গদ্য
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষও অদৃশ্য এক শত্রু করোনা ভাইরাসের ভয়ে আতঙ্কিত। শুধু আতঙ্কিত নয় বিপর্যস্তও বটে। ভেঙে পড়েছে সামাজিক বন্ধন। এমনকি প্রশ্নের সম্মুখীন আজ পারিবারিক সম্পর্কও। করোনা সন্দেহে সন্তান তার অসুস্থ মাকে জঙ্গলে ফেলে
যাওয়ার মতো অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে, ঘটেছে অসুস্থ বাবাকে তার ছেলেরা বস্তাবন্দি করে চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে এসে সিরাজগঞ্জে ফেলে যাওয়ার ঘটনা। সবচেয়ে অমানবিক ঘটনা ঘটছে তখন, যখন দেখা যাচ্ছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর মৃতের সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনের
কেউ তাকে দাফন বা সৎকার করতে এগিয়ে আসছে না। বাধ্য হয়ে প্রশাসন বা পুলিশের লোকজনকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দাফন বা দাহ করতে হয়েছে। এমনও দেখা গেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানাজা পড়াতে হচ্ছে, বা মুখাগ্নি করতে হচ্ছে। সংবাদমাধ্যম সূত্রে এমনও ঘটনা ঘটতে
দেখা যাচ্ছে যে, মৃত ব্যক্তির লাশ নিজ গ্রামে দাফন করতে দেওয়া হচ্ছে না, দাফনের চেষ্টা করলে তার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকির অভিযোগও আসছে। গত্যন্তর না দেখে ঘটনাক্রমে সেই লাশকে নদীতে ভাসিয়ে দিতেও দেখা গেছে। এতোটা নিষ্ঠুর কি আমরা কখনো ছিলাম?
শিরোনামের দিকে লক্ষ্য রেখে আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এই পরিস্থিতির সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের কী সম্পর্ক? সম্পর্ক আছে বৈকি।
গত ১১ জ্যৈষ্ঠ সোমবার ছিল কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। একইসঙ্গে দিনটি ছিল মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন। স্বাভাবিক সময় হলে দিনটি হয়ে ওঠতে পারতো সত্যিকারের উৎসব সত্যিকারের আনন্দের দিন। কারণ, এমন উপলক্ষ্য মিলে যাওয়া তো দূরের কথা, সম্ভাবনা তৈরি হতেই আমাদের আরও ৩৬ বা ৩৭ বছর অপেক্ষা করতে হবে। হিজরি বর্ষের শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে যে গানটি বেজে ওঠে ( ও মন রমজানেরই রোজার শেষে...) সেটি যে নজরুলেরই লেখা। রোজার ঈদ, ঈদের গান আর নজরুলজয়ন্তী- কী অপূর্ব সমন্বয়ই না ঘটেছিল এবার! কিন্তু বৈশ্বিক দুর্যোগের এই সময়ে ঈদও করোনাক্রান্ত। বিষণ্ণ হৃদয়, অসীম উৎকণ্ঠা আর হতাশার মধ্য দিয়ে সমগ্র মুসলিম জাতিকে এবার নিরানন্দে কাটাতে হয়েছে ঈদুল ফিতর।
নজরুলের জীবনেও কি এমন সময় এসেছিল? সন্তান মাত্রই পিতামাতার কাছে প্রিয় হয়ে থাকে, হয়ে থাকে অসীম আনন্দের উৎস। নজরুলের কাছে বুলবুল ছিলেন তেমন। কবি বুলবুলের আসল নাম রেখেছিলেন অরিন্দম খালেদ। মাত্র তিন বছর আট মাস বয়সের এই পুত্র ছিল কবির কাছে অনেক প্রিয়। বুলবুলের স্বভাব ও প্রতিভাও ছিল অসাধারণ, ছিল বিস্ময়কর স্মরণশক্তি। এই অল্প বয়সেই সে গান শোনে রাগ-রাগিণীর নাম বলে দিতে পারতো। শোনে শোনে বহু ইংরেজি শব্দও সে শিখে ফেলেছিল। তাই অনেকের মতে, " ছন্নছাড়া উচ্ছৃঙ্খল নজরুলের সে ( বুলবুল ) ছিল এক শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। "
১৯৩০ সাল। নজরুলের অতি আদরের পুত্র বুলবুল বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয় এপ্রিলের শেষ দিকে। রোগশয্যায় অসুস্থ পুত্রের পাশে শুশ্রূষারত কবিকে যারা দেখেছেন তাঁদের মধ্যে খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন অন্যতম। তাঁর বর্ণনা থেকে মনে হয়, পুত্রের অসুস্থতায় কবি প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। বসন্ত রোগে অভিজ্ঞ এক চিকিৎসক দ্বারা প্রচলিত চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি মরিয়া হয়ে সন্ন্যাসী-ফকিরেরও শরণাপন্ন হয়েছিলেন। এমনকি পুত্রের জীবনরক্ষায় কবি তাঁর বন্ধু মঈনুদ্দীন ও স্নেহভাজন শান্তিপদ সিংহ ( ধূমকেতু পত্রিকার ম্যানেজার )-কে দমদমে পাঠিয়েছিলেন এক সাধুর খোঁজে। কারণ, কবি শুনেছিলেন এই সাধু নাকি জটিল বিপদ থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে পারেন। কিন্তু সকল প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে তখনকার মরণব্যাধি বসন্তের ছোবলে বুলবুল পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল ৭ মে ১৯৩০। খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন তাঁর 'যুগস্রষ্টা নজরুল' গ্রন্থে লিখেছেন,
... কবির বাড়ীতে যখন ফিরে এলাম, তখন বেশ রাত হয়েছে। ...আমাদের সাড়া পেয়ে কবি ওপর থেকে নীচে নেমে এলেন। আর বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললেন। বললেন ঃ " ওরে, সাধু কি এলেন না? আচ্ছা বলতে পারিস, সাধু মরাদেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারে কিনা? বল্ বল্, তিনি কি মরাদেহে
প্রাণ দিতে পারেন? "...
