হেমন্তে রচিত হেমলোকের কবি মুনিরা চৌধুরী কে উৎসর্গ দুর্জয় খানের মেহেকাকাব্য সিরিজ।
~~
পর্বঃ পূর্ব অর্ধেন্দু -১
প্রথম রাত্রি, মুনিরা ও আমার কথোপকথন-
আপনি এসেছেন!
কতক্ষণ থেকে আপনার প্রতিক্ষা করছি
দেখুন তো ক'টা বাজে?
এই প্রগাঢ় অন্ধকারে কার্ডিফের দিকে মুখ করে বসে আছি
নিয়তির জানালা খুলে-
আপনি আসবেন বলে
মৃত্যুর কপালে চুমু খেয়ে মৃত্যুকে পাঠিয়েছি মৃত্যুর কোলে!
কতদিন ঘুম হয়না মৃত্যুর!
ঈশ্বর ও সময়ের আজ্ঞায় ক্লান্ত উপুড়
তার সবকটা বুকের হাড়;
একদম হাসবেন না আপনি,
" মুনিরামায়া " নামক ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত করে
বড্ড মজা আপনি তাই না?
অতঃপর মুনিরা আমার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে বসলেন-
" জানেন, আজ পঁচিশ বছরের বুড়ো মাচায় নেতিয়ে পড়া লতাটা স্নান করেছে কুয়াশার জলে,
মাটির প্রসব বেদনা সেরে ওঠার আগেই তার নাম রেখেছি আপনার নামে
নাহ্ ; না মুনিরামায়া, না মেহেকানন্দা কিংবা বৃষ্টি ও কৃষ্ণদাগের নাম নয়
আপনার মতোই আমার করোটি থেকে জন্ম নেয়া দ্বিতীয় মায়ানাম!
শুনবেন কি নাম?
বোধহয় এর আগেও আপনাকে বলেছি আমি কোনো এক আলকাপের রাতে-
মেহেকানন্দার আনন্দ কেটে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সমাহারে এক নাম!"
মুনিরা বললেন,
"আমি কত জন্ম ঘুরে এলে তুমি বলবে সে নাম?
আমি কতবার কুয়াশার ভোরে মিলিয়ে গেলে তুমি বলবে সে নাম?
আমি কতবার প্রাচীন মোমে গলে গেলে তুমি বলবে সে নাম?
আর, আর কতবার এই প্রগাঢ় অন্ধকারে তোমার মুখোমুখি হলে, তুমি বলবে সে নাম?"
আপনাকে আমি ধৈর্যশীল বলে জানতাম
অথচ দেশমাতৃকার ও প্রেমের সাতকোটি বিরহ বুকে চেপে
আজ অধৈর্য হয়ে গেছেন!
চলে যান আপনি
এই মুহূর্তে চলে যান আপনি
আজকের মতো চলে যান আপনি।
এই প্রগাঢ় অন্ধকারে কালো পর্দা ঢাকুক
আমার সুর-স্বর-কন্ঠহীন জীবন।।
২)
দ্বিতীয় রাত, মুনিরা ও আমার কথোপকথন -
অন্ধকারের পটভূমিকায় রাত আরো
গভীর থেকে গভীর হলো;
পড়ন্ত অন্ধকারের আগেই আমার ঘুম ভেঙে গেছে -
গান্ধী বাগান থেকে সুসজ্জিত কাঁধেলী চাপিয়ে
কাদের যেনো ঘোড়বহর আসে,
আমি শুনতে পাই ঘোড়ার খুরের শব্দ!
পোতাধান করে যে শিশু মাছগুলো আনা হয়েছিলো ঘরে
তারা ঘুমিয়ে গেছে গভীর নিনাদে-
দারুণ ভয়ে!
মৃত্যু
কবর
কিংবা
এই
অন্ধকার আয়নার সামনে কেবলই নিজেকে
মায়াপাখি বলে আবিষ্কার করতে থাকি!
ফজরের আজানের আগেই
পুনরায় শরীরে প্রবেশ করে " মুনিরামায়া "!
সে এক বিকট আওয়াজে!
মৃত্যুনারী তথা যোগিনীর আবির্ভাব হয়;
বুকে চেপে রাখা গতরাতের নাম শুনতেই
আমার
গলা
মুখ
আর
বুক চেপে ধরে " মুনিরামায়া "!
