কবি হাসানআল আব্দুল্লাহ। উত্তরাধুনিক শক্তিমান এক অগ্রসর কবির নাম। প্রচারের ডামাডোলের বাইরে বিদেশ বিভুঁই-এ নিভৃতচারী আছেন এই মেধাবী কবি। স্বভাবে প্রচার বিমুখ এবং খ্যাতির প্রলোভন মুক্ত। উদার মানবতাবাদী, কাল ওসমাজ সচেতন, প্রগতিপন্থী এই কবির কাব্য-যাত্রা নব্বই দশকে।
তিনি একাধারেকবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, ও অনুবাদক।সনেটের স্বতন্ত্র ধারার উদ্ভাবক এবং ‘নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ’ নামেমহাকাব্যের রচয়িতা। তার কবিতা অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, ফরাসি, স্পেনিশ, কোরিয়ান, পোলিশ ও রোমানিয়ান ভাষায়। পরে রোমানিয়ান ভাষায় অনূদিত কবিতা দিয়েসে দেশের কবি মারিস স্যালারির সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশিত হয়েছে দ্বিভাষিক (ইংরেজি-রোমানিয়ান) কবিতার বই। ২০১৫ সালে চীন থেকে প্রকাশিত সুইডিশ কবিব্যারেট বার্গ ও চীনা কবি ডিয়াবলো সম্পাদিত একটি বৃহৎ বিশ্ব কবিতারএন্থালজিতে বাংলাদেশ পর্বে স্থান পেয়েছে তার কবিতা। প্রকাশিত গ্রন্থেরসংখ্যা ৪০ এর উপরে। আন্তর্জাতিক দ্বিভাষিক কবিতা পত্রিকা ‘শব্দগুচ্ছ’ সম্পাদক তিনি। অনলাইনে দীর্ঘ এ সাক্ষাতকারে সময় দিয়েছেন সাহিত্য বার্তাকে । সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাহিত্য বার্তার সম্পাদক আরিফুল ইসলাম ।
সাক্ষাৎকার:
আরিফুল : আপনার কবি হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছেন?
হাসানআল আব্দুল্লাহ: একজন লেখকের প্রথম ও প্রধান অনুপ্রেরণা হলো জীবন। আমি মূলত আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কবিতার অনুপ্রেরণা পাই। তবে আপনার প্রশ্নটি যদি হয়, কীভাবে আমি প্রথম কবিতা লিখতে আসি, তাহলে বলবো যে আমার গৃহ শিক্ষকের হেয়ালীর মাধ্যমে লেখা শুরু করি। তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। একদিন বৈশাখি ঝড়ে সব উড়িয়ে নিচ্ছে দেখে আমার গৃহ শিক্ষক, বইটা উল্টে রেখে বললেন, ঝড় নিয়ে একটি কবিতা লিখে দাও। আমি গণিত রেখে শব্দ কাটাকাটি শুরু করে দেই। এবং কিছুক্ষণের মধ্যে একটা কিছু যেমন “এলো ওই ঝড়, উড়িলো রে খড়” দাঁড় করিয়ে ফেলি। মজাও পাই। সেই থেকে গণিতের পাশাপাশি আমি শব্দও কাটি।
আরিফুল : কবিতা কেমন হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন?
হাসানআল আব্দুল্লাহ: কবিতা অন্য সবার থেকে আলাদা হওয়া উচিৎ। আমি যদি অন্যদের থেকে আলাদাই না লিখতে পারি তাহলে সময় নষ্ট করে কোনো লাভ হবে না। মজার ব্যাপার হলো আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, (সবে আমার দু’একটা কবিতা এখানে সেখানে ছাপা শুরু হয়েছে) তখন আমার এক শুভানুধ্যায়ী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আচ্ছা বলো তো বাংলা কবিতায় তোমার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কে? আমি তৎক্ষণাৎ উত্তর দেই শামাসুর রাহমান। তিনি আমার দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, এতো বড়ো কথা তুমি বলে ফেললে? আমি বললাম, অতোটা ভেবে তো বলিনি। তবে বাংলা কবিতায় এখন শামসুর রাহমানকেই প্রধান কবি বলা হয়; প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তো তাঁর সাথেই করা উচিৎ। শুরু থেকেই যে আমি আমার কবিতা রাহমান বা তিরিশের প্রধানদের থেকে আলাদা করতে পেরেছি তা কিন্তু নয়, একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আমি আমার চতুর্থ গ্রন্থ থেকে অন্যরকম কবিতা লেখা শুরু করেছি। এবং পরে, আপনারা জানেন ‘স্বতন্ত্র সনেট’ ও ‘নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ’ আমার কবিতাকে একেবারেই অন্যদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। শামসুর রাহমান (তখন রাহমান ভাই বলেই সম্বোধন করতাম) নিজেই বলেছেন যে এই কবিতাগুলো আলাদা। এ-ও সত্য যে আলাদা হতে হলে জানার গুরুত্ব অনেক বেশি; সেই জানা হতে হয় বহু বিস্তৃত। প্রথমে নিজের ভাষার ঐতিহ্য, তারপর বর্তমান সময়ে কারা কি লিখছেন, এবং শেষে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার উৎকর্ষ।
আরিফুল: আপনাকে কেউ কবি বললে সে অনুভূতি কেমন হয়?
হাসানআল আব্দুল্লাহ: এক সময় পুলক বোধ করতাম। এখন মনে হয় কবির দায় কিন্তু অনেক। একটি ভালো কবিতা রচনা করতে, রিলকে বলেছিলেন, দশ বছরও তেমন বড়ো কোনো সময় নয়। অতএব ভালো কবিতা রচনা করা, অন্যদের ভালো কবিতায় আকৃষ্ট করা, কবিতার ভাষা বদলে ফেলা; এইসব হিসেব নিকেষের টানাপোড়েনে মনে হয় কে কবি বলে ডাকলো আর কে ডাকলো না তাতে কিছুই যায় আসে না।
আরিফুল: আপনার একটি প্রিয় কবিতার কথা বলবেন কী?
হাসানআল আব্দুল্লাহ: আমার প্রিয় কবিতার সংখ্যা তো অনেক। কোথা থেকে শুরু করবো? চর্যাপদ? মধ্যযুগ? মধুসূদন দত্ত? রবীন্দ্রনাথ? নজরুল? জীবনানন্দ? তিরিশের কবিতা? পঞ্চাশের কবিতা? আমাদের নব্বইয়ের কবিতা? না নিজের কবিতা? তারপরে বিশ্ব কবিতার ভাণ্ডার তো রয়েছে উন্মুক্ত। ফলে, আমার প্রিয় কবিতার সংখ্যা এতো ছোটো করে বলা যাবে না। আমার সম্পাদিত ‘বিশশতকের বাংলা কবিতা’ গ্রন্থখানা দেখে নিলে অন্তত কিছু ধারণা পাওয়া যাবে। বিশ্ব কবিতার ক্ষেত্রে আমার অনূদিত ‘বিশ্বকবিতা সংগ্রহ’ও সাহায্য করতে পারে।
আরিফুল: কবিতা কখন অকবিতা হয়?
হাসানআল আব্দুল্লাহ: ভালো কবিতা বা পাঠযোগ্য কবিতা একযুগে খুব বেশি লেখা হয় না। অতএব চারপাশে যা কিছু হয় তার সিংহভাগই অকবিতা। উত্তরটা অন্যভাবে দেই, কবিতা সিংহভাগ ক্ষেত্রেই অকবিতায় পরিণত হয়, কিন্তু অকবিতা কখনোই কবিতায় রূপান্তরিত হয় না।
আরিফুল: বিশেষ কারও লেখা ভালো লাগে কি?
হাসানআল আব্দুল্লাহ: অবশ্যই। আমি ইতিমধ্যে বেশ কিছু নাম উল্লেখ করেছি। তাছাড়াও বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এঁদের প্রত্যেকেরই কিছু কিছু কবিতা, আবার অন্যান্য ভাষায় এজরা পাউন্ড, টিএস এলিয়ট, সিমাস হিনি, স্ট্যানলি কিউনিটজ, জোসেফ ব্রডস্কি, নাজিম হিকমাত, টমাস ট্রান্সট্রোমার, ডেরেক ওয়ালকটসহ বেশ কিছু কবির কবিতা।
আরিফুল: প্রথম কোন্ কবিতা লিখে কবি জগতে প্রবেশ করেন?
হাসানআল আব্দুল্লাহ: আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয় ‘রক্তঝরা একুশ’ নামে একটি সংকলনে। কবিতার নাম মনে নেই। দৈনিকে প্রথম ছাপা হয়েছিলো সংবাদের ‘খেলাঘর’ পাতায়, আর সাহিত্য সাময়িকীর দিক দিয়ে অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার বাণীতে। এইসব কবিতার নামও মনে নেই। কারণ এরা আমার সংগ্রহে নেই। তবে আমার দু’একটি কবিতা যেমন ‘বঙ্গীয় উপনিষদ’ ‘হাত ধরে রেখেছে সময়’ ‘কিছু পয়সা হলে’ ‘ঈশ্বর যখন মৃত’ ‘শকুনেরা ভালো আছে’ ‘অন্তরাত্মার আহ্বান’ ‘উচ্চারণ’ বিভিন্ন সময়ে আবৃত্তি হতে শুনেছি। কিছু কবিতা একাধিক ভাষায় অনূদিতও হয়েছে।
আরিফুল: প্রথম কবিতা ও সম্প্রতি লেখা কবিতার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান কী? PLEASEএকটু খুলে বলুন...
হাসানআল আব্দুল্লাহ: বিস্তার পার্থক্য আছে। অষ্টম শ্রেণিতে যে কবিতা লিখেছি তা তো শিশুর মুখের আদোআদো বোল। তখন তো ছন্দ মাত্রা জ্ঞান ছিলো না, যদিও এই জ্ঞান থাকলেই যে একটি ভালো কবিতা লেখা যায় তাতোও নয়। তবে, প্রতিটি শব্দের আলাদা ওজন আছে, তাছাড়া কোন শব্দের পরে কোন শব্দ বসলে দ্যুতি ছড়াবে তাও অভিজ্ঞাতার ভেতর দিয়ে ধরা দেয়। উপমা অনুপ্রাস চিত্রকল্পের ধারণাও কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে। আর ছন্দ তো একজন কবির রক্তে হিমোগ্লোবিনের মতো প্রবাহিত হয়। এডিথ সিটওয়েল নামের ব্রিটিশ এক কবি বলেছিলেন যে ছন্দ-মাত্রা তথা কবিতার কলকব্জা না জেনে লিখতে আশা পণ্ডশ্রমের সামিল। শিবনারায়ণ রায়ও তাই মনে করতেন। আমার ‘কবিতার জন্মদাগ’ বইটিয়ে একটু চোখ রাখলে দেখবেন, একটি ভালো কবিতা কিভাবে লেখা যায় তার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করে উপসংহারে বলেছি, “তারপরেও কথা থেকে যায়। মূলতঃ কিসে একটি কবিতা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে বলা কঠিন! কবিতাকে যেমন কোনো সংজ্ঞার খাঁচায় বাঁধা যায় না, নির্মাণ কৌশলও কোনো নির্দিষ্টতার ধার ধারে না। তবে সংযোজন, বিয়োজন, অভিযোজনের পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকে।”
আরিফুল: সমসাময়িক কোন্ বিষয়টি কবিতায় প্রাধান্য দিচ্ছেন? অথবা কবিতা কী কোনো সমসাময়িক বেড়াজালে আবদ্ধ?
হাসানআল আব্দুল্লাহ: কবিতা কখনো বিষয় নির্ভর নয়, কিম্বা বিষয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিতও নয়। আমাকে অনেকসময় পত্রিকার সম্পাদক বলেন বর্ষা, শীত, শরত ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে কবিতা লিখে দেন। এ পর্যন্ত আমি এধরনের অনুরোধ যারা করেছেন তাদের সবাইকে হতাশ করেছি। তাৎক্ষণিকের ওই পণ্ডশ্রম করতে আমি রাজি নই। তার অর্থ কি এই যে আমার কবিতায় কোনো বিষয়ই প্রতিফলিত হয় না। অবশ্যই হয়। জীবনের সবগুলো মৌলিক ব্যাপারই আমার কবিতায় উঠে এসেছে। কিন্তু বিষয়কে মূখ্য করে সেগুলো লেখা হয়নি। কবিতার শরীরকে তার নিজের মতো করে বাড়তে দিয়েছি।
আরিফুল: আপনি একজন কবি, আর কবি হিসেবে কবিতার সংজ্ঞা কি হওয়া উচিত বলে মনে করেন ?
হাসানআল আব্দুল্লাহ: ইতিমধ্যে বলেছি যে কবিতাকে কোনো সংজ্ঞার খাঁচায় বাঁধা যায় না। তবে অনেক কবিই তো নানা ভাবে দেখতে চেয়েছেন। মালার্মের বিখ্যাত সংজ্ঞা শ্রেষ্ঠতম শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাস। আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলাম, কবির একান্ত ব্যক্তিগত সময়ের শৈল্পিক চিন্তার ফসল কবিতা। কিন্তু জুতোর ফিতে বাধতে বাধতে যখন কবিতা লিখি সেই সময়টা তো আমার একান্ত ব্যক্তিগত নয়, কিম্বা ট্রেনের হাজারো মানুষের কোলাহলে যখন লিখি? ফলে জীবনানন্দের কাছেই আসি, তিনি বলেছেন, কবিতা নানা রকম!
আরিফুল: কবিতা বিজ্ঞানকে আপনি কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেন? কবিতা কি যন্ত্রকুশলতাকে ধারন করে?
হাসানআল আব্দুল্লাহ: এখানে ছোটো করে একটা গল্প বলি। আমি পিএইচডি করার জন্যে আমার প্রফেসরকে বললাম রিকমান্ডেশন লেটার দিতে। তিনি একটি সাদা কাগজ আমার সামনে টেবিলে রেখে বললেন, এখানে লিখে দাও যে আগামী পাঁচ বছর তুমি কবিতা লিখবে না। আমি তো আকাশ থেকে পড়ি। বলি, তা কেনো? তিনি বললেন, আমি তোমার মতো আর কোনো ক্রেজি কবি দেখি নাই যে বলে কবিতা ও গণিতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমার পিএইচডি করা হয়নি। আপনি যদি ’কবিতা-বিজ্ঞান’ বলতে এর কালাকৌশলকে বুঝিয়ে থাকেন, তার উত্তর আগেই পেয়েছেন। আরেকটু এগিয়ে বলবো কবিতার শরীরটিই একজন মানুষের শরীরের মতো। কোনো অঙ্গকে ছেড়ে দিলে ওটি আর পরিপূর্ণ হয় না। কিন্তু তার মানে এ-ও নয় যে ক্লাসে বসে ছন্দ মাত্রা শিখে কবিতা লিখতে এলেই পশার হয়। আবার তাও তো হচ্ছে আমেরিকায় হাজার হাজার কবির। তবে, একথা সত্য যে এদের কেউই টিএস এলিয়ট হয়ে ওঠেননি।
আরিফুল: বাংলাদেশে বর্তমানে কবিতা চর্চার বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি ?
হাসানআল আব্দুল্লাহ:
শুধু কবিতা নয়, বাংলাদেশের সব চর্চাই এখন চাটুকারীতা নির্ভর। উৎকর্ষ এখানে মূখ্য নয়, মূখ্য পত্রিকার পাতা আর পুরস্কার। পাতায় আর পুরস্কারে যেতে হলে চাটুকারীতাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। তোষামোদি ছাড়া ক’জন বড়ো পুরস্কার পায় বলতে পারবেন? অন্য যেসব পুরস্কার দেয়া হয় তারও তো নিরানব্বই শতাংশই এমন। বলবেন, তাহলে ভালো কবিতা পাঠক কিভাবে পায়? খুঁজে নেয়। ভালো কবিকে পাঠক খুঁজে বের করে। তিনি ভিড়ের মধ্যে থাকেন না।
আরিফুল: বাংলাসাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের নিরিখে আপনার তুলনামূলক ধারনা কি?
হাসানআল আব্দুল্লাহ: আবহমান বাংলা সাহিত্যকে মাথায় রাখলে বিশ্বের যেকোনো বড়ো ভাষার সাহিত্যের সাথে আমরা সমান তালে প্রতিযোগিতা করতে পারি। এখানে একশ’ জন চাটুকার, কিম্বা একহাজার জন পত্রিকার পাতা নির্ভর হলেও একজন স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যান, নতুন কিছু সৃষ্টি করেন। ফলে একজন জীবনানন্দ থেকে যান, একজন হুমায়ুন আজাদকে দেখতে পাই গুলি চাপাতিকে তোয়াক্কা না করে অসামান্য সৃষ্টিশীলতায় বাংলা ভাষা ভরিয়ে তুলতে। এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে।
মাত্র তিন দশকের জীবন পেয়েও একজন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কবিতায় আলাদা হয়ে ওঠেন। তবে আমাদের সাহিত্যে বাজারিদের দাপট অনেক বেড়ে গেছে, কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো চলে গেছে অকেজোদের হাতে।
আরিফুল: কবিতার ক্ষেত্রে দশক ভিত্তিক কোন সংজ্ঞা আছে কি? যদি থাকে, আশি থেকে শূন্য দশকের সংজ্ঞাগুলো কি কি বলে আপনি মনে করেন ?
হাসানআল আব্দুল্লাহ: কবিকে মূল্যায়ন করা হবে শতক ও সহস্রের কাঠিতে। দশকের মাপটা শুরু হয় ইংল্যান্ডে বিশশতকের প্রথম দিকে। চিন্তাটি এমন যে প্রতিদশকেই কবিতার ভাষা ও প্রকরণের কিছু পরিবর্তন ঘটে যা একেবারে উড়িয়েও দেয়া যায় না। তবে বাংলা ভাষায় বিশশতকের তিনটি দশক আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়: তিরিশ, পঞ্চাশ ও নব্বই। তিরিশে আধুনিকতার শুরু, পঞ্চাশে এর পূর্ণতা, এবং নব্বইয়ে উত্তরাধুনিক কবিতার বিকাশ, সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করছে শূন্য ও পরের দশকগুলো। ষাটের নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ, রফিক আজাদও অবশ্য অন্যরকম অবদান রেখেছেন।
আরিফুল: বলা হচ্ছে বাংলা কবিতার পাঠক দিন দিন কমছে, কেন ?
হাসানআল আব্দুল্লাহ: আমার কখনোই এমনটি মনে হয়নি।
বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার আবৃত্তি একাডেমিগুলো দেখে তো মনে হয় কবিতার পাঠক দিন দিন বাড়ছে। জীবনানন্দের কতোগুলো ‘কবিতাসমগ্র’ বাজারে আছে তার কি কোনো পরিসংখ্যান দিতে পারবেন? আর আমার নিজের কাব্যগ্রন্থ ‘স্বতন্ত্র সনেট’-এর চারটি সংস্করণ হয়েছে। ‘নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ’ নামের তিন শতাধিক পৃষ্ঠার বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ এখন বাজারে।
আরিফুল: একজন কবির লেখালেখির পূর্ব প্রস্তুতি কি হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন ?
হাসানআল আব্দুল্লাহ: কবি যদি পুরস্কার ও দৈনিকের পাতায় উঠতে চান, তার কোনো প্রস্তুতির দরকার নেই। যদি দশকের নিক্তিতে টিকে থাকতে চান, তাহলেও কিছু সাদা কাগজ নষ্ট করলেই চলবে। কিন্তু তিনি যদি সত্যিকারের নতুন কিছু করে শতক ও সহস্র বছরের কালখণ্ডে স্থান পেতে চান, তাহলে তাকে চব্বিশঘণ্টা বইয়ের গুদামে, কিম্বা বাড়িকে বইয়ের আড়াত বানিয়ে তার ভেতরে বসে থাকার বিকল্প দেখি না।
আরিফুল: নতুন যারা লিখছেন তাদের সম্পর্কে কিছু বলুন ?
হাসানআল আব্দুল্লাহ: নতুনেরা সবসময়ই অন্য কিছু সৃষ্টি করে, পুরোনোদের পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। আমি আজ যা কল্পনা করতে পারছি না, আগামী দিনের কবি তাই করে দেখাবেন। এটাই তো নিয়ম। এবং আমি তাদের খুঁজে খুঁজে পড়বো। নতুন দিনের নতুন কবির থেকে শিখবো। তবে ছোট্ট একটা কথা বলি, সেটা হলো সততা। সাহিত্যে অসৎ লেখকের কোনো জায়গা নেই।
একনজরে কবি হাসানআল আব্দুল্লাহ
( প্রকাশিত কবিতার বইগুলি)
১.একবিংশ শতাব্দীর আগে, ১৯৯৩
২.
গোলাপের নাম তুমি, ১৯৯৪
৩. শকুনেরা ভালো আছে, ১৯৯৬
৪. সনেটগুচ্ছ ও অন্যান্য কবিতা, ১৯৯৬
৫. স্বতন্ত্র সনেট, ১৯৯৮, ২০০৪,
২০১৪
৬. আঁধারের সমান বয়স, ২০০২
৭. নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ, ২০০৭, ২০১৭
৮. এক পশলা সময়, ২০০৯
৯. ক্যাফের কবিতা, ২০১২
১০. শীত শুকানো রোদ, ২০১৩
১১. নির্জনে একাকী সূর্য, ২০১৮
১২. নির্বাচিত কবিতা, ২০১০, ২০১৪
১৩. নির্বাচিত ১০০ কবিতা, ২০১৬
১৪. বৃত্তের কেন্দ্রেও কবিতার মুখ, ২০১৬
১৫. ব্রেথ অব বেঙ্গল, ২০০০
১৬. অন্ডার দ্যা থিন লেয়াস অব লাইট, ২০১৫
১৭. স্বতন্ত্র সনেটস: বেঙ্গলি উইথ ইংলিশ ট্রানস্লেশন, ২০১৭
১৮. কবিতায় বঙ্গবন্ধু, ২০০২, ২০০৯
( প্রকাশিত গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নাটক)
গল্প
:
১৯.
শয়তানের পাঁচ পা, ২০১৫
উপন্যাস:
২০.
আহত মুকুল, ১৯৯৪
২১.
ডহর, ২০১৪
নাটক:
২২.
অধোমুখ, ২০১৬
প্রবন্ধ:
২৩.
কবিতার ছন্দ, ১৯৯৭, ২০১১
২৪.
কবিতার জন্মদাগ, ২০০৮
২৫.
নারী ও কবিতার কাছাকাছি, ২০১২
২৬.
ঐতিহ্য ও ব্যক্তিপ্রতিভা, ২০১৬
২৭.
শহীদ কাদরী: সময়ের সম্পন্ন স্বর, ২০০৫, ২০১৭
২৮.
হুমায়ুন আজাদ: রক্তাক্ত কবির মুখ, ২০০৭
( প্রকাশিত ছড়া, গান, ভ্রমণ, অনুবাদ, সম্পাদিত বই)
ছড়া:
২৯.
বরই গাছে চড়ুই নাচে, ২০০৮
৩০. ছড়া মহাশয়, ২০১১
৩১. ছড়াছড়ি, ২০১৭
৩২. ফুলের হাসি চাঁদের হাসি, ২০১৮
গান:
৩৩.
নির্বাচিত গীতিকবিতা, ২০১৫
ভ্রমণ:
৩৪.
বই মেলায় আটদিন, ২০০৯
প্রকাশিত অনুবাদ:
(ইংরেজী থেকে বাংলা)
৩৫.
বিশ্ব কবিতার কয়েক ছত্র, ২০০৮, ২০১৪
৩৬.
বিশ্বকবিতা সংগ্রহ, ২০১৮
(বাংলা থেকে ইংরেজী)
৩৭.
সিলেক্টেড পোয়েমস অব হুমায়ুন আজাদ, ২০১৪
৩৮.
হলোনেস অন দ্যা হরাইজন ( নাজনীন সীমনের কবিতা), ২০১৬
৩৯.
পোয়েটস অব বাংলাদেশ, ২০০৮
সম্পাদিত
বই:
৪০.
মার্কিন দেশের বাংলা কবিতা, ১৯৯৫
৪১.
বিশশতকের বাংলা কবিতা, ২০১৫
(লেখক মূল্যায়ন)
(স্বতন্ত্র
গ্রন্থ)
১.
হাসানআল আব্দুল্লাহ'র কবিতার নানা প্রেক্ষিত, স্ট্যানলি
এইচ বারকান, নাজনীন সীমন ও রুকসানা রূপা সম্পাদিত, দ্বিভাষিক
গ্রন্থ, প্রকাশক:ক্রস-কালচারাল
কমিউনিকেশন্স ও শব্দগুচ্ছ প্রেস, ২০০৭
২. উত্তরাধুনিক তিন কবি, লেখক: রেজা নুর, হাসানআল
আব্দুল্লাহ বায়তুল্লাহকাদেরী ও রহমান হেনরীকে নিয়ে আলোচনা গ্রন্থ, প্রকাশক: অনন্যা, ২০১২
৩. কাব্য অভিযাত্রী, রনি অধিকারী সম্পাদিত, কবির ৫০ উপলক্ষে প্রকাশিত গ্রন্থ, প্রকাশক: পুথিনিলয়, ২০১৭
৪. অনুভূতি লিটল ম্যাগের হাসানআল আব্দুল্লাহসংখ্যা,
সম্পাদক: রনি অধিকারী, ২০১৬; দ্বিতীয়
সংস্করণ, ২০১৭
(প্রবন্ধগ্রন্থে
স্থান)
৫.
"কবিতা তোমাকে", ম্যাজিক লন্ঠনে কয়কটি মুখ (প্রকাশিতব্য),
লেখক
মীনাক্ষী দত্ত, প্রতিভাস, কলকাতা, ২০১৯
৬.
"হাসানআল আব্দুল্লাহর দ্বিতীয় উপন্যাস 'ডহর' এক
মুক্তিকামী মানবীরগল্প", গ্রন্থ:
ভিন্ন মানুষ অন্য স্বর, লেখক: পূরবী বসু, পুথিনিলয়,
২০১৮
৭.
"হাসানআল আব্দুল্লাহ: স্বতন্ত্রধারার সনেট ও মহাকাব্যের কবি", গ্রন্থ:কবি ও কবিতা নিয়ে কিছু কথা, লেখক: আনোয়ার
কামাল, এবং মানুষ প্রকাশনী, ২০১৮
৮.
"আঁধারের সমান বয়স", গ্রন্থ: অক্ষরযোজনা জায়মান, লেখক:
রুদ্র কিংশুক, অভিজান, কলকাতা, ২০১৪
৯.
"নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ: বাংলা সাহিত্যে নতুন যোজনা", গ্রন্থ:ওমরের রুবাই প্রসঙ্গ: তার সাথে কবি ও কবিতা বিষয়ক নানা প্রশ্ন,
লেখক:মোহাম্মাদ আতাউর রহমান, লেবুভাই
ফাউন্ডেশন, ২০০৯
(যেসব আন্তর্জাতিক ও দেশীয় অ্যান্থোলোজিতেকবির কবিতা স্থান পেয়েছে।)
(আন্তর্জাতিক)
১.
ওয়ার্ল্ড পোয়েট্রি ২০১৪, জিয়াং জি ও লাই টিংজি সম্পাদিত, চীন,
২০১৪
২. ওয়ার্ল্ড পোয়েট্রি ২০১৫, জিয়াং জি ও লাই টিংজি সম্পাদিত, চীন, ২০১৫
৩. ব্রিজিং দ্যা ওয়াটার: ইন্টারনেসনাল বাইল্যঙ্গুয়াল
অ্যান্থোলোজি, উন-হো চাও ও
স্ট্যানলি এইচ বারকান সম্পাদিত, কোরিয়া,
২০১৩
৪. লং আই ল্যান্ড সাউন্ড: এন অ্যান্থোলোজি অব পোয়েট্রি,
ট্যামি নুজো মারগান সম্পাদিত, যুক্তরাষ্ট্র, ২০০৯
৫. রাইটিং আউটসাইড দ্যা লাইন, ট্যামি নুজো মারগান ও পিটার ডাগান সম্পাদিত, যুক্তরাষ্ট্র, ২০১২
৬. বার্ড: এ ফ্লাইট অব পোয়েমস, জোন ডিগবি সম্পাদিত, যুক্তরাষ্ট্র, ২০১৭
(দেশীয়)
৭.
