আম্বিয়া কোন কথা বলে না।
কী, তুই কী কতা কবি না?’ আম্বিয়া কোনো উত্তরও দেয় না। মাথা নিচু করে বসে থাকে। মনে ভীষণ জেদ তার। অদ্ভূত এক গ্রামীণ জীবন; গ্রামীণ সমাজ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে তখন অন্ধকারের কালো চাদরে ঢাকা পড়তে শুরু করছে সব। ‘বল কই গেছিলি, এত দিন কই আছিলি, কী করছস ক? তা না অইলে খুন কইরা ফালামু কিন্তু, ক,’
আম্বিয়া এবারও কোন উত্তর দেয় না। বরং মাথা আরও একটু নিচু করে ফেলে। অবসন্ন দেহবোধটা ছাড়া আর কোনো চেতনা আছে বলে মনে হয় না। তবে রে’ বলেই নজু মিয়া আম্বিয়ার চুলের মুঠি খপ করে ধরে ফেলে। গ্রামীণ সভ্যাচার যে উথলে উঠতে থাকে। পিঠে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা কিল আর চড় মেরে বসে নজু মিয়া। কিন্তু আম্বিয়ার কোনো প্রতিউত্তর নেই। সাথে চলতে থাকে গালি—গালাজ। সমস্ত অত্যাচাররের আম্বিয়া নীরব । কোনো ভাষা ফুটে উঠে না মুখে, নির্বাক ও নিস্তব্ধ।
‘কী মাইয়াডারে মাইরা ফেলবা নাহি?’ রান্না ঘর থেকে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে নজু মিয়ার হাতটা ধরে ফেলে আম্বিয়ার মা। তারপরও নজু থামতে চায় না। বারবার হাতটা ছাড়িয়ে কিল— চড় লাগাতেই থাকে। আর সহ্য করতে না পেরে আম্বিয়ার মা নজু মিয়ার কোমর পেঁচিয়ে ধরে ফেলে—
‘আম্বিয়া সইরা যা এহান থেইক্যা, তর বাপের মাথায় আগুন উইঠ্যা গ্যাছে, খুন হইয়া যাবি কইলাম।’
এরপরও আম্বিয়া নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। যেন নীরবে কষ্ট সহ্য করার একটা মহড়া চলছে। মারই যেন খেতে চায় আম্বিয়া। হয়ত মার খেতে খেতে মরে যেতেই চায় আম্বিয়া।
আম্বিয়ার মার ‘সইরা যা’ চিৎকার, নজু মিয়ার ‘হারামজাদি, তরে আজ মাইরা ফালামু’ধুপধাপ শব্দ ক্রমশ বাড়তেই থাকে। বাড়ির ভিতরের এমন ধপাধপ শব্দ এ বাড়ি ছাড়িয়ে আশে পাশের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আশে—পাশের লোকজন ছুটে আসে। লোকজন যখন আম্বিয়াকে উদ্ধার করে তখন আম্বিয়া বেঁহুশ। মা মুখে হাত দিয়ে বসে আছে। দাঁত দিয়ে রক্ত পড়ছে। বাবা নজু মিয়া উঠ—বস করছে আর প্রলাপ বকছে। পাশের বাড়ির সালেহা ভাবী আম্বিয়াকে পাঁজাকোলা করে টিউবওয়েলের কাছে নিয়ে যায়। এমন সন্ধ্যায়ও লোকজনে বাড়ি ভরে গেছে। কেউ বালতিতে পানি তোলে, কেই আম্বিয়ার মাথায় পানি ঢালে, কেউ আবার ডাক্তার ডাক্তার করে মহাব্যস্ত হয়ে পড়ে।
জ্ঞান ফিরে আসে আম্বিয়ার। আবিষ্কার করে বিছানায় শুয়ে আছে। দুজন হাতে—পায়ে খাঁটি সরিষার তেল মালিশ করছে। আম্বিয়া উৎসুক লোকজনকে একবার দেখে পরক্ষণেই চোখ বন্ধ করে কেঁদে উঠে।
‘এরা মানুষ না পশু? শিয়ান মাইয়াডাকে এমন কইরা কেই মারে?’ মালিশ করতে করতে সালেহা ভাবী বলে।
কথাটা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আম্বিয়া।
‘কী হয়ছে আম্বিয়া ক ত? তুই কই ছিলি?’