পরস্পরের ধস্তাধস্তি চলতে থাকে প্রহরখানেক
অকস্মাৎ
ডেল কার্নেগি -জুল ভার্ণ পড়ে যায় সেল্ফ থেকে,
আমি ছুটে যায় তাদের দিকে-
ডেল কার্নেগি আপনি ঠিক আছেন তো?
জুল ভার্ণ আপনি ব্যথা পাননি তো?
মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসে আজান;
" আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার............. "
সাথে সাথে অন্তর্ধান হয়ে যায় "মুনিরামায়া "।
জানালার ওপার থেকে মুনিরার কন্ঠ ভেসে আসলো,
" ক্ষমা করো দুর্জয়,ভুল হয়ে গেছে;
আমি বড্ড উদগ্রীব সেই নামের প্রতিক্ষায়
আমার শরীর পচে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে!
আমি কতবার তোমার শ্বাস চেপে ধরলে
তুমি ক্লান্ত হয়ে বলবে সে নাম?
আমি কতবার অস্ত্রের কাঁধেলী চাপিয়ে আসলে
তুমি বলবে সে নাম?
আর, আর কতবার ডেল কার্নেগি - জুল ভার্ণ পড়ে যেতে দেখলে
তুমি বলবে সে নাম?
মেহেকানন্দা, আপনাকে আমি নদী বলে জানতাম
অথচ আপনি সমুদ্রের গর্জন নিয়ে হৃদয়ে আছড়ে পড়লেন!
চলে যান আপনি,
এই মুহূর্তে চলে যান আপনি
আজকের মতো চলে যান আপনি......
এই কুসুমকলী ভোরের ডগা লেপ্টে লেগে থাক
আমার সুর-স্বর- কন্ঠহীন জীবন!
৩)
তৃতীয় রাত, মুনিরা ও আমার কথোপকথন -
পরমায়ুর কলা আমি বুঝিনা দুর্জয়; আহতডানা নিয়ে কেবলই দীর্ঘশ্বাস ফেলি মেহেকানন্দা কিংবা তোমার মহানন্দার তীরে-
এই রাষ্ট্র এক গলাকাটা নক্ষত্র!
অজস্র হিংস্র প্রাণী তারদিকে হা করে আছে।
আমি কুয়াশার ভোরে খালি পায়ে হেঁটে যাই; মরা বাগানের ভেতর দিয়ে-
কোথায় তোমার ঘর আর কোথায় বা তাহাদের!
গভীর এক ফর্সা মুখ জংধরা সোডিয়াম আলোর মতো
জ্বলছে
আর নিভছে,
নিভছে
আর জ্বলছে.....
চা বাগান কিংবা মাতামুহুরির ঘ্রাণ আমি ভুলে গেছি;
ভুলে গেছি কার্ডিফ আর স্লিভলেসের পথ!
এই রাষ্ট্র আমাকে কিছুই দেয়নি
আর
নেয়নি কিছুই
অতঃপর
আমি জেনে গেছি
ফলাফল শূন্য নিয়ে আমার বিদায় হয়েছে....
তুমি বলতে পারো দুর্জয়,
নয় দরজার নদীতে এখন কাহাদের আনাগোনা?
কাহারা রোজ মাছ ধরে জেলেপাড়ায়
কিংবা বাজারে ছুটে যায়-
কপালে আর আগের মতো চিন্তার রেখা ফেলি না
আর ফেলেই বা কি লাভ!
পৃথিবীতে না আছে কষ্ট না আছে ভালোবাসা;
কেবলই
সব
মায়া...
দুর্জয় তুমি একবার মরে দ্যাখো,
এর মতো মুক্তি আর আনন্দ কোথাও পাবেনা তুমি-
স্বরসংগীতের 'মা'কে দীর্ঘকাল স্নায়ুর ভেতর পুষে রেখেছিলাম ;
অথচ
মানবাশ্রয়ী রাষ্ট্র হেমলোকের বিষ পান করিয়ে
সমস্ত সম্পর্ক থেকে আমাকে আলাদা করে দিলো
ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের কি অপূর্ব ক্ষমতা দুর্জয়!
স্বর্গ আর নরককে এক পায়ে দাবিয়ে রেখেছে!!
