মে দিবসের প্রচ্ছদ
কর্মই ধর্ম- এই কথায় আস্থা রেখে সকল কর্মজীবী মানুষের প্রতিনিয়ত যাত্রা শুরু হয়। ইসলামে শ্রমভিত্তিক উপার্জনকে ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। শ্রমিক সম্প্রদায় সকাল থেকে সন্ধ্যাবধি অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে আপনজনদের প্রয়োজন মেটাতে। দেশ বিদেশে শ্রমের প্রেক্ষিতে জাতির ভাগ্যের চাকা আজ সুপ্রসন্ন। প্রবাসী শ্রমিকরা নিজের জীবনের সর্বসুখ বিসর্জন দিয়ে পরিবারবর্গের সুখে রাখার দায়িত্ব বয়ে চলছে অর্ধাহারে অনাহারে। সেই দায়িত্ববোধের বোঝা এতই ভারি যে, লাশ হয়ে দেশে ফিরছে অনেকে। তবুও চলছে জীবনযুদ্ধ।
বিশ্ব ইতিহাসে কোন আন্দোলনই তাৎক্ষনিকভাবে সফলকাম হয়নি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সূত্রপাত থেকে পর্যায়ক্রমে চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। একেকটা আন্দোলন সফল হওয়ার পশ্চাতে আছে নানান ত্যাগ তিতিক্ষা, জীবনদানসহ রক্তাক্ত করুন ইতিহাস। তেমনি আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস একদিনে সফল হয়নি। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটের শ্রমিকরা উপযুক্ত পারিশ্রমিক আর দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
কল-কারখানা তখন দূর্বিষহ করে দিয়েছিল শ্রমিকের গোটা জীবন। অসহনীয় পরিবেশে প্রতিদিন ১৬ ঘন্টা কাজ করতে হতো। সপ্তাহ জুড়ে কাজ করে শ্রমিকের স্বাস্থ্যহানী হচ্ছিল। শ্রমজীবী শিশুরা হয়ে পড়ছিল কংকালসার। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে দৈনিক ১৬ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবি জানায়। ১৮৮৬ সালের ১লা মে শ্রমিকরা ধর্মঘট আহ্বান করে। প্রায় তিন লাখ মেহনতি মানুষ ঐ সমাবেশে অংশ নেয়। নেতৃত্ব দেন অগাস্ট স্পাইস। শুরু হলো অধিকার আদায়ের যুদ্ধ। আন্দোলনরত ক্ষুদ্ধ শ্রমিকদের রুখতে পুলিশ বাহিনী গুলি চালায়। ১১ জন নিরস্ত্র শ্রমিক নিহত হন, আহত ও গ্রেফতার হোন অনেকেই। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃত শ্রমিকদের মধ্য থেকে অগাস্ট স্পাইসসহ ছয় জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। কারাগারে বন্দিদশায় এক শ্রমিকনেতা আত্মহত্যা করেন। এতে করে আন্দোলনের মাত্রা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
১৮৮৯ সালের ১৪ই জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আর্ন্তজাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১লা মে ‘শ্রমিক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী ১৮৯০ সালে থেকে মে দিবস বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে শ্রমবজীবী মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি মে দিবসের সম্মানার্থে বাংলাদেশেও ১লা মে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়।
অধিকার আদায় করতে হলে প্রথমেই নিজেকে যোগ্য করতে হবে। অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। জোড় প্রতিবাদ ও আন্দোলন ছাড়া জীবনে কোন চাওয়ার সফল করা সম্ভব নয়। অধিকার আদায়ের পাশাপাশি দায়িত্ব পালনেও হতে হবে নিষ্ঠাবান।
আমাদের দেশের নারী-পুরুষ শ্রমিকদের বৈষম্যের চোখে দেখা হয়। একই কাজ উভয়ে সম্পাদন করে যাচ্ছে অথচ পারিশ্রমিককের ক্ষেত্রে অসমতা বিদ্যমান। শ্রমিকদের আর্থিক নিশ্চয়তা, মানসিক স্থিরতা এবং কাজের সুষ্ঠু পরিবেশের নিশ্চিত না হলে কোন প্রতিষ্ঠানই সাফল্যের উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারবে না। তাই মালিক সম্প্রদায়কে নিজেদের স্বার্থে এসব ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে কোন কাজকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম বদ্ধপরিকর। শ্রমিকদের প্রতি সু-বিচারের পাশাপাশি সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পূর্ণ প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন ইসলাম। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ (স:) শ্রমিকের পারিশ্রমিক সর্ম্পকে বলেছেন-
‘‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর পূর্বেই
তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও।’’
সভ্যতার এ পর্যায়ের এসে আমাদের বোধশক্তি নিস্তেজ হয়ে গেছে। শপিংমলে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে আমাদের গায়ে লাগে না, বিদেশি খাবার খেয়ে মোটা অংকের বিল বকশিশ দিতে কষ্ট হয় না। পাার্লারের বিল মেটাতেও হিসাব হয় না। শুধু টাকার হিসেবটা জোড়ালো হয়ে যায় রিক্সা ভাড়া দিতে গিয়ে। যাদের ঘাম ঝরা আয়ে গোটা সংসার চলে তাদের কিছু টাকা বেশী দিতে গিয়ে আমাদের আয় ব্যয়ের হিসাব মনে পড়ে যায়। আমাদের মতো নিন্ম মধ্যম আয়ের দেশে যদি শ্রমিক কুলি, মুজুর, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, রিক্সাচালক কাজের আয়া বুয়া না থাকতো তাহলে বিলাস বহুল প্রাসাদের ধনিক শ্রেণী স্বস্থির নিশ্বাস নেওয়া কি সম্ভব হতো ? পৃথিবীর সব মহৎ কাজের পিছনে অজ¯্র মানুষের শ্রম ও মেধা জড়িত।
মূলত মে দিবস হলো দুনিয়ার মেহনতী মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিন। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসকে সফল করতে যারা অসীম ত্যাগ ও জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের জানাচ্ছি বিনম্ন শ্রদ্ধা। মালিক শ্রমিকের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় দেশ ও জাতি সাফলের স্বর্ণ শিহরে আরোহণ করুক। মালিক শ্রমিক নয় সবাই মানুষ হয়ে বেঁচে থাকুক এই শুভ প্রত্যাশান্তে সবাইকে ধন্যবাদ।
আকলিমা চৌধুরী লাভলী