আম্বিয়া মুখটা খুলে কিছু বলতে যায়। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। কয়েকবার ঠোঁট নড়ে উঁচু কেঁদে উঠে। কোন কথা বলতে পারে না। বাইরের গমাগম শব্দ ক্রমশ বাড়তে থাকে। গমাগম শব্দ বাড়তে বাড়তে এক সময় ঝগড়ার মতো শব্দ হয়ে যায়। সালেহা ভাবী বাইরে আসে।
খালেক মিয়া খুব ক্ষিপ্ত নজু মিয়ার উপর। নজুর মেয়েটাকে দিয়ে ভুলিয়ে—ভালিয়ে ছেলে আব্বাসকে হাত করেছে। বাবা—মার নাম পর্যন্ত ভুলিয়ে দিয়েছে নজু ও তার মেয়ে আম্বিয়া। উঃ কী শয়তানের শয়তান, যাদু করেছে, ছেলেটার মাথা খেয়েছে। কয়েক মাস ধরে আব্বাসকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু ঘটনা আসলে কী ঘটেছে তা না এখনও কেউ স্পষ্ট নয়। আব্বাসকে লুকিয়ে রেখেছে নজু মিয়া। মেয়েটাকে আজ বের করেছে, এখনই ছেলেকে বের করতে হবে নইলে নজুর লাশ পড়ে যাবে। নিজেদের দুরসম্পর্কের আত্মীয় বলে বেশি কিছু করেনি, আজ অবশ্য ছাড়বে না। একটা কিছু করবেই। খালেক মিয়ার চোখে মুখে যেন আগুনের ফুলকি ঝরে পড়ছে। খালেক মিয়া চিল্লুাতে থাকে নজু মিয়ার উপর। মুখে যত অকথ্য ভাষা আসে তাই দিয়ে গালি দিতে থাকে। লোকজন থামতে বললেও সে থামে না। থেমে কী হবে— গ্রামের সালিশ তো কিছু করতে পারল না, দুই দুইবার বিচার বসল কিন্তু কৈ আব্বাস? কেউ তো ফেরত দিলে পারল না। থানা—পুলিশ কম হলো না, পুলিশ বলে—আমরা জোর শোর তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। ভরসা নেই কোনকিছুর উপর । এবার যে ভাবেই হোক একটা কিছূ করে ছাড়বে খালেক মিয়া। প্রয়োজনে নজুর বংশকে নির্বংশ করে ছাড়বে।
এতক্ষণ ধরে সালেহা সইছিল, এবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না।
‘আপনে মেলা দেহাইছেন, অহন চুপ করেন, অহন ঝগড়া বিবাদ করলে ম্যাইয়াডা মারা যাইবো’
‘আরে আমার উপকারী। পোলাডারে ফিরাইয়া দে।’
‘দেহেন আপনি চুপ কইরা যাড়ি যানগা, নইলে আজ খুন পইরা যাবুগা কইলাম’ রাগে সালেহা চেঁচিয়ে উঠে ।
‘কী! খুন করবি, তুই আমারে খুন করবি, চুরের মুখের বড় গলা। তরে খুন করণ দেহাইতেছি।’ বলে সালেহার দিকে এগিয়ে যায়।
‘খবরদার, আর এক পাও আগাবিনা, মেলা দেহাইছস, আজ তুর একদিন কী আমার একদিন’ নজু মিয়া রামদা হাতে হুংকার ছেড়ে এগিয়ে আসে খালেক মিয়ার দিকে।
উপস্থিত জনতা বুঝতে পারে এদের না থামালে কিছুক্ষণের মধ্যেই অঘটন ঘটে যাবে। দুপক্ষকেই ধরে ফেলে, পাঁজাকোলে করে পৃথক করে ফেলে দুজনকে। দুজনেই যথারীতি বঝাঝকা ও গালিগালাজ করতে থাকে। ঝগড়ার আওয়াজ কমে গেলেও গমাগমের শব্দে ভরে থাকে নজু মিয়ার বাড়ির আঙ্গিনার আনাচে—কানাচ। গমাগম শব্দ ক্রমশ ফিশফিশানিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আবার চারদিক ফিসফিসানির সমারোহে ভরে উঠে সমস্ত আঙ্গিনা । আনাচে কানাচে ফিসফিসানির আড়ালে শোনা যায়—‘বিচার হবে, সালিশ বসবে, কাল সকালে মসজিদের সামনে, আম্বিয়া—আব্বাসের বিচার’ আর বেশি কিছু শোনা যায় না। বুঝতে আর বাকি থাকে না যে, খালেক মিয়া সালিশ ডেকেছে আগামীকাল সকালে মসজিদ প্রাঙ্গণে। কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে হাউমাউ করে কান্নার শব্দ বের হয়ে আসে। দেখা যায়— নজু মিয়া বেঁহুশ হয়ে পড়েছে। সবাই নজু মিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ বালতি নিয়ে ছুটছে পানি আনতে। কেউ কী করা যায় তা নিয়ে হতবম্ব।
রাত গভীর হতে থাকে। আকাশের জোসনা যেন ঠাঁই দাড়িয়ে আছে তাদের বাড়ির উপরে। সিন্ধু চাঁদের আলোয় সালেহা ভাবী আম্বিয়াকে নিয়ে বেঞ্চে বসে। আম্বিয়ার জন্য আজ সালেহা ভাবী বাড়ি যায়নি। স্বামীও দেশে নেই, ছেলেপুলেও নেই গিয়েই বা কী করবে। তার চেয়ে ভাল আজ আম্বিয়াকে সঙ্গ দেওয়া গেল। ভরা পূর্ণিমা, যেন আকাশের চাঁদ নেমে এসেছে ঘরের আঙ্গিনায়। নিঃস্তব্ধ পরিবেশ। ¯িœগ্ধ আলোয় যেন স্বর্গীয় পৃথিবী। সালেহা ভাবী ¯স্নিগ্ধ কোমল দৃষ্টিতে একবার পূর্ণোজ্জল চাঁদকে দেখে নিয়ে চোখ রাখে আম্বিয়ার নত মুখের দিকে। আম্বিয়া বুঝতে পারে না। ডান হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই আম্বিয়া চমকে উঠে।
‘আমার সামনে গোপন করবি না, ক সব খুইলা ক, কী অইছে?’
আম্বিয়া কোন উত্তর দেয় না।
‘তুই তো হুনছস, কাইল সকালে সালিশ বইবো, বিচার হইবো......’ আরও কিছু বলতে যায় সালেহা কিন্তু থামিয়ে দেয় আম্বিয়া।
‘ভাবী মানুষগুলান জন্মের বদ ক্যান?’ আকুতিগ্রস্ত প্রশ্ন তুলে আম্বিয়া। কান্নায় কণ্ঠরোধ হয়ে আসে। আর কোন কথা বলতে পারে না। সালেহা ভাবী বুঝতে পারে মনের দুঃখ। একটু থামিয়ে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে স্বাভাবিক হয়ে নেয় তারপর আবার ঘটনা শোনানোর কথা জানায়। আম্বিয়া বেশ শক্ত হয়ে উঠে।
‘আব্বাস মেলাদিন থ্যাইক্যা আমার পিছনে ঘুরঘুর করতো। কী বুঝাইতে চাইতো কিন্তুক আমি বুঝতে পারতাম না। এর লেইগা বাপজানও হেরে বকাবকি করছে। একদিন হে আমার লেইগ্যা চুড়ি কিনা আনল, তাও বুঝলাম না। মাঝে মধ্যেই আমারে দেহা করবার কথা কইতো—আমার জন্য নাহি তার পরাণ কাঁন্দে। আমার মনডাও কাইন্দা উঠলো । আমার বুকের মধ্যে কেমন জানি শিরশির করতো ওর লেইগ্যা। দিন দিন কেমন জানি ওর লেইগ্যা আমি পাগল অইয়া যাইলে লাগলাম। দুজনে পলাইয়া গেলাম বড় শহরে।........’ আর কোন কথা বলতে পারে না আম্বিয়া ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে।
‘তারপর আর কী অইলো?’ সালেহা ভাবীর প্রশ্ন। শুনতে থাকে সালেহা ভাবী আর ক্রমশ রাগতে থাকে আব্বাসের প্রতি।
‘তারপর বুঝলাম, ও প্রতিশোধ নিয়েছে। আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে । চক্রান্ত করেছে। তারপর গত দুই সপ্তাহ হলো ওর কোনো খুঁজ নাই। ...
