এইমাত্র ট্রেন চলে গেল, লাফিয়ে ওঠা বাতাসের সাথে নড়ে উঠলো কিছু চকলেটের
বাকল। এ ভাবেই কিছু না কিছু নড়ে ওঠে, যা কিছু অবহেলায় পড়ে থাকে। কেউ
জেনে শুনেই ফেলে যায় আবার কেউ অখেয়ালে।
লাঠিপাগলকে কে কবে এই
ষ্টেশনে রেখে গেছিলো আজ তার এসব কথা মনে নেই, পুরনো স্টেশন মাস্টার খাজা
সাহেব কিছুটা জানে তার জীবনের ইতিবৃত্ত। আগে তো পাগলকে জিজ্ঞেস করলেও
তুতলিয়ে তুতলিয়ে বলতো, "আমি তো আমার মার হাত ধইরাই আছিলাম, মায় কই গেলো?"
নাম জানতে চাইলে বহুদিনের অপরিষ্কার লাল দাঁতকটা বের করে একগাল হাসি দিয়ে
বলে লাঠিপাগল। এই নামেই সবাই তাকে চিনে এখন। তার হাতে অনবরত একটা লাঠি
থাকে, ঘুমালেও লাঠিটাকে সে দুপায়ের মাঝখান দিয়ে চাপা দিয়ে রেখে তারপর
ঘুমায়, যাতে কেউ তার লাঠিটাকে কেড়ে নিতে না পারে। চরম নিরাপত্তাহীন এই
সমাজে লাথিগুতা খেতে খেতে হয়তো কোন একদিন আত্মরক্ষার তাগিদে এই লাঠিটা উঠে
এসেছে তার হাতে।
তার একার সংসার এই ষ্টেশনটির বারান্দায়। কতো মানুষের
কোলাহল, আসে যায় কত মানুষ, কেউ তাকে চিনে না, শুধু সবার মুখের দিকে
তাকিয়ে থাকে সে কারও প্রতীক্ষায়। একবার কারও কাছে খাবার চাইতে
গেলে
কোন এক বেজন্মা গরম চায়ের কাপ ঢেলে দেয় তার শরীরে, সে কী যন্ত্রনা! এখনো
গলার পাশের চামড়ায় পুড়ার দাগ। সে তো আর আয়নার সামনে দাঁড়ায় না যে
পুড়া দাগটি তার চোখে পড়বে,তাই কেউ জানতে চাইলে মন খারাপ করে খুব।
ঘরহারাদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই কখনো, যে
ঘড়ির সময় নিয়ে কোন খবর রাখে না তার কাছে
পেরিয়ে যাওয়া বেলা জীবনের কাছে শুধু সত্য।
আরেকটি ট্রেন আসার সময় হয়ে যাচ্ছিল,লাঠিপাগল
একটু জলদি করেই মূল গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
ট্রেন এসে থামলো, এক এক করে সবাই যে যার গন্তব্যে ছুটে গেল। লাঠিপাগল
ট্রেনের দরজা দিয়ে জানলা দিয়ে কাকে যেন খুঁজার ভঙ্গিতে উঁকি দিয়ে দেখে আর
ট্রেন চলে গেলে নির্বাক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে মানুষের ঘরে ফেরা।
তার
ঘাড়ের উপর রাখা গামছা দিয়ে এর মধ্য অনেকবার চোখ মুছে নিয়ে ফিরে আসলো
যেখানে সে সবসময় বসে থাকে। ষ্টেশন মাষ্টার খাজা সাহেব তাকে
কিছুই বলেন না, মাঝে মধ্যে বাড়ি থেকে খাবার এনে দেন। গতবার ঈদে একটি লুঙিও দিয়েছেন।
কখনো অসুখের কথা শুনলে খাজা সাহেব একপতা
ঔষধও এনে দেন। আপনজন হারা মানুষটি অন্তত কাউকে না কাউকে তো আপন ভাবতে
পারছে। কখনও সে কারো কাছে হাত পেতে চায় না কিছু, কেউ নিজের থেকে দিলে তা
খায়। তার মাথা ভর্তি কালো চুলে অযত্নের চিৎকারে বেরিয়েছে জট, মুখ ভরা
দাড়ি, এতো লম্বা না তবু আজানের ধ্বনি ছোঁয়া বাতাস এসে লাগে।
গেলো
কদিন থেকে তার শরীর ভালো যাচ্ছে না,খাজা সাহেব খবরটি জেনে ছুটে আসেন,
বললেন, চল, তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই । কোন ভাবেই রাজি হলো না
