয়ার পথটা একটু পরিবর্তন করবো। তুমি ফেসবুক পছন্দ করো, তাই তোমার ফেসবুকের ভালবাসায় সিক্ত হয়েই আজ আমার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছেছি। স্বপ্নীল প্রত্যাশাগুলো আবারও পেখম মেলেছে। কি, ঠিক করিনি ?
সোহানা নির্বাক। শান্ত’র কথাগুলো শুনে মুখটা একটু নীচু করলো। তার মুখাবয়বে একরাশ লজ্জা এসে ভীড় করেছে। অবনত মুখেই অস্ফুট স্বরে বললো-
I am really sorry, sorry for all.
শান্ত মুচকি হেসে বললো- চল যাওয়া যাক, প্লাবনের জন্য গিফট কিনতে হবে।