শ্যাষে অনেক কষ্টে আমি চইল্যা আইতে পারলাম। জানো ভাবী আমার প্যাটে কী জানি নড়াচড়া করে ।’
চমকে উঠে সালেহা। কী জানি বলতে যায়, নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলে—
‘রাইত শ্যাষ অইয়া আইতাছে, চল ঘুমাইগ্যা। কাইল সহালে আবার বিচার।’
দুজনেই চলে ঘরের মধ্যে। শুধু পূর্ণিমার চাঁদ জেগে থাকে আকাশে, আর মিটিমিটি হাসতে থাকে মানুষের অসহায়ত্ব দেখে। সবার কাছে ঘটনাটি আর অজানা থাকে না। চাঁদের আলোর মতো দীপ্যমান হয়ে উঠতে থাকে সবার কাছে। সবাই ক্রমশ ক্ষীপ্ত হয়ে উঠতে থাকে আব্বাসের প্রতি। সকাল হোক আগে; তারপর আব্বাসে ফাঁসির দড়ি না পড়িয়ে কেউ ছাড়ছে না। ক্রমশ রাত আরও ঘূণিভূত হয়ে উঠতে থাকে।
মসজিদ প্রাঙ্গণে সবাই সমবেত হয়েছে। হুজুর অনেকক্ষণ ধরে চোখ বন্ধ করে তসবিহ টিপছে। চেয়ারম্যানও এসে পৌঁছেছে, নজু মিয়া মাথা নিচু করে বসে আছে। গ্রামের গণ্য মান্য লোকজন সব চলে এসেছে। সালিশের এক পাশে মেয়েলোকদের জটলা। আম্বিয়া ও সালেহা ভাবী এক কোণায় নিথরের মত দাঁড়িয়ে আছে। এক পক্ষের অনুপস্থিতে বিচার হয় কীভাবে? মূল আসামী আব্বাস, সেই তো নেই। বিচার কীভাবে হবে সেটাই তো ভেবে পাওয়া যাচ্ছে না। তারমধ্যে এখনো ছেলে বাপ খালেক মিয়া এসে পৌঁছাইনি। সবারই দৃষ্টি নিবন্ধ খালেক মিয়ার আসার দিকে। সমবেত লোকজন বারবার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। লোকজন বলাবলি করছে— ‘যে বিচার ডেকেছে তারই খবর নেই’ ‘ নজু মিয়া ও খালেক মিয়া কী পর?’ ‘এমন অঘটন ঘটাতে পারে?’ ইত্যাদি। সালিশের সমবেত প্রতীক্ষায় অবসান ঘটিয়ে খালেক মিয়ার মেয়ের ঘরের এক ছেলে দৌঁড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে— ‘আব্বাস মামা বাসে একডিসেন করছে, হাসপাতালে আছে, মরমর অবস্থা। বিয়ানের আজানের সময় খবর আইছে, নানা সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে চইল্যা গেছে।’