একজন মায়ের সংগ্রাম - শাবলু শাহাবউদ্দিন
একজন মায়ের সংগ্রাম - শাবলু শাহাবউদ্দিন

তিনটা বাচ্চা সহ স্বামী তালাক দিলো। তিনটাই মেয়ে। বড়টা শুফমা। বয়স কত আর হবে। সবে মাত্র চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। কচুর পাতার মত কচি মেয়ে। মেজটা রহিমা। ক্লাস ওয়ানে পড়ে। তোতাপাখির মত কথা বলে। ছোটটা হালিমা। দুধের বাচ্চা। এখনো ঠিক ভাবে কথা বলতে পারে না। একটা কিছু হলে পুঁইশাকের মত নেতিয়ে যায়। তাই তো সব সময় শুফমা আর রহিমা তাকে নিজেদের কাছে আগলিয়ে রাখে।বড় লক্ষ্মী মেয়েগুলো আমার।

মাস কয়েক আগে আরো একটা মেয়ে বাচ্চা হয়ে মারা গেছে। মারা গেছে বললে ভুল হবে। মেরে ফেলানো হয়েছে। ঠিক বিড়ালের বাচ্চার মত, জন্ম থেকে একটু অসুস্থ ছিল। ডাক্তার বলেছিল পুুষ্টির অভাব আছে। ওষুুধ খাওয়াতে হবে। গ্রামের ডাক্তার খগেন মণ্ডল। বাকিতে কিছু ওষুধ দিয়ে ছিল। টাকা পরিশোধ করি নাই বলে আর ওষুধ দেয় না। তারপরে এক পয়সার ওষুধ অবধি কিনে খাওয়ালেন না ওর বাবা। মেয়ের ওষুধ খাওয়ানোর দরকার, এই কথা বলে একবার টাকা চেয়ে ছিলাম। সে বললো, " মেয়ে সন্তানের আবার ওষুধ কিসের? মেয়েদের ওষুধ লাগে না। অসুখ হয়েছে; এমনি ভালো হয়ে যাবে। নয়লে সৃষ্টিকর্তার মাল সৃষ্টিকর্তা নিয়ে যাবে। এহা নিয়ে এত দরদ দেখানোর কিছুই নেই।"

একবার কিছু টাকা ওর পকেট থেকে চুরি করে ডাক্তারের দেনা পরিশোধ করি। যাতে ডাক্তার আবার ওষুধ দেয়। কিন্তু সেই চুরি করার কথা কিভাবে যেন শুফমার বাবা জানতে পারে। তারপরে বাঁশের কাঁচা কুনছি দিয়ে ও ইচ্ছে মত আমাকে মেরে ছিল। মনে হচ্ছিল ও যেন আস্ত একটা কালগোখরো সাপ মারছে। প্রতিবেশীরা যদি না ঠেকাতো তাহলে সেই দিন ও আমারে একদম প্রাণে মেরে ফেল তো। সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের পাঠিয়েছেন পুরুষের খেলার পুতুল হিসেবে। তাই পুতুলকে যা খুশি তাই করতে পারে পুরুষেরা।

সেদিন বিছানায় ঘুমায়ে রেখে মাঠে গেলাম ছাগল আনতে। উঠোনে বসে দেখে গেলাম আমার শাশুড়ি, ভাসুর, এবং স্বামীকে। হায়নার মত একবার চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে। আমিও তাকালাম কুকুরের মত। আমার চাহনিতে বড় হতাশ হয় ওরা।

প্রথম প্রথম মানুষগুলোকে অনেক সম্মান করতাম। যখন তারা তাদের সেই সম্মান রাখতে পারে নাই; তখন কুকুর বিড়ালের মত ব্যবহার করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আমার। পৃথিবীর সব মানুষ এখন মানুষ নামের জানোয়ার হয়ে গেছে। শুধু টিকে আছে তাদের দেহশ্রী প্রাকৃতিক অস্তিত্ব।

আমার ভাসুরের চারটি স্ত্রী। একটারো ছেলেমেয়ে হয় না। একে একে সবগুলোকে তিনি তালাক দিয়ে দিছেন। এক বার কেবল বলে ছিলাম ডাক্তার দেখাতে। তাতেই তার মেজাজ গগন স্পর্শ করলো। আমি নাকি তাকে খোঁজা বলেছি। তার তালাক প্রাপ্ত সব স্ত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের সবার ঘরে এখন বাচ্চা-কাচ্চা আছে। মাঝে মাঝে আমার ভাসুর তাদের শয়তান বেটি বলে গালি দেয়। তারা যুক্তি করে নাকি তার সংসারে সন্তান দেন নাই। বড্ড শয়তান বেটি ঐগুলা।

শুনেছি আগামী মাসে নাকি আবার বিয়ে করবে। এবার বিয়ে করবে স্বামী মরা বিধবা একটি মেয়েকে। এই মেয়ের আবার আগের পক্ষের একটা ছেলে সন্তান আছে। ভালোই হবে। শয়তান বেটি সন্তান না দিলেও সমস্যা হবে না। তার একজন তো ছেলে সন্তান আছে। এটাকে দিয়েই চালিয়ে নেওয়া যাবে। এই বলে আমার ভাসুর খিলখিল করে ইঁদুরের মত করে দাঁত বের করে হাসে আর আশি বছরের বৃদ্ধ বুড়ার মত হোক্কর হোক্কর করে কাশে। কাশবে না? যে পরিমাণ বিড়ি খায়। আমার বিশ্বাস ও একদিন ক্যান্সার হয়ে মরবে।

ছাগল নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে দেখি বাড়িতে কেউ নেই। মনে মনে আমিও বাড়ির সবার উপর সব সময় রেগে থাকতাম। ছেলে সন্তান হয় না বলে সবাই আমাকে সব সময় খোঁটা দিত। খোঁটা শুনতে শুনতে কান প্রাণ ঝালাপালা হয়ে গেছে। সৃষ্টিকর্তা দেয় না তো আমি কী করবো!

আমার ছোট মেয়ে তাদের দু'চোখের বালু। তারা অনেক আশা করে ছিল চতুর্থটা ছেলে সন্তান হবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার দয়া হলো না। তিনটার পরে আবার আরেকটা মেয়ে হল। মাঝে মাঝে নিজের উপর নিজের-ই রাগ হয়। আমি কত হতভাগা! একটা ছেলে সন্তান জন্ম দিতে পারি না। সৃষ্টিকর্তার উপরও রাগ হত, তিনি নাকি সব পারেন! কিন্তু আমার একটা ছেলে সন্তান দিতে পারেন না। কেন পারেন না? ধর্মীয় গ্রন্থে আছে যে, যে মন থেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে চায়; তিনি নাকি তাকে হতাশ করেন না। আমি তো মন থেকে না, দিলের গহীন থেকে চাই। কই আমাকে তো তিনি একটা ছেলে সন্তান দিলেন না! নাকি তিনি কিছুই দিতে পারেন না? তিনি যা পারেন তাহা কী তাহলে মানুষের বানানো ফন্দি? মসজিদ-মন্দির, হুজুর-পীর, আলেম-মোল্লা, পুরোহিত-ঠাকুর সবার হাতে পায়ে ধরে বলেছি; সৃষ্টিকর্তাকে বল আমার যেন একটা ছেলে সন্তান দেয়। সব শয়তানের বাচ্চা আমাকে আশ্বাস দিছে আর টাকা নিছে। সরকারি লোক ঘুষ খেলেও কাজ করে দেয় কিন্তু সৃষ্টিকর্তা লোক ঘুষ খেয়ে আমার কিছুই করে দিলো না।

কত কবিরাজ ধরলাম। কত গাছগাছালি খেলাম। কত জিন-পরীর কাছে গেলাম। কিছুতেই কিছু হলো না। যা হয় সব মেয়ে। মেয়ের গোডাউন আমার ঘর।

মাঠ থেকে ছাগল এনে বেঁধে রাখি। তাহার কিছু সময় পরে গিয়ে ঘরে ঢুকে দেখতে পেলাম বাচ্চা নির্ঝরে ঘুমোচ্ছে। মনে মনে স্থির করলাম এই সুযোগে বাড়ির সকল কাজ সেরে নেই। বিকাল পরে এলো। শুফমা, রহিমা, হালিমা সবাই বাড়ি ফিরছে। একজন আরেকজনের সাথে মারামারি করছে আর খেলছে। মাঝে মাঝে খুব জোরে চিল্লায়ে উঠছে শুফমা। হালিমা ওদের সাথে খেলতে চায়। খেলার কড়ি নষ্ট করে দেয় তাই শুফমা চিৎকার করে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা চলে এলো। বুক (স্তন) ফাট ফাট করছে। বুকে প্রচুর দুধ। তিন থেকে চার ঘণ্টা বাচ্চাকে না খাওয়াইলে আপনা আপনি দুধ বের হয়ে ব্লাউজ ভিজে যায়। দেখলাম ব্লাউজ ভিজে গেছে। রহিমাকে ডেকে বললাম ইমুকে নিয়ে আসতে। রহিমা খেলা রেখে দৌড়িয়ে গিয়ে ঘর থেকে ঘুমন্ত ইমুকে নিয়ে আসলো। একি ইমুর শরীর ঠান্ডা বরফ। হাত পা শক্ত হয়ে গেছে। ইমু নিশ্বাস নিচ্ছে না। বুক ফেটে গেলো আমার। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। বাড়িতে লোকে ভরে গেলো। কেবল ওদের তিনজনকে আমি দেখতে পেলাম না তখন।

ইমু আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেলো। আমার বিশ্বাস ওরা বালিশ চাঁপা দিয়ে দমবন্ধ করে ইমুকে মেরে ফেলে রেখেছে। ইমু মরার পর থেকে আমার স্বামী, শাশুড়ি এবং ভাসুর সব সময় চেষ্টা করতো আমার কাছ থেকে দূরে থাকার। পুলিশকে দেখলে যেমন চোর পালানো জন্য চেষ্টা করে ঠিক এমনি করে চলতো ওরা। এ যেন চোর পুলিশ খেলা চলছে এই বাড়িতে।

আমি প্রথম থেকে বলছিলাম ওরা আমার ইমুকে গলা টিপে মেরেছে, বালিশ চাঁপা দিয়ে মেরেছে। কথাগুলো ওদের কাছে অসহ্য লাগতো। যে, যে অপরাধ করে, সে সেই অপরাধের কথা তার সামনে বললে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে এটাই স্বাভাবিক।

এক পর্যায়ে গিয়ে ওরা সবাই সিদ্ধান্ত নিলো। আমার স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করাবে। ওদের ছেলে সন্তান লাগবে। আমি চরম বিরোধিতা করলাম। ছেলে সন্তান যতসত, ওরা বাড়ি ছাড়া করতে চায় আমাকে। ওরা চায় না আমি আর এ বাড়িতে থাকি। তাই কোন উপায়ে আমাকে বাড়ি ছাড়াতে হয় তাঁর সহজ পথ ওরা খুঁজে পেয়ে গেলো। এই পথটা সবার কাছে যেমন গ্রহণযোগ্য হবে তেমনি টেকসই হবে, এই কথা মাথায় রেখে তাঁরা আমার স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করাতে উৎসাহ্ দিলো। তাতেই আমার কপাল পোড়লো।

এক পর্যায়ে গিয়ে ওদের কথা মত আমাকে তালাক দিয়ে দিলেন আমার স্বামী। তিনটা সন্তান নিয়ে স্বামীর সংসার ত্যাগ করলাম।

আমার তালাক অবৈধ বলে দাবি তুললো আমার ভাইয়েরা। নালিশ দিলো গ্রামের প্রামাণিকদের কাছে। সালিশ বসলো, বিচার হলো। সালিশের প্রধান বললেন যেহেতু বউ তালাক হয়ে গেছে, ধর্ম অনুযায়ী এই বউ ঘরে তুলা যাবে না। এই বউকে আবার অন্য পুরুষের সাথে বিয়ে দিতে হবে। তারপরে এই বউ শুফমার বাপের জন্য জায়েজ হবে। আমাকে সালিশের প্রধান নিজেই বিয়ে করতে চাইলেন। প্রস্তাবে সবাই রাজি। আমি কেবল রাজি হলাম না। এক জীবনে স্বামী একজনই হয়, বহুজন নয়। আমার দ্বিমত পোষণ করায় সালিশের প্রামাণিকগণ রেগে গেলেন। অবশেষে জোর ধ্বস্ত করা হল। তবুও রাজি না হওয়ায় আমাকে বেত্রাঘাত করা হলো। আর শুফমার বাবাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা। সেই জরিমানার টাকা দিয়ে ধর্মশালার ঘর উঠবে। হাইরে দুনিয়া, পাপের টাকায় পুর্ণ্যের ঘর। এই কি তাহলে সৃষ্টিকর্তার অশেষ কেরামতি! এ ভাবেই যদি সৃষ্টিকর্তা খুশি হয় তাহলে সেই সৃষ্টিকর্তাকে আমি প্রত্যাখ্যান করলাম।

আমার মত হাজার হাজার গ্রাম বাংলার মেয়েরা বিচার নামের প্রহসন নিয়ে গ্রাম ছাড়ছে। এই ধর্মীয় বিচার ব্যবস্থার জন্য হাজারো নারীর কপাল পোড়ছে তার হিসাব কে রাখে? ধর্মকে ব্যবহার করে কত অনিয়মকে নিয়মে আর নিয়মকে অনিয়মে আনা হচ্ছে তার হদিস কেউ কী রাখে? যতক্ষণ আমাদের শরীরের শক্তি আছে ততক্ষণ সৃষ্টিকর্তা, ধর্ম বলতে কিছুই নেই। বাহুবলে কাজ হলে ধর্মের কথা কে শোনে, সৃষ্টিকর্তার আদেশ কে মানে। যখন শরীরের শক্তি কাজে লাগে না, বাহুবলে জয় আসে না তখন আমরা ধর্ম নামের কুসংস্কারের নানা আবেগী শব্দ ব্যবহার করি। ধর্ম হলো মানুষের বানানো এক নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে হাজারো অনিয়ম বিশৃঙ্খলার ঘর বসতি। সালিশ নামে গ্রামের যে বিচার ব্যবস্থা আজও টিকে আছে তা হলো গ্রামের মোড়লদের ফুর্তি ও টাকা পয়সা রোজগারের একমাত্র পথ।

স্বামীর সংসার শেষ হল; এলাম ভাইয়ের বাসায়। বাবা-মা অনেক আগেই মারা গেছে। কী আর করবো। প্রথম প্রথম ভাইয়েরা খুব ভালোবাসতো। ভাবিদের চাপে ভাইদের ভালোবাসা আষাঢ়ের ময়লার মত ভারী বর্ষণে ধুয়ে মুছে গেলো। মাস তিনেক ছিলাম ভাইদের বাসায়।

আমার কষ্ট দেখে গার্মেন্টস ফেরত গ্রামের মেয়ে ছালেহা আমাকে বুদ্ধি দিলো গার্মেন্টসে যেতে। কার সাথে যাবো। কীভাবে যাবো। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

অবশেষে সালেহাও মনস্থির করলো। সে আবার গার্মেন্টসে যাবে। আমি ওর সাথে গার্মেন্টসের উদ্দেশ্য বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঢাকায় এলাম।

ছালেহা উঠে গেলো তার পরিচিত একটা ম্যাচ বাসায়। আমিও উঠতে চাইলাম। কিন্তু হলো না। বাচ্চা কাচ্চা আছে। উঠা যাবে না। এতগুলো ছোট বাচ্চাকাচ্চা দেখে কেউ বাসা ভাড়া দেয় না। বাচ্চা কাচ্চা কান্নাকাটি করবে, চিৎকার চেঁচামেচি করবে এই ভয়ে কেউ বাসা দেয় না। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে মিললো একটা বাড়ি। দেখতে ভূতরী। কেউ থাকে না। বাসায় কেন কেউ থাকে না তা আমার জানা ছিলো না। উঠার পরে শুনতে পেলাম এখানে নাকি দুইটা মহিলা ফাঁসি নিয়ে মারা গেছিল। তাদের আত্মা নাকি এখনো পানি চায়। প্রথম প্রথম ভয় লাগতো। এখন আর ভয় পাই না। আত্মাগুলোর সাথে আমার কোন দিন সাক্ষাৎ হয় নাই। তাই ভয় পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

অনেক বলে কয়ে পাঁচ হাজার টাকা মাসিক হিসাবে বাসটা ভাড়া নিলাম। আগে যে পরিবার ছিল তাঁরা নাকি দশ হাজার টাকা দিত। লোক উঠে না বলে এত কম ভাড়ায় বাসটা আমাকে দিয়ে দিলো।

মাস শেষে গার্মেন্টস থেকে নয় থেকে দশ হাজার টাকা বেতন পাই। তাতে সংসার চলে না। সাপ্তাহিক সাত দিন ডিউটিতে আগে কাজ করতাম একটা গার্মেন্টসে। বেতন একটু বেশি পেতাম। কিন্তু অসুবিধা ছিল একটা। কোন ছুটিফাটা ছিল না। প্রতিদিন চোদ্দ ঘন্টা ডিউটি। আরো এক ঘন্টা যাওয়া আসা। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আর কতটুকু বা সময় থাকে? বাচ্চা কাচ্চা আছে। ওদের দেখভাল করবে কে? এমন দিন গেছে আঠারো থেকে ঊনিশ ঘন্টাও ডিউটি করতে হয়েছে। বাচ্চা কাচ্চার সংসার। এভাবে চলতে পারে না।

গার্মেন্টস পরিবর্তন করলাম। সেখানেও ঐ একই অবস্থা। তবে শুক্রবার অর্ধেক বেলা ছুটি পাওয়া যায়। সেই অর্ধেক বেলায় ওদের বুকে আগলে রাখতে পারি। মাঝে মাঝে তাও পারি না। যা বেতন পাই তাতে তো আর চলে না। নতুন কর্মের সন্ধান করতে হয়। টাকা রোজগারের পথ খুঁজতে হয়।

গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা মানুষ না, এ যেন মেশিন! সারাদিন একটানা কাজ করতে হয়। প্রথম যখন গার্মেন্টসে ঢুকি তখন মাঝে মাঝে বুকের দুধের চাপ ঠেকাতে পারতাম না; বুক ফাট ফাট করত। বুকের দুধের চাপ হালকা করতে একটু সময় যেই টয়লেটে ঢুকতাম অমনি বাইর থেকে ডাকাডাকি শুরু হয়ে যেত। এ তো ডাকাডাকি নয় যেন আকাশ থেকে বিনামেঘে বজ্রপাত হচ্ছে। টয়লেটে ঢুকে কী করছি তার জবাবদিহিতা করতে হত। সবে মাত্র বাচ্চা মরেছে মাস চারেক আগে। বাড়িতে থাকলে হালিমাকে বুকের দুধ খেতে দেই। কিন্তু গার্মেন্টসে কী করবো! লজ্জাসরমে উত্তর দিতে পারি না বলে কত বিশ্রী ভাষায় গালাগালি শুনতে হয়েছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের উপর যে পরিমাণ মানসিক চাপ দেওয়া হয় তাতে তাদের বয়স এবং কর্ম শক্তি দু'ই জীবন থেকে অর্ধেক নাই করে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই তুলনায় পারিশ্রমিক দেওয়া হয় যত্সামান্য। এ যেন ভূতের বেগার খাটা।

অনেক গার্মেন্টসে এখন আর পুরুষ শ্রমিক নেওয়া হয় না। কারণ তাঁরা বেতন নিয়ে আন্দোলন করে। শ্রম ঘন্টা কমাতে বলে। এই আন্দোলনের হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের সব গার্মেন্টসে মহিলা শ্রমিকের কদর দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহিলাদের চোদ্দ ঘন্টার জায়গায় আঠারো আঠারো ঘন্টা খাটানো যায়। অর্ধেক বেতনে কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। যা খুশি তাই করা যায়। গার্মেন্টসে মানবতা বলে কোন কথা নেই, যা আছে তা হল প্রোডাকশন।

ছালেহার সুপারিশে প্রথম যেদিন গার্মেন্টসে চাকরি নেই। সেদিন খুব ভালো লাগছিল। কত ছেলে কত মেয়ে এক সাথে কাজ করছে। সবাই যেন ভাইবোন। খুব আগ্রহ করে কত ছেলে কত মেয়ে আমার সাথে কথা বলতে আসে। পরিচয় নেয়। বিবাহিত কিনা জানতে চায়। ছালেহা অবশ্যই বলেছিল, অবিবাহিত বলতে। কিন্তু আমি সত্য লুকাই নাই। বিবাহিত বলেছি। কিন্তু তালাক প্রাপ্ত তা বলি নাই। অনেকেই জানতে চেয়েছেন, আমার স্বামী কী করে। সোজাসুজি বলেছি কৃষি কাজ। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের আগ্রহ আমার প্রতি একটু বেশি। কেন বেশি তা আমি জানি না।

প্রথম প্রথম ছেলেদের সাথে কথা বলতে লজ্জা পেতাম। এখন আর পাই না। অনেকেই জানতে চাইতো  গার্মেন্টসে কেন ঢুকলাম। উত্তরে তেমন কিছুই বলতে পারতাম না। গার্মেন্টসে একটা রীতি আছে। অল্প বয়সী ছেলেরা ডুকে একটা কারনে, আর মেয়েরা ঢুকে অন্য আরেকটি কারনে। বেশি বয়সীরা আবার ঢুকে বিশেষ কারণে।

অল্প বয়সী ছেলেরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে প্রেম করে। আবেগের বসতে বিয়ে করে। বাবা মা মেনে না নিলে কূল হারা নৌকার মত ভেসে এসে গার্মেন্টসে ঢুকে। একা একার বেতন দিয়ে কী আর সংসার চলে! নয় থেকে দশ হাজার টাকা বেতন। ঘর ভাড়া চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। আর থাকে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। জন প্রতি মাসে খেতে লাগে প্রায় পঁচিশ থেকে তিন হাজার টাকা। তাহলে দু'জনের খাওয়া খরচ পরে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। মাস শেষে দুই থেকে তিন হাজার টাকা ঋণ। এ দেনার টাকা দিবে কে? ছেলেটি তার নবকুমারী সতী স্ত্রীকে দিশেহারা হয়ে গার্মেন্টসের চাকরি নিয়ে দেয়। নব কুমারী আর কুমারী থাকে না। হয়ে যায় গার্মেন্টসের সম্পত্তি। মেয়েরা গার্মেন্টসে একশত পার্সেন্ট সতীত্ব নিয়ে প্রবেশ করে। তার বিশ পার্সেন্ট চলে যায় সুপারভাইজারের গালাগালিতে। কাজের অত্যাচার আরো চলে যায় বিশ শতাংশ। আর থাকে ষাট শতাংশ। তার চল্লিশ শতাংশ নষ্ট করে নবযুবকদের কলুষিত চোখ মন আর পাপিষ্ঠ হাত। আর বাকি বিশ শতাংশ খায় ঘরের স্বামী। অনেক সময় আছে ঐটুকুও পায় না ঘরের মানুষটি। কারণ স্বামীর থাকে দিনে ডিউটি আর স্ত্রীর থাকে রাতে ডিউটি। সাপ্তাহে কিংবা মাসে দেখা হয় এক থেকে দুই বার। চাহিদার তফাৎ থেকে কোন এক সময় সৃষ্টি হয় মন মিলন। ঘটে যায় বিচ্ছেদ। ভিন্ন জীবন ভিন্ন সংসার।

কিছু কিছু মেয়ে আবার গার্মেন্টস থেকে সতীত্ব হারিয়ে একদম দেউলিয়া হয়ে ফেরে পথ হারা শিশুর মতো। তবুও সে গার্মেন্টস ছাড়ে না। তাদের কাছে জীবনে টিকে থাকার মানে হলো সব হারিয়ে চোদ্দ পনেরো থেকে আঠারো ঘন্টা গার্মেন্টসের ডিউটি। সুখ নামের বিলাসিতা এই দুয়ারে নেই। জিএম থেকে ক্রমাগত গালাগালি এসে টিকে থাকে এই অবহেলিত শ্রমিকদের উপর। কাজের সৃষ্টি হয় চাপ। তিন থেকে চার জনের কাজ করে দিতে পারলে চাকরি থাকবে। নয়লে না। শ্রমিক আইন বলে কোন কথা নেই। মানবতার কথা টিভি পেপার পত্রিকায় মানায়, গার্মেন্টসে নয়। আট থেকে দশ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছি আমাদের সবার আত্মা। প্রোডাকশন চাই, কারো জীবন চাই না। শ্রমিকদের দেহ মন জৈবনের বিনিময়ে আজ বাংলাদেশ পোশাক শিল্পে এত উন্নত। কিন্তু তাতে শ্রমিকদের কী। তাঁরা ঠিক মত না পায় বেতন না পায় ভরণপোষণ।

আমরা গার্মেন্টসের শ্রমিক খেয়ে পড়ে কোন মত দিন যায়। ধনী থেকে ধনী হয় বাসাবাড়ির মালিকগণ আর গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা। এভাবে চললে এ দেশে দরিদ্র কমবে কিন্তু দারিদ্র্য কমবে না। কে দেখবে গার্মেন্টস শ্রমিকদের দুঃখ। কে রক্ষা করবে তাদের হাড় পাজর মাংস। এই বর্বরতা চোদ্দ থেকে আঠারো ঘন্টার হাত থেকে কেউ রক্ষা করার লোক নেই জানি। কারণ গার্মেন্টসে চাকরি নেয় মানুষ কপালের ফেরে। ভাগ্যের বিড়ম্বনায়।

আমার মত তালাক প্রাপ্ত মেয়েরা আসে গার্মেন্টসে। দেনার দায়ে দিশেহারা মানুষ গুলো আসে গার্মেন্টসে। দুঃখ কষ্টের যাদের শেষ নেই তারাই তাদের আত্মা মাত্র আট থেকে দশ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে গার্মেন্টসে।

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে শেষ করলেন রেসমা বেগম। কথাগুলো শুনতে শুনতে প্রায় ক্লান্ত হয়ে উঠছিল নব ইউটিউবার মজনু শাহ। মজনু শাহ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মানুষের জীবনের করুন কাহিনী তুলে ধরে তার SUFOM View ইউটিউব চ্যালেনে। আজ সে ভিডিও তৈরি করবে রাস্তায় ঝালমুড়ি বিক্রিতার একজন মহিলার জীবন কাহিনী নিয়ে। কিন্তু ঝালমুড়ি বিক্রিতা রেসমা যা বলছে তা পাবলিক মনে হয় গিলবে না। যত ভিউ তত আয়। নতুন কিছু চাই। ক্যামেরা বন্ধ করে দিলো মজনু শাহ। শুধু জানার জন্য জিজ্ঞাসা করলো, এখন আর আপনি গার্মেন্টসে চাকরি করেন না?

- না, করি না।

- কেন ?

- বেতনে পোষায় না। এছাড়া আমি ছাড়া মেয়েদের দেখবে কে। চোদ্দ পনেরো ঘন্টা ডিউটি করে; ক্লান্ত দেহ মন নিয়ে বাসায় ফিরে এসে কীভাবে সন্তানদের মাতৃত্ব পূরণ করবো আপনি বলুন?

- তাহলে এখন কী করে সংসার চলে?

- সকালে তরিতরকারি বিক্রি করি, দুপুরে মাঝে মাঝে ভিক্ষা করি, বিকেলে এই যে দেখছেন রাস্তার পাশে বসে ঝালমুড়ি চানাচুর আবার কখনো কখনো সিঙাড়া ইত্যাদি বিক্রি করি। যখন যেটা ভালো চলে।

 - তাতে আপনার সংসার চলে?

- চলে। গার্মেন্টসের বেতনের চেয়ে একটু ভালো চলে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের কোন ভবিষ্য নেই, নেই কোন সঞ্চয়। না আছে আশা না আছে ভরসা। ছোট মেয়ে সারাদিন আমার সাথে থাকে। ঐ যে দেখছেন না।

দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়েকে দেখিয়ে দিল। মেয়ে টা সবার কাছে হাত পাতছে। ছেঁড়া ময়লা মাখা জামা গায়ে। মনে হচ্ছে ভিক্ষা করছে।

- ভিক্ষা করছে?

- হম। বড় বোনের জন্য সাহায্য চাচ্ছে।

- মানে?

- আমার বড় মেয়ে স্কুলে মেডেল নিয়ে পাস দিছে। এক রোল হয়েছে। ওর শিক্ষকরা বলেছে, ওর মাথা নাকি অনেক ভালো। ওরে আমি বড় অফিসার বানামু। সরকারি অফিসার। আমিও দেখিয়ে দেবো। আমার মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে কোন অংশে কম না।

 কথা শেষে আঁচল দিয়ে দু চোখের পানি মুছলেন। আবেগ কত নিষ্পাপ। স্বপ্নগুলো এমনি হয়, নিজে পূরণ করতে না পারলে উত্তরাধিকার সূত্রে সন্তানদের উপর চলে যায়।

- আপনার বড় মেয়ে শুফমা ভালো শিক্ষার্থী হিসেবে সরকারি কোন সাহায্য পায় না?

- হুম, বৃত্তি পেয়েছে। তাতে কী আর চলে। ছোট মেয় ভিক্ষা করে। ওর টাকা কিছু খরচ করি আর কিছু জমা রাখছি। যাতে ও যখন পড়াশোনা করবে তখন খরচ করতে পারি। বড় মেয়ের মত ছোট মেয়েরও মাথা ভালো। ওদের অনেক বড় অফিসার করবো। মেজটার মাথা ভালো না। ভালো ছেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দিমু।

মায়েদের স্বপ্নগুলো এমনি হয়। কখনো কখনো তাদের স্বপ্ন পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আবার কখনো কখনো তাদের স্বপ্ন আকাশের চন্দ্র তারাকেও স্পর্শ করে। এই তো সেই শুফমা। যার মা রাত দিন পরিশ্রম করছে শুফমাকে মানুষের মত মানুষ করবে বলে, সেই শুফমা কী মায়ের পরিশ্রমের মূল্য দিচ্ছে! নাকি প্রকৃতির খেয়ালে গাঁও ভাসিয়ে আধুনিকতার স্পর্শ নিচ্ছে? আধুনিকতার ছোঁয়ায় যে কত মায়ের স্বপ্ন মরুভূমির চোরাবালির ফাঁদে পড়ে জীবন্ত দাফন হয়ে যাচ্ছে তার হিসাব কে রাখে। আমি আপনি নাকি রাষ্ট্র? আসলে কেউ রাখি না। সবাই আমরা স্বপ্ন পূরণে ব্যস্ত। কেউ কারো খবর রাখি না। তবে এখন থেকে চলে যাওয়ার পড়ে মজনু শাহ নিয়ত করছে, সে পূরণ করবে শুফমার মায়ের স্বপ্ন। কিন্তু তার এই যে শপথ মনে থাকবে তারই বা গ্যারান্টি কী! শপথ তো মানুষ রাতে দিনে সব সময় করে থাকে। তার কতটুকুই বা পালন করে। আধুনিকতার কাছে বিনাশ হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি থেকে শুরু করে অপ্রকৃতির সব। কেবল মাত্র টিকে আছে একটা ঠুনকো কাঠামো আর শুফমাদের মায়ের প্রত্যাশিত কিংবা অপ্রত্যাশিত স্বপ্ন।

 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান