কবি :ওয়াহিদ জালাল
হিজরতের অন্তিম চিঠি
কয়েকদিন থেকে হজম করছি
সময়ের বেদনা আশ্রয়ের করুন মিনতি
এক অদৃশ্য সুন্দরের কামনায়,
এরপর হয়তো আর থাকবো না
আমি কিংবা আমার ছায়াটিও
মনে রেখো,একটি বাউন্ডুলে বেঁচেছিলো
এতোদিন তোমার ভালবাসার আশায় ।
হঠাৎ আত্মার মোকামে
আগামীকাল থাকব কি না জানি না ।
মনের খুব ভেতরে দৌড়াদৌড়ি করছে
কোন এক বাড়ির দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা একটি ফ্লেমের ভেতর
লিখা 'স্মৃতি তুমি বেদনা-র মতোন একখণ্ড
কালবৈশাখী রঙা কারও রেখে যাওয়া আদর ।
আনাজের হাড়ের মতোই নরম একটি মুখের
অভিমান চেয়ে আছে সেই সুবেহসাদেক থেকে ।
কতোবার চোখের ভেতর থেকে আঙুলের মুখে তুলে এনেছি
দূরত্বের ধামাইল গানে তোমার তুমিরে ।
আমার জন্য কখনো কষ্টের চাদর মুড়ি দিয়ে
মাছের মতো ঘুমায়নি কেউ,কখনো
পালঙ্কের খুঁটিতে ধরে অপেক্ষার আঁকা মসৃণ রুমালে
মুছেনি চোখের পানি,তবু মানুষ চায় তার জন্য
অপেক্ষা করে প্রহরগুলো নিজের বুকে লুকিয়ে রাখুক কেউ ।
বুঝতে চায় না মন,সেই অপেক্ষার আড়ালে কতোটা সহজে
নিজেই চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে সত্যর বিরুদ্ধে প্রণতির সীমা অতিক্রম করে ।
আমি মাংসের দরিয়ায় রক্তের হাসি দেখবো বলে,
মাটির কাছে বংশের জায়নামাজ বিছিয়ে
বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম, হঠাৎ
আত্মার মোকামে অন্ধকার নিজের হাতে আলো
নিভিয়ে দিয়ে চিৎকার করে ডাক দেয়, ওয়াহিদ-
ওয়াহিদ, তাকিয়ে দেখো, প্রতিটি আগামীকাল
ধ্বংসের সিংহাসনে বসে কূলহীন এক মহা জিজ্ঞাসার কাছে
অক্ষম পুরুষের দৃষ্টি হয়ে কামনায় ভেজা নারীর মতোন পবিত্র
আর সে প্রাণীদের অধীর প্রতীক্ষায় কাঞ্চনময় সুন্দরে চির জয়ী ।
তলো বেলিয়ে দাই মা
(চকবাজার অগ্নিকান্ডে নিহত এবং আহতদের স্মরণে)
আমাদের শহর ভিজে গেছে কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন বিষাদের বিলাপে,
শুরু হলো পর পর আগুনের বিশাল চিৎকার,
বৃদ্ধ লোকটির হাতের লাঠি ছিটকে পড়ে লেলিহান আগুনের সিনায়,
ছেলে ভূবন ভাঙা ডাক দেয়, বাবা বাবা হাত বাড়িয়ে দাও,
বাবার হাত ধরলো তখন পাষান মৃত্যু!
অবুঝ শিশুর সারল্যে ভরা ডাক,মা অ মা আগুন
'তলো বেলিয়ে দাই মা', অসহায় মা সন্তানের মুখের দিকে
তাকিয়ে সিঁড়ির পথ দেখিয়ে দিতে দিতে বলে,যা,
লাফ দিয়ে পড়ে যা কলিজার টুকরো আমার,
তারপর মায়ের কন্ঠস্বর স্তব্ধ ।
জীবনের সৌন্দর্য মিথ্যার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়,
মৃত মায়ের জ্বলে পুড়ে যাওয়া হাতটি ধরে
সন্তানের কান্না ফুরাতের ঢেউকে থামিয়ে দিলো,
চারপাশের প্রকৃতি বিশ্ব ধরিত্রীকে ডাক দেয়,
হে পৃথিবী, একটিবার তাকিয়ে দেখো,
জন্মের জলায় করুন চিৎকারে ভাসছে কতো অসহায় মানুষ,
আত্মবিলাপের এই দৃশ্য আজ সৃজন সম্মুখে দৃশ্যমান ।
মানুষের শরীর পুড়ে দুরন্ত বাতাস একদম স্থির হয়ে গেলো,
বেঁচে থাকার জন্য কিছু মানুষ মানুষের পুড়া ছাঁইয়ে
হামাগুড়ি দিয়ে রক্তের টানে প্রিয়জনদের শরীরের ঘ্রান শুকতে লাগলো ।
কে কার আপন এখানে কেউ জানে না,
তবু জীবনের ঠিকানা খুঁজে আহত প্রাণের খতিয়ান ।
আহারে হতভাগী মা, কালো ছাঁইয়ের আড়ালে
হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে খুঁজতে খুঁজতে পাগলীনি হয়েছে,
তার দীর্ঘশ্বাসে শুকোচ্ছে নীলনদ,
তার চোখের জলে ভরছে সুখের সাগর,
একটিবার তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চায় ।
একসময় আনমনে বলে ওঠে, বাবা তুই না বলেছিলে,
মা আজ একটু পটল রান্না করো অনেকদিন খাইনি মা,
পাগলীনি মা করুন বিলাপে বলে ওঠে, খোকারে,
আজ আর খাবো না,
যতোদিন বাঁচব আমি,তুই বিহনে- জীবন খেয়ে বাঁচব ।
কতো তৃষ্ণা মুখ বাড়ায়
যে ফাল্গুনে গলে মোমের মতো প্রকৃতির মন
এই ফাগুন মাখিয়ে দিলাম তোমার কপালে।
একটিবার তুমি বসন্তের মতো এসে
ডাক দিও সেদিনের মতো সকালে।
তৃষ্ণার্ত পথিক আমি এক
বসে আছি পাখির ডানার ছায়ায়,
তোমার আঁচল পেলে কষ্টের ঘাম মুছি
কাতর চোখে চেয়ে এই গোধূলির মায়ায়।
কোকিলের গানে কতো তৃষ্ণা মুখ বাড়ায়
আমার হৃদয় উত্তাপে নিরন্তর,
জীবনের গাঢ় শিহরণ অসুখি বেলার মতো
যুগল ঝর্ণা হয়ে বুকে বাঁধে তবু ঘর।
দিলাম ভোরের আকাশ,সুন্দর যতো বেলা
তোমাকে দিলাম বর্ণমালায় লিখে ভালবাসি।
তুমি শুধু দিয়ে যাও আজ একটিবার এসে
বসন্তে ফোটা ফুলের মতো মুগ্ধকরা হাসি।
বেজোড় শালিকের অস্থির প্রতীক্ষা
《 উৎসর্গ: কবি আল মাহমুদ কে》
আমি আগামীর কথা বলবো বলে
সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়
অমন জলের দৃষ্টির কাছে রেখে যাচ্ছি
মনের খোঁজে বের হওয়া ধন্যের রশি ।
বিকেল হয়ে গেলে, হিজরত থেমে যায় নীরবে
তোমার বাড়ির পুকুর পাড়ের ভাঙা মাটির পিঞ্জিরার ভেতর ।
জানিনা কি করে নগরে ভিখিরি এতো ভালো করে
চাইতে পারে মনের থেকে অনুরাগের ভিখ,
যেভাবে আমি চাইছি আজ,আর কেউ কি কখনো
নিজের জীবন নিলামে তুলে প্রার্থনার জন্য
ইবাদতে ফুঁ দিয়েছিলো এমন করে বেদনার বাঁশির মতোন?
যদি আমার অজান্তে দিয়েইবা থাকে,
তাকে হত্যা কিংবা আয়ুর খননের কাজে অন্ধদের
মূয়াজ্জিন করে দাও ঈগলের আকাঙ্ক্ষার চয়নে
নিয়ুত কর্ম বাহনে ।
আমি কথা বলবো বলে ব্যাকুল হয়ে অসংখ্য
তামাশাকে বুকের উপর জিওল রেখেছি,
সেই সকল তামাশা, তোমার মনে আছে?
আমিও না-ভুলে যাই, এতোসব তোমার মনে থাকবার কথা নয় ।
আমার মনে আছে, একদিন মেলা ভেঙ্গে গেলে
আমার শূন্য হাত থেকে কষ্ট ঝরছে দেখে তুমি হেসেছিলে ।
পৃথকভাবে তলব করলেন আহত জীবনভূমির অর্ধেক মালিক,
ফিরতি মেহমান যেমন খুশির আড়ালে লুকিয়ে দেখে
অনাত্মীয়ের বুকের জ্বালা, ঠিক সেই ভাবে
চেয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিছুই রইলো না করবার।
হতাশার ক্লান্তি বহন করা পথে হেঁটে যেতে যেতে
চোখে পড়ে সন্ধ্যার আবীরে একা একটি শালিক
বাউড়ি বাতাসে বড় বেশি বাউল হয়ে গেছে
ইমানের আলিঙ্গনে এক প্রেমিকের কবরের পাশে ।