৫টি কবিতা ।। মজিদ মাহমুদ
৫টি কবিতা ।।  মজিদ মাহমুদ


গড্ডলিকা

 

আমি সেই ভেড়াদের চিনি-

যারা আমার জন্মের সময় স্বর্গের উদ্যান থেকে এসেছিল নেমে

যাদের বাকানো শিং, ধূসর রোমের সাথে মিশে ছিল

অন্য এক পৃথিবীর গান

জলস্থলে অন্তরীক্ষে বিচরণ কালে তারা আমার নাম ধরে ডাকে

পৃথিবীর মা-দের কাছেও তারা আমাকে ভাবে না নিরাপদ

গভীর ক্লান্তিতে মানুষের মায়েরা ঘুমিয়ে পড়লে

তারা ঘরে ফিরে আসে

শিথানের কাছে গাইতে থাকে ঘুম পাড়ানি গান

বলে, গুণে দেখ তোমার মাসিরা ঠিক আছে কিনা

জানি, এখনো আনাঘ্রাত তাদের উরুসন্ধি পয়োধর

তাদের নৃত্যের তালে-  অলোকানন্দ-

বেদনার গভীরতা জেগে ওঠে

তাদের প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা নাম

যদিও পৃথিবীর মানুষ তাদের সংখ্যার আদলে চেনে

অথচ নামের থাকে না প্রয়োজন নিজের কাছে

এই নামহীন ভেড়িদের দুগ্ধপান রতিক্রিয়া শেষে

ফিরে যাই তাদের জগতে

জানতে ইচ্ছে করে আমি তবে কে

কে তবে এনেছে আমাকে

এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জানি নেই প্রয়োজন

নেই দর্শন তত্ত্বের জটিলতা

শুধু জানি, এইসব ভেড়ার পাল, ভেরিদের সাথে

রয়েছে গাঁথা আমার জন্মের মানে


জন্মদিন

 

আমার জন্মদিন হয়ে গেছে জন্মের আগে

যদিও আমাদের জানা নাই তার সঠিক দিন-ক্ষণ কবে

পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়েছিল যে সব জলের ধারা

তাদের কেউ বাতাসে এসেছিল ভেসে

কেউ তারা হারিয়ে গেছে সমুদ্রের চড়ায়

গাছের বাকল থেকে ঝরে পড়ে যে সব কস

জমাট বাঁধেনি যে রক্তের ধারা

তাদের হাজারো জন্মের কাহিনি কে তবে কবে

প্রথম জন্মের দিনে পিতামহ এনেছিলেন পিঠা

তার কি জানা ছিল পুত্রবধূর প্রকোষ্ঠের খবর

আমরা শুধু জানি জন্মের হয় নাকো দিন

কেবল পালন করি বাসা বদলের উৎসব

তুমি এতদিনে যে সব বাসা করেছ বদল

অনেক ফুল ফুটেছিল সেখানে

রয়েছে অনেক মৃত্যু- সঙ্গমের স্মৃতি

বাথরুমে স্লিপ খেয়ে কোমর ভেঙ্গেছিল মা

কোনো অবসরে ডেকেছিল বাড়িওয়ালার তরুণ ভার্যা

তার মানে ছিল- তুমি যা বুঝেছিলে তেমন; কিংবা অন্য কিছু

সকল কথার জন্মদিন আছে

আমরা খুঁজেছি কি সকল নদীর যাত্রার দিন

নদী মরে যাবে একদিন

ধু ধু লাশ পড়ে রবে মাঠের ভেতর

তারপর একদিন শূন্য মিশে যাবে বাতাসের গায়

কত কত মৃত্যু নিয়ে পৃথিবী বেঁচে আছে

তার বেদনার কথা কখনো ভাবি নাই

হে পৃথ্বি, জননী আমর-

আমরা মরে গেলেও আমাদের সমাধি রয়ে যাবে তোমার ভেতর

তুমি উর্বরা হও, ঋতুবতী হও পুনরায় প্রসব করো আমাদের

আবার আসুক ফিরে নতুন জন্মদিন তবে

 


পুতুল পাখি

 