লাঠিপাগল। একসময় বলে উঠলো, মাষ্টার সাব আপনি আমারে আগের মতো একপাতা ঔষধ
দিলেই আমি খাইয়া ভালো হয়া যামু। কোন উপায় না দেখে খাজা সাহেব তার অফিসের
কর্মচারী ছবুরকে দিয়ে ঔষধ ও এক বোতল পানির ব্যবস্থা করে পাঠিয়ে দিলেন।
সন্ধ্যা হয়ে অন্ধকার নামলো সমস্ত দিনের চলে যাওয়া এবং ফিরে আসা
মানুষগুলোর মুখের ছায়া ভেসে উঠলো ষ্টেশনটির মলিন চেহারার উপর। লাঠিপাগল
একটি চাদর দিয়ে নিজেকে ঢেকে শুয়ে থাকে আর ট্রেন আসার শব্দ শুনলেই উঠে
তার স্বভাবমতো দৌড়ে ছুটে যায়। যেনো তার কত আপনজন আসার কথা আছে এই ট্রেনে।
আবার তার একজীবন শূন্যতা ভর করে দুই চোখের উপর।
বারবার মনে করতে
চেষ্টা করে,তার আপন কেউ কী নেই, আর যদি থাকে তবে ওরা কোথায়? সে জানে না,
চোখের জলও কখনো নিজেকে লুকিয়ে নেয় আপন গতির হিসেব পায় না বলে।
অনেকেই তার নাম ও আপনজনদের খবর জানতে চেয়েছে,কোন উত্তর মেলেনি। স্টেশন
মাস্টার ছাড়া আজ আর কারো সাথেই কোন কথা বলে না সে। একমনে হাসে,কয়েকটি কাক
যখন তার কাছে খাবার খেতে আসে তাদের সাথে। তাকিয়ে থাকে অপলক। বড় বড়
বৃক্ষগুলোও যেমন অসহায় হয়ে ইতিহাসের মতো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ঐ আকাশের দিকে।
ভোরের অপেক্ষা করতে করতে আজও লাঠিপাগলের ভোর হলো, কাকগুলো ফিরে এলো তার
কাছে অথচ কোন সাড়াশব্দ নাই তার।
ষ্টেশনে মানুষের ভিড় বাড়তে লাগলো,বৃষ্টির শব্দের মতো শব্দ হচ্ছে,
কারও কাছে না গিয়ে কথা বুঝা মুস্কিল।
কাজের ফাঁকে ষ্টেশন মাষ্টার ছবুরকে ডাক দিয়ে বললেন, আমার লাঠিপাগলের একটু
খবর নিয়ে আসো তো। ছবুর ছুটে গেল তার কাছে, গিয়ে চাদর সরিয়ে ডাক দেয়
পাগল, অ লাঠিপাগল কেমন আছিস?
পাগল কোন কথাই বলে না আজ। হাত দিয়ে নাড়া দেয় ছবুর, লাঠিপাগল চোখ অর্ধেক খুলে তাকায়, ছবুর জানতে চায়,
ঔষধ খাইছিস?
পাগল হালকা করে মাথা নেড়ে জানায় খেয়েছে। চলে যায় ছবুর।আবারও চোখ বন্ধ
করে লাঠিপাগল। এ যেন চিরকালের এক ঘুম তাকে মায়ের মত বুকে টেনে নিচ্ছে।
দুপুরের খাবার খেতে যাবেন খাজা সাহেব, মনে পড়লো পাগলের কথা
হোটেলের থেকে উল্টো দিকে হাঁটতে লাগলেন তিনি।
পাশে গিয়ে ডাক দিলেন,পাগল, পাগল রে, অ লাঠিপাগল
কেমন আছিস আজ?
কোন মতে মুখের উপর থেকে চাদর সরিয়ে তাকায় লাঠিপাগল। মাথা নেড়ে জানায়
ভালো আছি আর একটি হাসি দেয়।
খাজা সাহেবের মনে হলো,পাহাড়ের বুকে বৃক্ষের চুল ফাঁক করে কখনো যদি
সূর্যের আলো সেই মাটিতে পড়ে যেমন হবে সেই দৃশ্যটি ঠিক তেমনি লাগলো আজ
লাঠিপাগলের হাসি।
বললেন,কী খাবি তুই বল?
আবার মাথা নাড়িয়ে বলে,খাবে না।
খাজা সাহেব আজ নিজেও না খেয়ে অফিসে চলে গেলেন।
ভালো মানুষেরা অন্যর কষ্ট দেখে নীরবে চোখের জল ফেলে।
আবার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে রাত নামলো হাজার মানুষ তাদের স্পর্শ রেখে
নিজেদের গন্তব্য চলে গেল। লাঠিপাগল ষ্টেশনটির এক কোনায় শুয়ে আছে। কে আছে
তার যে একটু আদর করে খাবার মুখে তুলে দিবে? ঔষধ খাইয়ে দিবে?
হায়রে নিয়তি,একা মানুষের রাত আসে সবাই যখন জেগে থাকে, আর ভোর হয় সবাই যখন ঘুমায়।
সময়ের সাথে বিশ্বাসের একটি সূত্র মায়ার মতোন ডাক দিয়ে বলে
উল্টো হাটলেই জীবনের কাছাকাছি।
পরদিন ভোরে খাজা সাহেব অফিসে এসে কাজ সেরে
লাঠিপাগলকে দেখতে গিয়ে দূর থেকে দেখলেন দুই চারজন মানুষ ঘুমন্ত
লাঠিপাগলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কথা বলছে, ওরা সবাই এই ষ্টেশনের কোন না
কোন কাজে জড়িত। খাজা সাহেবকে দেখেই ওরা সালাম জানালো। তিনি জানতে চাইলেন
কী হয়েছে পাগলের। সবাই বললো ভোর থেকে তার কোন নাড়াচাড়া নাই,শরীরও কেমন
শক্ত হয়ে আছে। সবাই এতক্ষন খাজা সাহেবেরই অপেক্ষা করছিলো। খাজা সাহেব তার
হাত ধরে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলেন, হয়তো যা বুঝার তা বুঝেও গেলেন, তবু
মনকে বুঝ দেবার জন্য একজন ডাক্তার ডেকে আনলেন,
ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন,
অন্তত কয়েক ঘন্টা আগেই লাঠিপাগলের মৃত্যু হয়েছে। খাজা সাহেবের চোখ দুটো
ঝাপসা হয়ে আসলো, ওর কপালে আর গালে একটু হাত বুলিয়ে দিলেন। এ জীবনে এমন
হাতের ছোঁয়া কোনদিনই পড়েনি তার কপালে, বেঁচে থাকলে হয়তো খাজা সাহেবের হাতটা
আরো শক্ত করে চেপে ধরে রাখতেন গালের সাথে, হয়তো ঝাপসা হতো পাগলেরও দুটি
চোখ।
ষ্টেশনের সবাইকে ডেকে খাজা সাহেব পাগলের দাফন সম্পন্ন করলেন।
হঠাৎ সবুর, মাষ্টার সাহেবকে ডেকে বলে লাঠিপাগলের মথার নীচে যে চটের থলিটা
পেয়েছে তারা তা একটু খুলে দেখার প্রয়োজন। তার সামনেই খোলা হল থলিটি, ভিতর
থেকে বেরিয়ে এলো একটি গামছা, কিছু পুরানো কাগজ আর কয়েকটি ঔষধের শূন্য
বোতল।
খাজা সাহেব কাগজগুলো তার টেবিলের উপর রেখে
লাঠিপাগলের জানাজায় চলে গেলেন। দাফন শেষে অফিসে ফিরে এসে বসে বসে ভাবছেন মানুষ কতো সহজে চলে যায়। পাগলের মুখখানি তার চোখে ভাসছে।
চোখ পড়লো টেবিলের উপর রাখা কাগজগুলোর দিকে। কয়েকটি শূন্য কাগজের পরে
বেরিয়ে এলো একটি ময়লা কাগজ। সেখানে ক্লাস টু থ্রির বাচ্চার হাতের লেখার মত
একটা কলমে লেখা কাগজ। সেটা পড়তে লাগলেন খাজা সাহেব।
মা,
তুমি
কোথায় আছো মা। আমি খুব একা একটি ষ্টেশনের মধ্য পড়ে আছি। আমি কোথায়
যাবো,কার কাছে যাবো তুমি বলো মা। আমার খুব কান্না পায় মা, আমার কান্নার
শব্দ শুনে কেউ জানতে চায়না আমি কেনো কাদছি।
আমি বাড়ির পথ চিনি না মা,তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও। মা,আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি তোমাকে দেখবো, কতো মানুষ আসে এই ষ্টেশনে
তুমি কী আসতে পারো না,আমি অপেক্ষায় আছি
একদিন এসে নিয়ে যেও আমাকে।"
লেখাটি পড়তে পড়তে খাজা সাহেবের সামনে ভেসে উঠল লাঠিপাগলের মুখখানি আর
তার চোখ থেকে কাগজের উপর গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা চোখের জল।
১২ অক্টোবর ২০২০
মানচেষ্টার,ইংল্যান্ড