দুই বাংলার প্রেমের কবিতা, শামসুর রাহমান ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সম্পাদিত, ভারত, ২০০৩
৮.
বাংলাদেশের তিন দশকের কবিতা, অধ্যাপক রফিকুল্লাহ খান সম্পাদিত,
ঢাকা,২০০৫
৯.
বাংলাদেশের কবিতা: এন এন্থোলোজি অব কনটেম্পোরারি পোয়েমস অব বাংলাদেশ, সিদ্দীক
এম রহমান অনূদিত ও সম্পাদিত, ঢাকা, ২০১৪
১০.
বিশ শতকের বাঙলা কবিতা, রহমান হেনরী সম্পাদিত, ঢাকা,
২০০৯
১১.
নব্বই দশকের নির্বাচিত কবিতা, রবিউল মানিক সম্পাদিত, ঢাকা,
২০১৪
১২.
পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা, মনজুরে মওলা সম্পাদিত, ঢাকা,
২০১৭
১৩.
বাংলাদেশের কবিতা, মনজুরে মওলা সম্পাদিত, ঢাকা, ২০১৮
( কবিকে
যাঁরা
বই উৎসর্গ করেছেন)
১.
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, জীবনানন্দের খোঁজে (গল্পগ্রন্থ), বিপিএল,
ঢাকা,
২০১৫
২.
রফিক আজাদ, সুন্দরের দিকে চোখ রেখে (কাব্যগ্রন্থ), নান্দনিক,
ঢাকা
২০১১
৩. পূরবী বসু, সভ্যতা
নির্মাণে নারী (প্রবন্ধগ্রন্থ), অন্যপ্রকাশ,
ঢাকা, ২০১৫
৪. বায়তুল্লাহ কাদেরী, বিতিকিচ্ছিরি লাইফ যাচ্ছে (কাব্যগ্রন্থ), প্রতিশ্রুতি প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৮
৫. প্রবীর দাস, প্রবহমান
(কাব্যগ্রন্থ), প্রকাশক:
আজকের কবিতা, শান্তিনিকেতন,
২০০৭
৬. বিষ্ণুপদ রায়, অক্ষরযোজনা
(কাব্যগ্রন্থ), নবপত্র
প্রকাশন, কলকাতা,
২০১২
৭. মতিন রায়হান, আগলে
রাখি নদীর সম্ভ্রম (কাব্যগ্রন্থ), র্যামন,
ঢাকা, ২০১২
৮. নাজনীন সীমন, বিশেষণের
বিশেষ বাড়ি (কাব্যগ্রন্থ), চিত্রকল্প
প্রকাশনী, ঢাকা,
২০১৪
৯. গোলাম মঈনউদ্দিন, বাতাসের পায়ে পায়ে (কাব্যগ্রন্থ), আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, ২০১১
১০. টিপু কিবরিয়া, তান্ত্রিকের
কবলে (কিশোর উপন্যাস), সেবা
প্রকাশনী, ঢাকা,
১৯৯৭
১১. আনিসুর রহমান অপু, সিদ্ধান্তহীন শিরদাঁড়া (কাব্যগ্রন্থ), ধ্রুবপদ, ঢাকা,
২০১৮
(পুরস্কার)
১.
হোমার মেডেল (হোমার ইয়োরোপিয়ান মেডেল ফর পোয়েট্রি), বিশ্ব
কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্যে, ২০১৬
২.
লেবুভাই ফাউন্ডেশন পুরস্কার, বাংলায় নতুন ধারার
সনেট 'স্বতন্ত্র সনেট' প্রবর্তনের জন্যে, ২০১৩
৩.
সম্মাননা স্মারক, ৫০ উপলক্ষে আয়োজিত
অনুষ্ঠান কমিটির পক্ষ থেকে 'নতুনধারার সনেট ও মহাকাব্যের মাধ্যমে বাংলা
কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্যে', ২০১৭
(তাছাড়া ঘোষণার আগেই প্রস্তাবিত তিনটি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।)