বিত্তবান বাবার কনিষ্ঠ কন্যা প্রকৃতি। সেই ছোট্টবেলা থেকে অপরিসীম আদর, স্নেহ, মমতায় বেড়ে ওঠে। কোন চাওয়াই কখনো অপূর্ণ থাকেনি। কষ্ট কাকে বলে আজ পর্যন্ত বুঝতে পারেনি। বাবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। দুই ভাই সৌদি আরব প্রবাসী আর দুই ভাই ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি-ব্যবসা-চাকরি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। বড় বোন স্বামীর সংসারে সুখেই আছে। দুঃখ নামের শব্দটি আজন্মকাল তার কাছে অপরিচিত।
এই প্রথম কষ্টটাকে অনুধাবন করল। তা কেবল পিতৃহীন ভুবনকে ভালোবেসে। ভুবন বেচারা নিরুপায়। অসম্ভব জেদী মেয়ের ভালোবাসার প্রস্তাব সে প্রত্যাখ্যান করতে গিয়েও পারেনি। ভুবন অবশেষে জড়িয়ে যায় প্রকৃতির অকৃত্রিম ভালোবাসায়। ভুবন সম্মান দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। বাড়িতে মা একা। জমি-জমা যা ছিল, একে একে সব বন্ধক রেখেই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে।
ভুবন ও প্রকৃতির জন্ম একই গ্রামে। দীর্ঘ সাত বছর যাবৎ একে অপরকে ভালোবেসে আসছে । কত না মধুময় স্মৃতি আজ ভেসে ওঠে প্রকৃতির চোখে। একই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুবাদে তাদের ভালোবাসার বীজ অংকুরিত হয় । ভুবন গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমালেও তাদের ভালোবাসা অটুট রয়েছে। আর এই ভালোবাসার কারণেই কষ্টেরা বাসা বেঁধেছে প্রকৃতির নরম হৃদয়ে। আজও মুখ ফুটে পরিবারের কাউকে বলা হয়নি তার ভালোবাসার কথা। এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ধুকে ধুকে মরছে প্রকৃতি।
সেদিন এক ছেলে এসেছে প্রকৃতিকে দেখার জন্য। বাধ্য হয়ে বাবা-মাকে অনেক বোঝালো সে। প্রকৃতি আরও পড়াশোনা করতে চায়। কিন্তু একথা বলতে পারে না যে, সে একজনকে ভালোবাসে। তার অনুনয়-বিনয় সেদিন কেউ শোনেনি। যথাসময়ে ছেলেপক্ষ এসে হাজির। প্রাথমিকভাবে আপ্যায়ন শেষে ডাকা হলো মেয়েকে। মেয়ে তাদের সম্মুখে আসতে নারাজ। বাবার ফ্যাকাসে মুখ দেখে অঝরে কেঁদে ফেলল প্রকৃতি। কিন্তু অব্যক্ত বেদনায় সে পাথরের মতো বসে রইল ভেতর ঘরে। পাÐুর মুখে বিদায় নিলো ছেলেপক্ষ।
মেহমান বাড়ির আঙিনা পেরোতেই গর্জে উঠল প্রকৃতির বাবা অলক চৌধুরী। রাগে- ক্ষোভে খুব করে বকলেন মেয়েকে। শাসালেনও খুব। কিন্তু প্রকৃতি তার সিদ্ধান্তে অনড়। অবশেষে অলক চৌধুরী বললেন, ‘তোমার ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। তোমার পথ তুমি দেখো।’
সে রাতটা যে কী কষ্টে কেটেছে। তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারেনি প্রকৃতি। ভেতর ঘরের সব জানালা-দরজা বন্ধ করে না খেয়ে, কারো সাথে কথা না বলে কেঁদে কেঁদে কাটিয়েছে। বোন, মা-বাবা কেউ একটিবারের জন্যও তাকে ডাকেনি। প্রকৃতি ভাবতে থাকে, ‘ভালোবাসা কি অপরাধ? ভালোবাসায় এত কষ্ট কেন? ভুবনকে ভালোবেসে সে তো কোনো পাপ করেনি। ভুবনের মতো একটা মেধাবী ছেলে আমার কারণে নষ্ট হয়ে যাবে। আমার কারণে কষ্টের আগুনে জ্বলবে। তার ভবিষ্যতের স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে যাবে। না, এ হতে পারে না। যেভাবেই হোক ভুবনকে পেতেই হবে।’
