ঝিনুক নামের কিশোরী মেযয়েটি ভারী চঞ্চল আর ছটফটে। কানের দুপাশে দুটো বেনি ঝুলিযয়ে ঘুরে বেড়ায় ছোট্ট উপজেলা শহরে। স্কুলের বান্ধবীদের আর পাড়ার ছেলেদের সাথে খুনসুটি করে। এসএসসি পাশ করে আই এ তে ভর্তি হল ঝিনুক উপজেলা শহরের কলেজে। বান্ধবীদের মধ্যে বেশ কযয়েকজন আছে ওর নেই। সুতরাং মোবাইল ফোন চাই -ই-চাই। মা-বাবার কাছে জেদ ধরল ও। দিনমজুর বাবার ফোন কিনে দেওয়ার সাধ্য ছিল না। তবুও অনেক কষ্ট করে মেয়ের আবদার পূরণ করলেন তিনি। যতই হোক কলেজে পড়া মেয়ে তার।
ঝিনুক যখন আইএ শেষ বর্ষে, এক মধ্যরাতে ফোন এলো বাচ্চু মিয়ার। অচেনা নাম্বার কিন্তু তবুও ধরল ঝিনুক। কথা বললও অনেকক্ষণ। লোকটা মিষ্টি মিষ্টি করে অনেক কথা বলল। একটা ভালোলাগা গুনগুন করলো ওর সারা শরীরে। এরপর শুরু হল রোজ মাঝরাতে কথা বলা। তারপর যখন তখন। মোবাইলের মাধ্যমে ও জানল, বাচ্চু মিয়া চাকরি করে প্রাইভেট ফার্মে। বেশ ভালো টাকা বেতন পায়। আই এ পরীক্ষা শেষ হলেই ঢাকা এল ঝিনুক। দেখা করল বাচ্চু মিয়ার সাথে। আনন্দের জোয়ারে ভাসল কিছুদিন। তারপর মা বাবাকে জানিয়েই বিয়ে করলো দুজনে। অনেকটা বাচ্চু মিয়ার জোরেই । বিয়ের পরই ধাক্কা খেলো ঝিনুক। বাচ্চু মিয়া শুধু বেকারি নয় সে নেশাগ্রস্থ। চুরি ছিনতাই এইসব করে দিন চলে তার। ঝগড়াঝাঁটি একটা রুটিনে পরিণত হল। ঝিনুক চাকরি নিল একটা গার্মেন্টসে । বেতন পাওয়ার সাথে সাথে টাকাটা জোর করে কেড়ে নেয় বাচ্চু মিয়া। বাধ্য হয়েই অর্ধেক টাকা ও এক সহকর্মীর কাছে রেখে আসে। না হলে সারা মাস ও চলবে কিভাবে? এরই মধ্যে একটা মেয়েও সংসারে এসেছে ওদের। এখন মারধোর একটা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হযয়েছে। আর একটা নতুন জিনিস লক্ষ্য করে ঝিনুক। যতক্ষণ ঘরে থাকে বাচ্চু মিয়া তখনই ফোনে কথা বলে বাচ্চু মিয়া। ঝিনুকের মনে হয় যেন বাচ্চু মিয়ার মুখ থেকে মধু ঝরে পড়ছে। যদি ঝিনুক কিছু জিজ্ঞাসা করে, সাথে সাথে শুরু হয় মার।এরকম কোন এক সন্ধ্যায় অসহ্য হয়ে মেয়েকে সাথে নিয়ে ঘর ছাড়লো ঝিনুক। রাত টুকু কাটলো সেই সহকর্মীর বাসায়। যার কাছে ও টাকা লুকিয়ে রাখত। পরদিন ছিল ছুটির দিন, ও আর ওর সহকর্মী মিলে অনেক খুঁজে একটা ঘর ভাড়া করল। মেয়েকে নিয়ে উঠে এল সেখানে। মোটামুটি জীবনে খানিকটা স্ব¯িত ফিরল ওর। এইযে নতুন জীবনটা, এ জীবনে যেমন সংগ্রাম আছে, তেমন আছে স্বাধীনতা। ও এবার সম্পূর্ণ টাকা ও হাতে নিয়ে ঘরে ফিরতে পারে। দু›বেলা দু’মুঠো খাবার কষ্ট এখন হয় না। ছুটির দিনে মেয়েকে সাথে নিয়ে শিশু পার্কে ঘুরতে যেতে পারে ও। পার্কে যেয়ে বাচ্চা মেয়েটা যখন হাসে আর ছোটাছুটি করে ঝিনুক মুগ্ধ হয়ে দেখে। ওর মনে হয় এই ছোট্ট মেয়েটাকে ও কখনও এত হাসতে দেখেনি আত্মমগ্ন হয়ে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, ওর এই ছোট্ট মেয়েটি যেন বড় হয়ে কোনরকম বিপথে না যেতে পারে ঝিনুকের নিজের মত। সেজন্য ও সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে। ওর নিজের জীবনের পুনরাবৃত্তি যেন ওর সন্তানের জীবনে না ঘটে। ভালো স্কুলে পড়াবে, ভালো হোস্টেলে রাখবে। যাতে বিপথে না যেতে পারে। তার জন্য প্রযয়োজন হলে অনেক ওভারটাইম কাজ করবে ও। মেয়েকে ক্যারাটে জুডো শেখাবে, গান শেখাবে, নাচ শেখাবে।
হঠাৎ একদিন আবার বাচ্চু মিয়া উদয় হয় ঝিনুকের
সামনে। টাকা দেওয়ার জন্য জোর করতে থাকে। টাকা দেয়না ঝিনুক। প্রতিবেশীদের
ডেকে ধুমকে ঘর থেকে বের করে দেয় বাচ্চু মিয়াকে। বাচ্চু মিয়া ঝিনুককে দেখে
নেবে বলে শাসাতে শাসাতে চলে যায়। এরপর থেকেই একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে
ঝিনুকের মধ্যে। মেয়েকে দুহাতে বুকের মধ্যে জাপ্টে ধরে ও। কি করে বাঁচাবে
মেয়েকে কি করবে? ভীষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে ঝিনুক। মেয়ের বয়স ৬
পেরিয়ে সাত এ পড়েছে। ওকে স্কুলে দিতে হবে। ঝিনুকের ব্যবহারের জন্য ঝিনুককে
সবাই ভালোবাসে। বিশেষ প্রয়োজন হলে সুপারভাইজার এর কাছে ছুটি চাইলে পাওয়া
যায়। সকাল সকাল ছুটি চাইল ঝিনুক সুপারভাইজার এর কাছে। মেয়েকে নিয়ে স্কুলে
যাবে বলে।কপালপোড়া মেয়েটিকে সুপারভাইজার বিশেষ স্নেহ করে। ছুটি দিলেন তিনি।
আর বললেন দেখ চেষ্টা করে যদি মেয়েটিকে মানুষের মতো মানুষ করতে পারিস।
মেয়েকে
নিয়ে স্কুলের সামনে রিকশা থেকে নামল ঝিনুক। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে মেয়েকে
নিয়ে স্কুলে ঢুকলো। প্রধান শিক্ষকের ঘরে যেয়ে তার সাথে কথা বলল ও। ভর্তি
পরীক্ষার ফরম পূরণ করে জমা দিল ঝিনুক। ভর্তি পরীক্ষার দিন, সময়, টাকার অংক
সব জেনে তারপর অফিস ঘর থেকে বেরোলো ঝিনুক। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে।
সারা মাঠ নতুন ছোট ছোট মেয়েরা খেলছে। দুচোখ ভরে দেখল ও। মনে মনে ভাবল আর
কয়দিন পরে ওর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ওর মিষ্টি মেয়েটিও ছোটাছুটি করবে এই
মাঠে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল, কিরে খেলবি ওদের সাথে? ঘাড়
নাড়লো মেয়েটি এখন নয়, অন্য দিন। মেয়ের হাত ধরে স্কুল থেকে বেরোল ঝিনুক।
একটু দূরেই চোখে পড়ল শয়তানি দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চু মিয়ার দিকে।
সাথে সাথেই ‹চিৎকার করে উঠল বাচ্চু মিয়া ্রছেলে ধরা ছেলে ধরা ।
অসংখ্য কিল, ঘুসি, চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না ঝিনুক। প্রাণপণ শক্তিতে ও বোঝাতে চাইলো আমি ছেলে ধরা নই ,আমি ছেলে ধরা নই ,কিন্তু কিছুই --বলা হলো না ওর।
পরদিন সকালে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে সুপারভাইজার দেখলো--হেডলাইন, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে এক মহিলা খুন। পাশেই মহিলার ছবি। প্রচন্ড ঝাঁকুনি খেয়ে আঁতকে উঠলেন সুপারভাইজার-- ঝিনুক!