যে সব পাখি মরে গেল হাত থেকে পড়ে

দুখণ্ড হয়ে গেল মাটির দেহÑ

থাকল দু ডানা দু দিক পড়ে

যদিও তাদের বুকে ছিল উড়বার সাধ

মাটির পুতুল তাই আমরা দেখতে পাইনি

কুম্ভের ঘুর্ণয়মান চাকা তাকে দিয়েছিল উড়বার বেগ

ম্যাজেন্টা রঙ দিয়েছিল কুমারের মেয়ে

কোথায় ছিল তার মাটির আবাস

শরীরে লেগে ছিল বহু জনমের আদর

উড়ার ইচ্ছা থেকে এসেছিল আমাদের গাঁয়ে

আমার পুত্র কন্যাকে ডেকেছিল জনক-জননী

তাদের ছিল সে নাড়িছেড়া ধন

মায়ের বিয়ের শাড়ি কেটে

বানিয়ে দিয়েছিল জামা

রাতে তারা ঘুমাতো এক সাথে

মানব সৃষ্টির রহস্যও তাই

প্রাচীন কিতাবে লেখা আছে সেই সব কথা

মাটি দিয়ে ঈশ্বর গড়েছিলেন আদম মূর্তি

একাকীত্বের কষ্ট দেখে দিলেন সঙ্গীনী

এই তবে ইচ্ছের খেলা

কিন্তু যে সব পাখি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়

তারাও কি একাকিত্বের যন্ত্রণা সইতে পারেনি

তাদের শিশু পিতা-মাতা

পুতুল বিহঙ্গের কষ্ট বোঝেনি

তাই খাট থেকে পড়ে হয়ে গেল অর্ধ-নারীশ্বর

যদিও তাদের উড়া এখন হয়ে যাবে কঠিন

তবু দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে

পিতামার দৃষ্টির আড়ালে উড়ে

যাবে খণ্ডিত সঙ্গীর খোঁজে

যখন হবে বিভাজিত ডানার মিলন

তখন আনন্দে উঠবে কেঁদে

তবু তারা জেনে গেছে মুক্তির পথ বিচ্ছেদে

তারপর একদিন টুকরো টুকরো

অসংখ্য মাটির পুতুল হয়ে

ফিরে যাবে উৎসের সন্ধানে

 


তার জন্য শেষকবিতা

 

তার জন্য আমি শেষ কবিতাটি লিখতে চেয়েছিলাম বহুবার

অনেকবার করেছিলাম শুরু; অনেক চরণ লিখেছিলাম বেশ

ভেবেছিলাম এই তো- এমনই ছিল আমাদের পরিচয়ের দিন

হয়তো আকাশে মেঘ ছিল; ছিল মৃত-নক্ষত্রদের অন্ধকার ছায়া

নিঃসঙ্গ সমুদ্রের ঢেউগুলো আছড়ে পড়েছিল শুকনো চড়ায়

জ্যোৎস্নার ভুতুড়ে নীরবতা কিংবা ছিল ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ রাত-

যদিও কবিরা অহেতুক এসব লেখেন- যা প্রকৃতির নিয়ম;

কিন্তু কেউ জানি না, কিভাবে হয়েছিল পরিচয় আমাদের

কে আগে ধরেছিল হাত; পেয়েছিল টের ঠোঁটের স্পন্দন;

 

আমি তো ছিলাম পরিত্যক্ত জাহাজের মতো ডাঙায় একাকি

অস্ত্রে সজ্জিত রাজন্য নই, ছিল না পর-রাজ্য অধিকারের আনন্দ

তবু তুমি দিয়েছিলে অবাধ বিচরণ ভারÑ যতদূর চোখ যায়

একটি অবাধ্য-অশ্ব কদম তুলে ঘুরে বেড়াতো অজানা ভূখণ্ডে

যেন তার জন্যই রাজ্যের প্রতিটি ঘাস বিছানা হয়ে ছিল

আজ যখন ভাবি তোমাকে নিয়ে শেষ লেখাটি লিখব; তখন

ঠিক বুঝতে পারি না; ভাবি কোথায় শেষ আর কোথায় শুরু

প্রতিটি কবিতার শেষে থাকে একটি পরিত্যক্ত চরণের ব্যাথা

 


নিষ্কামী

 

তুমি ঠিকই জানো, তোমার তো জানারই কথা

আজ অনেক লিঙ্গের মাঝে বিপন্ন আমি

অথচ এই লৈঙ্গিক পরিচয় ছিল আমাদের খেলা

আমরা যখন পানির পিচ্ছিল ঘাটলায় জেগে উঠছিলাম

যখন আমাদের ছিল প্রোটোজোয়া কাল

তখনো হয়নি শুরু আমাদের হ্যাপ্লয়েড বিভাজন

শরীরের মেয়োসিসগুলো তখনো ছিল মাইটোসিসের সাথে

আপন কোষের আড়ালে আমরা তখন স্বমেহনরত

সেই তো ছিল আমাদের সম্পূর্ণ আনন্দের কাল

তুমি বা আমি; আমি বা তুমি এর কোনো লিঙ্গান্তর ছিল না

তখন আমরা ছিলাম, সম-বিষম-উভকামী

আমাদের শয়ন, উপবেশন কিংবা পদব্রজ

হিমালয়শৃঙ্গের গলিত তুষার-তরঙ্গের সাথে

পতিত হয়ে তোমাকে তুলে নিচ্ছিলাম কোলে

কখনো তুমি নিচে, কখনো আমি

শরীরের ভারে নুব্জ, আবার জরায়ুতে গেছি মিশে

হয়তো এসব তুমুল উত্তুঙ্গু মিলনের কালে

আমার সুপ্ত অহংকার তোমকে হারিয়ে ফেলেছিল

যদিও চন্দ্রিমা রাতে আমরা কাছে এসেছিলাম

যদিও আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম অন্ধকার গুহায়

তবু দিনের আলো আমাদের মিলতে দেয়নি

অথচ এখনো যারা তাদের লিঙ্গকে পারে চিনতে

তারা হয়তো সমকামী, তারা হয়তো এখনো আছে

ঈশ্বরের উদ্যানে

তাদের অযৌনজনন, পক্ষপাতহীন মিলন

কেবল মিলনের আনন্দের তরে

কিন্তু যে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম

হয়তো শরীরের চিহ্ন রেখায় ছিল দৃশ্যত অমিল

সেই তুমি যখন আমার সঙ্গে মিলিত হও

তখনই তো আমি হয়ে উঠি অভিন্ন পূর্ণ মানুষ

তখন আমরা পরিণত হই নিষ্কাম কর্মে

তখন দৃশ্যত কামের আড়ালে পারে না দেখতে

আমাদের বিভাজন রেখা


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান