০১.
বার্মার রাজধানী থেকে প্রায় নব্বই কিলোমিটার
ক্ষিণে সমুদ্র সৈকতের একটি অত্যাধুনিক Resort
. রাত্রি প্রায় ড়েটারও কিছু পরে একটি Private Car -এসে থামলো Resort -টির সামনে। খুব দ্রুত কারটি থেকে একজন তরুণ এবং একজন তরুণী নেমে এসে লিফ্টে উঠে সোজা
চলে গেলো 4th
Floor
-এর একটি কক্ষের সামনে। কড়া নাড়তেই কক্ষের
দরোজাটি খুলে গেলো এবং ওরা’জন প্রবেশ করলো কক্ষটিতে। ভেতরে যারা ছিলো ওরা
জানতো এতো রাতে কারা এসে রোজায় Knock
- করবে ওই কক্ষটির দরোজায়। Schedule
-করাই ছিলো। আর সে কারণেই দরোজাটি খুলে দিতে মোটেই সময় লাগলো না। ওরে আসবার অপেক্ষাতেই
যেন ছিলো কক্ষটির ভেতরের লোকগুলি। ভেতর থেকে একজন এসে রোজাটি খুলে দিতেই তড়িৎ গতিতে ভেতরে প্রবেশ
করলো ওরা’জন। সঙ্গে সঙ্গে রোজাটি আবার বন্ধ করে দিলো লোকটিযে লোকটি এসে দরোজাটি খুলে দিয়েছিলো। কক্ষটিতে এতক্ষণ আলো
ছিলো না। সবগুলি ইঁষন-এর Switch-B Off
-করা ছিলো। ওরা প্রবেশ করবার পর এখন শুধুমাত্র উরস ইঁষন-টির Switch
-টি-ই অন করা হলো। স্বাভবিকভাবেই অনেকক্ষণ অন্ধকারে থাকবার পর সামান্য আলোতেই কক্ষটিকে
এখন অনেকটাই উজ্জ্বল বলে মনে হলো। এবং এ মুহূর্তে সেটি-ই ছিলো সবার কাছে কাক্সিক্ষত। কারণ ওরে আসবার অপেক্ষাতেই
কক্ষটিকে ইচ্ছে করেই ওরা আলোহীন করে রেখেছিলো। একই সাথে ভেতর থেকে করে রেখেছিলো Locked.. যাতে বাইরে থেকে কিছুতেই আঁচ করা না যায় যে, ওই কক্ষটিতে কেউ অবস্থান করছে।
কক্ষটিতে একটি ামী খাট, খাটে উন্নত মানের বেডশিটে ঢাকা পরিপাটি করে সজ্জিত বিছানা,
সোফা সেট, বেড টেবিল,
য়োলে লাগানো চল্লিশ ইঞ্চি মাপের বিশাল Display Screen -এর TV Set, Wardrob, লেখার টেবিলের পাশের
আর একটি ছোটো টেবিলে টেলিফোন সেট, টেলিফোন সেটের পাশে
একটি Laptop.. Laptop. -টির পাশেই আর একটি ছোটো কক্ষের রোজা। দরোজার ভেতরের আর একটি ছোট্ট কক্ষে ড্রেসিং
টেবিলসহ ড্রেসিংয়ের অন্যান্য আয়োাজন, এ্যাটাচ্ড বাথরুমÑসব মিলিয়ে একটি অত্যাধুনিক রিসোর্টের একটি অভিজাত শয়নকক্ষ যে
ধরনের হওয়া উচিত ঠিক সেভাবেই সজ্জিত করা। যেু’জন কক্ষটিতে প্রবেশ
করলো তাদের একজন উ মিন্ট্ এবং অন্যজন ওর স্ত্রী লিউ সান লিউ। লিউ সান লিউ একজন আইনজীবীÑ তরুণী । বয়স ত্রিশোর্ধ্ব। ও বার্মিজ বুদ্ধ। ওদের রাজনৈতিক লের আইন সংক্রান্ত বিষয়গুলি খোশুনা করবার জন্যে
যে ‘Advocacy Pannel’ - রয়েছে লিউ সান সে Pannel -এর একজন সদস্য। ওদের রাজনৈতিক লটির নামÑ‘National Movement
for Democratic Burma
.’ সংক্ষেপেএনএমডিবি। বাংলায় যার অর্থাঁড়ায় ‘গণতান্ত্রিক বার্মার জন্যে জাতীয় আন্দোলন।’ এটি একটি রাজনৈতিক
ল তবে Undergrounded
.দীঘ দিন থেকে অত্যন্ত
গোপনে এ লটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছে উ মিন্ট্। উ মিন্টের আগে পঞ্চাশোর্ধ আর একজন ব্যক্তিলটির নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি একটি Military Operation -এ নিহত হলে তারদ্বা
য়িত্বটি উ মিন্টের কাঁধে এসে বর্তায়। সেই থেকে সামরিক জান্তার কবল-মুক্ত করে বার্মাকে
একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করবার লক্ষ্যে টহফবৎ মৎড়ঁহফ-এ থেকে যথেষ্ট সতর্কতার
সাথে আন্দোলন চালিয়ে আসছে ওই
রাজনৈতিক লটি। লটির একটি Military Wing -ও রয়েছেযা দৃশ্যমান
নয়।দলটি। দলটির একটি Military Wing -ও রয়েছেযা দৃশ্যমান নয়। সাধারণ মানুষজনকে ঐক্যবদ্ধ করে বার্মার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে একটি চূড়ান্ত আঘাত
হানবার সকল প্রস্তুতিই প্রায় সম্পন্ন করে এনেছে ওরা। সামরিক বাহিনীর তরুণ এবং উদারপন্থী একটি অংশের
সমর্থনও পেয়েছে ওরা। যদিও সেটি খুব একটি বড় বিষয় নয় তবুও তাদের সমর্থনটি সরকারী বাহিনীর ভারসাম্যতে
যে বিঘেœর সৃষ্টি করবে সেটিকে কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে
পারবে না ওদের সেনা-প্রশাসন। আর এটি রাজনৈতিক দলটির জন্যে হয়ে উঠতে পারে একটি ইতিবাচক অর্জনের
জন্যে একটি অতিরিক্ত Plus Point. তবে গোটা আন্দোলনে
জনগণের কথাই শেষ কথা। এর বাইরে কিছু নেই। যদি সেনা সদস্যদের ওই অংশটি কোনো ভূমিকা পালন না-ও করে তথাপি গণমানুষের ভূমিকাটিই
ওদের কাছে মৌলিক এবং সর্বোচ্চ শক্তিশালী Nuclear Weapon. কারণ দেশের আনাচে, কানাচে, শহরে, বন্দরে, গ্রামে গঞ্জে সবখানেই ছড়িয়ে রয়েছে ওদের দলের শাখা প্রশাখাÑ
যেসব শাখা প্রশাখাগুলি সেসব এলাকার জনগণের সাথে খুবই ঘনিষ্টভাবে
সম্পৃক্ত।
আজকের আলোচনায় যে ক’জনকে ডাকা হয়েছিলো তাদের সবাই এসেছে। মোট দশ জন। দু’জন বার্মিজ সামরিক বাহিনীর সদস্য। বার্মার এক একটি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল থেকে ওরা এসেছেÑ যে অঞ্চলের ওরা প্রতিনিধিত্ব করে। ওরা ওদের এ রাজনতিক দলটির প্রতি পুরোপুরি বিশ্বস্ত এবং নিবেদিত। উ মিন্ট্ ভেতরে প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গে তারা সবাই উঠে দাঁড়লো। উ মিন্ট্ ওদেরকে বসতে বলে আলোচনা শুরু করলো ‘আমাদের হাতে সময় খুবই সীমিত। শুধু সীমিতই নয় চরমভাবে সঙ্কটপূর্ণ। এই মূহূর্ত থেকে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে অতি সাবধানী, অতি বিচক্ষণ। কোনোভাবেই আমাদের একটি পদক্ষেপও ভুলভাবে নেয়া যাবে নাÑসবার আগে এখন থেকে এ কথাটিই আমাদের প্রত্যেকের মাথায় অগ্রাধিকারের পর্যাযে রাখতে হবে। যাক, তোমাদেরকে যে সব দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলোÑ করা হয়েছে তো যেভাবে বলা হয়েছিলো?’Ñ আগেই বলা হয়েছে কক্ষটিতে সর্বমোট ওরা ছিলো দশজন। দশজনের মধ্যে দু’জন ছিলো বার্মিজ আর্মির ক্যাপটেন র্যাংকের। ওরা কোনো কথা বলছিলো না। তাছাড়া ওদেরকে ওই পরিবেশে যে কোনো কারণেই হোক কোন প্রশ্নও করতে চাইছিলো না উ মিন্ট্। ওরা শুধু শুনে যাচ্ছিলো। অন্যদের মধ্যে থেকে একজন উ মিন্ট্রে প্রশ্নের উত্তর দিলোÑ ‘আপনার নির্দেশ অনুযায়ী সবকিছুই সম্পন্ন করা হয়েছে স্যার। আমরা কোথাও কোনো ত্রুটি রাখি নি।’Ñ আর একজন সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললোÑ ‘ Mobilization’- যত নিবিড়ভাবে করা প্রযোজন তা আমরা সঠিকভাবেই করে যাচ্ছি। সাধারণ মানুষের সমর্থনও আমরা পেয়ে যাচ্ছি স্বতঃস্ফূর্ত এবং কুণ্ঠাহীন ভাবে। সামরিক জান্তার নির্মম নির্যাতন কোনো রোহিঙ্গা মুসলিম তো নয়ই বরং কোনো সাধারণ বৌদ্ধও মেনে নিতে পারছে না। তারাই আমাদেরকে চাপ দিচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব কিছু একটা করে তাদেরকে নির্যাতনের কবল থেকে রক্ষা করতে। কখন যে কার মাথার ওপর খড়গ নেমে আসবেÑ এ আতঙ্কেই তারা রাতে ঘুমোতে পর্যন্ত পারছে না। আমাদেরকে একটা না একটা কিছু করতেই হবে স্যার। আপনি আমাদেরকে শুধু নির্দেশ দিন।’Ñ কথা শেষ করলো দি¦তীয় ব্যক্তি।
‘যে পোস্টার এবং লিফলেটগুলি আনতে বলা হয়েছিলো সেগুলি আনা হয়েছে?Ñ প্রশ্ন করলো উ মিন্ট্।
‘হ্যাঁ স্যার, সবই আনা হয়েছে এবং সেগুলি অন্য আর একটি কক্ষে রাখা আছে। আপনার নির্দেশ পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’Ñ উত্তর দিলো প্রথম ব্যক্তি।
‘ঠিক আছে, এবার তোমরা যাও। প্রয়োজন অনুযায়ী তোমরা সেগুলি তোমাদের আট জনের মধ্যে শেয়ার করে নাও। আগামী পরশু সূর্য ওঠার আগেই যতগুলি পোস্টার প্রয়োজন ততগুলি দিয়ে গোটা নেপিডোকে ঢেকে দিতে হবে। আর আগামীকাল অত্যন্ত গোপনীয়তা মেইনটেইন করে যত বেশী সংখ্যক সম্ভব সাধারণ মানুষের মাঝে লিফলেটগুলি Distribute -করবে। যেভাবে এর আগেও করা হয়েছে। মনে রাখবে আগামী পরশুর পরদিনটিই আমাদেরÑ ‘ The 13th October.’ ওই দিনই সারা বার্মায় পরিকল্পিত বিস্ফোরণটি ঘটবে। আজকের রাত ভোর হবার আগেই আমি এবং লিউ সান যে গাড়ীটিতে এসেছি সেটি নিয়ে তোমরা চলে যাবে। ড্রাইভারকে সেভাবেই বলা আছে। এখন তোমরা এসো।’Ñ ওরা আটজন এক এক করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলো। ওরা বেরিয়ে যাবার পর উ মিন্ট্ কথা বলতে শুরু করলো সেনা সদস্য দু’জনের সঙ্গে। তবে খুবই নীচু কণ্ঠে এবং সতর্কতার সঙ্গে। প্রথমেই উ মিন্ট্ প্রশ্ন করলো ওদেরকেÑ‘তোমাদের পজিশন বলো। গোটা দেশের রাজনৈতিক অবস্থা তো তোমরা বুঝতেই পারছ। আজকের আলোচনাতেও নিশ্চয়ই তোমরা বুঝতে পেরেছÑ আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। আমাদের পেছনে ফিরে যাবার আর কোনও পথ খোলা নেইÑ একমাত্র সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া। আমরা চাই আগামী পরশুর পর দিনের অর্থাৎ থারটিন্থ অক্টোবরের গণবিস্ফোরণটি শতভাগ সফল হোক এবং জাতীয় লজ্জাÑ এই ‘Ethnic Cleansing’-টি চিরদিনের মতো বন্ধ হোক এবং এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই বার্মায় একটি শক্তিশালী সক্ষম গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিষ্ঠা হোক। আর যে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত একটি সার্বভৌম জাতীয় সংসদ। বিস্ফোরণের তারিখটি ‘13th’.Ñঅনেকেই এ তারিখটিকে বলে থাকেন Unlucky Thirteenth. আমরা ওই Unlucky-শব্দটিকে ‘lucky’-তে রূপান্তরিত করতে চাই। হ্যাঁ, এবার তোমরা বলো।’Ñ থেমে গিয়ে অনেকটাই যেন গম্ভীর হয়ে গেলো উ মিন্ট্। তাকাতে থাকলো ওদের মুখের দিকে। এবং ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকলো ওর মুখোম-লের আকৃতি। দু’গালের দু’টি চোয়াল শক্ত থেকে শক্ততর হয়ে অনেকটাই ফুলে উঠলো। বোঝা গেলো দাঁতে দাঁত চাপবার ফলেই এ রকমটি হবার কারণ। চোখ দু’টিও রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। কপালেও মোটা দাগের কয়েকটি ভাঁজের রেখা ফুটে উঠলো। এ সব ঘটে গেলো কয়েক নিমেষের মধ্যেই। বুঝতে পারলো সেনা সদস্য দু’জনÑ উ মিন্ট্ প্রচ-ভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। উ মিন্টের এ রকম অভিব্যক্তি লক্ষ করে কথা বললো প্রথম সেনা সদস্যটিÑ ‘স্যার, আমরা অনেক আগে থেকেই Time to Time - আপনাকে আমাদেরঅবস্থানের কথা জানিয়ে আসছি। এই Ethnic Cleansing -এর বিষয়টি নিয়ে আমাদের সিনিয়র এবং Junior Officer -দের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম বিভাজন রেখাÑযেটি অনেক দিন আগে থেকেই ছিলো সেটি এখন মোটামুটি একটি স্থুলাকৃতি নিয়ে দৃশ্যমানতায় চলে এসেছে। Junior Officer -দের মধ্যে নগণ্য কিছু সংখ্যক অফিসার ছাড়া অধিকাংশ অফিসারই Senior -দের সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তটি মেনে নিতে পারছে না। সার্বিক অবস্থা বুঝে জনগণের স্বার্থে প্রয়োজনে তারা Senior -দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবার প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছে। তবে এটির পুরোটিই নির্ভর করবে আপনাদের সম্ভাব্য রাজনৈতিক কর্মসূচীটির সফলতার ওপর। কিন্তু কোনোভাবেই এ প্রস্তুতিটিকে দীর্ঘায়িত করা যাবে না।’Ñ কথা শেষ করলো প্রথম সেনা সদস্যটি। ওর কথা শেষ হবার পর দ্বিতীয় সদস্য বলতে শুরু করলোÑ ‘স্যার, আমাদের মনে হয় এটি-ই সঠিক সময় আঘাত করবার। আর সে লক্ষ্য অর্জনে আগামী ‘The 13th October-এর জনবিস্ফোরণের কর্মসূচিটিকে যেকোনো মূল্যে সফল করে তুলতে হবে। সফল হবার সঙ্গে সঙ্গেই সেনা ছাউনিতেও বিপ্লবটি ঘটে যাবে। আর একটি কথাÑ আমরা যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে আমাদের স্থির বিশ্বাসÑ যে ক’জন জুনিয়র অফিসার সিনিয়রদের অনুগত বলে আমরা ধরে নিয়েছি তারা শেষ পর্যন্ত সঠিক সময়টিতে এসে আমাদের সমর্থন না করলেও একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকবে। সরাসরি আমাদের বিরুদ্ধে Rifle -তাঁক করবার পর্যায় পর্যন্ত ওরা পৌঁছুতে পারবে নাÑ যা আমরা ওদের কথাবার্তার ভেতরে থাকা ইঙ্গিত থেকেই স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি নিশ্চিতভাবে শুধু এ কারণে যে, আমরা ওদের ইঙ্গিতগুলিকে সামরিক বিধি বিধানের আলোকে বহুমাত্রিক Multi-Angled -দৃষ্টি থেকে নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করে ওই ইঙ্গিতের ভেতরেরPsyche -টিকে পুরোপুরি আত্মস্থ করে নিয়েছি।’Ñ কথা শেষ করে ও তাকালো প্রথম সেনা সদস্যটির দিকে। মোটেই সময় ক্ষেপণ না করে প্রথম ব্যক্তিটি উ মিন্ট্কে উদ্দেশ্য করে বললোÑ ‘সবকিছুর পরেও সামরিক বাহিনীতে তাৎক্ষণিক কৌশলগত দিক বলে একটি কথা আছেÑ যে দিকটি সরাসরি যুদ্ধের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আর সে বিবেচনায় আমরা Positive position -এ থাকলেও আমাদেরকে কৌশলগত কারণেই Negative- দিকটিকে সামনে রেখেই এগুতে হবে। যদিও এটি সামরিক কোনও যুদ্ধ নয় তথাপি বিষয়টিকে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।’
‘Sure and Certain’. এখানেই আমাদের Intellectuality -এর কৌশল প্রয়োগ করতে হবে।’Ñকথা বললো উ মিন্ট্। এটুকু বলার পর আর কিছু বললো না উ মিন্ট্। কিছুক্ষণের জন্যে তিনজনই নীরব হয়ে গেলো। যার যার দিক থেকে ওরা গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে গেলো বুঝিবা। কতটি সময় কেটে গেলো বুঝতে পারলো না ওরা তিনজন। হঠাৎ কথা বলে উঠলো উ মিন্ট্Ñ ‘শোনো, তোমাদের নৈতিক বোধের Division -টি Hundred Percent- না হলেও যেটুকু হয়েছে সেটুকুকেই Hundred Percent - ধরে নিয়ে তোমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। 13th October - আমাদের বিস্ফোরণ ঘটবেই। আমি নিশ্চিত। জনগণ এ চূড়ান্ত আঘাতটি হানবার জন্যে সর্বোতভাবে প্রস্তুত। সে GreenSignal -টি আমি ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছি। সঠিক সময়টিতে তোমরা তোমাদের দায়িত্ব পালন করবেÑ জীবন দিয়ে হলেও। কারণ মনে রাখতে হবে আমাদের লক্ষ্য একটিইÑ বার্মার সার্বিক জনগণের নিঃশর্ত মুক্তি। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের চাওয়া পাওয়ার এখানে কিছুই নেই। এবার তোমরা এসো। আর একটি কথাÑ সেনাবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে যে ‘মগ উপজাতিটি’র লোকেরা সারা বার্মা জুড়ে অব্যাহতভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে, মানুষের বাড়ীঘরে অগ্নিসংযোগ করে যে ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করেছে সেই লোকদেরকে যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করতে হবে। এই লোকগুলিই সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দক্ষিণ বাহু। এই দক্ষিণ বাহুকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে তোমাদের অন্যতম দায়িত্ব এবং কর্তব্য। এরাই বার্মিজ জাতিটিকে ধ্বংসের উপকণ্ঠে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এদেরকে মার্জনা করবার কোনো যুক্তিই নেই। কোনোভাবেই এদেরকে তোমরা ক্ষমা করবে না। এবার এসো।’Ñসামরিক নিয়মে উ মিন্ট্কে স্যালিউট করে ওরা দু’জন কক্ষ থেকে প্রস্থান করলো। কক্ষে থাকলো শুধু উ মিন্ট্ আর ওর স্ত্রী লিউ সান লিউ। পুরো আলোচনাটি শেষ করতে খুব বেশী সময় লাগলে না। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই আলোচনাটি শেষ হয়ে গেলো। উ মিন্ট্ আবার চিন্তা করতে শুরু করলোÑ ‘ এই মগরা সেনাবাহিনীকে উস্কে দিয়ে একদিক থেকে নিজেরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে আর একদিক থেকে সেনাবাহিনী ওদেরই কাছ থেকে সাহস ধার করে গোটা বার্মায় এথনিক ক্লিনজিং শুরু করেছে। এদেরকে অবশ্যই ক্ষমতা এবং ক্ষমতার আশপাশ থেকে উৎখাত করতে হবে। এটাই সিদ্ধান্ত।
উ মিন্ট্ এবং ওর স্ত্রী এক এক করে ওয়াসরুমে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। এর পর ফোন করে রিসেপশনকে দু’কাপ কফি পাঠিয়ে দিতে বললো। এর মধ্যে ওদের দু’জনের মধ্যে কোনো কথা হলো না। কিছুক্ষণ পর দু’কাপ কফি এনে টেবিলের ওপর রেখে উ মিন্ট্কে বললোÑ ‘স্যার, আপনাদের কফি।’-বলে প্রস্থান করলো। কফি পান শেষ করে ওরা দু’জনই বিছানায় শুয়ে পড়লো। বিছানায় কিছুক্ষণ নিশ্চুপ শুয়ে থাকবার পর উ মিন্ট্রে চুলে ডান হাতটি রেখে প্রথম কথা বললো লিউ সানÑ ‘আচ্ছা বলোতো মিন্ট্ আমাদের বিয়ে হবার কতদিন পর আমরা আজকের এই একই বিছানায় পাশাপাশি শোবার সুযোগ পেলাম? বিয়ে হবার পর আমরা তো ফুলশয্যার রাতটিও এক বিছানায় আজকের মতো শুয়ে কাটাতে পারিনি। একটি নব-দম্পতির কাছে এটি যে কত যন্ত্রণার তুমি কি ভেবে দেখেছ কখনও?’Ñকথাটি শেষ করে উ মিন্টের মাথার চুলের ভেতর থেকে ডান হাতটি সরিয়ে নিয়ে এবার রাখলো ওর বুকের ওপর। প্রশস্ত বুকের ওপর হাত বুলোতে বুলোতে আরও ঘনিষ্ঠ হলো লিউ সান উ মিন্টের। নিঃশ্বাস ভারী হতে থাকলো। গোটা মুখম-ল জুড়ে ফুটে উঠলো যেন অপূর্ব এক সোনালী আভা। এমনিতেই লিউ সানের শরীরের রং উজ্বল ফর্সা। তার ওপর এই মুহূর্তেরএকটি বিশেষ উত্তেজনা যেন সেই ফর্সা রংয়ের সাথে রক্তিমতার লালিমা মিশিয়ে দিয়ে অদ্ভুত এক মোহনীয় দুধে-আলতার রংয়ে রাঙ্গিয়ে দিলো ওর উন্মুখ কামনায় আকুল মুখশ্রীকে। এর মধ্যেই উ মিন্টের মাথাটিকে জড়িয়ে নিয়েছে লিউ সান ওর উন্নত বক্ষের সাথে। যুগল স্ফীত পেলব স্তনের মিহি স্পর্শ স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছে উ মিন্টের রক্ত-রাশিতে। যেন সমুদ্রের গভীর তলদেশ থেকে প্রচ- বেগে উত্থিত প্রবল ঝঞ্ঝার তোলপাড়ে উত্তপ্ত স্ফুলিঙ্গের মতো তাপদগ্ধ হয়ে উর্ধ্বমুখী হয়ে উঠছে ওর প্রতিটি রক্তকণা। কপালে ফুটে উঠছে মসৃণ ঘামের ফোটা ফোটা স্বেদবিন্দু। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে একটি মাত্র আকাক্সক্ষার জঙ্গমতা। কিছুতেই আর নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না উ মিন্ট্ সে আকাক্সক্ষার জঙ্গমতাটিকে। আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে এক সময় নিজেকে পুরোপুরি সমর্পন করলো উ মিন্ট্ লিউ সানের উদ্বেলিত শরীরি কামনার উতুঙ্গ উন্মাদনার কাছে। মিশে গেলো দু’জন দু’জনের অতলান্তিক ভালোলাগায়। ধীরে ধীরে ‘মেঘমল্লার’-রাগে ধ্বনিত বীনার উন্মাদ সুরের ছন্দ বেয়ে নেমে এলো ওদের দু’জনের মাঝে মৃদুমন্দ হাওয়ার পাল্কিতে চড়ে শ্রাবণের মসৃণ বারিধারা। সিক্ত হলো দু’জনই সে শ্রাবণ- বারিতে অবগাহন করে। শান্ত হয়ে এলো দু’টি নারী পুরুষের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আকাক্সক্ষার মেলা। ঝঞ্ঝা শেষে পুনরায় মিলে গেলো দু’জনের দু’জোড়া ঠোঁট এক পবিত্র ভালোলাগার নিঃসীম তৃপ্ততায়। পুনরায় পরপর দু’জন ওয়াসরুমে গিয়ে ফিরে এলো একেবারে র্ঝঝরে হয়ে। আসলে সদ্য ¯œাত বয়স্ক নারীদেরকেও ভেজা চুলে কেমন যেন একটি পৃথক লাবণ্য এনে দেয়। আর লিউ সান তো রীতিমত তরুণীÑ ভেজা চুলে ওর লাবণ্যটি যেন একটু বেশী মাত্রাতেই ফুটিত। অভিভূত হয়ে অবাক বিস্ময়ে কিছু সময় তাকিয়ে থাকে উ মিন্ট্ লিউ সানের দিকে। বিশ্বাসই করতে চায় না এ মুহূর্তের এই লিউ সানই ওর স্ত্রী। উ মিন্টের চোখের দিকে তাকিয়ে বিষয়টি বুঝে নেয় লিউ সান। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নেয় উ মিন্ট্ এবং লিউ সান দু’জনই নিজেদেরকে। কোনো কথা না বলে উ মিন্ট্ শুয়ে পড়ে বিছানায়। লিউ সানও ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে অনুসরণ করে উ মিন্ট্কে।
বিছানায় শুয়ে কিছু সময় নির্বাক থেকে খুবই স্বাভাবিকভাবে এবার কথা বলে লিউ সান। মুহূর্ত কয়েক আগে যা ঘটে গেছে তার এতটুকু চিহ্নমাত্রও যেন নেই ওর এই মুহূর্তের কথা বার্তায়। লিউ সান প্রশ্ন করে উ মিন্ট্কেÑ ‘আচ্ছা মিন্ট্ তুমি আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দেবে?’Ñ লিউ সান কিছুটা ঔৎসুক্য নিয়ে তাকায় উ মিন্টের দিকে।
‘কেন, আমি কি তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর কখনও দিই নি? নাকি আমার ওপর তোমার অস্থার মাপকাঠিটিকে সন্দেহের তীক্ষèধার ছুরি দিয়ে দ্বিখ-িত করবার দাগটি স্পষ্ট হতে শুরু করেছে এখন? কই, আগে তো এমন করে কখনও প্রশ্ন করো নি। বলো কী জানতে চাও?’
‘জানতে চাই, আমি বার্মিজ বৌদ্ধ জেনেও কেন তুমি আমাকে বিয়ে করলে? তুমি তো বৌদ্ধ নও।’Ñলিউ সানকে কথা শেষ করবার অবকাশ না দিয়েই বিপরীত প্রশ্ন করলো উ মিন্ট্Ñ ‘ তাহলে আমি কী?’
‘তুমি মুসলিম। যাদেরকে বলা হয়Ñ “রোহিঙ্গা মুসলিম”। তোমার মা’জি আমাকে সবকিছুই খুলে বলেছেন। তোমার তো আমাকে বিয়ে করবার কথা নয়।’
‘তাহলে তুমি এবার আমাকে একটি প্রশ্নের উত্তর দাওÑ সবকিছু জেনে শুনে তুমিই বা কেন আমার মতো একজন রোহিঙ্গা মুসলিমকে বিয়ে করলে? তোমার তো আমাকেও বিয়ে করবার কথা নয়।’
‘একদম ঠিক বলেছ। আসলেই তোমাকে আমার বিয়ে করবার কথাই ছিলো না। আমি ভাবিওনি কখনও। তারপরেও বিয়েটি হয়ে গেলো। কেন জানো?’
‘না বললে জানবার বিকল্প কোনও পদ্ধতি আছে কি?’Ñ উ মিন্টের প্রশ্নে এবার যেন একটু হেয়ালির প্রচ্ছায়া অনুভব করলো লিউ সান।
‘যে দিন তুমি আমাকে একটি রাজনৈতিক মামলা সম্পর্কে আলোচনার জন্যে ফোন করে তোমার বাড়ীতে আমাকে আসতে বললে সেদিন আমি তোমার বাড়ীতে না যাবারই ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। পরে অনেক কিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলামÑ যেহেতু রাজনৈতিক মামলা এবং তোমার মতো একজন অসাধারণ মানুষÑ যার সম্পর্কে আমি অনেকের মুখে অনেক কিছুই শুনেছিলাম কিন্তু তাকে দেখতে পাই নিÑ তিনিই আমাকে আহ্বান জানিয়েছেনÑ এটি যেমন একটি কারণ ঠিক তেমনি রাজনৈতিক মামলা সম্পর্কে আমার কৌতূহলও ছিলো প্রচুরÑ এ সব দিক বিবেচনা করেই আমি তোমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলাম। তোমার বাড়ীতে গিয়েছিলাম। তারপর তুমি যখন আমাকে তোমার মামলা সম্পর্কে ব্রিফ করছিলে তখনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম তুমি কত বড় মাপের মানুষ এবং কত উদার তোমার মানসিক প্রশস্ততার পরিধি। আমি মামলাটি গ্রহণ করেছিলাম এবং সফলও হয়েছিলাম। তোমাদের দলের তিনজন রাজনৈতিক কর্মীকে আমি আইনী প্রক্রিয়াতেই মুক্ত করতে সক্ষম হয়ে ছিলাম।’
‘তারপর?’Ñ উ মিন্টের প্রশ্ন।
‘তারপর তুমি আ-ারগ্রাউ-ে থাকলেও তোমার প্রয়োজনে যতই তোমার মুখোমুখি হবার সুযোগ পেয়েছি, যতই তোমাকে দেখেছি, তোমার সঙ্গে কথা বলেছি ততই আমি অভিভূত হয়েছি তোমার দেশপ্রেম, তোমার মানবিকতা প্রেম, দেশের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের প্রতি তোমার অপার ভালোবাসা, নিজের দেশকে, বার্মিজ জাতিকে সামরিক জান্তার হাত থেকে মুক্ত করবার অঙ্গীকারÑ এ সবকিছুই ধীরে ধৈির আমাকে তোমার প্রতি দুর্বলতার দিকে ধাবিত করতে শুরু করেছিলো। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে তোমকে আমার বিয়ে করবার অনেক কারণের মধ্যে এ সব কারণ বুঝি ছিলো সামান্য কিছু। আরও অনেক বড় বড় কারণ ছিলো। আর সে সব কারণেই তো শেষ পর্যন্ত তো বিয়েটি হয়েই গেলো। এখন আর কী প্রশ্ন করবে তুমি?’Ñ
‘না। আর কোনও প্রশ্ন করবো না। তুমি যে কারণগুলির কথা বললে সে সবের চাইতে আর কী বড় কারণ থাকতে পারে আমার জানা নেই। তবে আমি উত্তর দেবো। তোমাকেও আমি বিয়ে করেছিলাম ওই একটি মাত্র কারণেÑ যা জাতি, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ নির্বিশেষে দেশের মানুষের প্রতি তোমার অসীম মমত্ব বোধ। এ বিষয়টিই আমাকে প্রাণিত করেছিলো সবচাইতে বেশী। আমিও তোমাকে আগে কখনও দেখি নি। তবে শুনেছি ক্রিমিনাল মামলার ক্ষেত্রে তুমি খুবই সিরিয়াস। সে সূত্রেই তোমার সাথে আমার পরিচয়। অবশ্য সে পরিচয় এবং কর্ম প্রবাহের ধারাবাহিকতার মাঝখানে ভালোলাগার মতো একটি বিষয়ের যোগ চিহ্ন কখন যে সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো বুঝতে পারি নি। যখন বুঝেছি তখন তোমার অস্তিত্ব ছাড়া আমার উপলব্ধিতে আর কিছুই ছিলো না। এখন তো আমি আশা করতে পারিÑ আমাকে আর কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে হবেনা।’
‘না, এ সংক্রান্ত বিষয়ে আর তোমাকে কোনও উত্তর দিতে হবে না। তবে এবার আমি মূল প্রসঙ্গে আসতে চাই।’Ñ ইচ্ছে প্রকাশ করলো লিউ সান।
‘যেমন?’Ñ উ মিন্টের ছোট্ট প্রশ্ন। যদিও প্রশ্নটির উত্তর উ মিন্টের অজানা নয় তবুও প্রশ্নটি করলো লিউ সানকে। মূল প্রশ্ন বলতে লিউ সান ভিন্ন কোনো বিষয়ের অবতারণা করে কিনা শুধু এটি জানবার জন্যে। পূনরায় বললো উ মিন্ট্Ñ‘ঠিক আছে এবার বলো, তোমার প্রশ্নটি কী।’Ñ শুরু করলো লিউ সানÑ
‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছি। এই আন্দোলন করতে গিয়ে আমাদের অনেক নিবেদিত কর্মীকে কারা বরণ করতে হয়েছে। বর্ণনাহীন সামরিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অসংখ্য নেতা, নেত্রী, কর্মী করূণভাবে মৃত্যু বরণ করেছে। আমরা যদিও আইনের মাধ্যমে তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছি কিন্তু সব ক্ষেত্রে আমরা সফল হতে পারিনি। আমরাও পরপর তিনবার নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে অতি-অলৌকিকভাবে ফিরে এসেছি। অনেক সাধ্য সাধনা, নিরলস পরিশ্রম আর জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে আমরা এবারের আন্দোলনটিকে একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছি, সাধারণ মানুষকে শেষ আঘাতটি হানবার জন্যে প্রস্তুত করেছি। এখন যদি এতকিছু করবার পরেও কোনও কারণেআমাদের এ চূড়ান্ত আন্দোলনটিও ব্যর্থ হয়ে যায় তখন আমাদের করণীয় কী হবে?’Ñ লিউ সানের দীর্ঘ প্রশ্ন কিন্তু যথার্থ। কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে লিউ সানের প্রশ্নের উত্তরে উ মিন্ট্ বলেÑ
‘এই প্রশ্নটিতে তোমার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। তবুও আমি পড়াশুনার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন জন-আন্দোলনের সফলতা, ব্যর্থতার চরিত্র থেকে যা অর্জন করেছি সেই সব অর্জনের প্রেক্ষিত বিবেচনা করে আমি এ টুকুই শুধু বলতে পারিÑ আমাদের এ আন্দোলনটি যদি ব্যর্থও হয়ে যায় তবুও কিছুই হবে না। হয়তো কিছু মানুষের জীবন থাকবে না, আমাদের জীবনও হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তারপরেও আমাদের মধ্যে থেকেই গড়ে ওঠা নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে নতুন উদ্যম নিয়ে নবতর আঙ্গিকে আবার দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে আন্দোলন গড়ে উঠবে। যদি তাতেও আন্দোলন ব্যর্থ হয় অথবা নতুন নেতৃত্বও জীবন সঙ্কটে পতিত হয় তাহলে নতুন প্রজন্ম এসে সে আন্দোলনকে আবার ধারণ এবং বহন করবে। ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা এলেও ক্রমান্বয়িকভাবে গণ-আন্দোলন চলতেই থাকবে, কখনই নিঃশেষ হয়ে যাবে না। একটি কথা মনে রাখবেÑ জনগণের আন্দোলন কখনই ব্যর্থ হয় না। হয়তো সময় দীর্ঘ হতে পারে কিন্তু গণ-আন্দোলন ব্যর্থ হতে পারে না কারণ এটি জনগণের স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে বেঁচে থাকবার আন্দোলন। এবং সে কারণেই ব্যর্থ হয় না এবং হবে না। এটি ইতিহাস।’¬Ñ চিৎ হয়ে থাকা উ মিন্ট্ এবার পাশ ফিরে লিউ সানের একটি হাত নিজের হাতের মুঠোর ভেতরে নেয়। লিউ সানও পাশ ফিরে উ মিন্টের আর একটি হাত নিজের হাতের মুঠোর ভেতর নিয়ে ওর চোখের ওপর চোখ রেখে প্রশ্ন করেÑ ‘ আচ্ছা, ধরে নাও তোÑ এমন কি হতে পারে না?’
‘কেমন?’Ñ পাল্টা প্রশ্ন করে উ মিন্ট্ লিউ সানকে।
‘যেমন---------------------------------।’Ñ কথা বলতে বলতে কখন যে ওরা ঘুমিয়ে পড়েছেÑ জানে না ওদের দু’জনের কেউই।
০২.
একটি তরুণ। একটি চীনা অটো রাইফ্লের-এর গোড়া কাঁধে ঠেকিয়ে ডান হাত দিয়ে ট্রিগার টিপে অব্যাহতভাবে শুন্যের দিকে ফায়ার করেই চলেছে। বাম হাতে ধরা রয়েছে ওভার পাওয়ার্ড লেন্স সম্বৃদ্ধ একটি বাইনোকুলার, পরনে জিন্সের
প্যান্ট। প্যান্টের নীচের দিকের প্রান্ত দু’টি গুটিয়ে হ্টাুর নীচে পর্যন্ত তুলে দেয়া। পায়ে কাদা মাখা কেড্স। কারণ ওই সীমান্তের যে নির্দিষ্ট অঞ্চলটি তাকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে দেয়া হয়েছে সে এলাকাটিতে অবিরাম টহল দেবার কারণেই ওর কেড্স্ দু’টি কদর্মাক্ত। উর্দ্ধাঙ্গ শুন্যÑ কোনো জামা কাপড় নেই। অবস্থান- ওর দেশের একটি সীমান্তের কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা সীমানা প্রাচীরের মাত্র এক ফুট আগে। সীমানা প্রাচীরের ঠিক পরেই মায়ানমার এবং বাংলাদেশ সীমান্তের মাঝের এলাকাটি ‘No-Man’s LandÕ. তরুণটির দায়িত্বÑ মায়ানমার সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ওর নিয়ন্ত্রিত নির্দিষ্ট একটি এলাকার ভেতর দিয়ে যেন প্রতিবেশী দেশ থেকে কেউ প্রবেশ করতে না পারে। বিশেষ করে মায়ানমার থেকে উচ্ছেদকৃত মুসলিমদের কেউÑ সম্প্রদায়গতভাবে যাদেরকে রোহিঙ্গা মুসলিম বলে চিহ্নিত করা হয়। শুন্যের দিকে Fire -করবার উদ্দেশ্যÑ প্রতিবেশী দেশটির সীমান্ত রক্ষীদেরকে সতর্ক করে দেয়া- তারাও যেন কাউকে তাদের সীমান্ত দিয়ে ওর দেশের সীমান্তের দিকে Push-back করবার চেষ্টা না করে। নাগরিক হিসেবে তরুণটি মায়ানমারের, জাতিগতভাবে বার্মিজ, সম্প্রদায়গতভাবে রাখাইন বৌদ্ধ। সুঠাম দেহ, পেশীবহুল বাহু। মাথার চুল একেবারেই ছোট করে কাটা। স্ফীত বুক লোমশুন্য। শরীরের আকার অনুযায়ী চোখ দু’টি একেবারেই ছোটÑ দেহের সাথে বড় বেশী বেমানান। কোমরের পেছন দিকের Hip -এর ওপর প্যান্টের বেল্টের নীচে দিয়ে অতিরিক্ত দু’টি ChineseAuto Rifle -এর ম্যাগজিন সাঁটানো। চোখ দু’টি ছোটো হলেও দৃষ্টি তীক্ষœ এবং উজ্জ্বল। ওর চোখের দিকে তাকালেই সেটি স্পষ্ট বোঝা যায়। দেহ ভঙ্গিমার সাথে চোখের দৃষ্টি মেলালে উগ্রতার প্রকাশ প্রকট হয়ে ওঠে। কিন্তু এই উগ্রতাটি কিসের ইঙ্গিত বহন করে তা বোঝা যায় না।
শুন্যে কিছুক্ষণ অব্যাহত Fire -করবার পর কতকটা যেন ক্লান্ত হয়েই একটি বড় আকারের শিলা খ-ের ওপর অবসন্ন শরীর নিয়ে বসে পড়লো তরুণটি। প্যান্টের বেল্টের সাথে আটকানো ছোটো আকারের এটি চামড়ার বক্স থেকে সিগারেটের প্যাকেট এবং লাইটার বের করে একটি সিগরেট জ্বালিয়ে সেটি থেকে ধূমপান শুরু করলো তরুণটি। তরুণটির নামÑ ‘সোয়ে উ মিন্ট’। তরুণটির বয়স ত্রিশ থেকে বত্রিশের মধ্যে। উচ্চ শিক্ষিত। Social Science-G Masters -করেছে কয়েক বছর আগে। কাজ করতো একটি বিদেশী NGO -এর Social Management - বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে। বার্মিজ সেনাবাহিনী সেখান থেকেই ওকে Recruit -করেছিলো সেনাবাহিনীরÑ‘Social Development BrigadeÕ-এর একজন সদস্য মনোনীত করে। এ ধরণের আরও বেশ কিছু তরুণ শিক্ষক, সমাজ কর্মী এবং শিক্ষার্থীকে ওরা Recruit -করেছিলো ওই Brigade’-এর সদস্য হয়ে কাজ করবার জেেন্য। ওদের কাজটি ছিলো সারা দেশের গ্রাম-ভিত্তিক সমাজের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কী কী বিষয়ে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন সে সব বিষয়ে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গবেষণা-কেন্দ্রিক যথাযথ পরামর্শ সেনাবাহিনীকে প্রদান করা। এটি তাদের মূল কাজ হলেও এর অতিরিক্ত হিসেবে যে কাজ যখন তাদেরকে দেয়া হবে তা তারা সম্পন্ন করতে বাধ্য থাকবে। এই কাজের অংশ হিসেবেই সোয়ে উ মিন্ট্ এখন মায়ানমারের দূর্গম সীমান্ত অঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট এলাকার প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত। তার দায়িত্বের অধিভুক্ত কাজগুলির মধ্যে প্রধান যে কাজটি তা হলোÑ মায়ানমার থেকে উচ্ছেদকৃত যেসব রোহিঙ্গা মুসলিম প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলো তারা যেন কোনোক্রমেই মায়ানমারের সীমান্ত অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। মায়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি দেখামাত্রই যেন তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়।
দু’একবার ধূমপান করবার পর হঠাৎ থেমে গিয়ে কি যেন ভাবতে শুরু করলো তরতাজা তরুণ সোয়ে উ মিন্ট। এভাবে ভাবতে ভাবতে কিছু সময় কেটে যাবার পর লক্ষ করলো উ মিন্ট্Ñ ওর হাতের জ্বলন্ত সিগরেটটি নিভে গেছে। প্যান্টের পকেট থেকে লাইটার বের করে পূণরায় সিগরেটটিতে অগ্নি সংযোগ করে আবার ভাবতে শুরু করলোÑ ‘এই কী মায়ানমার, এই কি বার্মা, এই কী আমার দেশ, আমার জন্মভূমি? এত রক্ত, এত লাশ, এত আগুন, এত বিভৎসতা, এত নৃশংসতাÑ এগুলি লুকোবার জায়গা কি গোটা মায়ানমারের এত বড় ভূখ-ের কোথাও আছে? নাকি সারা বিশ্বের কোথাও এত বিশাল মৃত্তিকা আছে যে মৃত্তিকার তলদেশের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া অসীমের মাঝেও এত ঘৃণা আর এত লজ্জাকে চোখ বন্ধ করে পুতে ফেলা যাবে? এ কেমন দেশ, এ কেমন ধর্ম? যে ধর্মের মূল কথাইÑ ‘অহিংসা’। যে ধর্মের মূল নির্যাসকে অন্তরে ধারণ করে প্রতিটি মানুষই এক অপরের সহোদর। অথচ তাদেরই একটি অংশ আর একটি অংশকে তাদের কুৎসিত হিংসার অসভ্য তীক্ষè নখর দিয়ে প্রতি মুহূর্তে গণহত্যার উৎসবে মেতে উঠে উল্লসিত হয়ে এক ধরনের আত্ম-অহঙ্কার অনুভব করছে। এই কীÑ ‘মহামতি বুদ্ধের’ শিক্ষা! এসব করে প্রকৃত অর্থে স্বয়ং বুদ্ধকেই কি মুহূর্তে মুহূর্তে হত্যা করা হচ্ছে না?’Ñ তরুণটির হাতে ধরা সিগরেটটি শেষ হয়ে গেছে। আরও একটি সিগরেট জ্বালালো তরুণটি। সিগরেটটি জ্বালিয়ে আবার ভাবতে শুরু করলোÑ ‘এখন আমাকে সীমান্ত প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়েছে। অর্থাৎ আমাকে মানুষ হত্যার Open Certificate - প্রদান করা হয়েছে। এখন আমার দায়িত্ব পালনকালীন দিনে অথবা রাতে যে কোনো মানুষকে যে কোনো মুহূর্তে আমার ইচ্ছেমতো আমি হত্যা করতে পারবোÑ সে Guarantee - আমাকে ওই openCertificate -এর মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছে। হত্যার পর যে কোনো কারণ দেখিয়ে দিলেই হত্যার অনুমোদনটি অনায়াসেই পাওয়া যাবে। অর্থাৎ এই হত্যার অনুকূলে আমার কৈফিয়তটি যা-ই হোক না কেনÑ অনুমোদিত হবে। আর এই-ই যদি হয় গোটা রাষ্ট্রটির চিত্ররেখা তাহলে আমার নিজের দাঁড়িয়ে থাকবার জায়গাটিও ভবিষ্যতে অবশিষ্ট থাকবে কী? আমার তো মনে হয় আমার এ দুর্ভাগা দেশটি সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। এই যে শুন্য প্রান্তরে আমি বসে আছিÑ জনমানবহীন, পাখিদের কাকলি শুন্য, বৃক্ষরাজির পল্লব সমুহও বুঝি মৃদু সমীরণের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত, নদীর পানির ¯্রােতের গতি বেয়নেটের ডগায় ক্ষত বিক্ষত হয়ে রুদ্ধবাকÑনিস্তব্ধ, শষ্য ক্ষেত্রগুলি নিস্প্রাণ, উৎপাদনের ক্ষমতা-রহিত সারিবদ্ধ লাশের কফিনÑ এই শব্দশুন্য, সঙ্গীতশুন্য নিদারুণ বিরান প্রান্তরে আমরা বাঁচবো কি করে? এখানে জীবনের সাহিত্য নেই, সংস্কৃতি নেই, বেঁচে থাকবার অবলম্বন নেইÑ শুধুই হা-হাকার আর অফুরান মৃত্যুর মিছিল।’Ñ ওর এ ধরনের চিন্তারাশি থেকে একটি বিষয় অতি-স্পষ্ট হয়ে যায়Ñ তরুণটি বার্মিজ বৌদ্ধ হলেও চরম উদারপন্থী। বৌদ্ধের ধর্মে পূর্ণ বিশ্বাস রেখে ও সবাইকে সাথে নিয়ে এক সঙ্গে বসবাস করতে চায়। উগ্রতার অপর নাম হিংসাÑ যে হিংসার আগুন থেকে সব সময়ের জন্যেই ও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। অথচ কী আশ্চর্য ভাগ্য ওর- সেই হিংসার অগ্নিকু- নিজ হাতে জ্বালিয়ে সে অগ্নিকু-ে নিরপরাধ মানুষজনকে নিক্ষিপ্ত করবার দায়িত্ব নিয়ে আজ ও সীমান্ত প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত একজন মানুষ হত্যাকারী! এখানেই একটি মিহি সন্দেহের সৃষ্টি হয়ে যায় যে, রাখাইন রাজ্যের বৌদ্ধ হিসেবে ওর যে পরিচয় সে পরিচয়ের বাইরেও বোধকরি ভিন্ন আর একটি পরিচয় ওর আছেÑ যে পরিচয়টি কখনই ও কাউকে প্রদান করে নি। না হলে ওর মৌলিক চিন্তা প্রবাহ, সেই চিন্তা প্রবাহের সূত্র ধরে ওর সকল কর্মকা- এত উদারতার চিহ্ন বহন করে কি করে? যার প্রমাণ একটু পরেই আমরা প্রত্যক্ষ করবো।
০৩.
আর ভাবতে পারলো না তরুণটি। শিলা খ-টি থেকে অতিদ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে Rifle -টি হাতে নিয়ে কক্ করলো। অনেক দূর থেকে মাইন বিষ্ফোরণের শব্দ ভেসে আসছেÑ হয়তো সীমান্তেরই ভিন্ন কোনো অংশে মাইনগুলি বিষ্ফোরিত হচ্ছেÑ সীমান্তের যে অংশটি দিয়ে হয়তো বা কোনো উদ্বাস্তু তাদের মাতৃভূমির মমতা ত্যাগ করতে না পেরে জীবন উৎসর্গ করেই মায়ানমারের অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলোÑ অন্ততঃ এইটুকু ভেবে যে, তাদের লাশটি তো তাদের মাতৃভূমিতে কবরস্থ হবেÑ এটি-ই তাদের কাছে পরম সান্ত¦না হয়ে থাকবে। আর সে কারণেই এ বিষ্ফোরণ। বুঝতে পারে তরুণটি। বিষ্ফোরণের ফলে তারা আর তাদের দেশে প্রবেশ করতে পারে নি। বিষ্ফোরণের সাথে সাথে তারা নিশ্চিত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে হয়তো। যেহেতু বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তের মায়ানমার অংশের পুরো এলাকাজুড়ে মাইনগুলি পুতে রাখা হয়েছিলো সে কারণেই। যেন কোনোক্রমেই মায়নমার থেকে উচ্ছেদকৃত কোনো রোহিঙ্গা মুসলিমই আর সে দেশে প্রবেশ করতে না পারে।
এবার Binocular-টিতে চোখ লাগালো উ মিন্ট্। চোখে লাগিয়ে ওর আওতাভুক্ত সীমান্ত অঞ্চলের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো ‘ÔNo-Man’s LandÕ -এর গভীর অভ্যন্তর পর্যন্তÑ যাতে ওর দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষিত হয় কিনা? এভাবে বারবার পর্যবেক্ষণের এক পর্যায়ে মায়ানমার সীমান্তের পাশের ‘ÔNo-Man’s LandÕ -এর ওপর দিয়ে বয়ে চলা খুবই শীর্ণ এবং ¯্রােতবিহীন একটি নদীর ওপর দিয়ে ভেসে আসছে ক্ষুদ্র একটি ডিঙ্গি নৌকো। নদীটি বাংলাদেশ সীমান্তের দক্ষিণ দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে ‘ÔNo-Man’s LandÕ -এর ওপর দিয়ে প্রায় মায়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি ‘ÔNo-Man’s LandÕ -এর প্রান্ত ছুঁয়ে ধাবিত হয়ে আবার উত্তর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশেই প্রবেশ করেছে কিন্তু মায়ানমার সীমান্তকে স্পর্শ করেনি। অস্পষ্টভাবে বোঝা যায় ডিঙ্গি নৌকোটিতে তিনজন মানুষের অস্তিত্ব। দূরত্বের মাত্রা কিছুটা বেশী হওয়ার কারণে Binocular -এ-ও ডিঙ্গিটি অস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। কতকটা ছায়ার মতো একজন ডিঙ্গিটির দাঁড় বাইছে আর অপর দ’ুজন ডিঙ্গিটির পাটাতনের মাঝের আড়ার ওপর পাশাপাশি বসে হয়তো গন্তব্যে পৌঁছুবার লক্ষ্যে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। কিছুটা বোঝা যায় ওদের দু’জনের মধ্যে একজন নারী। কেননা সে যে একটি বোরখা পরে রয়েছেÑ এটি বুঝতে খুব বেশী কষ্ট করতে হয় না উ মিন্ট্কে। এ ধরনের কোনোকিছু বুঝে উঠবার বিষয়টিতে ওর পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে ও আগে থেকেই অভ্যস্থ। এটি সহ আরও অনেক অতিসূক্ষ্ম বিষয়ে প্রায় প্রতিনিয়তই ওদেরকে Training - দেয়া হয় এবং খুবই নিবিড়ভাবে Brief -করা হয় মায়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক।
উ মিন্টের যখন মনে হয় ডিঙ্গিটি ওর Rifle -এর Range -এর আওতার ভেতর ঢুকে পড়েছে ঠিক তখনই ডিঙ্গিটিকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউ- গুলিবর্ষণ করে উ মিন্ট্। গুলিবর্ষনের পর পরই ডিঙ্গিটি উল্টে গিয়ে পানির গভীরে ডুবে যায়। কিন্তু কেউ হতাহত হয়েছে কিনা বোঝা যায় না। কিছু সময় অপেক্ষা করে উ মিন্ট্Ñ তীক্ষè দৃষ্টি দিয়ে লক্ষ করতে থাকে কেউ পানির ওপর ভেসে ওঠে কিনা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর বুঝতে পারেÑ না সে ধরনের কোনো লক্ষণ নেই। চারদিকে ভালো করে একবার তাকিয়ে নিয়ে এবার ডুবে যাওয়া ডিঙ্গিটির দিকে এগুতে থাকে উ মিন্ট্। উ মিন্ট যখন কাটাতারের প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে নদীটির তীরে পৌঁছে যায় ঠিক তখনই একজন আর একজনের হাত চেপে ধরে উ মিন্টের পায়ের কাছে নদীটির তীরে এসে তীরের মাটি আঁকড়ে ধরে তীরে উঠবার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। আবার পানিতে ডুবে যায়। মাত্র কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে মোটেই আর বিলম্ব না করে উ মিন্ট্ও নেমে পড়ে নদীর পানিতেÑ যেখানে মানুষ দু’জন একটু আগেই ডুবে গিয়েছিলো। কেন উ মিন্ট্ এ রকমটি করলো বোঝা গেলো না। তবে এটুকু বোঝা গেলো হয়তো ওর ভেতরের তীব্র মানসিক দ্বৈরথ ওকে এ রকমটি করতে বাধ্য করেছিলো। কারণ ওর কাজ ওর দেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ-উন্মুখ কোনো মানুষকে উদ্ধার করা নয় বরং হত্যা করা। অথচ ও কাজটি করলো ঠিক ওরদায়িত্বের উল্টো। এর পরিণতিটি ওর জন্যে কতটা ভয়াবহ এবং নির্মম হতে পারেÑ বিষয়টি সে মুহূর্তে হয়তো ভাবতেই চায় নি উ মিন্ট্। হয়তো মানবিকতার দিকটিকেই ও প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলো সবচাইতে বেশী। অথচ এটি ওর জন্যে নিষিদ্ধ। এটি জেনেও ও ওই কাজটিই করে বসলো। এমনও তো হতে পারেÑ পুরো ঘটনাটিতে ওর বাস্তব জীবনের ওপর প্রক্ষেপিত প্রকৃত শিক্ষার প্রচ্ছায়াটিই মানবিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে হয়তো ওর মানসিকতাটিকে তাৎক্ষণিকভাবে আচ্ছাদিত করে ফেলেছিলো কোনো প্রশ্নের অবকাশ না রেখেই। যে লোকটি ওই ডিঙ্গিটির দাঁড় বেয়ে ওদেরকে নিয়ে আসছিলো তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। বুলেট বিদ্ধ হয়ে মারা গিয়ে থাকলে এতক্ষণ নদীর পানিতে ভেসে উঠবার কথা কিন্তু তা হলো না। যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর পর্যন্ত নদীর পানিরর ওপর লোকটিকে দেখা গেলো না।
০৪.
কিছুক্ষণের মধ্যেই উ মিন্ট্ ওর শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মানুষ দু’জনকে নদীর পানি থেকে ঠেলে তীরের ওপর তুলে দিয়ে নিজেও তীরের ওপর উঠে এলো। একজন নারী এবং একজন পুরুষ। অতিরিক্ত পানি পান করবার ফলে ওদের পেট দু’টি অস্বাভাবিক রকমের ফুলে ওঠা। ওদের ভেতরে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা বুঝতে পারলো না উ মিন্ট্। দু’জনের মুখম-লের প্রায় পুরোটাই যেন সাদাটে হয়ে গেছে। নাকের কাছে হাত দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বুঝবার চেষ্টা করলো। বুঝতে পারলো না কিছুই। ভয় পেয়ে গিয়েছিলো উ মিন্ট্Ñ শেষ হয়ে যায়নি তো! তার পরেও ওদের দু’জনের পেটের ওপর প্রচ- চাপ দিয়ে যতটা সম্ভব পানি বের করে আনলো ওদের পেট থেকে। এভাবে পর পর কয়েকবার চাপ দিয়ে প্রচুর পরিমাণের পানি বের করে আনলো। এবার থামলো উ মিন্ট্। ওদের মুখের ওপর দৃষ্টি রেখে অপেক্ষা করতে থাকলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর উ মিন্ট্ লক্ষ করলো পুরুষ মানুষটির একটি পায়ের পাতা কেঁপে উঠেই থেমে গেলো। এটি দেখে আরও একটু কাছাকাছি হলো পুরুষটির। এর মধ্যেই নারীটির ডান হাতের দু’টি আঙ্গুলও কেঁপে উঠলো। এবার নিশ্চিত হলো উ মিন্ট্ দু’জনই বেঁচে আছে। আরোও কিছু সময় কেটে যাবার পর ওদের শ্বাস প্রশ্বাসের মাত্রাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ পানির নীচে থাকবার কারণে ওদের শরীর হিম হয়ে গিয়েছিলো। ঠা-ায় ওদের শরীর কাঁপছিলো। কথাও বলতে পারছিলো না। চোখগুলিও ছিলো মুদিত। এ রকম অবস্থায় ওদেরকে তাপ দিয়ে উষ্ণ করে তুলবার জন্যে উ মিন্ট্ কিছু শুকনো উদ্ভিদের ডালপালা, খড়কুটো জোগার করে ওর লাইটার জ্বালিয়ে সেগুলিতে আগুন ধরিয়ে দিলো। এবং ইঙ্গিতে সেই আগুন থেকে ওদেরকে তাপ গ্রহণ করবার নির্দেশ দিয়ে উ মিন্ট্ আবার নদীতে নেমে পড়লো। বেশ কিছু সময় কেটে যাবার পর যেখানে ডিঙ্গিটি ডুবে গিয়েছিলো সেখান থেকে ডুবে যাওয়া ডিঙ্গিটিকে নদীর পানির ওপর তুলে ডিঙ্গিটিতে বসে নিজের দু’হাতকে দাঁড় বানিয়ে সেই দু’হাতের দাঁড় বেয়েই ডিঙ্গিটিকে তীরে এনে ভেড়ালো। ডিঙ্গিটি খুবই ক্ষুদ্রাকৃতির হওয়ায় ওটিকে পানির ওপরে তুলতে সক্ষম হয়েছিলো উ মিন্ট্। তারপরেও ডিঙ্গিটিকে পানির ওপর তুলতে ওর অনেকটা সময় লেগেছিলো। ওটি তুলতে গিয়ে দু’বার ওকে শ্বাস নেবার জন্যে পানির নীচে থেকে মাথা পানির ওপরে তুলতে হয়েছিলো। ডিঙ্গিটি তীরে রেখে তীরের ওপরে উঠে উ মিন্ট্ দেখলো ওরা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। চোখ মেলে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। একে অপরকে কিছু বলবারও চেষ্টা করছে। ঠা-া কিছুটা কমলেও ওদের কাঁপুনি একেবারে কমে যায় নি। তবুও ওদের এ অবস্থাতেও ওরা যে কথা বলতে সক্ষমÑ এটিতে নিশ্চিত হলো উ মিন্ট্। এবং সে নিশ্চিতির ওপর বিশ্বাস রেখে ওদেরকে কয়েকটি প্রশ্ন করবার সিদ্ধান্ত নিলো। প্রথমেই পুরুষটিকে প্রশ্ন করলো উ মিন্ট্Ñ ‘অনুগ্রহ করে আপনার নামটি বলবেন কি?’Ñ প্রশ্নটি শুনে নারীটির দিকে তাকালো পুরুষটি। ওদের দু’জনের মধ্যে চোখে চোখে কিছু কথা হলো। কী কথা হলো ওরাই বুঝলো। এরপর একটু সময় নিয়ে অনেক কষ্টে কথা বললো পুরুষটিÑ ‘ আমার নাম শিশ মোহম্মদ।’Ñ নামটি শুনে কিছুটা যেন চকিত হলো উ মিন্ট্। একটু ভেবে আবার প্রশ্ন করলোÑ ‘শুধু এটুকুই? এ নামের সাথে আর কিছুই ছিলো না?
‘ছিলো বাবাÑ ‘বাজ বাহাদুর’। অর্থাৎ আমার পুরো নামটি ছিলো ‘শিশ মোহম্মদ বাজ বাহাদুর’। তবে ওই বাজ বাহাদুর নামটি আমি আমার নাম থেকে ছেঁটে ফেলেছি সেদিনই যেদিন আমার পিতা ‘বাজ বাহাদুর’কে বার্মিজ সেনারা আমার চোখের সামনেই গুলি করে হত্যা করেছিলো। এবং আমাকে আর আমার স্ত্রীকে শক্তি প্রয়োগ করে আমাদেরকে আমার ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করে বার্মা সীমান্তের বাইরে ‘ÔNo-Man’s LandÕ -এর ভেতর Push - করেছিলো। সেদিন থেকে ওই নামটি আর আমি ব্যবহার করিনি। কারণ ‘আরাকান’ ছিলো আমার পিতৃভূমিÑ ওই মাটিতেই আমার পিতা জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। সে মাটির ওপরেই যখন আমার পিতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো এবং সে মাটি থেকেই যখন আমাকেসহ আমার গোটা পরিবারকে উচ্ছেদ করা হলো তখন ওই নামটি আমার নামের সাথে আর আমি যুক্ত করবার কোনো যুক্তি খুঁজে পাইনি। কেননা ওই নামটির রক্তের সাথে আমার পিতার জন্মভূমির গন্ধ জড়িয়ে ছিলো। আমার পিতাকে হত্যার পর এবং ওই নামটি আমার পুরো নাম থেকে মুছে ফেলবার পরেও যখন কেউ আমার পুরো নামÑ ‘ শিশ মোহম্মদ বাজবাহাদুর’-বলে ডাকতো তখন আমার হৃৎপি- দ্বিখ-িত হয়ে যেতো। আমি সহ্য করতে পারতাম না।’Ñ আবেগে আপ্লুত হয়ে কথাগুলি বললো পুরুষটি। কথাগুলি বলবার সময় ওর চোখ দু’টি আরও ছোট হয়ে এসেছিলো। ওর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে নারীটি তীব্র আবেগে কান্না-জড়িত কন্ঠে কথা বলতে শুরু করলোÑ ‘আমার নাম আলিয়া তুরপুন। আমি ওর স্ত্রী।’Ñবলে পুরুষটিকে দেখিয়ে দিয়ে আবার বলতে শুরু করলোÑ ‘যে ঘরটি থেকে ওরা আমাদেরকে তুলে নিয়ে গেলো সে ঘরের পাশেই আর একটি ঘরে আমাদের এক বছরের শিশুপুত্রটি ঘুমিয়ে ছিলো। সন্তানটিকে নেবার জন্যে ওদের হাতে পায়ে ধরে কত মিনতি করলাম কিন্তু ওরা কিছুতেই শিশুটিকে নিতে দিলো না। আমাদেরকে ‘ÔNo-Man’s LandÕ -এ পাঠিয়ে দিলো। সে আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। পরে শুনেছি যে ক’জন সৈন্য আমাদেরকে আমাদের ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করেছিলো তাদের সাথে একজন বার্মিজ বৌদ্ধ নারী সৈনিকও ছিলো। সেই নারী সৈনিকটি তার দলের অন্য সৈনিকদেরকে বুঝিয়ে আমার সন্তানটিকে গ্রহণ করেছিলো এবং নিজেই তার মাতৃ¯েœহ দিয়ে তার পরিচয়েই ওকে লালন পালন করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলো। কিন্তু সেই নারী সৈনিক আর আমার পুত্রসন্তানটি আজও বেঁচে আছে কিনা আমরা জানি না।’Ñ থামলো নারীটি। চোখ মুছলো নারীটি ওর পরনের ভেজা শাড়ীর আঁচলের এক প্রান্ত চিপে নিয়ে সেই কুচকোনো আঁচলটির প্রান্ত দিয়ে। এবার পুরুষটিও হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে আবার বলতে শুরু করলোÑ ‘আমরা জানি না এই তিরিশ বছরে আমাদের সন্তানটি বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওকে খুঁজে বের করে একবার দেখবার জন্যেই এই চরম দুর্যোগের দিনে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও আমরা পা বাড়িয়েছি বার্মা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আরাকান রাজ্যে প্রবেশের লক্ষ্যে। সন্তানটিকে আমরা যদি খুঁজে না-ও পাই আর এই খুঁজতে গিয়ে যদি আমাদের মৃত্যুও ঘটে তবু এটুটকু সান্ত¦না আমরা পাবো যে, আমাদের দাফন হয়েছে আমাদের মাতৃভূমি আরাকানের পবিত্র মাটিতেই। কারণ আমরা মুসলিম, মৃত্যুর পর দাফন ছাড়া অন্যকিছু তো হবে নাÑ এটি আমাদের বিশ্বাস মাত্র। এবিশ্বাসটুকুর ওপর নির্ভর করে এত কষ্ট করে এত দূর থেকে বলতে গেলে বাংলাদেশের গভীর অভ্যন্তর থেকে আমাদের এখানে আসা। ও দেশে আমরা খুবই ভালো ছিলাম বাবা। বাংলাদেশের কোনো মানুষ আমাদেরকে কখনই বাঁকা চোখে দেখে নি, আমাদেরকে ভিনদেশী ভাবে নি বরং আমাদের দুর্দিনে সহায়তার হাতই প্রসারিত করেছে আমাদের নিজেদের কোনো স্বার্থ না দেখে। কিন্তু সন্তানটির মায়া কাটাতে না পেরেই আমাদের আজ এখানে আসা।’Ñ থামলো পুরুষটি। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো স্বামী স্ত্রী দু’জনই। ওরা দু’জনই কথা বলছিলো বাংলার সাথে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বার্মিজ ভাষা মিশিয়ে। উ মিন্ট্ বার্মিজ ভাষায় কথা বললেও বাংলা ও বুঝতে পারতো।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওদের কথাগুলি শুনলো উ মিন্ট্। নিজে কোনো কথা বললো না। তবে যখনই ওদের স্বামী স্ত্রীর নাম দু’টি শুনলো ঠিক তখনই ওর চোখে মুখে একটি চকিত পরিবর্তন লক্ষিত হলো। ডান হাতের মুঠোটি শক্ত হয়ে এলো। চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেলো ওদের দু’জনের মুখম-লের ওপর। ওদের কথা শেষ হয়ে যাবার পরেও অনেকক্ষণ ধরে ওদেরকে শুধু দেখতেই থাকলো উ মিন্ট্। দু’জন মানুষ। একজন পুরুষ আর একজন নারী। দু’জনই বৃদ্ধ। পুরুষটির বয়স ষাট থেকে সত্তরের মধ্যে, নারীটিরও ষাটের নীচে নয়। পূরুষটির মাথার প্রায়-সাদা চুলগুলি একেবারেই ছোটো করে ছাঁটা, কপালে বলিরেখা, মুখে দাড়ি গোঁফ কিছু নেই। চোখ দু’টি ছোটো। মুখম-লের মাপ জোঁকের হিসেবে কান দু’টি অস্বাভাবিক রকমের বড়। শরীর স্থুল নয় আবার একেবারে শীর্ণও নয়। বিদ্ধস্ত। নারীটির মাথার দীর্ঘ পর্যাপ্ত চুলে সাদা কালোর মিশ্রণ খুব সহজেই চোখে পড়ে। কপালে বলিরেখা নেই তবে দু’গালের চামড়া শিথিল। দু’গালেই ভাঁজের রেখা স্পষ্ট। ওর চোখ দু’টিও ছোটো তবে তুলনামূলকভাবে পুরুষটির চাইতে কিছুটা বৃহৎ আকারের। ঠোঁট দু’টি শীর্ণ হলেও এত বছর বয়সেও একটি পৃথক মাধুরী আছে বলে মনে হয়। যৌবনে যুবতির ঠোঁটের মাধুরীর মত যেন।
এতক্ষণ ধরে ওদের কথা শুনে অভিভূত হবার যে তন্দ্রাচ্ছন্নতার গভীরে ও ডুবে গিয়েছিলোÑ অতি আকস্মিকভাবে সে গভীরতায় তুমুল তোলপাড় করা চৈতন্য-প্রাখর্যের সিঁড়ি বেয়ে ও যেন জেগে উঠলো এক ভয়ংকর মূর্তি নিয়ে । আর জেগে উঠেই ওদের ওপর থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে মাত্র দুটি বাক্য উচ্চারণ করলোÑ ‘এবার তো আমিই আপনাদেরকে হত্যা করবো। আর হত্যা করাই আমার দায়িত্ব এবং কাজ।’Ñ কথা শেষ করে আবার ওদেরকে দেখতে থাকলো উ মিন্ট্। অপেক্ষা করলো এটুকু দেখবার জন্যে যে, এ কথা শুনবার পর ওদের প্রতিক্রিয়া কী হয়।
খূব বেশী সময় অপেক্ষা করতে হলো না উ মিন্ট্কে। ওদের চেহারায় কোনো প্রতিক্রিয়াই প্রতিফলিত হলো না এবং কোনো পরিবর্তনও লক্ষ করা গেলো না। বরং কিছুটা নির্ভীকভাবেই যেন নারীটি বললোÑ ‘তোমার দায়িত্ব তো তোমাকে পালন করতেই হবে বাবা। আমরা কিছুই বলবো না। শুধু---।’ এবার নারীটির মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে পুুরুষটি বলতে শুরু করলোÑ ‘শুধু আমাদেরকে তুমি আরাকান সীমান্তের ভেতরে প্রবেশ করতে দাও তারপর যতবার খুশি তুমি আমাদেরকে হত্যা ক’রো, যতবার ইচ্ছে আমাদের শরীরের ওপর তুমি গুলিবর্ষণ ক’রো। শুধু আমাদের লাশ দু’টিকে তুমি আরাকানের পবিত্র মাটিতে পাশাপাশি দাফন করবার ব্যবস্থা করে দিও। তোমার কাছে চাইবার মতো আর আমদের কিছুই নেই বাবা। কেবল একটিমাত্র দুঃখই মৃত্যুর পরেও আমাদেরকে তাড়া করে ফিরবেÑ আমাদের সন্তানটিকে আর আমরা দেখে যেতে পেলাম না। সন্তানটিকে বড় করে তুলতে পারলাম না, মানুষও করতে পারলাম না। সন্তানটির পাশে গিয়ে দাঁড়াতেও পারলাম নাÑ যদি ও বেঁচে থেকে থাকে। আমরা আমাদের সন্তানের অযোগ্য পিতা মাতা।’ Ñ থামলো পুরুষটি।
উ মিন্ট্ পুরুষটিকে উঠে দাঁড়াতে নির্দেশ দিলো। ধীরে ধীরে পুরুষটি উঠে দাঁড়ালো। ওর উঠে দাঁড়ানো দেখে নারীটি বোধকরি ভয় পেয়ে গেলো। নারীটিও উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো। ওকে থামিয়ে দিলো উ মিন্ট্। ইঙ্গিত করলো ওকে বসে থাকতে। নারীটি আর দাঁড়ালো না। উ মিন্ট্ পুরুষটির একটি হাত নিজের কাঁধে নিয়ে অতি সাবধানী পা ফেলে নদী তীরে নিয়ে গেলো এবং নদীর তীর বেয়ে নীচে নেমে পুরুষটিকে ডিঙ্গিটিতে বসিয়ে দিয়ে ফিরে এলো নারীটির কাছে। নারীটিকেও একইভাবে ডিঙ্গিটিতে পুরুষটির পাশে বসিয়ে দিয়ে ওর কাঁধে থাকা জরভষব-টি থেকে ম্যাগজিনটি খুলে নিয়ে সেটি প্যান্টের বেল্টে গুজে রেখে ওই জরভষব-টির বাট দিয়ে ডিঙ্গিটি বাইতে শুরু করলো। ডিঙ্গিটি কিছুদুর যাবার পর পুরুষটি উ মিন্ট্কে জিজ্ঞেস করলোÑ ‘ আমাদেরকে তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছো বাবা?’Ñ পুরুষটির এ প্রশ্নের উত্তরে উ মিন্ট্ বললোÑ ‘আপনাদের ইচ্ছে পূরণের জায়গায়। চুপচাপ ডিঙ্গির ওপর বসে থাকুন। কথা বলবার সময় এটি নয়।’ চুপ হয়ে গেলো পূরুষটি। প্রায় দেড় ঘণ্টারও অধিক সময় ধরে ডিঙ্গিটি বেয়ে যেখানে উ মিন্ট্ পৌঁছুলো সে জায়গাটি উ মিন্টের আওতাভুক্ত- এলাকার একেবারে শেষ প্রান্ত। সেখানে পর পর দু’টি টিনের চালা ও মাটির দেয়াল বেষ্টিত দু’টি বাড়ী লক্ষ করা গেলো। ডিঙ্গিটিতে ওদের দু’জনকে রেখে উ মিন্ট ওই বাড়ী দু’টির দিকে যেতে শুরু করলো। ওদেকে বলে গেলো ডিঙ্গিটি থেকে ওরা যেন কোনোক্রমেই নীচে না নামে। চলে গেলো উ মিন্ট্। অনেকটা সময় কেটে যাবার পরেও যখন উ মিন্ট্ ফিরলো না তখন আপনা আপনি দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো ডিঙ্গিতে বসে থাকা স্বামী স্ত্রী দু’জনের চোখে মুখে। ধীরে ধীরে অস্থির হয়ে উঠে তাকাতে থাকলো ওরা দু’জন উ মিন্টের গমন পথের দিকে। এভাবে কিছক্ষণ কেটে যাবার পর ওরা দেখলো উ মিন্ট্ ফিরে আসছে কাঁধে একটি বড় আকারের ব্যাগ নিয়ে। ওরা বুঝতে পারলো না কিছুই। কিন্তু ওদেরকে ডিঙ্গির ওপর বসিয়ে রেখে তরুণটি চলে যাবার পর থেকে ওরা ভীষণ সন্দিগ্ধ হয়ে পড়েÑ তরুণটির কথা মতো আসলেই ও কি ওদেরকে হত্যা করবে? ও কি অতিরিক্ত আরও কোনো সৈনিককে ডাকতে গেলো? তরুণটি যখন ওদেরকে মুমূর্ষু অবস্থায় নদীর পানি থেকে উদ্ধার করে সুস্থ্য করে তুলেছিলো তখন তো তাকে সে রকমের মনে হয় নি! এসব চিন্তা করতে করতে ওরা অনেকটাই দূর্বল হয়ে পড়েছিলো। কিছুতেই ভাবতে পারছিলো না কী আছে ওদের ভাগ্যে! এখান থেকে এ অবস্থায় পালাবারও তো কোনো পথ নেই।
০৫.
কী করবে এখন ওরা? কোনো সিদ্ধান্তই যখন ওরা নিতে পারছিলো না ঠিক তখনই ওরা ওদের দিকে আসতে দেখলো তরুণটিকে একটি বড় ব্যাগ কাঁধে করে। কিছুটা স্বস্তি পেলো ওরা এই ভেবে যে, অন্ততঃ ওর সাথে অতিরিক্ত কোনো সৈনিক নেই। আবার ভাবছেÑ যদিও ছেলেটি ওদেরকে হত্যা করবার কথা বলেছে তারপরেও তো ওর কর্মকা-, আচরণ দেখে মনে হয় না ছেলেটি ওদেরকে সত্যি সত্যিই হত্যা করবে। যদি তাই-ই হবে তাহলে এতক্ষণ ওদেরকে বাঁচিয়ে রাখলো কেন, নদী থেকেই বা তুলে আনলো কেন? এসব ভাবনার মধ্যেই তরুণটি ওদের কাছে এসে ডিঙ্গিটির পাশে এসে দাঁড়িয়ে ব্যাগটি পুরুষটির হাতে দিয়ে বললোÑ ‘এর ভেতরে নারী এবং পুরুষের বার্মিজ জামা কাপড় রয়েছে। আমি তীরে উঠে কিছুটা দূরে অপেক্ষা করছি আপনারা যত দ্রুত সম্ভব আপনাদের পরনের কাপড়গুলি খুলে এই ব্যাগে থাকা জামা কাপড়গুলি পরেনিন। আর আপনাদের পরনের কাপড়গুলি ডিঙ্গিটির গলুইয়ের নীচে রেখে দিন। নতুন কাপড়গুলি পরা হলে আপনারা হাত ওপরের দিকে তুলে আমাকে ইঙ্গিত দেবেন। আমি ডিঙ্গিতে উঠে আপনাদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেবো।’Ñ তরুণটি কথা শেষ করে তীরে উঠে কিছুটা দূরত্বে চলে গেলো। এবং সেই পূর্বের শিলাখ-টির ওপর সে একটি সিগরেট জ্বালিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো আর ভাবতে থাকলোÑ কী আছে ওদের ভাগ্যসহ উ মিন্টের নিজের ভাগ্যে! ভাবতে ভাবতেই একটি সিগরেট শেষ হয়ে গেলো। আবার একটি নতুন সিগরেট জ্বালালো। তরুণটি Chain Smoke -করেÑ বোঝা গেলো। ডিঙ্গিতে থাকা স্বামী স্ত্রী দু’জন অতি দ্রুততার সাথে ওদের গায়ে থাকা কাপড় চোপড়গুলি পাল্টিয়ে পুরোপুরি বার্মিজ দম্পতিতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়ে দু’জনই হাত ওপরের দিকে তুলবার সাথে সাথেই তরুণটি সেই শিলাখ-টি থেকে উঠে ডিঙ্গিতে এসে বসে পূর্বের মতোই ওর Rifle -এর বাট দিয়ে ডিঙ্গিটি বাইতে শুরু করলো। ডিঙ্গিটি বাইতে বাইতে তরুণটি ওদেরকে বললোÑ ‘আমাকে আপনারা কোনো প্রশ্ন করবেন না। শুধু আমার কথাগুলিকে মেনে চলবেন। ব্যতিক্রম হলে আপনারা বাঁচবেন না, আমার জীবনও থাকবে না। আমি আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপনাদেরকে বহন করছি একটি বিশেষ লক্ষ্যে পৌঁছুবার জন্যে। এখন থেকে আপনারা রোহিঙ্গা মুসলিম নন। আপাদমস্তক বার্মিজ বৌদ্ধ। আমি আপনাদেরকে যে বাড়ীতে নিয়ে যাচ্ছি সে বাড়ীতে মাত্র দু’জনের বসবাস। ওরা দু’জন স্বামী স্ত্রী। ওরা ছাড়া আর কারো সঙ্গেই বাংলায় কথা বলবেন না। প্রয়োজনে ওদের সাথে বাংলায় কথা বললে কোনো সমস্য হবে না। ওদেরকে আমি আপনাদের সম্পর্কে যা বলবার তা যতটা সম্ভব বলেছি। কিন্তু বাইরের কারও সাথে বার্মিজ ভাষা ছাড়া ভিন্ন কোনো ভাষায় কথা বলবেন নাÑ শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষা ব্যতীত। প্রয়োজনে বাইরে বেরুলে আপনাদের আচরণে কোনোভাবেই যেন প্রকাশ না পায় আপনারা রোহিঙ্গা মুসলিম। আর যতটা পারবেন কম কথা বলবেন। আমি আপনাদেরকে গুলি করে হত্যা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার কথা মেনে না চললে আপনাদেরকে অত্যন্ত কঠিন শাস্তি ভোগ করে মৃত্যু বরণ করতে হবে।’Ñতরুণ সৈনিক সোয়ে উ মিন্টের কথা শেষ হয়ে গেলো। স্বামী স্ত্রী দু’জনও ওর কথা শুনে এবং কথাবলার ভঙ্গিটি বুঝে নিয়ে বোধকরি কিছুটা আশ্বস্তই হলো। ডিঙ্গিটি চলতেই থাকলো। ডিঙ্গিতে থাকা তিনজন মানুষের মুখ দিয়ে আর একটি কথাও উচ্চারিত হলো না।
০৬.
ইতিমধ্যেই সন্ধ্যে নেমে এসেছে। একই সাথে অন্ধকারও ঘনতর হচ্ছে। সে সবের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে উ মিন্ট্ ডিঙ্গিটি বাইতেই থাকলো যত দ্রুত সম্ভব। কিছুক্ষণের মধ্যেই উ মিন্ট্ ওর কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে গেলো। ডিঙ্গিটি থেকে নেমে ডিঙ্গিটি নদীর পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে ওরা তিনজন এক সঙ্গে সেই বাড়ীটির দিকে হেঁটে যাত্রা শুরু করলোÑ যে বাড়ীটি থেকে উ মিন্ট্ ওদের জন্যে বার্মিজ জামা কাপড়গুলি সংগ্রহ করেছিলো। বেশ কিছুটা দূরত্ব পায়ে হেঁটে ওরা পৌঁছে গেলো সেই কাক্সিক্ষত বাড়ীটিতে। বাড়ীটিতে প্রবেশ করে একটি ঘরের একটি কক্ষে ওদেরকে বসতে বললো উ মিন্ট্Ñ যে কক্ষটি আগেই ওদের জন্যে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিলো। উ মিন্ট্ই সে ব্যবস্থা করে রেখে গিয়েছিলো। ওদেরকে ওই কক্ষে বসতে বলে বাইরে এসে উ মিন্ট ওই বাড়ীর প্রধান এবং উ মিন্টের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং উ মিন্টের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলের সেকে- ইন কমা- ‘শি মিং কান্ট’Ñ এর সঙ্গে অত্যন্ত চাপা স্বরে কিছু কথবার্তা বলে পূনরায় কক্ষটিতে প্রবেশ করে ওদের সাথে বন্ধুটির পরিচয় করিয়ে দিয়ে ওদেরকে শুধু বললোÑ ‘আজকের রাতটি আপনাদেরকে এখানেই যাপন করতে হবে। আগামী কাল সময় মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ দেখতে পাবেন।’Ñ আর কিছু না বলে উ মিন্ট্ চলে গেলো। শি মিং কান্ট বার্মিজ সরকারের Foreign Ministry -এর China Desk -এর দায়িত্বে কর্মরত। ওই Desk -এর সকল Corresponding -ওর মাধ্যমেই হয়ে থাকে। শি মিং ইংরেজি এবং চীনা দু’টি ভাষাতেই যথেষ্ট দক্ষ।
উ মিন্ট্ চলে যাবার পর অনেকক্ষণ ধরে শি মিং কান্ট ওদের দু’জনের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললো। ওরাও শি মিংয়ের অনেক কথার সাথে একমত পোষণ করলো। তবে শি মিংয়ের কথায় মাঝে মাঝেই বর্তমান অসামরিক সরকারের আবরণের ভেতরে থেকে আর একটি অদৃশ্য সামরিক সরকারের নির্মম শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং বিপ্লবের সুরটিই যেন ধ্বনিত হচ্ছিলো। যখন এ ধরনের সুরটি ধ্বনিত হচ্ছিলো তখন আপনা আপনিই ওর চোখে মুখে একটি বিশেষ কাঠিন্যের ছায়া ফুটে উঠতো। চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করতো, দু’হাতের আঙ্গুলগুলি মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে উঠতো। আজকের অসামরিক সরকারটিকে যে আপাদমস্তক নেপথ্যের সেই অদৃশ্য সামরিক সরকার অথবা জান্তা যা-ই বলা হোক না কেনÑ গ্রাস করে ফেলেছিলোÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই বলে বিশ্বাস করতো শি মিং। আর সে কারণেই অসামরিক সরকারটি যে হয়ে পড়েছিলো একটিÑ ‘ঠুটো জগন্নাথ’Ñএর স্বাক্ষাৎ প্রতিভূÑএটিকে শতভাগ বিশ্বাস না করবার মতো কোনও কারণ অথবা ইঙ্গিত কিছুই প্রত্যক্ষ করে নি শি মিং। যে কারণে ওই বিষয়ে শি মিংয়ের বিশ্বাসটি অটুটই রয়ে গিয়েছিলো।
ওরা বুঝতে পারছিলো শি মিং উচ্চ শিক্ষিত এবং প্রচুর পড়াশুনায় অভ্যস্ত। একটি আগুনের তীব্র শিখা যেন বারবার করে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো ওর কথার ভেতর দিয়ে। শি মিং স্বপ্ন দেখছিলোÑ এই নির্যাতক সামরিক শাসক গোষ্ঠীকে চিরদিনের মতো উৎখাত করে একটি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করবারÑ যে সরকারটি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে সরকার গঠন করে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। সংসদ হবে শতভাগ জন-প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সার্বভৌম সংসদÑ যে সংসদে সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্যের কোনো প্রকারের প্রতিনিধিত্ব থাকবে না। বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সার্বভৌম সংসদের আদলেই গঠিত হবে বার্মিজ সংসদ। আর এ সংসদই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সার্বিক জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত হবে।
ওরা বুঝে গেলো সোয়ে উ মিন্ট্ও হয়তো একই বিপ্লবী চিন্তাধারা লালন করে। না হলে এখানে উ মিন্ট্ ওদেরকে নিয়ে আসবে কেন? রাত বিছানায় শুয়ে সারা রাত ধরে ওরা স্বামী স্ত্রী দু’জনই নানা ধরনের চিন্তায় ডুবে যেতে থাকলো। কখনও কখনও ওরা এক অপরকে অনেক প্রশ্ন করলো কিন্তু সঠিক উত্তর কেউই দিতে পারলো না। বিশেষতঃ একটি প্রশ্নÑ ‘উ মিন্ট্ ওদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এবং ওদেরকে দিয়ে কী করবে?’Ñ এ প্রশ্নটিই ওদের কাছে সবচাইতে বেশী দুশ্চিন্তা এবং যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ালো। তারপরেও পুরুষটি একটি বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গেলো যে, মায়ানমারের সামরিক জান্তার ভবিতব্যটি যে একটি নির্ধারিত বিন্দুতে গিয়ে স্থির হয়ে গেছেÑ যে বিন্দুটি বার্মার সামরিক জান্তার পুরোপুরি বিপক্ষের সেটি মোটেই বুঝতে পারছে না বার্মার সামরিক জান্তা। সামরিক জান্তার গোটা শরীরের অভ্যন্তরেই যে ইতিমধ্যেই অসংখ্য ঘুনে পোকা যে পোক্ত অবস্থান নিয়ে নিয়েছেÑ এটি উপলব্ধি করবার মতো তীক্ষè ধী শক্তি ওই সামরিক জান্তার আর নেই। ক্ষমতার দম্ভে তারা এতটাই উন্মাদ যে তাদের শরীরে থাকা ঘুনে পোকার তীব্র দংশনকেও তারা কিছুতেই উপলব্ধি করতে পারছে না। এ সব চিন্তার ভেতর দিয়েকখন যে রাত্রি গভীরতর হয়েছে বুঝতে পারেনি শিশ মোহম্মদ দম্পতি। এখন আর কেউ কারো সাথে কোনো কথা না বলে শেষ রাত্রির দিকে ঘুমোবার চেষ্টা করলো। এক সময় ঘুমিয়েও পড়লো দু’জন।
পরদিন শি মিংয়ের স্ত্রীকে নিয়ে একসাথে বসে ওরা দুপুরের খাবার খেলো। খাবার টেবিলেই শি মিংয়ের স্ত্রীর সাথে ওদের অনেক কথা হলো। শি মিংয়ের স্ত্রীও যে উচ্চ শিক্ষিতা তা কথাবার্তাতেই বোঝা গেলো। খুবই মার্জিত এবং রুচিশীল মেয়ে। মেয়েটির পরনে বার্মিজ পোষাকের কোনো অস্তিত্বই নেই। একটি জিন্সের প্যান্টের ওপর একটি শরীরের সঙ্গে সেঁটে থাকা Half Sleev -চেক শার্ট। এই পোষাকটিতেই ও যেন অধিক সুন্দরী। শার্টের দৈর্ঘ্যটি ওর কোমড়ের সীমানা ছাড়িয়ে নিতম্বের ওপর অবধি প্রলম্বিত। মেয়েটিই বললোÑ ‘শি মিংয়ের সাথে আমার বিয়ে হবার বেশি দিন হয় নি। এ মাসটি গেলে আমাদের বিয়ের বয়স এক বছর তিন মাস পূর্ণ হবে।’ এর পর কোনো সঙ্কোচ না করে মেয়েটি নিজেই বললোÑ ‘আমরা দু’জনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এত দ্রুত সন্তান নেবো না। শি মিংয়ের ইচ্ছে আমি আরও পড়াশুনা করি। তাছাড়া এখন আমাদের দেশের যে অবস্থা তাতে সন্তান নেবার আকাক্সক্ষাটিরই মৃত্যু ঘটে গেছে। কখন যে কার ভাগ্যে কি ঘটবে সেটির নিশ্চয়তাও আমাদের কাছে নেই। যেমনÑ আপনাদেরকে দিয়েই একটি উদাহরণ দিই। আপনাদেরকে যখন এ দেশ থেকে উৎখাত করা হয় তখন আপনারাই কি আপনাদের এক বছর বয়সের শিশুপূত্রটিকে সঙ্গে নিতে পেরেছিলেন? পারেন নি। অবশ্য ‘পারেন নি’-বললে বিষয়টিকে ভুলভাবে বলা হবে। আসলে আপনাদেরকে নিতে দেয়া হয় নিÑ এটি-ই বাস্তব এবং সত্যি। আমাদের আশঙ্কা সন্তানটি জন্ম দেবার পর আমাদের ক্ষেত্রেও যে সে ধরনের কিছু ঘটবে নাÑ এর নিশ্চয়তাই বা কে দেবে আমাদেরকে? তাই আমাদেরও আর ইচ্ছে করে না সেদিকে পা বাড়াবার। একটি আতঙ্ক যেন সব সময়ের জন্যে থেকেই যায়।’Ñ শিশ মোহম্মদ এবং ওর স্ত্রী দু’জনই বুঝে যায় উ মিন্ট্ ওদের সম্পর্কে শি মিং এবং ওর স্ত্রীকে সব কিছুই বলেছে। শি মিং এবং ওর স্ত্রীর সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বার্তা বলে শিশ মোহম্মদ নিশ্চিত হয়ে যায় যে, আর যা-ই হোক উ মিন্ট্ অথবা শি মিং অন্ততঃ ওদেরকে হত্যা করবে না। হয়তো এদের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। হয়তো এরা ওদের স্বামী স্ত্রী দু’জনকেই কোনো না কোনো বিশেষ কাজে ব্যবহার করবে। তা-ও ভালো তাহলে ওদের সন্তানটিকে ওরা কিছু না হোকÑ খুঁজে দেখবার চেষ্টা করতে পারবে। এমনও তো হতে পারে এরাই ওদের সন্তানটিকে খুঁজে বের করবার চেষ্টা করে একদিন সত্যি সত্যিই সন্তানটিকে খুঁজে বের করে আনবে। সে ক্ষেত্রে ওদের সে প্রচেষ্টার প্রতি ওদেরকে উদ্বুদ্ধ করবার জন্যে একটি ইতিবাচক আবহ ওদের ওপর শিশ মোহম্মদ দম্পতিকেই সৃষ্টি করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই আর ওদের হাতে।
০৭.
আজ সারাদিন উ মিন্ট্ এবং শি মিং কেউই বাড়ীতে ছিলো না। কথাবার্তা যেটুকু হয়েছে তা কেবল শি মিংয়ের স্ত্রীর সঙ্গে। আর কথা বলবার আছেই বা কীÑ শুধুমাত্র যন্ত্রণা আর ওদের ভাগ্য বিপর্যয়ের করুণ ইতিহাসটি ছাড়া। এই কথা বার্তার মধ্যে দিয়ে শি মিংয়ের স্ত্রীও অনেকটাই সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছে ওদের ওপর। এত মিষ্টি ব্যবহার মেয়েটির যে অভিভূত না হয়ে থাকা যায় না। মেয়েটি বার্মিজ কিন্তু ওকে দেখে অথবা অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করেও বিশ্বাস করা যায় না যে মেয়েটি বার্মিজ। কারণ বার্মিজ বৌদ্ধদের শারীরিক গঠনের কোনো বৈশিষ্ট্যই মেয়েটির শরীরে নেই। ওর চোখ, নাক, ঠোঁট, মুখের আদল, গায়ের রং কোনো কিছুই যেন বার্মিজ বৌদ্ধদের শারীরিক গাঠনিক প্রকৃতির সাথে মেলে না। আর সে কারণেই সন্দেহ হয় যে, আসলেই মেয়েটি বার্মিজ বৌদ্ধ কিনা?
মেয়েটির সাথে কথা বলা শেষ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে অসংখ্য চিন্তা, দুশ্চিন্তা করে পুরো দিনটি কেটে গিয়ে এক সময় প্রকৃতিকে অন্ধকার নেমে আসবার আগমনী বার্তা জানিয়ে সন্ধ্যে নেমে এলো। এর মধ্যে কেউ এলো না ওদের খোঁজ করতে। ওরা কিছুটা অস্থির হয়ে উঠলো সাথে অস্বস্তিও বেড়ে গেলো। সন্ধ্যের পর আরও অনেকটা সময় অতিক্রান্ত হলো। সম্ভবতঃ রাত্রি আটটারও কিছু পর মূল সড়কের ওপর একটি জীপ এসে থামলো। জীপটিকে সড়কের বাম দিকে পার্ক করে একজন পঞ্চাশোর্ধ বয়ষ্ক ব্যক্তিÑ যে নিজে জীপটিকে Drive -করছিলোÑ জীপটি থেকে নেমে মূল সড়ক থেকে বাম দিকে বেরিয়ে যাওয়া একটি সরু ইট বেছানো পথ ধরে দ্রুত সামনের দিকে হাঁটতে থাকলো। পথের দু’ধারে ছোটো খাটো ঝোঁপ-ঝাড় তেমন একটা নেই। রাস্তাটির দু’পাশে তাকালে অনেক দূরে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু বৃক্ষের অবস্থান ছায়ার মতো চোখে পড়ে। এ ছাড়া দু’পাশের প্রান্তর একেবারেই বিরান। শস্য উৎপাদনের মতো কোনো উর্বর ভূমিই পথের দু’ধারে নেই। এখানকার মৃত্তিকা যেন পুরোপুরি পাথরের চাইতেও কঠিন। বহু দূরে ইট ভাটির চিমনি থেকে কালো ধোঁয়ার উদ্গীরণ লক্ষ করা যায়। রাত্রির গায়ে জ্বলা জোনাকির আলোগুলি যেন আঁধারের আতঙ্ককে কয়েক মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কারণ দু’পাশে জনবসতির কোনো চিহ্নই নেই। আকাশে তারার ঝিলিমিলি নেই। মনে হয় কতকাল থেকে বুঝি আকাশে চন্দ্রও উদিত হয় না। এ রকম পরিবেশে জোনাকির নিভে জ্বলা আলোগুলি যখন চকিতে জ্বলে উঠে আবার নিভে যায় তখন অনাকাক্সিক্ষত ভীতি যেন মনের আঙ্গিনায় আপনাআপনি ছায়াপাত করে। সব কিছুকেই মনে হয় যেন শশ্মনের শুন্যতার মতো একেবারেই শুনশান। এ রকমের একটি ভীতিকর পরিবেশের ভেতর দিয়ে নির্দ্বিধায় ভীতিহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে ব্যক্তিটি এক সময় কাক্সিক্ষত বাড়ীটিতে পৌঁছে গেলো। বুঝতে কষ্ট হয় না যে, এ ধরনের রাতের অন্ধকারে চলাচল করতে লোকটি অভ্যস্থ। বাড়ীটিতে কলিং বেল ছিলো না। দরোজায় Knock -করবার কিছুক্ষণের মধ্যেই শি মিংয়ের তরুণী স্ত্রী এসে দরোজা খুলে দিয়ে লোকটিকে ঘরের ভেতর আসতে বলে দরোজাটি বন্ধ করে দিলো।
ঘরটিতে প্রবেশ করবার পর দু’টি চেয়ারে দু’জন মুখোমুখি বসে খুবই নিবিড়ভাবে কিছু কথাবার্তা বললো। কী কথা হলো ওদের মধ্যেÑ দু’জনের কেউই প্রকাশ না করে তরুণীটি উঠে পাশের ঘরে প্রবেশ করে শিশ মোহম্মদ দম্পতিকে সাথে করে নিয়ে এসে ওদেরকে দেখিয়ে দিয়ে শুধু বললোÑ ‘ এরাই ওরা। নিয়ে যাও ওদেরকে। উ মিন্ট্ যেভাবে বলেছে ঠিক সেভাবেই সবকিছু করবে।’Ñ এর পর শিশ মোহম্মদ দম্পতিকে বললোÑ ‘আপনারা ওর সাথে যান। ও-ই আপনাদেরকে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেবে।’Ñ আর কিছু বললো না তরুণীটি। লোকটি ওদেরকে নিয়ে যাত্রা করলো জীপটির উদ্দেশ্যে। জীপটিতে স্বামী স্ত্রী দু’জন উঠবার পর আগন্তুক লোকটি জীপটির Steering -এ বসে জীপটি Start- করলো। যে পথ দিয়ে জীপটি এসেছিলো সে পথ দিয়ে এবার আর জীপটি গেলো না। মূল সড়ক ধরে সামনে কিছুদূর গিয়ে একটি বাঁক নিয়ে ভিন্ন একটি রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করলো জীপটি। জীপটির গতি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলো। জীপটি যখন দ্রুত বেগে ধাবিত হতে থাকলো তখন স্বাভাবিকভাবেই দু’টি প্রশ্ন এসে শিশ মোহম্মদকে বিদ্ধ করতে থাকলোÑ ‘ এদের সব কর্মকা- এত গভীর রহস্যে ঘেরা কেন? কী এদের মূললক্ষ্য?’Ñ কিন্তু কোনোভাবেই শিশ মোহম্মদ এ প্রশ্ন দু’টির কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না। শেষ পর্যন্ত নিজেদেরকে ওদের নিয়তির হাতেই সঁপে দিলো।
রাত্রি প্রায় আড়াইটের দিকে জীপটি মায়ানমারের রাজধানী ‘নেপিডো’তে (পুরোনো নাম-ইয়াঙ্গুন) প্রবেশ করলো। প্রবেশ করবার পর সামরিক চেক পোস্টগুলিকে এড়িয়ে যাবার লক্ষ্যে সোজা পথে না গিয়ে কিছুটা ঘুরে ঘুরে Sub-Way-গুলির ওপর দিয়ে খুবই দ্রুত গাড়ী চালিয়ে ওরা পৌঁছে গেলো নির্দিষ্ট বাড়ীটি সামনে। ষাটোর্ধ্ব বয়সের গৃহকর্ত্রী তৈরীই ছিলেন। ওর বাড়ীর সামনে গাড়ীটি থামবার শব্দ পেয়েই ড্রয়িং রুমের দরোজা খুলে দিয়ে অতিদ্রুত ওদের তিনজনকে ড্রয়িং রুমের ভেতরে নিয়ে গেলেন। এবং যিনি জীপটি Drive -করে ওদেরকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি গৃহকর্ত্রীর একটি অনুচ্চারিত নির্দেশের ইঙ্গিত মেনে একটুও সময় নষ্ট না করে তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে জীপটি নিয়ে চলে গেলেন। একটি কিশোরী এসে দরোজাটি বন্ধ করে দিলো।
ড্রয়িংরুমে এসে গৃহকর্ত্রী ওদেরকে সোফায় বসতে বলে ভেতরে গেলেন এবং পরপরই ফিরে এসে ওদের সামনের সোফাটিতে বসলেন। বসে গৃহকর্ত্রীই ওদের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন খুবই নীচু স্বরে। প্রথমেই পুরুষটির দিকে তাকিয়ে দু’টি প্রশ্ন করলেন পুরুষটিকেÑ‘উ মিন্ট্ আমাকে যেভাবে বলেছে এবং যে শারীরিক বর্ণনা দিয়েছে তাতে তো মনে হয় আপনিই শিশ মোহম্মদ বাজবাহাদুর? আমি কি সঠিক বলতে পেরেছি? আর আপনার সঙ্গে যিনি আছেন তিনি আপনার স্ত্রী আলিয়া তুরপুনÑ ঠিক বলেছি তো নাকি?’Ñ সবগুলি কথাই গৃহকর্ত্রী বার্মিজ ভাষাতেই বললেন এবং উত্তরের অপেক্ষায় পুরুষটির দিকে তাকিয়ে থেকে অপেক্ষা করতে লাগলেন। পুরুষটি কিছুটা সময় নিলেন ভাবতে। এর পর বার্মিজ ভাষাতেই তিনিও উত্তর দিলেনÑ ‘ হ্যাঁ, উ মিন্ট্ আপনাকে সত্যি কথাই বলেছে। আমিই শিশ মোহম্মদ। বাজবাহাদুর নামটি আমি আর ব্যবহার করি না। কেন করি না সে কারণটি আমি উ মিন্ট্কে বলেছি। আর আমার স্ত্রীর নাম আলিয়া তুরপুনÑযে আপনার সামনেই আমার পাশে বসে রয়েছে।’Ñএকবার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে কথা শেষ করলেন শিশ মোহম্মদ। তবে ওদের কথা বলার মধ্যে কোনো উচ্ছ্বাস, উৎফুল্লতা তো নেই-ই দু’জনের ঠোঁটে এক চিলতে হাসির রেখাও নেই। দু’জনের মুখোম-ল জুড়েই যেন রাজ্যের হতাশা আর বিষণœতা। আসলে এই মুহূর্তে ওদের মানসিক যে অবস্থা তাতে এ রকম হওয়াটিই বোধকরি স্বাভাবিক। বারবার কেন যেন মনে হচ্ছে ওদেরকে কোনো একটি Interogation Cell -এ নিয়ে কঠোরভাবে Interogate - করা হচ্ছে। এতদূর আসবার পর এখন যেন একটি বিশেষ ভীতির আশঙ্কা অনুভব করছে ওরা। ভাবছে উ মিন্টের প্রথম কথাটিই সত্যি হয়ে যায় যদি! যদি ওদেরকে সত্যি সত্যি হত্যাই করা হয়! কিছুই তো করবার নেই। কী করতে পারবে ওরা? দু’জনই একেবারে চুপসে গেছে। পুরো বিষয়টি গভীর মনযোগ দিয়ে লক্ষ করেছেন গৃহকর্ত্রী। কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন ওদের মানসিক অবস্থা। এ প্রেক্ষিতটি বিবেচনা করে কথা বললেন গৃহকর্ত্রীÑ ‘আমি আপনাদের পুরো মানসিক অবস্থাটিই বুঝতে পেরেছি ভাই। এ রকমের একটি অসহনীয় এবং দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হলে আমারও ঠিক আপনাদের মতো একই অবস্থা হতোÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এটুকু আশ্বাস আমি আপনাদেরকে দিতে পারিÑ যতদিন আপনারা আমার এখানে থাকবেন ততদিন এতটুকু ক্ষতিও আপনাদের হবে না। আর সে রকম দেখলে আমি নিজেই আপনাদেরকে Protection -দেবার সব ব্যবস্থাই করবোÑ আমার এ কথাটির ওপর আপনারা নিঃসন্দেহে আস্থা রাখতে পারেন। আমি আপনাদের সব দুঃখ কষ্টকে নিজের করে নিয়েছি। আমিও একজন মা। আমারও একটি পুত্র সন্তান ছিলো। কিন্তু অনেক দিন আগে পুত্র সন্তানটির বয়স যখন মাত্র দু’বছর এবং যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লোভে গোটা বার্মা জুড়ে সামরিক ত্রাস আর তা-ব শুরু হয়ে গেলো তখন ভুল করে বার্মিজ সেনারা আমার ওই শিশুপুত্রটিকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। পুত্রটিকে হারিয়ে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আমার স্মৃতিভ্রংশ হয়ে গিয়েছিলো। আমার স্বামী বহুদিন পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে আমার চিকিৎসা করিয়ে আমাকে সুস্থ করে তোলেন। আমাকে সুস্থ করে তুলবার কিছুদিনের মধ্যেই বার্মিজ সেনাবাহিনীর ভুলের Compensation - হিসেবে ওই সেনাবাহিনীতেই একজন সেনা সদস্য হিসেবে আমাকে একটি চাকরি প্রদান করে। কিন্তু কোনো সন্তানের মৃত্যু কি পৃথিবীর যে কোনো কিছুর বিনিময় দিয়ে পূরণ করা যায়? আসলে যায় না। আপনারা তো,এক অর্থে আমি বলবোÑ ‘ ভাগ্যবান।’ কারণ আপনারা জানেন না আপনাদের সন্তানটি আজও বেঁচে আছে কি নেই। বেঁচে থাকতেও পারে আবার না-ও পারে। ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’-এর এই দোলাচলের ওপর ভরসা করে এবং শুধুমাত্র সে ধারণাটির ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেই তো আপনারা আপনাদের নিয়তির হাতে নিজেদের জীবনকে সঁপে দিয়ে আজকে এ পর্যন্ত এসেছেন। কিন্ত আমার যে তা-ও নেই। আর এ দুঃখ রাখবার জায়গাও কি আমার আছে?’Ñএকটু থামলেন গৃহকর্ত্রী, তারপর আবার বলতে শুরু করলেন দু’চোখে অশ্রুর ঢল নিয়ে। সারা পৃথিবীর সব মানুষের হাসি, কান্না, দুঃখ, বেদনা আর আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশের ভঙ্গির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবারই একই ধরনের। গৃহকর্ত্রীর বেলাযও এর ব্যতিক্রম হলো না। চোখ ভর্তি পানি নিয়েই তিনি বলে যেতে থাকলেনÑ ‘আপনারা মুসলিম। রোহিঙ্গা মুসলিম। সম্ভবতঃ হাজার বছর ধরে আপনারা বংশ পরম্পরায় বার্মা আথবা মায়ানমারÑযাই-ই বলি না কেন এ দেশের নাগরিক, জাতিগতভাবে বার্মিজ। কিন্তু ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে তদানীন্তন সামরিক সরকার কর্তৃক প্রণীত এবং জারিকৃত একটি অসম্পূর্ণ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে আপনাদের এ অধিকারটি জোর করে কেড়ে নেয়া হয়। আপনাদের নতুন পরিচয় হয়Ñ‘বাংলাদেশী’Ñ বলে। আর এরই সূত্র ধরে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে আপনাদেরকে এ দেশ থেকে বিতাড়নের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। আর এখন তো শুরু হয়েছে সমূলে উচ্ছেদের তা-ব। আমি নিজে রোহিঙ্গা মুসলিম নই, পূরোপুরি বার্মিজ। এবং একজন বার্মিজ হয়েও আমি কখনই এই মুসলিম উৎসাদনের কর্মকা-টিকে মেনে নিতে পারি নি। বিষয়টিকে মনে প্রাণে ঘৃণা করেছি আমি। এবং এখনও ঘৃণা করি ঠিক যেভাবে আগে করেছিলাম। কিন্তু এই ঘৃণাটুকু করা ছাড়া তো আমার একার পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে আর করবারও কিছু নেই। যদিও আমি বার্মিজ সেনাবাহিনীর একজন সদস্য ছিলাম তারপরেও সরকারের এই একটি অখ- জাতিকে দ্বিখ-িত করণের নীতিটিকে আমি সমর্থন করতে পারি নি। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রে বহু ভাষাভাষী, বহু ধর্মের, বহু বর্ণের, বহু গোত্রের মানুষের বাস থাকবেÑএটিই তো স্বাভাবিক। সকল গোত্র, বর্ণ, ধর্ম, উপজাতি, ণৃ-গোষ্ঠির মানুষজনদেরকে নিয়েই সমন্বিতভাবে গড়ে উঠবে একটি বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠিÑ যে জাতিটি গোটা রাষ্ট্রটির প্রতিনিধিত্ব করবে। অথচ আমাদের রাষ্ট্রটিতে হয়েছে এর পূরো উল্টো। সে কারণেই শুধু আমি নই, বার্মার বৃহত্তর জনগোষ্ঠিও সামরিক সরকারের নিকৃষ্টতর এ সিদ্ধান্তটিকে মানতে পারে নি। তাই এসব চিরদিনের মতো বন্ধ করবার লক্ষ্যে আমরা একটি নতুন পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করে যাচ্ছি। সফলতা বিফলতা ভবিতব্যের বিষয়। তবে সবকিছু বিবেচণায় নিয়ে অত্যন্ত সতর্কভাবে আমরা বিচ্ছিন্ন না থেকে ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলন শুরু করেছি। আমার বিশ্বাস আপনারাও আমদের এ গণ-আন্দোলনে অংশ গ্রহন করবেন। আপনারা তো জীবন উৎসর্গ করবার জন্যেই এদেশে ফিরে এসেছেন! এমনও তো হতে পারে এ আন্দোলনেরভেতর দিয়েই আপনাদের সন্তানটিকেও আপনারা ফিরে পেলেন। আবার এ-ও হতে পারেÑ সে আন্দোলনের ভেতরে থেকেই আপনারাও মৃত্যু বরণ করলেন। আমিও বেঁচে থাকতে পারলাম না। কিন্তু আমাদের, আপনাদের সে মৃত্যু হবে গৌরবের, অহংকারের। কেননা আমরা, আপনারা মৃত্যু বরন করেছি আমাদের পিতৃ, মাতৃভূমির সার্বিক জনগণের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্য নিয়ে। এ মৃত্যু কখনই বৃথা যাবে না, অতীতে যায় নি কখনও।’Ñএতক্ষণ কথা বলবার পর আর কথা বাড়ালেন না গৃহকর্ত্রী। গৃহকর্ত্রীর মুখ থেকে এ কথাগুলি শুনবার পর শিশ মোহম্মদ এবং ওর স্ত্রীর চোখে মুখে যেন একটি উজ্জ্বল আলোর তীব্র শিখা মসৃণ স্পর্শ দিয়ে গেলো। বুঝতে পারলোÑ এরা সবাই Under ground -এ থেকে অবাঞ্ছিত সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অতি গোপনে সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ, উজ্জীবিত করে একটি বড় আকারের গণ-আন্দোলন গড়ে তুলে মরণপণ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেছে। এ আন্দোলনে এরা সফল হবে কিনা সেটি নির্ভর করবে পুরোপুরি গণআন্দোলনের অনিরুদ্ধ প্রবল শক্তির মাত্রার ওপর। তারপরেও যদি আন্দোলনটি ব্যর্থ হয় তবুও আন্দোলনের বীজটি নিশ্চিহ্ন হবে না। আবার সে বীজটি থেকেই সে আন্দোলনের অঙ্কুর উদ্গমিত হয়ে পত্র পল্লবে বিকশিত হতে থাকবে কাল থেকে কালান্তরেÑ এটিই ইতিহাস। এই ইতিহাস কখনই মিথ্যে হয় নাÑ অন্ততঃ সে আন্দোলনের অভ্যন্তরে যেখানে জন-আকাক্সক্ষার বিষয়টি অন্তরিত থাকে।
এ পর্যায়ে শিশ মোহম্মদ একটি প্রশ্ন করলো গৃহকর্ত্রীকেÑ ‘ আসলে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবার যোগ্যতা কি আমাদের আছে?’Ñ একটুও সময় না নিয়ে গৃহকর্ত্রী বললেনÑ
‘অবশ্যই আছে। আপনারা তো এ দেশেরই নাগরিক, জন্মগতভাবে এ দেশের মাটি আপনাদের। আর সে মাটিতে বসবাস করা আপনাদের মৌলিক অধিকার। অথচ সেই অধিকার কেড়ে নিয়ে আপনাদেরকে উৎখাত করা হয়েছে। উৎখাতের সময় আপনাদের সন্তানটিকেও আপনাদেরকে নিতে দেয়া হয়নি। আপনার পিতাকে আপনাদের সামনেই হত্যা করা হয়েছে। এখন সময় এসেছে সামরিক জান্তার ওপর সেই বর্বরতার প্রতিশাধ নেবার। আপনারাই তো আমাদের এই মহান আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকবেন। আন্দোলন সফল হবেÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ ঐক্যবদ্ধ জন-মানুষের -------আন্দোলন কখনই ব্যর্থ হয় না। আমরা কখনই আর বর্বর সামরিক জান্তার ক্রীতদাস হয়ে থাকবো না। আমরা সবাই ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবো। এতে যত প্রকার বাধাই আসুক না কেন আমরা অতিক্রম করবো। যত বিপুল ত্যাগেরই প্রয়োজন হোক না কেনো আমরা অকাতরে তা করে যাবো। আপনারা জানেন কোনো মহান অর্জনই সর্বোচ্চ ত্যাগ ছাড়া অর্জিত হয় না। আমরা স্বাধীন হলেও আমাদের স্বাধীনতা আমাদেরই অধীন কিছু সংখ্যক ক্ষমতালোভী, দূরাচারী কর্মকর্তা, কর্মচারীদের হাতের মুঠোয় অসহায়ভাবে বন্দি। আর এই বন্দি-দশা থেকে আমাদের স্বাধীনতাকে মুক্তি দিতে হবে আমাদেরকেই। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমাদের ঐক্যবদ্ধ সফল আন্দোলন গড়ে তুলবার সার্বিক প্রচেষ্টা।’Ñ থামলেন গৃহকর্ত্রী। এতগুলি আবেগপূর্ণ কথা বলবার মাঝেই গৃহকর্ত্রীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। হাতে থাকা রুমাল দিয়ে কপাল এবং মুখম-লের ঘাম মুছলেন গৃহকর্ত্রী। এতক্ষণ যে উত্তেজনার একটি প্রচ্ছন্ন প্রলেপ ওর মুখম-লে ছিলো তা তেমনি স্পষ্ট রয়ে গেলো। গৃহকর্ত্রীর কথাগুলি শ্রবণের মাঝেই শিশ মোহম্মদের মুখাকৃতির ওপর একটি অদ্ভুত কাঠিন্যের ছায়া স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকলো। এত বয়সেও দু’হাতের পেশীগুলি যেন শক্ত হয়ে উঠলো। চোখ দু’টিতে যেন বিষ্ফোরণের ইঙ্গিত লক্ষিত হলো। এতটাই উত্তেজিত হয়েছিলো শিশ মোহম্মদ যে সোফা থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। উঠে দাঁড়িয়েই বললোÑ ‘ এই মুহুর্তে আমি আপনার সামনে অঙ্গিকার করছি যে, আমাদের শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকা পর্যন্ত আমরা আপনাকে অনুসরণ করে চলবো। আপনার প্রতিটি নির্দেশ আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। আমরা তো আমাদের জীবনকে এই বার্মার পবীত্র মাটির কাছে সঁপেই দিয়েছি। আমাদের আর অবশিষ্ট আছেই বা কী?’
০৮.
আর বসে থাকতে পারলো না আলিয়া তুরপুন। সে-ও সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে স্বামীর সিদ্ধান্তের সাথে একমত পোষণ করলো। শুধু বাড়তি একটি কথা বললোÑ ‘আমাদের একটিই অনুরোধÑ আপনি কথা দিন- আন্দোলনের ভেতর দিয়ে যদি আমাদের মৃত্যু হয় আপনি আমাদের লাশ দু’টিকে আরাকানের মাটিতে কবরস্থ করবেন।’Ñ এবার বসলো আলিয়া তুরপুন।
‘সে সিদ্ধান্ত তো আমি আগেই নিয়েছিÑ যখন আপনারা আপনাদের জন্মভূমি আরাকানের মাটিতে চির নিদ্রায় শায়িত হবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। কার মৃত্যু কখন কীভাবে হবে আমি জানি না তবে আপনাদের মৃত্যুর পর আমি যদি বেঁচে থাকিÑ আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আপনাদের ইচ্ছের মৃত্যু আমি কখনই হতে দেবো না। তাছাড়া আমার মৃত্যুর পরেও যাতে আপনাদের ইচ্ছের মৃত্যু না হয় সে ব্যবস্থা আমি আমার জীবদ্দশাতেই করে যাবো। আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন। আর এ কাজটি আমি কেন করবো সেটিরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছেÑ যা অবশ্যই আমি আপনাদেরকে বলবো তবে এই মুহূর্তে নয়। আপনাদেরকে যত গোপনীয় কথা আমি বলেছি সে সব কথার একটি কথাও আপনাদেরকে আমার বলবার কথা নয় তবুও আমি বলেছি কারণ আমি আপনাদেরকে বিশ্বাস করেছিÑযেহেতু আমি আপনাদেরকে চিনি। আর এই চিনবার সূত্র ধরেই আপনাদের ওপর আমার আস্থা এবং বিশ্বাস এতটাই দৃঢ়তর হয়েছে যে, আমি নিশ্চিত হয়েছিÑআমি বা আমাদের কোনো প্রকার ক্ষতি সাধন করন কোনোভাবেই আপনাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও আপনারা আমাকে চেনেন না, আমার কর্ম সম্পর্কে আপনাদের কোনো ধারণা নেই, অবশ্য থাকবার কথাও নয়। তারপরেও সময় হলেই আপনারা সবকিছু জানতে পারবেন এবং প্রত্যক্ষ করবেন। ’Ñআর কিছু বললেন না গৃহকর্ত্রী। এর মধ্যে পূর্বের সেই কিশোরীটি একটি ট্রে-তে করে তিন কাপ কফি এনে সোফার টেবিলে রেখে চলে গেলো। তিনজন এক সঙ্গেই কফি পান করলেন। কফি পান শেষে গৃহকর্ত্রী ওদেরকে আর একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে বললেনÑ ‘এ কক্ষেই আপনারা থাকবেন। এর সাথে Attached Bathroom - আছে। Bathroom-G Towel ¯œানের আনুষঙ্গিক সব কিছুই আছে। এবং আপনাদের পড়বার জন্যে বার্মিজ জামা কাপড়ও দেয়া আছে। তাহলে এবার আপনারা ঘুমিয়ে পড়–ন, আমি আসি।’Ñ বলে গৃহকর্ত্রী কক্ষটি থেকে বেরিয়ে গেলেন। গৃহকর্ত্রী বেরিয়ে যাবার পর ওরা ওদের জন্যে নির্ধরিত বিছানায় শুয়ে পড়ে না-না কিছু ভাবতে থাকলেন।
কী হতে যাচ্ছে সামনের দিনগুলিতে। গৃহকর্ত্রী যা বলে গেলেন তার মর্মকথা একটিইÑ প্রবল গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সামরিক জান্তাকে উৎখাত করে জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতেই অর্পণকরণ। কিন্তু এ অতি-দুঃসাধ্য কাজটিকে কি আদৌ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে এদের পক্ষে? যদি না হয় তাহলে কী হবে? তাছাড়া আমাদের ওপর এত আস্থাই বা রাখছেন এরা কিসের ওপর ভিত্তি করে? আমাদেরকে এরা এত বেশী বিশ্বাসই বা করছেন কেন? আর আন্দোলন, বিশেষতঃ রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবার জন্যে যে তারুণ্যের প্রবল শক্তি-জোয়ারের প্রয়োজন তা-ও তো আমাদের নেই। আমাদের বয়স তো সেটি অনুমোদন করে না। এসব কিছু চিন্তা করবার পরেও ওরা স্বামী স্ত্রী দু’জন পরামর্শ করে স্থিরসিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, প্রকৃতই যদি আন্দোলন গড়ে ওঠেÑ ওরা সে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবে। আর সে আন্দোলন করতে গিয়ে যদি ওদেরকে মৃত্যুকেও জড়িয়ে ধরতে হয় তবুও সে মৃত্যুকেই ওরা ওদের সৌভাগ্য বলে মেনে নেবে। কারণ ওরা আরাকানের মাটিতেই চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে পারবে অনাদি অনন্তকালব্যপী। এর চাইতে বড় প্রাপ্তি ওদের জীবনে আর কিছু নেই। যদি সন্তানটি বেঁচে থাকে আর ওকে ফেরৎও পাওয়া যায় তাহলেও মায়ানমারের বর্তমানের এই Perspective -এ সেটি হবে একটি অতিরিক্ত প্রাপ্তি। কেননা এখন ওদের কাছে সন্তান প্রাপ্তিটি বার্মার সামরিক জান্তার একচ্ছত্র আধিপত্য এবং মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া নির্মম নির্যাতনের বাহুবন্ধ থেকে জাতীয় মুক্তির অর্জনটিকে সম্ভব করে তুলবার চাইতে মহীয়ান কিছু নয়। এবং এই লক্ষ্যে ওরা গৃহকর্ত্রীর সম্মুখে অঙ্গীকারও করেছে। ওরা অঙ্গীকারাবদ্ধÑ যে অঙ্গিকার থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হবার অভিপ্রায়ও ওদের নেই। ওরা স্থির-সিদ্ধান্ত। যার জন্যে এ সিদ্ধান্ত সে কিন্তু মূলতঃ ওদের সন্তানটিইÑ যদিও ওরা ভাবছে চূড়ান্তভাবে নির্যাতন, নিপীড়ন থেকে নিঃসীম মুক্তিই ওদের মোক্ষ তথাপি সন্তান প্রাপ্তির লক্ষ্যটি মনের কোনও এক গহীন কোণে টিমটিমে প্রদীপের মতো যেন জ্বলছে। প্রতি পলে ওরা সেটি অনুভব করতেও পারছে। আর এ বিষয়টিই যে ওদেরকে সম্ভাব্য জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে অংশ গ্রহণের জন্যে প্রবুদ্ধ করেছেÑএতে কোনও সন্দেহ নেই।
এভাবে অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে অতিক্রান্ত হয়ে গেলো পনেরোটি দিন। এই পনেরো দিনে একটি বিষয় লক্ষ করলো শিশ মোহম্মদ দম্পতিÑ এক দিন পরপর গৃহকর্ত্রী মধ্যরাত্রিতে বাড়ী থেকে বেরিয়ে যান, ফেরেন ভোরের আলো ফুটে উঠবার সামান্য পূর্বে। এটি যেন গৃহকর্ত্রীর ঠিক রুটিন ওয়ার্কের মতো। তিনি কোথায় যান কী করেনÑ এসব জানবার প্রচুর কৌতূহল থাকলেও ওর সামনে প্রকাশ করতে পারে না শিশ মোহম্মদ দম্পতি। গৃহকর্ত্রী নিজে থেকেও কিছুই বলেন না। তবে শিশ মোহম্মদ দম্পতির ধারণাÑ রাজনৈতিক কারণেই গৃহকর্ত্রী মধ্যরাত্রির পরপরই বাড়ী থেকে বেরিয়ে যান। এসব নিয়ে যতটা না ভাবা যায় ততটাই ভালো বলে ধরে নিয়ে চুপ করে থাকাকেই শ্রেয়তর মনে করে ওরা। এবং ওরা আর এ নিয়ে কোনোকিছুই ভাবে না।
০৯.
পনেরো দিন পেরিয়ে যাবার পর একদিন গৃহকর্ত্রী রুটিন অনুযায়ী মধ্য রাত্রিতে কেন যেন বাড়ী থেকে বেরুলেন না। বাড়ীতেই থেকে গেলেন। অনেক রাত হয়ে যাবার পরেও ঘুমোবার জন্যে বিছানাতেও গেলেন না । কক্ষের ভেতর বার কয়েক পায়চারী করে আবার সোফায় এসে বসলেন। আবার সোফা থেকে উঠে পায়চারী করলেন। আবার সোফায় এসে বসলেন। কেমন যেন এক ধরনের অস্থির হয়ে উঠতে থাকলেন তিনি। সময়ের গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বারবার তিনি যেন অস্থিরতর হয়ে উঠতে থাকলেন। মনে হলো প্রচ- আগ্রহ নিয়ে আর চরম উন্মুখ হয়ে কিসের জন্যে যেন তিনি হয়তো অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষার প্রহরটি বুঝি আর শেষ হতে চাইছে না। চোখে মুখে যথেষ্ট উদ্বিগ্নতার চিহ্নও ফুটে উঠেছে। কিছুতেই যেন আর ধৈর্য ধারণ করতে পারছেন না। ঠিক এমনি সময় বাইরের দরোজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। ঠিক এ শব্দটির জন্যেই বোধকরি তিনি অপেক্ষা করছিলেন। দ্রুত সোফা থেকে উঠে গিয়ে বাইরের দরোজা খুলে আবার বন্ধ করে দিয়ে নিজের কক্ষে প্রবেশ করে দরোজা বন্ধ করে দিলেন। ফিস্ ফিস্ করে কার সঙ্গে যেন অত্যন্ত গোপনীয় কিছু কথা বললেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে শিশ মোহম্মদ দম্পতির কক্ষের সামনে গিয়ে ওদেরকে ডেকে তুলে নিজের কক্ষে নিয়ে এলেন। কক্ষে প্রবেশ করে শিশ মোহম্মদ দম্পতি দেখলো সোফার ওপর উ মিন্ট্ বসে রয়েছে। চেহারাটি বিদ্ধস্ত, খোঁচা খোঁচা দাড়িতে দু’গাল ভরে গেছে। বোঝা যায় কয়েকদিন শেভ করা হয়নি। ঠোঁট দু’টি শুকনো। দৃষ্টি শিশ মোহম্মদ দম্পতির ওপর। শিশ মোহম্মদ দম্পতি কিছু বলবার আগেই গৃহকর্ত্রী ওদের কে উদ্দেশ্য করে বললেনÑ ‘ আজকে এই মুহূর্তে একজনের সঙ্গে আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেবো। ওকে আপনারা চেনেন বার্মিজ সৈনিক উ মিন্ট হিসেবে কিন্তু ও আপনাদেরকে চেনে ভিন্ন পরিচয়েÑ যা আপনারা জানেন না। আর এই না জানা পরিচয়টিই আপনাদেরকে জানাবার জন্যেই আজ আমি ওকে বাড়ীতে ডেকে পাঠিয়েছি। ওর হাতে সময় খুবই সামান্য। আপনারা জানেন Ñ আমিই আপনাদেরকে বলেছি- থারটিন্থ অক্টোবর আমাদের দেশে কী ঘটতে যাচ্ছে! সে দিনের সেই বিস্ফোরণটি সফল করবার জন্যেই ওকে এখুনি এখান থেকে চলে যেতে হবে। যেহেতু সেদিন কী ঘটবে আমরা কেউই জানি না। আমরা কে বেঁচে থাকবো আর কে থাকবোনাÑ সবই ভবিতব্য। তাই এ রকম একটি পরিস্থিতিতে ওর সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেয়াটাকে আমার নৈতিক কর্তব্য বলে মনে করেছি। এই পরিচয়টুকু করিয়ে দিতে না পারলে আমার মৃত্যুর পরেও আমার আত্মা শান্তি পাবে না। আপনারা আমার সামনে আসুন।’Ñ ওরা সোফা থেকে উঠে সামনের দিকে এগুতে থাকলো, উ মিন্ট্ও সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ওদের মুখোমুখি হলো। এবার উ মিন্টের ডান হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে গৃহকর্ত্রী শিশ মোহম্মদের একটি হাত টেনে নিয়ে উ মিন্টের হাতটি ওই হাতটির তালুতে স্থাপন করে শুধূ বললেনÑ ‘এই আপনাদের সন্তানÑ ‘সোয়ে উ মিন্ট’Ñ যাকে আপনারা তিরিশ বছর আগে এই বার্মাতেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। অর্থাৎ বার্মিজ সামরিক জান্তা তিরিশ বছর আগে আপনাদের সন্তানটিকে আপনাদেরকে না দিয়েই আরাকানের মাটি থেকে আপনাদেরকে উচ্ছেদ করেছিলো। আমি নিঃসন্তান। অনেক কষ্টে বার্মিজ সৈনিকদেরকে বুঝিয়ে, শান্ত করে নিজের সন্তান বলেই গ্রহণ করে তিলে তিলে বড় করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছি। যাতে কোনো দিন যদি ওর সাথে আপনাদের দেখা হয় আর ওর পরিচয় আপনারা পেয়ে যানÑ সেদিন যেন বলতে না পারেন যে, আপনাদের সন্তানটিকে আমি মানুষ করি নি। আমি যদি বেঁচে থাকি সেদিন যেন আমি আপনাদেরকে বলতে পারি আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী অন্ততঃ চেষ্টাটুকু করেছি।’Ñ দু’চোখের অব্যাহত বহমান পানির ধারা মুছবার চেষ্টা করলেন গৃহকর্ত্রী।
মুহূর্তের মধ্যেই গোটা পরিবেশের আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে গেলো। সৃষ্টি হলো এক বিষণœ বিধূর করুণ পরিবেশের। ভীষণ রকমের আবেগাপ্লুত হয়ে উ মিন্ট্ জড়িয়ে ধরলো ওর বাবা মাকে। গৃহকর্ত্রী ওদের তিনজনকেই জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করলেনÑ‘আমি আমার সর্বশেষ দায়িত্বটি পালন করতে সক্ষম হয়েছি। আমার হৃৎপি-ের ওপর থেকে এত দিনের একটি দুর্বহ ভার অপসারিত হয়েছে।’Ñ উ মিন্টএক উদ্দেশ্য করে বললেনÑ‘তোমাকে আমি তোমার বাবা মায়ের হাতে তুলে দিতে পেরেছিÑ এর চাইতে বড় কোনও আনন্দ আর সুখ বলে আমার কাছে কিছু নেই।’Ñশিশ মোহম্মদ দম্পতিকে উদ্দেশ্য করে বললেনÑ ‘উ মিন্ট্কে অপনাদের হাতে তুলে দিয়ে আমি আমার দায়িত্ব, কর্তব্য দু’টিই পালন করলাম। এখন থেকে এ দায়িত্ব এবং কর্তব্যটি আপনাদের।’Ñ থামলেন গৃহকর্ত্রী। আবার চোখ মুছলেন।
শিশ মোহম্মদ দম্পতি আর স্থির থাকতে পারলো না। আবেগও ধরে রাখতে পারলো না। এতক্ষণ যেন ওরা ওদের চৈতন্যই হারিয়ে ফেলেছিলো। হঠাৎ যেন চেতনা ফিরে পেয়ে গৃহকর্ত্রীর দু’টি হাত জড়িয়ে ধরে উথলে ওঠা আবেগ কোনোমতে সামান্য সংবরণ করে বলতে থাকলো শিশ মোহম্মদÑ ‘কী বলছেন আপনি! আমরা আমাদের সন্তানটি জীবিত দেখতে পেলামÑ এই-ই তো আমাদের কাছে সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। আমাদের আরকিছুই পাওয়ার নেই।’Ñ শিশ মোহম্মদের কথা শেষ না হতেই কথা বলে উঠলো ওর স্ত্রী আলিয়া তুরপুনÑ ‘আমি উ মিন্টের জন্ম দিয়েছি সত্যিই কিন্তু ওর প্রতি কোনও দায়িত্বই আমরা পালন করতে পারি নিÑ যেটি সম্পূর্ণই করেছেন আপনি। ওকে বড় করে তুলেছেন, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছেনÑ যা হয়তো আমরা নিজেরাও করতে পারতাম না বার্মার সে সময়ের বিরূপ পরিবেশে। তাই আমরা ওর মা, বাবা হলেও ওর প্রকৃত মা আপনিই একই সাথে বাবাও। কেননা ওর বাবার দায়িত্বটিও আপনাকেই পালন করতে হয়েছে এবং আপনি তা নিষ্ঠার সাথে করেছেন। আর সে কারণেই উ মিন্ট্ এতদিন যেমন আপনার সন্তানই ছিলো ভবিষ্যতে তাই-ই থাকবে। আমরা আর কোনো দিনই ওকে পুত্র বলে দাবী করবো না। আমরা শুধু দেখে গেলাম আমাদের সন্তানটি বেঁচে আছে এবং আপনার কাছেই আছে। আর কিছুই চাই না আমাদের।’Ñ এবার উ মিন্ট কথা বললোÑ ‘ আমি কত দিন থেকে থেকে যে তোমাদেকে খুঁজে ফিরছিÑ হিসেব করে বলতে পারবো না। মা’ই তোমাদেরকে খুঁজে বের করবার জন্যে আমাকে প্রতিনিয়তই নির্দেশ দিয়েছেন। আমিও সে নির্দেশ পালন করবার জন্যে প্রতিদিনই তোমাদেরকে খুঁজে ফিরেছি। কিন্তু পাই নি। তোমাদেরকে খুঁজবার জন্যে আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লুকিয়ে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশেও গিয়েছিলাম। বেশ কিছুদিন সে দেশে আমি ছিলাম। কিন্তু তোমাদের খোঁজ পেতে সে দেশেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। ফিরে এসেছিলাম আবার বার্মায়। কিন্তু এত বছর পর যেভাবে তোমাদেরকে আমি পেয়েছি তা আমি কল্পনাও করিনি কখনও। এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে আমার চাইতে সুখী বোধহয় পৃথিবীতে আর কেউ নেই।’Ñ এরপর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে আবার বলেছেÑ ‘মা, বাবা আমাকে এখুনি চলে যেতে হবে। থারটিন্থ অক্টোবর সামনেই। আমার আর সময় নেই। আমি যাই। তবে একটি কথাÑ ‘ থারটিন্থ অক্টোবরের সভামঞ্চে তোমাদের তিনজনকেই থাকতে হবেÑ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবার জন্যে। আমার মৃত্যুও যদি হয় তোমরা আন্দোলনকে এগিয়ে নেবে। কোনোক্রমেই আন্দোলন যেন ব্যর্থ না হয়। বার্মার জনগণ সামরিক জান্তার নিষ্পেষণ থেকে যেন মুক্ত হয়। এটি-ই আমার জীবনের একমাত্র আকাক্সক্ষা।’Ñ এ কথা ক’টি বলে গৃহকর্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে আবার বললোÑ ‘মা, তোমাকে যেভাবে বলেছি ঠিক সেভাবে আজ শেষ রাতের আগেই তোমরা সবাই এখান থেকে চলে যাবে। যেখানে যাবে সেখানে তোমাদের জন্যে সব ব্যবস্থাই করা আছে। শেষ রাত্রির আগে এখানে একটি জীপ আসবে আর সেই জীপের ড্রাইভার তোমাদেরকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে।’Ñ তিনজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো উ মিন্ট। ভোর হবার আগেই অবশিষ্ট তিনজনও নির্ধারিত জীপটিতে উঠে বেরিয়ে গেলো বাড়ী থেকে।
১০.
এলাকাটি আপাততঃ জনশুন্য। যাকে বলা যায় একেবারেই বিরান প্রান্তর। গোটা প্রান্তরটি জুড়ে কোনো শষ্য ক্ষেতের চিহ্নমাত্র নেই। বড় অথবা মাঝারি আকৃতির বৃক্ষ বলতে যা বোঝায় তারও কোনো অস্তিত্ব নেই। কিছুদূর পর পর ছোট ছোট উদ্ভিদের নগণ্য কিছু ঝোপ ঝাড় চোখে পড়ে। মাঝে মধ্যে আকাশের গায়ে দু’একটি ছোট, বড় পাখির আনাগোনা দেখা গেলেও সচরাচর সব সময় দেখা যায় না। অব্যাহত Auto Rifle -এর অন্তর্ভেদী শব্দ মুক্ত অসীম আকাশে পাখিদের ইচ্ছেমতো উড়ে চলবার সচ্ছন্দ স্বাধীনতাটুকুও নেই। এ সবই একমাত্র অবৈধভাবে ক্ষমতাকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদে হাতের মুঠোয় মুষ্ঠিবদ্ধ করে আকড়ে রাখবার জন্যে। সবকিছুই রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যে। রাজনীতির ঘোরতর বিপদ-সঙ্কুল পথ পরিক্রমায় যদি কোনোভাবে একবার লোভের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে তাহলে জনকল্যাণ নামের মূল লক্ষ্যে কোনোমতেই পৌঁছোনো যাবে না এবং সেই লোভের আগুনে পুড়ে নিজেরাই ছাই হয়ে যাবে। যেহেতু রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যই হলো জনকল্যাণ। আর রাজনীতি বিভ্রান্তিক হলে সেই পথ পরিক্রমা থেকে কিছুই আর অর্জিত তো হবেই না বরং আত্মধ্বংসই নিশ্চিত হবে। যে রকমটি হয়েছে বর্তমান বার্মার সামরিক জান্তার ক্ষেত্রে।
অবশ্য এর আগেও যে জাতি এবং সম্প্রদায়গত কারণে মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গা মুসলিম বিতাড়ন এবং রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় নি তা নয়Ñ হয়েছে, যার প্রমাণ এখনও মায়ানমার থেকে বিতাড়িত পাঁচ লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত এবং উচ্ছেদকৃত রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশেই বসবাস করছে। অথচ তারা বাংলাদেশের নাগরিক নয়। জাতিগতভাবে তারা বার্মিজ এবং নাগরিক হিসেবে ‘আরাকানী’- মুসলিম। এই আরাকান রাজ্যটি ছিলো বার্মারই একটি প্রদেশ। চারশত বছরেরও অধিক কাল থেকে তারা বংশানুক্রমিকভাবে আরাকান প্রদেশে বসবাস করে আসছে। বার্মিজ সামরিক সরকার বিদ্বেষ-প্রসূতভাবে ‘আরাকান রাজ্য’-টির নামটিও পরিবর্তন করে ‘রাখাইন রাজ্য’- হিসেবে গ্রহণ করে এবং নোংরা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে রাখাইন সম্প্রদায়ের বৌদ্ধদেরকে তাদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিয়ে এসে এই রাখাইন রাজ্যে বসতি নির্মাণের ক্ষেত্রে সার্বিক সহায়তা প্রদান করে। বার্মিজ হিসেবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সে দেশে তাদের যে ভোটের অধিকার ছিলো ১৯৯২ সালে তা-ও কেড়ে নেয়া হয়। বিগত নির্বাচনে তারা ভোট প্রদান করতে না পারলেও অউং সান সুচির দল ‘এন এল ডি’কেই তারা সমর্থন করেছিলো। শুধু সমর্থনই নয় সুচির দলের হয়ে তারা প্রত্যক্ষভাবে কাজও করেছিলো। তাদের স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকার স্বীকৃত অনুমোদন ছিলোÑ যে অনুমোদনের ক্ষমতাবলে তারা তাদের স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় বিক্রয় করতে পারতো। অথচ তাদেরকেই বর্তমান মায়ানমারের বেসামরিক সরকার তাদের নিজ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে গ্রামের পর গ্রামে তাদের বাড়ী ঘরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তিসহ অন্যান্য সম্পদও আত্মসাৎ করছে। যেটির সূত্রপাত করেছিলো সরাসরি সে দেশের ১৯৮২ সালের তদানিন্তন সামরিক সরকার। আর এখন করছে একজন ‘Nobel Laureate’ State Councilor -এর অধীন একটি অসামরিক সরকার। পার্থক্যটি এখানেই এবং গোটা ‘বিশ্ব-মানবতার’- দুঃখটিও এখানেই। এবং এখনকার বেসামরিক সরকার যা করছে তা পূর্বেকার সামরিক সরকারের চাইতেও কয়েকগুণ বেশী ভয়াবহ। অনেকে এটিকে মায়ানমার সরকারের EthnicCleansing - বলে আখ্যায়িত করতে চান কিন্তু মূল Context -তার চাইতেও অনেক বেশী ভয়ঙ্কর।
এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, বর্তমানে সে দেশের ‘ÔState CouncilorÕ - তার দেশের নির্বাচনের ভেতর দিয়েই জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদের প্রতিনিধি। আর সংসদে তার দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবার কারণেই ওই ‘Nobel Laureate’- নেত্রী আজকে সে দেশের ‘ÔState Councilor.. আর সেই নির্বাচনে তার দল NLD- (National League for Democracy)-কে সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দেবার ক্ষেত্রে এই রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠিরও একটি বিশাল ভূমিকা ছিলো। যদি তারামায়ানমারের নাগরিক হিসেবে এই অবদানটুকু না রাখতোএবং NLD -কে অগ্রাহ্য করতো তাহলে বর্তমান মায়ানমারের প্রেক্ষাপট হয়তো ভিন্ন প্রকৃতির হতে পারতো। রোহিঙ্গা মুসলিমরা তাদের পূর্ণ সমর্থন সুচির দলকে নিঃসঙ্কচিত্তে প্রদান করেছিলো শুধু এইটুকু প্রত্যাশা বুকে নিয়ে যে, বেসামরিক সরকার গঠিত হলে সামরিক সরকারের চরম অত্যাচার, নির্যাতনের পরিবর্তে তারা কিছুটা হলেও অন্ততঃ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। সন্তান সন্ততিদের মুখে দু’মুঠো আহারের সংস্থান করে তারা তাদের সন্তানদেরকে শিক্ষায় দীক্ষায় মানুষ করে তুলতে পারবে।
১১.
কিন্তু সামরিক জান্তার নির্যাতন আর নিষ্পেষণই স্বাধীনভাবে পথ চলবার, সচ্ছন্দে আত্ম-উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবার এবং চিরস্বাধীন বিহঙ্গ-কুলের মুক্ত অসীম আকাশে মুক্ত ডানা মেলে উড়ে চলবার পথে সবচাইতে বড় বাধা ওদের জন্যে। এ বিষয়টিকে গভীরভাবে অনুভব করলে স্বভাবতই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, গোটা মায়ানমারের আকাশেই বোধকরি কোনো পাখিই ওড়া উড়ি করে না। অত্যন্ত হীন রাজনৈতিক স্বার্থে উন্মুক্ত আকাশটিকেও অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। এটি চিরকালের নিঃসীম-উদার প্রকৃতি করে নি। করেছে দেশটির বেসামরিক সরকারের নেপথ্যে সে সরকারের পিঠে Auto Rifle-এর Barrel -ঠেকিয়ে দ-ায়মান ক্রুর, হিং¯্র আর একটি অদৃশ্য সামরিক জান্তার দাম্ভিক উপস্থিতি। যে জান্তার আদেশ, নির্দেশ এবং অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করবার সাহস এবং ক্ষমতা কোনোটিই ওই বেসামরিক সরকারটির নেই। আর সেই অসহায় বেসামরিক সরকারটির প্রধান শান্তিতে ‘NOBEL’-বিজয়ী একজন নেত্রী- যাকে পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকটি দেশ মিলে- বিশ্ব শান্তিতে তো নয়ই এমন কি তার নিজ দেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত জনগণের জীবনে শান্তি আনয়নের ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষভাবে যার ন্যূনতম কোনো অবদান নেই, যার দেশের আপামর নি¤œ আয়ের উপায়হীন সাধারণ মানুষগুলি অর্ধাহার, অনাহার আর জাতিগত বৈষম্যের শিকারে পরিণত হওয়া হারজিরজিরে কঙ্কালে রূপান্তরিত হয়ে যাবার পরেও তাদের ভাগ্য উন্নয়নে বিন্দুমাত্র দৃশ্যমান দৃষ্টান্ত না থাকবার পরেও শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় শান্তিতে ‘NOBEL’-এর মতো একটি অতি সম্মানজনক পুরস্কার ওই নেত্রীর হাতে তুলে দিয়েছিলো যে দেশগুলির পৃষ্ঠপোষকরা- সেই দেশগুলিই আজকে ‘রোহিঙ্গা ইস্যু’তে সারা বিশ্বের শান্তিকে চরম সংকটের মুখে ঠেলে দেবার জন্যে একমাত্র তাকেই দায়ী করে তাকে Genocide -সংঘটনের মতো অমার্জনীয় অপরাধে অভিযুক্ত করে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এবং তিনি Genocide -এর মতো জঘন্য অপরাধটি করেছেন মায়ানমারের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসবার পর। অথচ মায়ানমারে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি থাকবে না, অন্ততঃ শান্তিতে জনগণ তাদের সন্তান সন্ততি নিয়ে রাত্রিটুকুতে ঘুমোতে পারবেÑ এটুকু প্রত্যাশা করেই মায়ানমারের জনগণ মায়ানমারের সংসদে তার দলকেই সংখ্যাগরিষ্ট আসনে বিজয়ী করেছিলো। এবং নির্বাচনের আগে তিনিও তার জনগণকে সে প্রতিশ্রুতিই প্রদান করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য মায়ানমারের জনগণের যে, নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তাদের নেত্রী সামরিক সরকার প্রণীত সংবিধানটিকেই মেনে নিয়েছিলেন এবং তার প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিকে তিনি নিজের হাতেই হত্যা করেছিলেন ওই সংবিধানটিকে মেনে নিয়েÑ যে সংবিধানটিতে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংসদের মোট আসন সংখ্যার এক চতুর্থাংশ আসন সংরক্ষিত থাকবে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য। এবং সংবিধানে যে কোনো ধরনের পরিবর্তন আনয়ন করতে হলে পরিবর্তনের অনুকূলে প্রয়োজন হবে দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন। বোঝাই যায় সামরিক সদস্যদের সমর্থন ব্যতিত কোনোভাবেই সংবিধান পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না এ বেসামরিক সরকারের পক্ষে। আজকের State Councilor -ওই নেত্রী বিষয়টি ভালো করে জেনে বুঝেই এবং ওই সংবিধানটিকে মেনে নিয়েই বেসামরিক সরকার গঠন করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি জানতেন সামরিক বাহিনীর আজ্ঞাবহ হয়েই তাকে তার বেসামরিক সরকারটিকে পরিচালনা করতে হবে। তবুও তিনি তার নেতৃত্বে বেসামরিক সরকারটি গঠন করেছিলেন শুধুই ক্ষমতার লোভে। ফল যা হবার তাই-ই হয়েছেÑ ‘তিনি অসামরিক সরকার গঠন করে সে সরকারের প্রধান হয়ে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু ক্ষমতা পান নি।’ সে ক্ষেত্রে জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে তিনি কোনো প্রকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেনই বা কী করে? যেহেতু সামরিক সরকার প্রণীত দেশটির সংবিধান অনুযায়ী তিনিই বর্তমান মায়ানমারের অসামরিক সরকারের- ‘‘StateCouncilor’-অর্থাৎ সরকার প্রধানÑ কিন্তু প্রকৃত অর্থে যার কোনো ক্ষমতাই নেই। পক্ষান্তরে জনগণের কাছে যার আছে আকণ্ঠ দায়। সোজা কথায়Ñ ‘ দায় আছে, দায় পরিশোধের ক্ষমতা নেই।’
কিন্তু তিনি যদি এ বিশাল দায়টিকে জনকল্যাণের আন্দেলন, সংগ্রামের মূল চাবিকাঠি হিসেবে গ্রহণ করে সে চাবিটির ভার নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে তাকে প্রদত্ত তার জনগণের বিপুল সমর্থন অতি বিচক্ষণতার সাথে কাজে লাগিয়ে এবং তার জনগণকে সাথে নিয়ে জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্যে সামরিক সংবিধান পরিবর্তনের লক্ষ্যেÑ যতক্ষণ পর্যন্ত না সামরিক জান্তা বাধ্য হয় সব পক্ষের সাথে শান্তিপূর্ণ আলোচনা করে সংবিধানের সকল অসঙ্গতি দূর করে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সার্বভৌম জাতীয় সংসদ গঠন করে সেই সংসদের ভেতর থেকে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী এবং সক্ষম গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করবার লক্ষ্যে তীব্র গণ-আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারতেন তাহলে বার্মার ভাগ্যকে আজকের এই কলঙ্কিত পরিনতির দূর্লঙ্ঘ ভার বহন করতে হতো না। কিন্তু তা তিনি করেন নি। বরং সামরিক জান্তার হাতকেই শক্তিশালী করবার অকুণ্ঠ প্রয়াস চালিয়েছেন। জনগণের ভাগ্য নিয়ে ভাবেননি মোটেও। ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকেও তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন অত্যন্ত অসম্মানজনক এবং অসহায়ভাবে। এটি যে বার্মিজ জাতির ললাট জুড়ে সীমাহীন লজ্জা আর দুর্ভাগ্যের বিশাল কালো তিলক সেটিকে তিনি মোটেও মূল্য দেন নি এবং অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতেও চান নি।
১২.
কেটে গেছে আরও বহুদিন। দিনে দিনে ঘণিভূত হয়েছে জনতার ঐক্য। কয়েক খ-ে খ-িত হয়েছে মগ নামে পরিচিত উপজাতিটির একতাবদ্ধতা। একটি খ- থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আর একটি খ-। একটি খ-াংশের ওপর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে আর একটি খ-াংশ। কোনো অংশই কোনো অংশকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অবিশ্বাস আর সন্দেহ তাদের আত্মবিশ্বাসকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে। তারপরেও ওই খ-াংশগুলির কোনো কোনোটি এখনও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে সামরিক জান্তাকে। তবে পূর্বে যেটি একচ্ছত্র ছিলো এখন সেটি বহুধাবিভক্ত। আর এ বিষয়টি উপলব্ধি করে সেনাবাহিনীর উচ্চ স্তরও হয়ে পড়েছে বিচলিত, দ্বিধান্বিত। কিন্তু এ বিচলন এবং দ্বিধান্বয়কে কাটিয়ে উঠতে তারা হয়েউঠেছে আরও ক্ষিপ্ত, হিংস্র আরও বেশী আক্রমণাত্মক। থারটিন্থ অক্টোবরের জনসমাবেশটিকে টারগেট করে তারা ইতিমধ্যেই অঙ্কন করে নিয়েছে তাদের হত্যাযজ্ঞ পরিকল্পণার নিপুণ নক্শা।
সাধারণ জনগণও বসে নেই। তারাও প্রহরে প্রহরে ফুসে উঠছে দাবানলের মতো প্রতিশোধ গ্রহণের শপথ নিয়ে। এতদিন ধরে যে নিপীড়ন, নির্যাতন তারা উপায়হীনভাবে মুখ বুজে সহ্য করে এসেছেÑ আজকে লগ্ন সমাগত সে সব অত্যাচার, নির্যাতনকে তাদের ক্ষোভের দাবানলের লেলিহান শিখায় পুড়িয়ে ছারখার করে দেবার। জীবন দিয়ে হলেও তাদের পবিত্র শপথকে রক্ষা করবার জন্যে আজ তারা মরিয়া। এমন কোনো শক্তি এখন আর নেই নেই যা তাদের এই শপথকে ভেঙ্গে ফেলতে পারে। যেহেতু তারা জীবনের বাজি ধরেছেÑ এটি তাদের দৃঢ়ীভূত আত্মবিশ্বাস।
১৩.
আজ থারটিন্থ অক্টোবর।
অক্টোবর মাসের তেরো তারিখ। বার্মিজ জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের দিন। আজকেই বিস্ফোরণটি ঘটবার কথা। সামরিক বাহিনীও সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে এই আন্দোলনটিকে যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করবার জন্যে। মধ্যরাত্রি থেকেই নেপিডোর বড় বড় সড়কগুলিতে ট্যাংকের টহল শুরু হয়েছে। সামরিক যান চলাচলের মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জনসাধারণের ভেতর ভীতি আর আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে মাঝে মাঝে ফাঁকা গুলিবর্ষণও করা হচ্ছে। যাতে কোনোভাবেই লোকজন রাস্তায় নেমে আসতে না পারে। অথচ নেপিডোর অউং সান স্কোয়ারে এনএমডিবি (ন্যাশনাল মুভমেন্ট ফর ডেমোক্রেটিক বার্মা)-এর আজকের জনসভাটি করবার জন্যে সামরিক জান্তাই অনুমতি প্রদান করেছিলো। অনুমতিটি প্রদান করবার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি তাদের মাথায় কাজ করেছিলো সেটি হলো সোজ কথায় আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক বিশ্বকে এটি বোঝানো যে, গণতন্ত্রকে তারা মর্যাদা দেয় এবং গণতন্ত্রের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল। এ কারণেই বিরোধী পক্ষকে তারা তাদের মতামত ব্যক্ত করবার জন্যে জনসভাটি করবার অনুমতি প্রদান করেছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক বিশ্ব বুঝে নিয়েছে যেÑ এটি বার্মার সামরিক জান্তার একটি ‘আই ওয়াস’- মাত্র। কিন্ত যখন তারা অনুমতিটি প্রদান করেছিলো তখন তারা ভাবতে পারে নি যে, গোটা বার্মাার মানুষ নেপিডোসহ সম্পূর্ণ মায়ানমারকেই অবরুদ্ধ করে ফেলবে। এবং মগদের একটি বৃহত অংশ বার্মিজ বৌদ্ধ এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে যোগ দেবে। এটি হয়েছিলো মূলতঃ তাদের গোয়েন্দা ব্যর্থতার কারণে। আর সে কারণে ফলও হয়েছিলো উল্টো।
আকাশের পূর্বকোণে প্রভাতী সূর্যের আবির্ভাবের আগে থেকেই বার্মার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাধভাঙ্গা জোয়ারের পানির মতো হাজার হাজার মানুষের মিছিলের পর মিছিল আসতে শুরু করেছিলো নেপিডোর অউং সান স্কোয়ারের দিকে। বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করেও দলবদ্ধভাবে পিপীলিকার ¯্রােতের মতো আকাশ বিদীর্ণ করা শ্লোগান আর শ্লোগানের তরঙ্গ আছড়ে পড়ছিলো ওই স্কোয়ার টিতে। মুহূর্তেই স্কোয়ারটি কাণায় কানায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। আসবার পথে বিভিন্ন পয়েন্টে বার্মি বাহিনী গুলিবর্ষণ করে প্রচুর লোককে হত্যা করেছিলো। কিন্তু তাতেও মানুষের প্রবল ¯্রােতকে রুদ্ধ করতে পারে নি সেনা কর্তৃপক্ষ। এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধেই গোটা নেপিডোর নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিলো সাধারণ মাুষের হাতে। প্রধান সড়কগুলি থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিলো সামরিক ট্যাংকের বহর। কযেকটি ট্যাংক জনগণও দখল করে নিয়েছিলো। এত মানুষ বার্মার প্রধান প্রধান শহরগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ছিলো। সেসব শহরের জনসমাবেশ থেকেও উত্থিত হচ্ছিলো মুহুর্মুহু শ্লোগান। মানুষের ঢলে সমগ্র বার্মা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলো। চারদিক থেকে অবরোধ করে ফেলেছিলো বার্মার জনগণ সম্পূর্ণ বার্মাকে। আর সারা দেশে এত মানুষের ওপর নির্বিচার গুলি চালাবার সাহসও সেনা কর্তৃপক্ষের আর ছিল না। ভীত হয়ে পড়েছিলো সেনা কর্মকর্তারা। এর মধ্যে সামরিক বাহিনীর তরুণ যোদ্ধারা একাত্ম হয়ে গিয়েছিলো জনতার আন্দোলনের সাথে। বাধ্য হয়েই নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলো বার্মিজ সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের সকল সেনা কর্মকর্তা। তাদের অধীন সেনা সদস্যদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলো ব্যারাকে ফিরে যেতে। অসহায় হয়ে পড়েছিলো বার্মিজ জেনারেলরা ঐক্যবদ্ধ জনগণের প্রমত্ত শক্তির কাছে। বুঝে গিয়েছিলো এই লক্ষ লক্ষ জনতার মিছিলকে রুখে দেবার কোনো কৌশলগত অস্ত্র তাদের কাছে নেই। মগরাও বিভক্ত। ঐক্যবদ্ধ জনগণের শক্তিই যে শেষ কথা, জনগণের কথার পর যে আর কোনো কথা অবশিষ্ট তাকে নাÑ আজকে তারা তা অস্থি মজ্জায় উপলব্ধি করতে পারছিলো। তার পরেও সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য গোটা সভাটিকে ঘিরে রেখেছিলো তাদের অবস্থান পরিবর্তিত হলো না। তারা সেভাবেই পজিশন নিয়ে থাকলো। হয়তো সারা দেশ থেকে সেনা প্রত্যাহারের সংবাদটি তখনও তাদের কাছে এসে পৌঁছোয় নি। সে কারণে তারা তাদের পজিশন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধরে রাখবার চেষ্টা করছিলো। সভামঞ্চে উপবিষ্ট ছিলো বেশ কয়েকজন নেতাÑ যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো উ মিন্টের পালক মাতা এবং উ মিন্টের প্রকৃত মা আলিয়া তুরপুন, শিশ মোহম্মদ, শি মিং ছাড়াও আরও কয়েকজন। উ মিন্ট্ মাইক্রোফোনের মাউথপিস হাত নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করে চলছিলো। তার বক্তৃতার প্রতিটি বাক্য শেষের পর মুহুর্মূহু শ্লোগানের গগণ বিদারী শব্দ প্রকম্পিত করে তুলছিলো নেপিডোর জল, স্থল আর অন্তরীক্ষের প্রতিটি অণু পরমাণুকে। এ যেন এক অভাবিত, অভূতপূর্ব মুক্ত স্বাধীনতার নিরঙ্কুশ আবাহন। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে যে সব সৈনিক জনসভার চারদিক বেষ্টন করে রেখেছিলো হঠাৎ করেই তারা যেন মঞ্চ লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ শুরু করলো।
উ মিন্ট্সহ বেশ কয়েকজন তাৎক্ষণিকভাবে মঞ্চের ওপর লুটিয়ে পড়লো। অক্ষত থাকলো আলিয়া তুরপুন। বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে গেলো গোটা জনসভা জুড়ে। লোকজন এদিক ওদিক ছুটোছুটি করতে শুরু করলো। কয়েকজন কর্মী আহত নেতাদেরকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে নিয়ে খুব দ্রুত কাছে থাকা একটি ট্রাকে তুলে কোনো একটি ক্লিনিকে নেবার ব্যবস্থা করলো।
ঠিক এই মুহূর্তে মাইক্রোফোনের মাউথপিসটি হাতে তুলে নিয়ে বিশৃঙ্খল জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললো আলিয়া তুরপুন Ñ ‘আপনাদের নেতা উ মিন্টের পক্ষে এই মুহূর্তে আমি আপনাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছিÑ বিজয় আমাদের, আপনাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে। আপনারা বিশৃঙ্খল না হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যান। সামরিক বাহিনীর যেসব সদস্য একটু আগে আমাদের এই শান্তিপূর্ণ জনসভায় গুলিবর্ষণ করেছে তাদের প্রত্যেককে ধরে এনে জনতার আদালতের সামনে উপস্থাপন করুন। জনতাই তাদের বিচার করবে। আপনারা ধৈর্য ধারণ করুন এবং আপনাদের প্রিয় নেতা উ মিন্টের নির্দেশ পালন করুন।’ এই নির্দেশ পাবার পরপরই জনসভা থেকে লোকজন একযোগে ধাবিত হতে শুরু করলো সেনা অবস্থানের দিকে। এবং নির্দেশটি প্রচার হবার সঙ্গে সঙ্গে নেপিডোর অন্যান্য এলাকা থেকেও লোকজন শ্বাসরুদ্ধ গতিতে ছুটে আসতে থাকলো জনসভার দিকে। নিমেষেই পরিবর্তিত হতে শুরু করলো সম্পূর্ণ পরিস্থিতি। সেনা সদস্যরা অবস্থার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে অস্ত্র সস্ত্র ফেলে রেখেই জীবন বাঁচাতে ছুটতে শুরু করলো যে যেদিকে পারলো সেদিকে। জনতা কয়েকজন সৈনিককে ধরেও নিয়ে আসলো সভামঞ্চের সামনে। ওদেরকে বেঁধে রাখবার নির্দেশ দিয়ে ওদের ফেলে রেখে যাওয়া অস্ত্র সস্ত্রগুলিকেও সভমঞ্চের সামনে নিয়ে আসবার নির্দেশ দিলো আলিয়া তুরপুন। নির্দেশ পালিত হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই যতটা সম্ভব অস্ত্র সস্ত্র উদ্ধার করে নিয়ে এলো জনসাধারণ। রাখলো মঞ্চের সামনে। আবার শুরু হলো শ্লোগানের পর শ্লোগান। ‘বার্মা আজ মুক্ত।’ বার্মা আজ স্বাধীন।’Ñ নবতম প্রাণের স্পন্দনে মুখরিত হয়ে উঠলো যেন গোটা বার্মার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ।
এর মধ্যেই সূত্রপাত ঘটলো এক অভাবিত, অভূতপূর্ব ঘটনার। কয়েকটি দামী গাড়ী এবং মোটর সাইকেল এসে দাঁড়ালো জনসভার সামনে। গাড়ী থেকে সিকিওরিটির দু’জন লোক নেমে এসে গাড়ীগুলিকে মঞ্চের সামনে যাবার জন্যে পথ করে দিতে অনুরোধ করলো। কিন্তু জনগণ রাজী হলো না। বাক বিত-া শুরু হয়ে গেলো জনতার সাথে লোক দু’টির। মঞ্চ থেকে আলিয়া তুরপুন সবকিছুই লক্ষ করছিলো। শেষে সবাইকে নির্দেশ দিলো গাড়ীগুলিকে মঞ্চের সামনে আসবার পথ করে দিতে। পথ করে দিলো জনগণ। গাড়ীগুলি এসে মঞ্চের সামনে দাঁড়ালো। একটি গাড়ী থেকে নেমে আরও কয়েকজন সহ একজন ষাটোর্ধ বয়সের শীর্ণকায়া মহিলা সরাসরি মঞ্চে উঠে আলিয়া তুরপুনের সাথে কয়েকটি কথা বললেন। পরপরই জনসভা থেকে দাবি উঠলোÑ ‘ওকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেয়া হোক। ও আমাদের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। ও আমাদের এ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে দেশ থেকে উৎখাত করেছে। তাদের ঘর বাড়ী সব জ্বালিয়ে দিয়েছে। সহায় সম্বলহীনভাবে তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে ভিন্ন দেশের মাটিতে জোর করে ঠেলে দিয়েছে। ওকে মঞ্চ থেকে এখুনি নামিয়ে দেয়া হোক। জনতা সবার আগে ওরই বিচার করবে।’Ñ চরম উত্তেজিত জনতা ওকে দেখে যেন আরও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে।
সবকিছু বুঝে আলিয়া তুরপুন জনতাকে অনুরোধ করলো শান্ত হয়ে ওর শেষ কথা ক’টি শুনবার জন্যে। জনতা আলিয়া তুরপুনের অনুরোধে সাড়া দিলো। মহিলাটির দিকে আলিয়া তুরপুন মাইক্রোফোনের মাউথপিসটি এগিয়ে ধরলো। মহিলাটি মাউথপিসটি হাতে নিয়ে প্রথমেই বললেনÑ ‘আমি প্রথমেই আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমার বিশ্বাস আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি অকপটে স্বীকার করছি এই দেশে বিগত কিছুদিনে যা ঘটে গেছে তার জন্যে আমিই দায়ী। আমি আপনাদেরকে কথা দিয়েও সে কথা রাখতে পারিনি। কেন পারিনি তা-ও আপনারা জানেন। আর আমি বেশী কথা বলবো না। যে কথাটি বলবার জন্যে আজ আমি আপনাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি সে কথাটি বলেই আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নেবো। আমি অউং সান সুচি। আপনাদের সরকারের স্টেট কাউন্সিলর। এই মুহূর্তে আমি এবং আমার সরকার আপনাদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছে। এই মুহূর্ত থেকে আমিও আপনাদের মতো আপনাদের এই মহান আন্দোলনের একজন সাধারণ কর্মী মাত্র। আর একটি কথা আপনাদেরকে বলতে চাইÑ আর কোনো দিনই এ দেশে সামরিক জান্তা ক্ষমতায় আসতে পারবে না। ইতিমধ্যেই আমি সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যাবার নির্দেশ দিয়েছি। তারাও ব্যারাকে ফিরে গেছে। এবং এ দেশ থেকে যাদেরকে বিতাড়িত করা হয়েছে তাদেরকেও ফিরিয়ে এনে তাদের নিজেদের ভিটেমাটিতে পূনর্বাসন করবার কাজও আমরা ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছি । অচিরেই তারা আবার তাদের স্বদেশে ফিরে আসবেন, আবার সবুজ শষ্যের জন্ম দেবেনÑ এটুকু নিশ্চয়তা আমি আপনাদেরকে দিতে পারি। এবার আসুন আমরা সবাই মিলে যে কাজটি সবার আগে করা প্রয়োজন সে কাজটি শুরু করি। সংবিধানকে পরিবর্তন করা না হলে গণতান্ত্রিক বার্মা প্রতিষ্ঠা করা কোনোভাবেই আমদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আর সেটি করবার জন্যে আপনাদের সহায়তা আমার একান্ত প্রয়োজন। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে একটি মহান সংবিধান বার্মিজ জাতিকে উপহার দিই। আমার অতীতের ভুলকে দয়া করে আপনারা ক্ষমা করে দেবেন।’Ñ এই কথা ক’টি বলবার পর মাউথপিসটি তিনি পূনরায় আলিয়া তুরপুনের হাতে দিলেন। চারদিকে আবার শুরু হলো শ্লোগান, উচ্ছ্বাস, কল্লোলের উৎপ্লবন। সবাই স্বাগত জানালো অং সান সুচির বক্তব্যকে। ‘স্বাগতম, স্বাগতম’-ধ্বণির জোয়ার সৃষ্টি হলো সম্পূর্ণ সভা এলাকা জুড়ে। এর মধ্যেই আলিয়া তুরপুন বলতে শুরু করলেনÑ ‘ভাই ও বোনেরা আমার, আপনারা এতক্ষণ সবই শুনলেনÑ আমরা যাদেরকে হারিয়েছি তাদেরকে আর ফিরে পাবো না। কিন্তু এখনও আমরা যারা বেঁচে আছি সেই আমরা কি আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে কিছুই করবো না? আমরা কি সুচিকে ক্ষমা করবো না?’Ñ জনসভা থেকে ভেসে এলো বিশাল কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বণিÑ “আমরা ক্ষমা করে দিয়েছি। আমরা ক্ষমা করে দিয়েছি। আপনি ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।”Ñ এই উৎরোলের মধ্যে অউং সান সুচি আলিয়া তুরপুনের সাথে কিছু কথা বলে সবাইকে আগামী কাল সকাল দশটায় তার নিজ বাসভবনে আসবার আমন্ত্রণ জানিয়ে এবং সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভামঞ্চ থেকে বিদায় নিলেন। তিনি চলে যাবার পর গোটা সভা আলিয়া তুরপুনের নির্দেশের অপেক্ষা করতে থাকলো। আলিয়া তুরপুন বললোÑ ‘এবার আমাদেরকে সেই ক্লিনিকে যেতে হবেÑ যেখানে আমাদের আহত নেতা কর্মীরা চিকিৎসাধীন রয়েছে। চলুন।’Ñমঞ্চ থেকে নেমে এলো। এবং সবাই তাকে অনুসরণ করলো।
১৪.
সমুদ্র সৈকতের সেই রিসোর্ট। নির্দিষ্ট কক্ষটিতে ঘুমে আচ্ছন্ন ওরা দু’জন- সোয়ে উ মিন্ট্ এবং ওর স্ত্রী লিউ সান লিউ। ভোরের আলো তখনও ফুটে ওঠে নি। দু’জন দু’জনের সাথে মিশে গিয়ে গভীর ঘুমের মগ্নতায় মুহ্যমান। কোনো শব্দ নেই শুধু ওদের দু’জনের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া। দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে যেন ওরা চির নিদ্রার মোহসিক্ত বাহুবন্ধনে নিজেদেরকে সমর্পণ করেছে। এভাবে বিঘœহীন প্রশান্ত ঘুমে কাউকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলে আসলেই ভালো লাগে। কিন্তু বিশেষতঃ যাদের চোখে ঘুম আসে না অথবা রাতে যারা বৈষয়িক, শারীরিক বা মানসিক কোনো কারণে ঘুমোতে পারে নাÑ এভাবে কাউকে ঘুমোতে দেখলে তাদের বড় হিংসে হয়, বড় কষ্ট হয়। এ রকমের ঘুম তারা সহ্য করতে পারে না। তবুও তাদেরকে সহ্য করতে হয়।
হঠাৎ কক্ষটির দরোজায় কয়েকবার কড়া নাড়ার শব্দ পাওয়া যায়। প্রথম দিকে বুঝতে পারে না ওরা। ঘুমিয়েই থাকে। কিন্তু শেষ শব্দটি ওদের কানে আসে। দু’জনেরই ঘুম ভেঙ্গে যায় ওদের। ‘কে?’Ñ প্রশ্নটি করে উ মিন্ট্ বিছানা থেকে উঠে আলো জ্বালিয়ে দরোজার দিকে যায় এবং দরোজাটি খুলে দেয়। দরোজাটি খুলে দিতেই ঘরে ঢোকে দু’জন বার্মিজ সেনা। ঘরে ঢুকেই আলো নিভিয়ে দিয়ে দরোজা বন্ধ করে একজন চীনা স্টেনগান দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে উ মিন্টের বুকে। দরোজার পাশেই লুটিয়ে পড়ে উ মিন্ট্। রক্তের ধারা তীব্র বেগে বেরিয়ে আসতে থাকে উ মিন্টের বুক থেকে। চিৎকার করে বিছানা থেকে ওঠতে গিয়েও উঠতে পারে না লিউ সান। দ’ুজন সৈনিকই দ্রুত এগিয়ে যায় লিউ সানের দিকে। একজন ওর মুখ চেপে ধরে, অন্যজন বিবস্ত্র করে লিউ সানকে। এর পর শুরু হয় লিউ সানকে ধর্ষণের পালা। ধর্ষণ শেষে নগ্ন লিউ সানের বুকের ওপর ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে দ্বিতীয় সেনাটি। ব্রাশ ফায়ারের তোড়ে বিছানা থেকে মেঝেতে ছিটকে পড়ে যায় লিউ সান। কয়েক সেকে-ের মধ্যে মেঝের ওপরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ও। ওর বুক থেকেও রক্তের ধারা প্রবাহিত হয়ে মিশে যেতে থাকে উ মিন্টের রক্তের ধারার সাথে। তখনও বেঁচে আছে উ মিন্ট্। জ্ঞানও পুরোপুরি লুপ্ত হয়ে যায় নি। সৈনিক দু’টি বেরিয়ে যাবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে সৈনিক দু’জনকে উদ্দেশ্য করে নিজের বুক চেপে ধরে অনেক কষ্টে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে উ মিন্ট্ শুধু তিনটি কথা উচ্চারণ করেÑ ‘জনতার আন্দোলন কখনই ব্যর্থ হয় না। আগামী ‘থারটিন্থ অক্টোবর’Ñ আমাদের এ রক্তের উষ্ণতার আগুনে তোমাদের ক্ষমতার সব দম্ভ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, বার্মার পবিত্র মাটিও তোমাদেরকে আশ্রয় দেবে না। আমাদের এ রক্তের কণিকা দিয়েই নির্মিত হবে নতুন গণতান্ত্রিক বার্মা।’ চোখ বোজে উ মিন্ট।
মেঘমুক্ত নীলাকাশের পূর্ব দিগন্তের কোণ্ রক্তাক্ত করে উদিত হয় নতুন দিবসের রক্তমাখা প্রভাতী সূর্র্য। পৌঁছে যায় গোটা বার্মার প্রতিটি প্রান্তে সে প্রভাতী সূর্যের বিপুল আলোক রেখা। সে আলোকের প্লাবনে ঝলসে ওঠে যেন বার্মাার নির্যাতিত, নিপীড়িত বিশাল প্রকৃতিও।