কবি বারবার আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগলেন আর ঐ একই কথার পুনরুক্তি করতে লাগলেন।...
একজন এগিয়ে এসে বললেন ঃ " মিনিট দশেক আগে বুলবুল মারা গেছে। "
বুলবুলের মৃত্যুতে নজরুল যে কেবল তাৎক্ষণিকভাবে শোকাহত হয়েছিলেন তাই নয়, তাকে দাফন করতে গিয়েও হয়েছিলেন নানা বিড়ম্বনার শিকার। কারণ, এখনকার করোনায় মৃত্যু যেমন আতঙ্ক ছড়ায়, তখনকার সময়ে বসন্ত রোগে মৃত্যুও ছিল অনুরূপ আতঙ্কবাহী। দাফনের আনুষঙ্গিক ব্যয় নিয়েও নজরুল তীব্র সংকটে পড়েছিলেন। কবরের জায়গা কেনা, কবর খোঁড়ানোর খরচ, দাফনের খরচ, এবং কবির শখ - তাঁর মৃত পুত্র যেহেতু 'ভোঁ-গাড়ি'তে চড়তে ভালোবাসতো, সুতরাং তার মৃতদেহ একটা ট্যাক্সিতে করে গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া, ট্যাক্সিওয়ালারা বসন্তরোগে মারা যাওয়া বুলবুলের লাশ ট্যাক্সিতে নিতে না চাওয়া ইত্যাদি নানা রকমের সমস্যা দেখা দেয়। হিসেব করে দেখা গেলো সব মিলে প্রায় দেড়শো টাকা খরচ হবে। কবির 'সঞ্চিতা' নামে কাব্য থাকলেও সঞ্চিত কোনো অর্থ ছিল না। এই বিপদের মুহূর্তে তিনি প্রকাশকদের কাছে লোক পাঠালেন। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া পেলেন না। তেমন কেউ আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসলেন না। কেবল ডি এম লাইব্রেরির প্রকাশক গোপালদাস মজুমদার ৩০-৩৫ টাকা দিয়েছিলেন। সেই অসহনীয় দুঃসময়ে এই বিপদ থেকে কবিকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন আবদুল হামিদ নামে কলকাতা মিউনিসিপাল করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা।
বুলবুল মারা গিয়েছিল আগের দিন সন্ধ্যার পরে। তখন বৈশাখের প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে। তার মৃতদেহ নীচে নামানো হয় পরেরদিন দুপুরের আগে আগে। তিনতলা থেকে সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে তার গলিত মৃতদেহ নীচে নামিয়ে আনা, ট্যাক্সিতে তোলা এবং ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে কবরস্থ করা ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। কবরে লাশ নামানোর লোকও পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন এগিয়ে আসেন কৃষ্ণনগরের গল্পলেখক আকবরউদ্দীনের ভাই জহুরউদ্দীন এবং 'জয়তী' পত্রিকার সম্পাদক আবদুল কাদির। আর পুরো সময়টিতে কবির সঙ্গে থেকে বুলবুলের দাফন-কাফনের বিষয়গুলো সার্বিকভাবে সমন্বয় করেন কবিবন্ধু খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন।
এই করোনাকালে মানুষের মৃত্যু ও দাফন বা সৎকারের সংকট দেখে, আমরা যেন আবার ফিরে যাই নব্বই বছর আগে, কাজী নজরুল ইসলামের পুত্র বুলবুলের মৃত্যু ও দাফনের ঘটনার কাছে। তবে চরম হতাশার বিপরীতে পরম আশার কথা হলো এই যে- মঈনুদ্দীন, জহুরুদ্দীন বা আবদুল হামিদ, আবদুল কাদিরের মতো মহৎপ্রাণ হৃদয়বান উদারচিত্তের সাহসী মানুষেরা এখনো আমাদের সমাজে রয়েছেন।
তথ্যসূত্র :
১. কাজী নজরুল ইসলাম ঃ জীবন ও সাহিত্য
- রফিকুল ইসলাম
২. বিদ্রোহী রণক্লান্ত ঃ নজরুল জীবনী
- গোলাম মুরশিদ