আপনারা সবাই টেলিভিশনে ও পত্রিকার খবরে নিউ ইয়র্কে করনাভাইরাসে অসংখ্য মৃত্যুর কথা শুনছেন। একবারও কি ভাবছেন এ কেমন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন তারা! আত্মীয় পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কক্ষে যন্ত্রপাতির সাথে সাঁটা অবস্থায়, কিংবা হাসপাতালের নিঃসঙ্গ কক্ষে, বা নার্সিং হোমের শয্যায় অসহায় আর একাকী অবস্থায় মৃত্যুকে বরণ করছেন তারা। করোনা নিয়ে এসেছে এমনই এক অভিশাপ যা আক্রান্ত মানুষটিকে আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, করে দিচ্ছে অচ্ছুৎ আর অস্পৃশ্য। প্রিয়জনের সাথে শেষ দেখাটা হবারও সুযোগ নেই তাদের। রোগাক্রান্ত স্বজনকে এম্বুলেন্সে তুলে দেয়া, কিংবা তার সহযাত্রী হয়ে হাসপাতালের এমারজেন্সি পর্যন্ত যাওয়া ছাড়া বেশীকিছু করবার উপায় নেই আত্মীয়স্বজনদের। সেখান থেকে বিদায় নেবার সময় কেউই জানেননা জীবনে আর কখনো তাদের দেখা হবে কিনা। সেখানেই কি শেষ?
মৃত্যুর পর এক একটি মানুষ হয়ে যান এক একটি নম্বর। সেই নম্বর ধরেই স্বজনদের খুঁজতে হয় তাদের, কারণ করোনা ভাইরাসের কারণে শরীরটি সম্পূর্ণ সিল করে দেয়া হয়। মৃত্যুর পরপরই তাদের ঠাঁই হয় হাসপাতালের মর্গে, নয়ত হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষমাণ ভ্রাম্যমাণ মর্গে। কোথাও কোথাও নার্সিং হোমের মর্গও উপচে পড়ছে, ফলে মৃতের যায়গা হোয়ছে হোমের বাইরের শেডে। তারপর চলে তাদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আগের নানাধাপ। চুক্তিবদ্ধ ঠিকাদাররা তাদের হিমায়িত ভ্যানে করে দেহগুলো পৌঁছে দেয় মৃতের জন্য নির্ধারিত ফিউনারেল হোমে। এখানেই কি শেষ তাদের অন্তিম যাত্রার?
এ শহর ও শহরের প্রশসন কখনোও এত বিশাল মৃত্যুর মিছিল প্রত্যক্ষ করেনি, তাই শহরের মর্গের মত ফিউনারেল হোমেও ঠাঁই হচ্ছেনা সবার। শহরের এমনই একটি উপচে পরা ফিউনারেল হোমের বাইরে দেখা গেছে ব্যাগে ভরা মৃতদেহ। যাদের মৃতদেহ সনাক্ত করতে কিংবা পরিবার থেকে গ্রহণ করতে কেউ আসছেন না তাদের দেহ পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে নয়ত গনকবরে সমাহিত হচ্ছেন তারা।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নানা সংবাদ মাধ্যমের খবর আর অনলাইন রিপোর্ট থেকে এসব মৃত্যু নিয়ে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য মর্মন্তুদ চিত্র।কোন কোন হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীরা এসব রুগীর অন্তিম মুহূর্তে ভিডিও কলের মাধ্যমে আত্মীয়পরিজনের সাথে সংযোগ করিয়ে দিয়েছেন। অসহায় আর নিরুপায় আপনজন সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন আপনজনের অন্তিম মুহূর্তটি। অনেকেই এসময়ে অন্তিম প্রার্থনার আয়োজনও করেছেন। তবে সবার কপালেই এমন সৌভাগ্য যোটেনি। বেশ কটি নার্সিংহোম থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে বিশাল পরিমাণ মরদেহ, আত্মীয়রাও জানেননা তাদের আপনজন কখন কিভাবে মারা গেছেন।তবে আশার কথা ধর্ম ও আপনজনের ইচ্ছে অনুযায়ী সৎকারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে মৃতদের জন্য।
ভ্রাম্যমাণ মর্গ ও লাশ বহনকারী ট্রাকে কর্মরতদের কাছথেকেও পাওয়া গেছে নানা তথ্য। যে শহর এত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলনা সেখানে রয়েছে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অপ্রতুলতাও। যে মানন্সম্মত ব্যাগে করে মৃতদেহ মর্গ কিংবা ফিউনারেল হোমে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই ব্যাগেরও সংকট দেখা দেয়ায় নিম্নমানের ব্যাগ বা গারবেজ ব্যাগে করেই মৃতদেহগুল স্থানন্তর করা হচ্ছে বিভিন্ন যায়গায়।যে সব ধর্মের নিয়মে দ্রুততার সাথে মৃতদেহ সমাহিত করার আদেশ রয়েছে সেটাও সবসময় পুরপুরি মানা সম্ভব হচ্ছেনা নানা জটিল পরিস্থিতির কারণে।
জন্ম আর মৃত্যু, মানুষের সবচেয়ে বড় সত্য। আমরা এ নশ্বর আর ক্ষণস্থায়ী জীবনকে নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকি, মৃত্যুর কথা বলতে গেলে ভুলেই থাকি। কিন্তু অমোঘ নিয়মে তা আমাদের স্পর্শ করবেই আজ নয়ত কাল। মনেহয় আমরা কেউই চাইবনা আমাদের কুমরণ হোক। করোনায় দেশে বিদেশে মৃত্যু নিয়ে ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ও মর্মন্তুদ ঘটনা। দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ যেমন ইকুয়েডোর, গুয়াতেমালায় দেখা গেছে হাসপাতালের বাইরে, বাড়ির পাশে, কিংবা রাস্তার পাশে পরে রয়েছে করোনায় মৃত মানুষের মরদেহ। সেখানকার সরকারও অন্যদের মত প্রস্তুত নয় একসাথে এত মৃত্যুর ভার মোকাবেলা করবার জন্য। বাংলাদেশেও করোনা আক্রান্ত মৃত মানুষকেও কম ভোগান্তির শিকার হতে দেখা যাচ্ছেনা। আত্মীয় স্বজনের অনুপস্থিতিতে স্বযত্নস্পর্শহীন, বিনা অজু, বিনা গোছলে, ও প্রার্থনাহিনভাবে তারা সমাহিত হচ্ছেন।
মৃত্যু মানেই একটা জীবনের অবসান, একটি মানবের জীবন নামের উপন্যাসের শেষ অধ্যায়। কথায় আছে,‘সব ভালো তার, শেষ ভাল যার,। এমন করুণ আর মর্মান্তিক মৃত্যুর মাধ্যমে জীবন নাটকের শেষ হোকে তা আমাদের কারোরই কাম্য নয়। তারপরও অনলাইনে পড়া কয়েকটি লেখা থেকে একটু আশার আলো পেয়েছি। জানতে পেরেছি যারা নিউ ইয়র্ক শহরের মৃতদেহগুলো বিভিন্ন ফিউনারেল হোমে পৌঁছে দেন তারা মৃতদের সাথে যথাযথ সম্মানের সাথে আচরণ করে থাকেন। এমনকি তারা মৃতের সাথে কথাও বলেন। এরকম একজনের ভাষ্য, “ব্যাপারটা উদ্ভূত শোনালেও আমরা কিন্তু পরিবহনের সময় তাদের সাথে কথা বলি।“ তিনি আরও বলেন, “আমরা তাদের যত্ন নেই, তাদের কপালে হাত রাখি, কিম্বা হাত ধরি। বিশেষ করে যারা আধঘণ্টা আগে মারা যান।“