দুর্জয়;
বাস্তব আর পরাবাস্তবের সমস্ত মোহ কাটিয়ে
আজ আমি তোমার মুখোমুখি বসে আছি,
আজ বলবে কি সে নাম?
যে নামে লুকিয়ে আছে আমার সমস্ত অতীত
আর
ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের কিংবদন্তী ইতিহাস!
" আমি জানি আপনি' মুনিরামায়া,
আমাকে " মুনিরামায়া " নামক ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত করে বিভ্রমে ফেলেছেন;
আপনি তো জানেন-ই
মানুষকে বিভ্রমে ফেলে অধিকার আদায় করা মোটেও শোভনীয় নয়-
তাহলে আজ বিভ্রম কেনো!
প্লিজ আপনি চলে যান,
জীবন ও রাষ্ট্রের এই বিভ্রমে
আমাকে একটু একা থাকতে দিন
চলে যান আপনি
এই মুহূর্তে চলে যান আপনি
আজকের মতো চলে যান আপনি......
এই স্বার্থপর নগরীতে একা থাকতে দিন
এখানে কিছুক্ষণ লেপ্টে লেগে থাকুক
আমার সুর-স্বর-কন্ঠহীন জীবন"।।
৪)
চতুর্থ রাত, মুনিরা ও আমার কথোপকথন-
নষ্টেন্দু কলায় নষ্টচন্দ্র দেখেছিলাম বলে বুকের পাঁজর থেকে চাঁদের শীতলতা উবে গেছে ;
কাকাডাকা বারান্দায় বিষের অশ্রুতে ঝাউগাছের লতা নেতিয়ে গেছে -
এখন আর আকাশ থেকে রৌদ্দুর ঝরেনা
মাটির বুকে
আমার দুঃখে,
করোটির ভেতর অজস্র উইপোকা বাসা বেঁধেছে
এক বছর হলো।
আমি তো চেয়েছিলাম,
" পাথরগুলো মুক্ত করে আনো "
ঘামঝরা শরীরে ফুটে উঠুক
জলগোলাপ
কাঠগোলাপ
কিংবা
রক্তগোলাপ।
শাস্ত্রের কালো কালো অক্ষরগুলোর ক্রিয়াপদ কেনো জানি
চশমার ফ্রেমেই আটকে থেকে যায়!
আগুন ঝরা চোখে
সমরাশির শুভ্রজল ততোটাই প্রেম বেছে নেয়
যতটা আমি তার ভেতর
সূর্য
শাস্ত্র
কিংবা
ধর্মকে বেছে নিয়ে থাকি।
নাম শুনতে চান?
সেই নাম?
ধরুন,
মুনিরামায়া
মুনিরাগাছ
মুনিরাকথা
মুনিরাআগুন
কিংবা
চাঁদ ও সূর্যের ভেতর সূর্যকে বেছে নেয়া স্বয়ং দেবী।
লোকাকীর্ণ জনপদের প্রতি শালিকের কোনো মোহ থাকেনা,থাকতে পারেনা ;
তার কলার ভেতর কুসুমকুমারী প্রণয়!
মাগফেরাতের রাতে যদি সমাজ ও রাষ্ট্রের থেকে
একগোছা রজনীগন্ধা পেয়ে যেতাম
তবে সমুদ্র কিংবা মাটির আবশ্যকতা থাকতো না আমার-
ব্যাহরিত প্রতিধ্বনির অগ্রভাগে ধূমায়িত আলোর ব্যাসার্ধ
আরো উজ্জ্বল ও নিকটবর্তী হতো।
অতঃপর মুনিরার কন্ঠস্বর;
" ব্রহ্মবৈবর্ত্তের চক্রব্যুহ্যে তোমার শব্দের ব্যুৎপত্তি
আমার কাছে দারুণ জলের মতো ঘূর্ণায়মান!
স্বর্ধুনীর ভেতর আমার কলার ভেলার যাবতীয় রসদ
তোমাতেই বিদ্যমান,
এমন কি প্রকারে তুমি আমাকে ভুলতে পারো?
তোমার কাছে আমি এতোটাই মূল্যহীন?
ঘুরে বসো
আমার মুখোমুখি হও
দ্যাখো আমি নিরাশ্রয়
আমার শরীর গলে গেছে এক বছর হলো!
তারও আগে শরীর গলিয়েছি
ঠাকুরমার বুকের পাশে!!
