রহমান হেনরীর কবিতাগুচ্ছ
রহমান হেনরীর কবিতাগুচ্ছ

জেব্রা ক্রসিংয়ে

.

রক্তজবা পিষে দিলে, ভেতরে যে রং আর রূপ আর রস
সুন্দরের চিত্রকলা খোলে; কিংবা খুব নিরিবিলি পেকে-ওঠা
পুঁইফল অফসেট পেপারের ঘঁষা খেয়ে, নিমেষেই যে কবিতা
লিখে ফেলে; অকস্মাৎ, তীব্র আক্রোশে হয় অগ্নিলাল ঈশানের
ঝড়ের সংকেত; অন্তরে ফাঁপর লাগা আনচান সেরকম দিনে,
মনে করো— জেব্রা ক্রসিং ধরে পার হচ্ছি: হৈ-চিৎকার—
আর আমার মস্তিষ্কে এলজেব্রা, হিসাবপদ্ধতি ফেলে, মানুষের
যাপন-রহস্যে ধেয়ে যায়— দু'পাশে কোথাও কোনও বন নেই,
আফ্রিকা বা বতসোয়ানা নয়; তবু দেখো, কোত্থেকে, অবিনাশী
জেব্রাজুটি এসে, আমাকে তাগিদ দিচ্ছে: ‘‘জলদি করো—
অরণ্যান্ধ নগরীর এইসব ছায়া-পথ, ঘুণাক্ষরেও নিরাপদ নয়;
অধিক আলোর দিকে যেতে হবে। উদয়নে, মার্তণ্ড সূর্যকেও
অনুমতি প্রার্থনায়, যেখানে অপেক্ষা করতে হয়— সে কেমন
অন্ধকার? —এই বুঝে, দ্রুত পা চালাও!’’ তখন, নিশুতি;

রাজপথ, চিন্তারাশি, মানুষ ও বন্যপ্রাণি: খণ্ড-বিখণ্ড ঝরে পড়ে...
এলজেব্রা করতে করতে, চলে যাচ্ছি— ইরানে ও প্রাচীন মিশরে—

দুঃখমথিত গান

.


কলমিগাড়ির বিলে জল নেই; অথচ ওখানে,
ডাহুক ও ডাহুকির যৌথস্বরতন্ত্রী থেকে
সুরবৃষ্টি—

ফাল্গুনের বিষণ্ন দুপুর আজ স্নান করছে, পবিত্র শরীরে
সে-ও যোগ দেবে: দুঃখমথিত গানে, পাখিমোনাজাতে;

আমার অশুচি দেহ। বহু নগরীর ধুলো, ঝুলকালি
মেখে আছে— বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর
যুগ্মপঞ্জিকায়। অতিক্রান্ত জীবনের পথ বেয়ে
তিনফর্মা-বয়সের প্রতিটি পৃষ্ঠায়
ওইসব অপরং!

হয়তো নাজাত নাই। লৌকিক-উপাসনা
আমারও সম্বল; তবু কালিমার ক্লান্তি ঝেড়ে
ও ডাহুক, ডাহুকি লো, একবার সজল-ঋতুতে,
তোমাদের ছিন্নপালক দেখে, বুঝে নেবো: তীর্থ কোথায়—

কৃষ্ণতম চোখ


.
মর্ত্যের মানুষদের দেখেছি;
দেখেছি: সুন্দর ও নষ্ট— অগণিত চক্ষুযুগল।
ওইসব মণিতে: গোপন উনোন, সর্পদ্বীপ এবং স্বর্গোদ্যানও দেখেছি;
প্রশান্তি— এই ধারণাটির অর্থপূর্ণ মূর্তায়ন বলতে: তোমার চোখ দুটোই।
এত সজল-কালো, কৃষ্ণতম... অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের মধ্যবর্তী নো-ম্যান'স জোনে,
আমি এক অর্ধবাক্য; যার যতিচিহ্নে, কমা ও সেমিকোলনের দ্বন্দ্ব, অস্থির সংশয়—
আমার ধর্ম যাচ্ছে অধর্মের পথে; নাস্তিক্যের ভেতর গজাচ্ছে বিশ্বাসের চারা; ঈশ্বরচুম্বনে কাঁপছে মাটি...

নীরবতা

.

তোমার নীরবতাভেদি ঘাসগুলো, প্রবর্ধিত হতে হতে, এখন তো আসমুদ্রহিমাচল তৃণভূমি! রোজ রাতে, আমি সেই তৃণভূমির অবগুণ্ঠন সরানো হাওয়া— উন্মোচন করছি তোমার গুপ্ত বাসনা ও স্বপ্নসমূহকে; এবং তাদের উন্মেষবিন্দুতে পা রেখে ঢুকে পড়ছি এমন এক পৃথিবীতে, যার সাথে অতীতে ও বর্তমানে দেখা হয় নি মানবসভ্যতার। ওই পৃথিবীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে হতে, বুঝে ফেলছি: অচিরেই সে মুখোমুখি হবে পুরাতন পৃথিবীর;

প্রতিটি রাতেই, উন্মোচন করছি তোমার জীবন ও যাপনের মুহূর্তগুলোকে; অথচ প্রত্যূষেই মৃত তুমি। তোমার কবরের ঘাসগুলোকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে, দৃশ্যমান হচ্ছে: বুলডোজারের মত বিপুলদেহী নীরবতা—

প্রান্তরের গল্প


রেললাইনের পাশে, প্রায় গোলাকার সেই জলাশয়; অথচ অগভির জল— অনেক উঁচু ধানক্ষেতের আইল কবে যেন ফুটো করেছে মেঠোইঁদুর। ডিপমেশিনের সেচ অনেকগুলো ক্ষেত পেরিয়ে এসে, ইঁদুর-সুবাদে, ওপথেই গড়িয়ে পড়ছে জলাশয়ে... উজিয়ে ওঠা খলবল ঘোড়ার মতো, স্রোতের নিশানা ধরে, উঠে আসছো তুমি; ধরা যাক তোমার নাম অশ্বমাছ— ধরা যাক, অনেক বছর আগে মৃত। রক্তাক্ত কমলালেবুর মত জ্বলন্ত কাঠকয়লা চোখ, দিগন্তের দিকে তাকাচ্ছো। ধরা যাক, তোমাকে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়েছিলো— মন্দির, মসজিদ কিংবা গির্জাচত্বরে। সেই গনগনে হলুদ এবং দগদগে লাল— ঝরে পড়ছে তোমার দৃষ্টি থেকে, যেন ওই চোখদুটো বিক্ষত যমজ মৌচাক, মধু ঝরছে: ফোঁটায়, ফোঁটায়... কিন্তু কে তুমি? কুয়াশার ভেতরে অতীত হয়ে যাওয়া অদৃশ্য জল, বিগত দিনের ধোঁয়া, দিন ও রাত্রির মিলনস্থলে বিষণ্নমুখ আসমান? তোমার গাঁদাফুল চোখজোড়া আশ্চর্য সুগন্ধী ছড়াচ্ছে হাওয়ায়— আত্মহত্যার জন্য উন্মুখ রেলপথ শুয়ে আছে প্রান্তরে প্রান্তরে; পরিত্যক্ত, নির্জন মাঠের মধ্যে কেঁদে উঠছে: নীবর আড়বাঁশির ছয়টি হাওয়াপথ—

সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান