অন্ধজ্যোৎস্নার গল্প ।। মৃন্ময় চক্রবর্তী
এখন
গ্রামের উপর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। পাকা রাস্তা। আগে ছিল না। অনেকদূরে,
অন্যগ্রামে ছিল বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে অথবা মোষ বা
গরুরগাড়িতে চড়ে পারুলপুরে আসতে হত। বিদ্যুৎ তখন রূপকথা। সে কথা কতকালের।
এখন গল্পই হয়ে গেছে প্রায়। তখন পারুলপুর ছিল আদর্শ শরৎচন্দ্রীয় বা
বিভূতিভূষণীয় গ্রাম। গ্রামে চন্ডীমন্ডপের মজলিশ ছিল। বাড়িতে বাড়িতে মেয়েদের
বৈকালিক আড্ডা ছিল। গল্প ছিল, নির্জনতা ছিল।
কিশোর
ট্রেকার থেকে নেমে ছোটোপিসিমণির বাড়ির রাস্তায় যেতে যেতে দেখল, বদলে গেছে
অনেককিছুই। মাটির দোতলাগুলো পাকা হয়ে গেছে। ধূসর পাউডারের মতো রাস্তাটা এখন
সিমেন্ট ঢালাই। বর্ষায় কাদা হবার জো নেই। ফলে প্রচুর বাইক হয়েছে গাঁয়ে।
এখানে সেখানে, গাছের তলায় মাচার উপর বসে ছেলেরা মোবাইল ঘাঁটছে।
এরই
মধ্যে সে দেখল দাঁত বের করা, ক্ষয়া শিবমন্দিরের গায়ে বুনো কলমিলতা উঠে
গেছে চূড়া অবধি। ডাল আলো হয়ে আছে ফুলে। বাঁশবাগানের ভেতর সূর্য ঠিকরোচ্ছে,
বাঁশের গা বেয়ে গড়িয়ে নামছে শিশিরের ঘাম। লাল সর ভাসা পুকুরের জলে ধোঁয়া
উঠছে অল্প অল্প, চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে বুড়ো বাঁশপাতা। তেঁতুলগাছের ঘন ছায়ার
তলা দিয়ে যেতে যেতে কিশোর বুঝল এরাই এখনো একটু আধটু রয়ে গেছে, শুধু
মানুষগুলো নেই। ময়রার দোকানে সকালবেলাতেই রসগোল্লা পাকানো হচ্ছিল। সে
দাঁড়ালো নেবার জন্য।
রাঢ়বাংলার
গ্রামে কালীপুজোতেই বেশী ধুম। দুর্গাপুজোয় তত নয়। প্রত্যেক বাড়িতে
আত্মীয়স্বজন। দুদিনের জন্য গ্রাম গমগম করে খুব। হৈ হট্টগোল হয়। এ ওর বাড়ি
আসে সে তার বাড়ি যায়। কিশোর সেই পুরোনো আস্বাদ পেল না এবার। সবাই নিজেকে
নিয়েই, নিজের আত্মীয় নিয়েই ব্যস্ত। সে আসলে পড়ে আছে কুড়ি বছর আগের
পারুলপুরে। যেখানে গ্রামে তাদের গরুরগাড়ি ঢোকামাত্রই ছোটোখাটো কৌতুহলী ভিড়
বাড়তে বাড়তে জমে উঠত ছোটোপিসিমণির উঠোন। তারা কলকাতা থেকে এসেছে। নিস্তরঙ্গ
গ্রামজীবনে এ এক ছোটোখাটো তামাশা, বিস্ময়।
ছোটোপিসিমণির
সেই দেওয়ালটাও তো আর নেই। পিসিমণির সঙ্গেই যেন সেই অপূর্ব খড়িমাটির
কারুকাজসমৃদ্ধ দেওয়ালটা মিলিয়ে গেছে অনন্তে। এখন দেওয়ালটা ইটের। তাতে
এ্যাক্রেলিক রঙের পোঁচ। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল দেওয়ালে টানানো পিসিমণির
হাতের কাজ। সুতো দিয়ে সেলাই করে আঁকা টিয়াপাখির তলায় লেখা, গাও পাখি গাও
গান সদা বল ভগবান। না, সেটাও নেই আজ।
গ্রামে একটা
অদ্ভুত নিস্তব্ধতা আছে। শহুরে কান তা সহ্য করতে পারে না। কানের গভীরে গিয়ে
তার চাপ পড়ে। তালা ধরে যায়। এবার সেই নিস্তব্ধতা টের পেলনা কিশোর। বাইকের
সমারোহ, ডিজের উন্মাদন সেসব কেড়ে নিয়ে কোথায় চালান করে দিয়েছে।
সে
ভাবল শ্মশানে যাবে। ষষ্টিসাধু নেই, তবু একবার ঘুরে আসবে। এখানে একা একা আর
ভালো লাগছে না। গোটা গ্রামটাই কবে যেন তার অপরিচিত হয়ে গেছে। আর কিছুতেই
তাকে চিনতে চায় না।
বিকেল হতেই সে বেরিয়ে পড়ল।
বাউরিপাড়ার কালীরমন্দির পেরিয়ে চলে এলো শ্মশানে। এখানে কালীপুজো হয়
চৈত্রে,কার্তিকী অমাবশ্যায় নয়। ফলে এদিকে ততটা হট্টগোল নেই। কিন্তু
শ্মাশানে এসে তার একদন্ড দাঁড়াতে ইচ্ছে হল না। বৈদ্যুতিন সমারোহে গ্রামীণ
অজ শ্মশানটাও বদলে গেছে। শ্মশানকালীর ভাঙা ভয়াল শিমূল, তেঁতুল, বটের অরণ্যে
ছাওয়া মন্দিরটা ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেছে কোথাও। এই শ্মশানে বসে একদিন
সে অনেক রাত কাটিয়েছে। দেখেছে আকাশের নক্ষত্র সমাবেশ। পিশাচসাধক ষষ্টি,
নিরঞ্জন মাস্টার, ভঞ্জ বাউলদের সঙ্গে লোক অলোকের গল্প করেছে। সেসব নেই,
কোথাও নেই। একবিন্দু স্মৃতিও পড়ে নেই এখানে। সিমেন্টের চাতাল মুছে ফেলেছে
সবকিছু।
রাত্রি নেমে গেছে।
ভূতচতুর্দশীর ঘোর এই রাত্রির স্পর্শ সে কিছুতেই পাচ্ছে না এখানে। ফিরে এলো
সে। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে যাত্রার। গ্রামের আ্যামেচার পার্টি সামাজিক পালা
নামাবে। তার বিবরণ দিচ্ছে কেউ। পিসেমশাই যাত্রা করতেন। কিশোররা আসলে খুশি
হতেন খুব। কথায় কথায় বলতেন, যাত্রা দেখতে যেও যেন বাবা। এবার দারুণ পালা,
খুব জমবে। আমিও একটা পার্টে আছি। কিশোর ভাইয়ের ঘরের আয়নার দিকে তাকালো। তার
জুলপির কয়েকটা সাদা চুল নিয়ন আলোতেও ভেসে রয়েছে।
যাত্রা
দেখতে দেখতে তার মাথা ধরে গেল। সে উঠে এলো চুপিচুপি। যাত্রা দেখতে আসার
আগে ছেলেবেলার বন্ধু অরূপের সঙ্গে আচমকা দেখা হয়ে গেছিল রাস্তায়।
রাধাগোবিন্দতলায় বসে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করেছিল কিশোর। বেশ ভালো লাগছিল।
কিন্তু রাত হতেই অরূপ হয়ত তরল হাতছানিতে ভেসে পড়েছে কোথাও। এখন তাকে আর
পাওয়া যাবে না।
রাত কত হবে
এখন? মোবাইলটাও ফেলে এসেছে ঘরে। নিস্তব্ধ গ্রাম। আকাশে ফটফট করছে
জ্যোৎস্না। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে তবে? সে জেলেপাড়ার ডাকাতকালীর মন্দির পেরিয়ে
নতুনডাঙার রাস্তার দিকে চলে এলো। সুন্দরীপুকুরের উঁচু পাড় ঘেঁষে রাস্তাটা
চলে গেছে অনেকদূর। এই রাস্তাটায় বড় একটা লোক চলে না আজও। দুপারে বিস্তীর্ণ
ধানকাটা মাঠ হু হু করছে। ঝিরিঝিরি হিম ঝুলছে মাঠের উপর। পুকুরের বাঁধের শেষ
দিকে মড়ার মাথার মত ফনিমনসার ডাল ঘাড় বেঁকিয়ে রহস্য বাড়িয়ে তুলেছে। কিশোর
এগিয়ে গেল আরো। কালভার্ট পেরোলেই মতি নদীর বাঁক। দূর থেকে দৈতাকার কাশের
মাথাগুলো দেখতে পেল কিশোর। চাঁদের আলোয় মনে হচ্ছিল সেগুলো যেন অগুনতি
ডাইনির মাথা।
আচমকা কালভার্টের পাশে জারুলগাছের
আড়ালে থমকে দাঁড়ালো সে। তার হাত পা আর নড়ল না। সে দেখল কারা যেন একটি
মেয়েকে, মেয়ে ঠিক নয়, একটি বউকে জোর করে ধরে টানতে টানতে নদীর পাড়ের সেই
কাশবনে ঢুকে যাচ্ছে। তার আলুলায়িত শাড়ি কালো নিশানের মতো হাওয়ায় উড়ছে।
সে
কী করবে এখন, ছুটে যাবে, চিৎকার করে ডাকবে কাউকে? ভাবতে ভাবতে সে মাঠের
মধ্যে নেমে পড়ল। সদ্য কাটা ধানের নাড়া তার পায়ে খোঁচা দিল সজোরে। সে সম্বিত
ফিরে পেয়ে দূরে তাকাল আবার। নাহ, কই কিছু তো নেই, কেউ নেই। কী দেখল সে?
দূরে
হিমের অন্ধকারে ধূসর জ্যোৎস্নায় কীসব যেন দপদপ করে জ্বলছিল। কিশোর ভয় পেল।
মনে পড়ল সেই কবে একবার এই পথে রাত্তিরবেলায় ষষ্টিসাধুর সঙ্গে ফিরেছিল সে
সাইকেলে। গাঁজার নেশায় চুর ষষ্টি তাকে বলেছিল, জোরে চালাও ভাইপো, এই
রাস্তায় শিয়ালের বড় উৎপাত। এই বড় বাঘের মত সব শিয়াল, মানুষ ছিঁড়ে খেয়ে নেয়।
সে
যেন শুনল, এই রহস্যময় মাঠ তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ঠিক যেন কোনো প্রেতের
অট্টহাসি। সে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে, আছাড় খেতে খেতে, জামায় কাপড়ে কাদামাটি
লাগিয়ে ফিরে এলো। ঘরে এসে দেখল তার জামা ভিজে সপসপ করছে ঘামে আর হিমে।
পিসিমণির ছোটো ছেলে সন্দীপ বলল, কোথায় গিয়েছিলে দাদা? আমরা তো চিন্তায় পড়ে
গিয়েছিলাম।
পরদিন অরূপ
আবার এলো। একসঙ্গে আলুভাজা আর মাখা সন্দেশ সহযোগে মুড়ি খেল দুজনে। কিশোর
আজই ফিরে যাবে শুনে সারাক্ষণ আর নড়ল না অরূপ। পুরোনো দিনের গল্প করল ওরা।
এমনই এক কালিপুজোর রাতে কালিপটকা ফাটাতে গিয়ে বাঁশের লাঠি ফেটে সুমন্তর
তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের মাঝখান চিরে গিয়ে সেই যেবার রক্তারক্তি হল আর
গ্রামের নিরঞ্জন ডাক্তার ঘ্যাঁচাঘ্যাঁচ সূচ ফুঁড়িয়ে সেলাই করে দিল, সেসব
গল্প করল তারা। তারপর হাজরাদের ছেলেদের হাত থেকে কিশোর বাউল তোতনকে তারা
কেমনকরে বাঁচিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল, সেসব গল্পও ভেসে উঠল তাদের আড্ডায়।
সুমন্ত, তোতন এখন গ্রামে থাকে না। তাদের সঙ্গে দেখা হলে ভালো লাগত কিশোরের।
কিশোর আচমকা অরূপকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা গতকাল রাতে গ্রামে কিছু ঘটেছে?
অরূপ বলল, কই না তো! কী ঘটবে?
না, আসলে কেমন যেন মনে হল। সত্যিই কিছু ঘটেনি?
না, কিছুই ঘটেনি। কেন, তুই কি কিছু শুনেছিস?
না তেমনকিছু নয়। কেমন যেন একটা হৈচৈ শুনলাম।
ও। ওসব যাত্রা দেখে ফেরা লোকজনের চেঁচামেচি। গ্রামে কিছু ঘটলে তা হাওয়ার বেগে ছড়িয়ে যায়। চাপা থাকে না।
কিশোর ভাবছিল, সে তবে কী দেখল গতরাতে। ভুল? না, কিছুতেই নয়। সে খুব স্পষ্ট দেখেছে। খুব স্পষ্ট।
--তবে
গতবছর একটা ঘটনা ঘটেছিল। এমনই কালীপুজোর রাত ছিল সেটা। যাত্রা হচ্ছিল।
সবাই তখন যাত্রামাঠে পালা দেখতে ব্যস্ত। তখন বাউড়ি পাড়ার লক্ষণ বাউড়ির বউকে
কারা তুলে নিয়ে যায়। তারপর রেপ করে ভাসিয়ে দেয় মতির জলে।
গতবছর?
হ্যাঁ, গতবছর। তারা এখনো ধরা পড়েনি। তারা পাওয়ারের লোক, বুঝতেই পারছিস।
কিশোর বুঝতে পারছিল তার শরীরে কার্তিকের হিম গড়িয়ে নামছে।