পরদিন সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন অলক চৌধুরী। তিনদিন পরে ফিরে এলেন বড় ছেলেকে সাথে নিয়ে। রাতে এক জরুরি বৈঠকে বসলেন সবাই। মাথা নিচু করে বসে আছে প্রকৃতি। সব কিছু যেন আজ এলোমেলো মনে হচ্ছে তার। এ মুহূর্তে ভুবন তার জন্য কী করতে পারবে? এখনো পড়াশোনা শেষ হয়নি। মাঝখানে তার পরিবার এমন ফাঁদ পাতবেন, তা বুঝতে পারেনি প্রকৃতি। তাহলে গোপনে একটা কিছু করে রাখতো।
কথা শুরু করলেন প্রকৃতির বড় ভাই আজাদ চৌধুরী, ‘ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। তুমি আমাদের মান-সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছো। তোমার কোনো ইচ্ছাই আমরা অপূর্ণ রাখিনি। আমাদের শেষবারের মতো এই দাবিটা তোমাকে মানতে হবে।’
কোনো প্রতিউত্তর করতে পারেনি সে। নীরবে চোখের জল ফেলেছে। প্রকৃতির নীরবতায় ধমকে উঠলেন আজাদ চৌধুরী, ‘এই ছেলেকে তোমার যদি এতই পছন্দ হয়, তবে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা তোমার ভালো-মন্দ কখনোই দেখতে পারবো না। এমনকি বোন হিসাবেও কোনোদিন পরিচয় দেব না।’
তবুও প্রকৃতি নির্বাক । দুচোখ তার অশ্রæসিক্ত। তার চোখের ভাষাই বলে দেয়, ‘আমি ধন-ঐশ্বর্য চাই না। আমি ভুবনকে চাই। শুধু ভুবনকে চাই।’ সেই রাতের মতো বৈঠক সেখানেই সমাপ্ত হলো।
নিজের বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে প্রকৃতি। কখন যে তার মা এসে খাটের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছেন, তা টের পায়নি। আলতো ভাবে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন মা। কারো স্পর্শ অনুভব করে চোখ মুছে উঠে বসল প্রকৃতি। একবার তাকালো মায়ের দিকে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকিয়ে রইলো জানালা পেরিয়ে দূর আকাশের পানে। শান্ত গলায় মা বললেন, ‘আমাদের পছন্দটা তুমি গ্রহণ করো মা।’
প্রকৃতি এবার রুক্ষœভাবে এ কথার জবাব দিলো, ‘অসম্ভব মা। তুমি বরং জেনে রাখো, আমাকে কারো কন্যা বা বোন হিসেবে পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি ভুবনের পরিচয়েই বাঁচতে চাই।’
মেয়ের কথায় রেগে গেলেন মা, ‘ বাস্তবতাকে তুমি কতটুকু চেন? আমাদের শেষ কথা, শুনে রাখোÑআমাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’
কোনো কিছুই ভেবে পায় না প্রকৃতি। ভুবনকে খবরটা জানানো দরকার। রাগে গড় গড় করতে করতে যখন মা চলে গেলেন। এদিক-সেদিক তাকিয়ে নিñিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে কাগজ-কলম নিয়ে বসলো সে।
প্রিয়তম,
কিভাবে তোমাকে কথাটা বলবো। ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। কড়া নজরদারীর মধ্যে আছি। আমার অমতে আমাকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে আমারও শেষ কথা, আমি জীবন বিসর্জন দেবো, তবু তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।
তোমার প্রিয়তমা।
অনেক কষ্টে লোক মারফত চিঠিটা ঢাকা পাঠানো হলো। চিঠি পেয়ে ভুবন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই মুহূর্তে সে কী করবে? দু’চোখে সে অন্ধকার দেখতে লাগল। সামনে পরীক্ষা। বাড়িতে একমাত্র মা। বাবার মৃত্যুর পর সুখ কি জিনিস তা আর অনুধাবন করতে পারেনি। একমাত্র অবলম্বন ভুবনের জন্যই সব জমি-জমা বন্ধক রেখে প্রতি মাসে তাকে টাকা দিচ্ছে। এ সময় নিজের সুখের জন্য মায়ের চোখে বিষাদের ছায়া সে কেমন করে ফেলবে?
স্বেচ্ছাচারী একটা পরিবারের কাছে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হলো প্রকৃতি ও ভুবনের অনেক যতেœ গড়া ভালোবাসা। প্রকৃতির ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য থাকলো না তাদের কাছে। অন্যদিকে ভুবনও নিরুপায়। সীমাহিন কষ্টটাকে বুকের মধ্যে পুষে নীরবে পড়ে রইল রাজধানীতে। গলা কাটা কবুতরের মতো ছটফট করছে সে। এদিকে খাঁচায় আবদ্ধ পাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে প্রকৃতি । নীরবে অশ্রæ ফেলছে আর মুক্তির পথ খুঁজছে।
প্রকৃতির মন বলছে, আমাকে সাদা কাফনে সাজিয়ে দাও। আমি পরম আনন্দে এ নিষ্ঠুর পৃথিবী ত্যাগ করব। দামি দামি পোশাক, ভারী গহনা আমার দেহটাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আমার হৃদয়টাকে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। তোমরা বন্ধ করো সানাইয়ের সুর। বন্ধ করো হাসি-তামাশা, আনন্দের সুর লহরী। একটা নিষ্পাপ মনকে এত বড় একটা সাজা দিও না। একটা নিরাপরাধ মানুষের এত বড় সর্বনাশ তোমরা করো না। প্রকৃতির করুণ আরজি সেদিন চার দেওয়ালেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল। কারো কর্ণকুহুরে গিয়ে পৌঁছলো না।
অজানা, অচেনা নতুন এক পরিবেশে নববধূ বেশে ফুলশয্যায় বসে আছে প্রকৃতি। মাথার মধ্যে ঝিম ঝিম করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। নাড়ি- ভুঁড়ি জ্বলে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। বিষক্রিয়া প্রতিটি রক্তকণার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত শরীরে। ক্রমশ নীলাভ হয়ে আসছে ফর্সা-সুন্দর অবয়ব।
এইমাত্র দরজা ঠেলে প্রবেশ করল স্বামী নামের অবহেলিত মানুষটি। মনে যার স্থান নেই, দেহে তার ঠাঁই হতে পারে না। দরজাটা ভিজিয়ে হুড়কো এঁটে দিয়ে ফুলশয্যার পাশে এসে দাঁড়ালো নবস্বামী। নববধূর মুখপানে তাকিয়ে আঁৎকে উঠলো সে। প্রকৃতি কেমন যেন অনবরত গোঁঙ্গাচ্ছে। মুখ ভর্তি ফ্যানা। শক্ত ভাবে বসা। গিয়ে ধরতেই ধপাস করে পড়ে গেল বিছানায়। দিশেহারা হয়ে গেল তার স্বামী।
ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা খুব কষ্টে টেনে এনে প্রকৃতি বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি চাইনি যে, আমার মনটা পড়ে থাকবে এক জায়গায় আর দেহ পড়ে থাকবে অন্যত্র।’
‘এ তুমি কী বলছো’ বলে চিৎকার করে উঠল প্রকৃতির স্বামী। আর কোনো কথা বের হলো না প্রকৃতির মুখ দিয়ে। পরম শান্তিতে সে ঘুমিয়ে পড়লো স্বামীর কোলে।
স্বামী নির্বাক নেত্রে তাকিয়ে রইলো প্রকৃতির নীলবর্ণ মুখপানে । আঁচলে বাঁধা আছে ছোট্ট একটি চিরকুট। তাতে লেখাÑ
পৃথিবীর মানুষ,
আমাকে ক্ষমা করো। তোমরা বড্ড অহংকারী। অর্থ-বিত্ত আর ক্ষমতার নাগপাশে আটকে আছো তোমরা। তোমাদের চোখ অন্ধ। তোমরা আমার হৃদয়ের যন্ত্রণা কখনোই বুঝতে চাওনি। নারীর একটি মনে একাধিক পুরুষের স্থান হতে পারে না। এই দেহ-মন শুধু একজনের। সে আমার ভুবন। তার পবিত্র ভালোবাসায় আমার জীবন উৎসর্গ করলাম। চলে এসো ভুবন! পরজনমে তোমার আমার মিলন হবে। ধিক্কার সবাইকে। সাধুবাদ আমার ভালোবাসাকে।
তোমাদের প্রকৃতি।