আহমদ আজিজ এর গুচ্ছ কবিতা
আহমদ আজিজ এর গুচ্ছ  কবিতা
উন্নয়নশীল নদী

আমাদের উন্নয়নশীল নদী
যদিও সমুদ্রগামী---
কপট গাম্ভীর্যে তবু
সমুদ্র চায় না বুঝি তাকে;
প্রধান সমস্যা নয়
তাহার ভাঙন প্রবণতা
কিংবা বন্যার স্বভাব,
অন্যতম অন্তরায়
তার ঘোলাজল
আর নেই নাব্যতা মোটেই

তবুও সমুদ্রগামী
আমাদের উন্নয়নশীল নদী ;
চোখে নাচে তার সমুদ্রউর্বশী
বুঝি সমুদ্রেই স্বস্তি তার

উন্নয়নশীল সব কাজে
যেরকম বাধা থাকে আবেগের---
তেমনি সে বাধা পায়
বাধা দেয় দীনদুঃখী মাটি

তবে এহবাহ্য, কহতব্য নয়---
আবেগ মাড়িয়ে
সে সমুদ্রগামী হয় ;
সঙ্গী-সাথি তার
বর্জ্য- আবর্জনা, রথী- মহারথী ;
পাক খেয়ে ওঠে বুকে
উৎসবের ফেনা
সমুদ্রের স্ফীত ঢেউ :
মলিনসামন্তগ্রাম
ঘুম চোখে চেয়ে দেখে
তার যাত্রা পথ

ফেনিল সোফায় বসে
হাঁটুতে পা তুলে
ইশারায় ডাকে তাকে
হা- মুখ সমুদ্র :
পুঁজিবাদ ভোগবাদ
বলে আর কাকে!
এবার বিকট সরীসৃপ
বৃহৎ হা- য়ের ভিতর আমুণ্ডু
গিলে নেবে তাকে ---

এমনই নিয়তি
উন্নয়নশীল সকল নদীর---
হা- হতোস্মি আমাদের

 

পিপাসার ফাঁকে অবসরে

জীবনের অঙ্ক আর জগতের ছবি --- তার মাঝে
ডুবে থাকি; মাঝে মাঝে ভাসি, দেখি আকাশের মতো
নির্ভার উচ্চতা,সবুজের আলোড়ন--- বুক ভরে
শ্বাস নিই; কিছু বেলা ভেসে থাকিফের ডুবে যাই,
ডুবেই থাকতে চাই ভাবনার মতো মনে--- যদি
পিপাসার ফাঁকে এতটুকু অবসর পাওয়া যায়

অতি সাধারণ এই ডুবে যাওয়া,এই ভেসে ওঠা
অনুধাবনের মতো ডুবে থেকে দেখি লীলাময়
বাস্তবতা--- জীবনের ঘূর্ণিজল কতটা অতল;
নিকট বৃক্ষের মতো প্রতিবেশি- স্বজন- বান্ধব:
দেখি বিরহের প্রেম,অশ্রু--- কাউকে বলিনা কিছু,
যদি ব্যথা পায়, ব্যথাতুর বেদনার মতো ক্লীশ হয়!

এইমতো ডুবে থাকি পিপাসার ফাঁকে অবসরে
মগ্নতার ডুবোজলে ছুঁয়ে থাকি অতলপাথর

 

এইবার বানপ্রস্থে যাও

বোবা ক্যানভাসজুড়ে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস; ক্ষুব্ধ ঢেউয়ে
দৃশ্যের নৌকাটি উঠে আসে বাস্তবের
কঠিন ডাঙ্গায়;
মৃত স্বপ্নগুলো গলিত লাশের মতো পড়ে আছে
হৃদয়ের উপকূলে,কাদায় পঙ্কিলে

মেঘের সমুদ্র ভেঙে কত দূর দিতে হবে পাড়ি!
কে বাড়াবে হাত এবেলায় অতল জলের দিকে?

মুখ বুজে পড়ে আছে ছায়া
শীতার্ত সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে দুঃখ:
এইভাবে কত দিন--- এইবার বানপ্রস্থে যাও...