এই গোপন নাম
এই গোপন রহস্য
আর কতরাত পার হলে তুমি উপলব্ধি করবে?
কত জন্ম শরীর গলিয়ে তোমার মুখোমুখি বসলে
বলবে সে নাম"?
যতরাত কবিতা জন্মাতে থাকবে...
যতরাত মেহেকাকাব্য দীর্ঘায়িত হবে....
যতরাত গভীর নিনাদে আপনার মুখাবয়ব ভেসে উঠবে..
ঠিক ততরাত আপনি থাকবেন সেই নামের অমৃত কাঙাল!
আপনি আসতে পারেন আজ,
আজকের মতো আপনি আসতে পারেন,
গভীর নিনাদে লেপ্টে লেগে থাকুক
আমার সুর-স্বর-কন্ঠহীন জীবন!!
৫)
পঞ্চম রাত, মুনিরা ও আমার কথোপকথন-
অশরীরির প্রণয় নিয়ে যে খুঁজেছিলো আত্মার আত্মজ জন্ম। লিলিফুলের ডগায় সমূহ তৃপ্তি আনয়নে যে মুক্তো খুঁজে এনেছিলো ডাঁরার পাদদেশ জুড়ে, তার এখন স্বপ্নবোঁজার দিন কাটছে। তাকে ও তাকে খুঁজে আনতে বলা হলে, হাতের আঙ্গুলে তিমিরময় ফিরিঙ্গি নেচে ওঠে। আবাসিক পাখি স্নান করে নেয় অন্ধকারে, এই হ্রদে। ___ তমাল বনে হ্রদের স্রোতধারা কৃষ্ণদাগ মুছিয়ে কতটুকু লঘু করে জীবন ও যৌবন! এই এক বিস্ময়ে সামনে পিছন ম্লান হয়ে আসে। প্রলেহ শাবক বিদ্যমান অভিরুচি বহাল রেখে অশরীরির পশম কেটে ফেলে দারুণ নিনাদে। মানুষ পাথরের ভাষা বুঝতে না পেরে ঝিলমিল আলোর আয়োজন করে থাকে, অথচ ওদিকে আত্মা পুড়তে পুড়তে সুখের চৌকাঠ মাড়িয়ে মাতাল হয় ভালোবেসে, সে মেকি ভালোবাসা নয় তো! পরিবার তথা সমাজ পৃথিবীর একমাত্র শীত ঋতু। এখানে জীবন এতোটাই হিম ধরে আসে যে জীবন্ত চোখ ছুটে যায় জন্মের দাগ মুছতে। আহা! পাথরের চোখ আছে বলে কেবলই অবলোকন করে!! আর মুখ নেই বলে চুপ থেকে যায় মহাকাল অব্দিই। কবি মুনিরা চৌধুরী, আপনি তাকিয়ে দেখুন- একজোড়া স্তন বুড়ো হয়ে নেতিয়ে যায় চৈত্রের দাবদাহে! পাখিদের যাত্রা দূরূহ নয় তবুও নিজস্ব ডানা আহত করে আপনার মতো কুয়াশার ভোরে সমুদ্রে মিলিয়ে যায়।
ম্যাজিক্যাল আয়না থেকে মুনিরার পদার্পন;
" আমার ভ্রমণ, তেমার কাছে ভ্রম মনে হয় বুঝি!
ময়ূরের ঝুঁটি ধরে বসন্ত নামে পৃথিবীর বুকে, অথচ বসন্ত ময়ূরকে ছেড়ে একসময়
মিলিয়ে যায় প্রজাপতির আজ্ঞায়। আমাদের শব্দসমূহ কালের আগেই উচ্চারিত হয় বলে
অজস্র পাখি পাল্টে নিয়েছে পথ। একবার অনুমান করো তো দুর্জয়, অপ্রকাশিত প্রেম
প্রকাশিত প্রেমের থেকে কতটা শুদ্ধ আর পবিত্রতা নিয়ে হৃদয়ে বৃক্ষের ন্যায়
বেড়ে ওঠে"!
ম্যাজিক্যাল আয়নায় মুনিরা মিলিয়ে গেলো!
আপনি চলে গেলেন মুনিরা!
এইসব নিগূঢ় রহস্য আমার সুর-স্বর- কন্ঠহীন জীবনে লেপ্টে লেগে থাকুক।