 

খতিয়ান

এ জীবন খতিয়ানহীন, বিস্মৃতির:
কোনো পথ, ছাইগাদা --- অজপাড়াগাঁর

এ সংসার শূন্যের গণিত, ফলাফল শূন্যতার --
আকাশের মতো, দিগন্তের অনুরূপ

এ সমাজ ধর্মপাঠ জানে, পুণ্যে ধন্য;
এখানে ফুলের শব বিক্রি হয় সহজ নিয়মে

এই দেহ বিনষ্টির, তুচ্ছ আর্দ্র ঘাস---
বুক ছুঁয়ে মাটি ছুঁয়ে ঝরে পড়ে মৃত্যু অগণন

আলোহীন অন্ধদিনে


শাশ্বত মৃত্যুর মতো অন্ধকার প্রেরণার নয়;
তবু প্রেরণার মতো মনে হয় এই ঘনীভূত
উদ্বেলিত অন্ধকার

আলোর অতীত চিরদিন অন্ধকার ----
অন্ধকার গর্ভ থেকে জন্ম নেয় আলোর অঙ্কুর

বহু দিন স্তব্ধ হয়ে আছে জাগরূক দিনগুলি,
বহু দিন অন্ধ হয়ে আছে
আমাদের নয়নজানালা,
বহু দিন শূন্য হয়ে আছে
আলোহীন প্রভাতের থালা ;
বর্ষায় বর্ষায় জলে ভিজে মুছে গেছে
অসফল নিঃস্ব অতিক্রান্ত দিনলিপি

ঘুমন্ত বীজের মতো স্বপ্নগুলি ফিরে চায় আলো ---
আগামীর ভোর তবে ফিরে পাবে রৌদ্রের নিখিল ;
ম্লান কৃষকের মতো
হতভাগ্য দিনগুলি
আবার দাঁড়িয়ে যাবে
সার- সার সেগুন অর্জুন ঋজু গাছেদের মতো

আজ তাই আলোহীন এই অন্ধদিনে
আলোর শক্তির মতো প্রেরণার দুঃখ ভালোবাসি



এসো দূর দেখি

এসো দূরে তাকাই আমরা যত দূর চোখ যায়--
সমুখের দিকে উপরের দিকে -- এসো দূর দেখি;
কত উচুঁ দিয়ে ওড়ে চিল, কত দূরে দূরে নীল
পাহাড়ের ঢেউ -- আহা, কত দূর আর দেখা যায়!

আমাদের নয়নসমুখে কুহেলিকাময় ভোর,
কুয়াশায় ডুবে আছে সূর্য, নগরতোরণ; এক
দিকে জীবনের সীমাবদ্ধ নশ্বরতা, আরদিকে
ক্ষীণ দৃষ্টি -- আহা, কত সামান্যই না দেখি আমরা!

সভ্য হতে হতে কতবার নেমে গেছি নর্দমায়
সভ্য হতে হতে কতবার মেতেছি মারণযজ্ঞে --
চক্ষুষ্মান সভ্যতার এই ছিল দলিত আখ্যান
দেশে দেশে অন্ধদৃষ্টি, ছিন্নবাহু, রক্তের নিশান!

যা কিছু অদৃশ্যে আছে, সবুজের অন্তরালে আছে,
আলোর ভিতরে আছে -- আমাদের দেখা হয় নাই;
ক্ষীণ দৃষ্টি আমাদের, এসো চোখ মুছে নিয়ে, চোখে
জলের ঝাপটা দিয়ে যত দূর চোখ যায় দেখি:

যা কিছু অদৃশ্যে আছে -- ছায়াময় জীবনের ছবি

 

 

একদিন হঠাৎ সন্ধ্যায়

সমষ্টির অধিকার নিয়ে অনেক স্লোগান হলো উচ্চরবে
এবার নীরবতার সাথে বেদনার মিছিলের সাথি হবো

পথের দুধারে সামন্তবাদের অবশেষ প্রাচীন বৃক্ষরা
সব জানে --- যা কিছু লিখিত আছে মানুষের সংগ্রামে সংগ্রামে;

রক্তপাত থেকে ক্ষুধা, মানুষের ওগরানো বমি, লোলুপতা
দাঙ্গার আগুন, জাতিতত্ত্ব, নতুন রাষ্ট্রের ব্যর্থ স্বপ্ন --- সব ;

তারপর রক্তপলাশের দিন এলো, নদীবক্ষে ভাটিয়ালী,
তার মাঝে পিদিমের আলো --- যুদ্ধ, স্বাধীনতা, দুঃখী গণতন্ত্র

আজ বাজারের বন্ধনহীনতা এনেছে মৌতাত ব্যষ্টি দুর্গে
তাতেই বদলে গেল সব! আহা গলিত পুঁজের সাদা হাসি!

আজ নীরবতা, বিষণ্ন মৌনতা, রুদ্ধবাক হাতে রাখো হাত
অনেক দুঃখের সারাৎসারে জেগে ওঠে বায়ু হঠাৎ সন্ধ্যায়

গরীবের পদ্য


গরীবের পদ্য নিয়ে
এসেছে দারিদ্র্য বিমোচন সংস্থা:
এবার বইবে সুবাতাস
বাঁকা কুঁজো জীবনের ঘরে ঘরে

দারিদ্র্যসীমার মানদণ্ডে
নিরূপিত আঙিনায়
বসবে জমজমাট পদ্যের আসর,
ন্যাড়া মাঠে হবে
লোক-সংস্কৃতির মেলা, সাপখেলা ----
আরো আরো অসম্ভব-সম্ভবের
যাদু আছে সংস্থার ঝাঁপিতে

ব্যস্ত তাই উদ্বুদ্ধ কর্মীরা
ছুটছে শুকনো কলাপাতার আব্রুতে ঢাকা
দুয়ারে দুয়ারে ;
আর উৎসবের আমেজে
আবেশিতমোহাচ্ছন্ন
বিদ্যুৎবিহীন সন্ধ্যার আঁধার,
ভেঙে-পড়া ছনের ছাউনি,
দাদনগ্রস্ত কোটরগত ছানিচোখ,
ভেজা বসনের মতো
চামড়ায় সেঁটে-থাকা বুকের পাঁজর

এবার জীবনানন্দ দাশ
তোমার কবিতা থাক ;
দীর্ঘশ্বাসের মতো তোমার
দীর্ঘমাত্রার কবিতা
যোগাবে না কোনো ঝণ ;
তার চেয়ে বিষণ্ন আকাশ হয়ে থাকো
শ্রাবণ বাংলার মেঘে মেঘে

আমরা গরীব, পেতে-রাখা হাত,
নিতান্তই নিয়তি নির্ভর ;
পদ্যের পয়ার আর
ত্রিপদী ছন্দের বেড়াজালে
আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ে গেছি ---
আমাদের ক্ষমা করো

 

ছিন্নস্মৃতি

ছিন্নস্মৃতি তবু রক্তক্ষরণের মতো মাংসময়
যেন কাটা মাংসের উত্তাপ লেগে আছে মৃতদেহে ;
অকাল মৃত্যুর মতো কত দিন আগে ঝরে গেছে
তরুণ বৃক্ষের অভিলাষী-পাতা--- আজো জেগে আছে
নীরব ক্রন্দন তার হলুদ শিরায় ; কত দিন
আগে ডুবে গেছে সূর্য ---- আজো তার রক্তিম বাসনা
খেলা করে সমুদ্রের জলে পরিত্যক্ত বেলাভূমে ;
ছিন্নস্মৃতি তবু রক্তক্ষরণের মতো মাংসময়

যে জীবন ফড়িঙের
জীবনানন্দ দাশ -কে

আকারহীনতা আর
আকারসর্বস্বতার প্রশ্ন তুলে কোনো লাভ নেই ---
আলোর জলের আর বাতাসের কোনো দুঃখ নেই ;
আকাশের মতো যেসব শূন্যতা আছে
অন্ধ নক্ষত্রের মতো যেইসব প্রজ্বলন আছে
তাদেরও কোনো দুঃখ নেই

দুঃখাক্রান্ত হয় ঢের গাছেদের বিশুদ্ধ পত্রালি
দুঃখাক্রান্ত হয় মানুষের শরীরের ভাঁজ ত্বক
আর খসে খসে পড়ে
ভোরের পাপড়ি
রোদ্দুরের সুখ -দুঃখ নিয়ে তুমি এতটা দিবস
বৃথাই গড়ছ সাদা কাগজের ঘর

এই যে এতটা পথ এলে খানাখন্দ পার হয়ে
কোথায় পৌঁছুলে তুমি?
যে বইটি এতদিন ধরে পড়ছ নিবিষ্ট চিত্তে
সে মলাটবদ্ধ পুস্তকের
প্রারম্ভ - সমাপ্তি নেই সূচনা থেকেই ---
তুমি জানো তবুও জানো না

গাছে গাছে প্রচ্ছন্ন সংকেতে
হাওয়ারা এসে দোল খাবে
অলৌকিক উত্তরীয় জড়িয়ে সর্বাঙ্গে,
জলের সাম্পানে চড়ে পৌঁছুবে গন্তব্যে
বিলুপ্ত নদীর ঢেউ ; আর সেই তুমি
কূলে বসে থেকেওঅকূল হবে ভুবনডাঙ্গায়

আকারহীনতা আর
আকারসর্বস্বতার প্রশ্ন তুলে কোনো লাভ নেই ;
জাগতিক সকল অক্ষর, ভাষা, নিভন্ত প্রদীপ
মিলাবে বাতাসে,
ভেসে যাবে ঘাটে -বাঁধা -তরী
চিরচেনা চিরজানা জলের ঢেউয়ে

 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান