আমরা শিশুর শারীরিক বিকাশে যতটা মনোযোগ দেই, মানসিক বিকাশে ততটা মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি না। সুস্থ শিশু বলতে শুধু শারীরিকভাবে সুস্থ শিশুকেই বোঝায় না। শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবে শিশুকে সুস্থ রাখতে হবে। মানসিকভাবে সুস্থ না হলে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। শিশুকে সুস্থ রাখার জন্য গড়ে তুলতে হবে কিছু ভাল অভ্যাস। কম পরিশ্রম শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই এমতাবস্থায় ঘরেই হালকা বেয়াম ও খেলাধুলা করতে হবে। শিশুর মন ভাল রাখতে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল প্রয়োজন রয়েছে। কম ঘুম মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে। নির্দিষ্ট সময়ে শিশুদের ঘুমাতে হবে। শিশুর কাছে আমাদের সহজ হতে হবে। যেন পিতা-মাতাকে সে সব বলতে পারে। এতে তার মন ভালো থাকবে এবং স্ট্রেস হরমোনের প্রভাব কমে শরীর থাকবে তরতাজা। শিশুর সামনে কখনোই ধূমপান করবেন না। পরোক্ষ ধূমপানে তার শরীরেও ঢুকতে পারে নিকোটিন বিষ। তাই নিজে তো সাবধান হবেনই, সঙ্গে খেয়াল রাখুন শিশু যেন স্মোকিং জোনের কাছে না থাকে। একটি শিশু যখন বড় হয়, তখন চারদিকের পরিবেশ তাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে এবং এর প্রতিফলন ঘটে তার ব্যক্তিত্বে। শিশুর সামগ্রিক বিকাশের সঙ্গে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা নিবিড়ভাবে জড়িত। আজকের শিশু ভবিষ্যতের নাগরিক। তাই তার সুন্দর ও নির্ভয় শৈশব নিশ্চিত করার দায়িত্ব মা, বাবাসহ পরিবারের সব সদস্যের।
আমাদের দেশে কোভিড-১৯ ভাইরাসটি প্রথম মানব শরীরে সংক্রামন শুরু করে এই বছরের মার্চ মাসে। তারপর থেকেই এই করোনাময় সময়ে আমরা সবাই মোটামোটি ৫-৬ মাস যাবৎ ঘরবন্দী আছি। এটা যে ক্ষণস্থায়ী নয় তা এতদিনে আমরা বেশ অনুধাবন করছি। আমাদের সাথে আমাদের পুরো পরিবার। পরিবারে শিশুরাও আছে, আছে কিশোরেরা। স্বাভাবিক সময়ে ওরা স্কুল, কোচিং, খেলাধুলা, বাসায় পড়া, ছবি আঁকা, গল্প করা, গান শোনা, নাটক, সিনেমা বা কারটুন/এনিমেশন দেখা ইত্যাদি কাজ করে সময় কাটাতো। কোভিড-১৯ সময়ে কিন্তু চিত্রটা একেবারে আলাদা। বড়ই মনমরা সময় কাটাচ্ছে তারা। গ্রামের অনুকূল পরিবেশগত কারণে সেখানে শিশুদের মানসিক চাপ কিছুটা কম হলেও হতে পারে। অন্তত শহরের শিশুদের তুলনায় গ্রামের শিশুরা মানসিকভাবে কিছুটা ভাল আছে বলে আমার ধারণা। করোনাকাল শুরুর দিকে আমরা ও আমাদের শিশু কিশোরেরা একদম স্থীর, ঘরবন্দী ও ভীষণ দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিলাম। এরপর হাত ধোওয়াসহ স্বাস্থ্য সচেতনতা, মাস্ক ব্যবহার, লকডাউন ইত্যাদি সময় গড়িয়ে চলেছে। তারপর যুক্ত হয়েছে, প্রযুক্তির সাথে আমাদের নতুন পরিচয়। বিভিন্ন মাধ্যমে নানান এ্যাপ্লিকেশনের সাথে যুক্ত হওয়া এবং যথা সম্ভব স্কুলের পড়া চালিয়ে যাওয়া। আমি মনে করি, সম্মানিত অভিভাবকদের এটা সঠিক সীদ্ধান্ত। সময়ের সাথে আমাদের সবাইকে মানিয়ে চলতে হবে। এতে করে আমাদের সন্তানেরা পিছিয়ে পড়বেনা জীবন সংগ্রামে। পাশাপাশি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকেরাও উপকৃত হবেন, তারা কাজ হারাবেন না। মনে সাহস রাখতে হবে, এই খারাপ সময় চলে যাবে। আমাদের সবাইকেই আসলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। আমি জানি, বর্তমান সময়ে একজন মায়ের জন্য হঠাৎ কাজের চাপ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বাড়ির বাবা হয়তো অফিস যাচ্ছেন, ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন পরিবারের কথা ভেবে। প্রায় সবাই এভাবেই চলছেন। আসলে, আমাদের এই বিপদে বেশী পরিবারের চিত্র প্রায় এমনই। কোথাও মা, কোথাও বাবা, কোথাও দুজনেই ঝুঁকি নিয়ে বাইরে কাজ করছেন।
যত যাই হোক, শিশুদের বিষয়টি মাথায় রাখতেই হবে। কোনওভাবে তারা যেন মানসিক আঘাতগ্রস্থ না হয় বা তাদের মনে কোন স্থায়ী ভয় বাসা না বাঁধে। আনন্দ দিয়ে তাদের মনের চাপ হালকা রাখতে হবে। আমরা জানি, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জটা এখানে অনেক বড়। সবার তো আর এক রকম আর্থিক সচ্ছলতা থাকেনা। তবুও যার যার অবস্থান থেকে শিশুদের বিষয়ে ভাবতে হবে। আর যাঁদের সচ্ছলতা আছে তাঁদের উচিৎ হবে নিয়মিত স্কুলের অনলাইনে ক্লাস করানো ও পড়ার পাশাপাশি শিশুদের সৃজনশীল শিক্ষাগুলি চলমান রাখা। অনেক সাংস্কতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সময়ের প্রয়োজনেই অনলাইনে নাচ, গান, অংকন শেখাচ্ছেন। আপনার শিশুর কথা ভেবে এতে অংশ নিন। এতে করে দুটো কাজ হবে, এক - সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে আপনার অংশগ্রহণ করা হবে এবং দুই - শিশুদের মানুষিক বিকাশের মাধ্যমে তার মন ভাল রাখার কাজ হবে। শিশুরা অনিহা প্রকাশ করলে তাদের এই বিষয়ে বোঝাতে হবে, এই সময়ে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি সৃজনশীল কাজে মন দিলে তারা বেশী ভাল থাকবে। শিশুদের সাথে আমাদের ভাল সময় কাটাতে হবে। এতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার সাথে সাথে সে বুদ্ধি ও মেধা বিকাশে এগিয়ে থাকবে, জীবন যুদ্ধে পিছিয়ে পড়বেনা। আমাদের সবাইকে ভাল থাকার চেস্টা করতে হবে। আমার পাশে কিছু ফ্ল্যাটে বাচ্চাদের আমি মাঝে মাঝে দেখি। কখনও আমি দেখেছি তারা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মন খারাপ করে। আরেক বাসায় শুনলাম দুই ভাই ঝগড়া করছে। কেউ আবার বাবার সাথে ছাদে ঘুড়ি উড়াচ্ছে। কেউবা মায়ের সাথে লুডু খেলছে। কেউ চ্যাঁচামেচি করছে, ভাঙচুর করছে, পাশের বাসা থেকে শোনা যাচ্ছে। কেউবা বন্দী আছে দিনের পর দিন। কেউ গান গাইছে, কেউ আঁকছে। এমন নানান কাজে তারা মগ্ন। তারা ভাল থাক, সুন্দর থাক। এটাই আমাদের কাম্য। আপনার সন্তান কীভাবে সময় কাটাচ্ছে তার খোঁজ রাখুন।
একটি অসাধারণ শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে শিশুরা জন্ম নেয়। আমরাই তাদের সাধারণ বানিয়ে ফেলি। আমার পরম শ্রদ্ধার প্রিয়জন চিত্রশিল্পী অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হক স্যার শিশুদের সাংস্কৃতিক শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেন, 'শিশুরা কোন না কোন প্রতিভা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। ওদের কাছাকাছি অবস্থান করে যত্নের সাথে শেখাতে হবে।' আমার মনে হয় একটা শিশু যদি ছবি আঁকায় মজা পায়, তাকে তা করতে দিতে হবে। এটা তার মেধা ও মননকে বিকশিত করতে পারে। শিশুদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। শিল্পচর্চার মাধ্যমে বাড়াতে হবে সৃজনশীলতা। সংস্কৃতিচর্চা শিশুর চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটায় এটা সর্বজনবিদিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চা শিশুর মনোযোগ বাড়ায়। শিশু হচ্ছে একটি ঘরের প্রাণ। তার হইচই, দুষ্টুমির মধ্যেই যেন টিকে থাকে বাকি সবার আনন্দ। সুস্থ শিশু মানেই হাসিখুশি আর প্রাণোচ্ছ্বল। একটি সুস্থ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমরা যদি শিশুদের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে পারি তাহলে তাদের চিন্তাচেতনার মধ্যে আমরা পরিবর্তন আনতে পারব। শিশুদের ভালো রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। আগামী দিনে এ দেশ কেমন থাকবে, পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ কিভাবে তার স্থান করে নেবে তা নির্ভর করছে আজকের শিশুরা কিভাবে তৈরি হচ্ছে তার উপর। কতটা সামগ্রিকভাবে তৈরি হচ্ছে তারা। আমাদের বুঝতে হবে, শিশুদের তৈরি করার পেছনে সংস্কৃতিচর্চার একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। একস্ট্রা কারিকুলাম নয় সংস্কৃতি চর্চাকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। বিজ্ঞানীদের মতে, শিল্পচর্চার মাধ্যমে শিশুদের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অভিনব চিন্তার মাধ্যমে শিশু যখন বিভিন্নভাবে শিল্পচর্চার সুযোগ পায়, তখন তার সৃজনশীলতাও বৃদ্ধি পায়। সে অসাধারণভাবে ভাবতে ও চিন্তা করতে শেখে। এটা তাকে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে শেখায় এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে সে তখন সহজেই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। সুখে-দুঃখে সংগীত যেমন আমাদের মনোরঞ্জন করে, তেমনি শৈশব থেকেই শারীরিক ও মানুষিক অনেক কাজের ওপরেও রয়েছে সংগীতের নিবিড় প্রভাব। তাই শিশুকে একেবারে ছোটবেলা থেকেই সংগীতের সঙ্গে পরিচয় করানো জরুরি। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে সংগীত। ভালো সংগীত শুনলে মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন নামের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়, যা কোনো কিছু শেখার ক্ষেত্রে শিশুকে আগ্রহী করে তোলে।
বড়ই অনুতাপের বিষয়, এই দুঃসময়ে অনেকের জীবন ঝরে যেতে পারে। জীবনের পথ বদলে যেতে পারে শুধুমাত্র আর্থিক কারণে। এটা খুবই দুঃখজনক। সাথে এও মনে রাখতে হবে, একদিন কিন্তু আলো ফুটবেই। সেদিন অর্থের চেয়েও সুস্থতা বেশী প্রয়োজন হবে। আমরা দেখতে চাই, পরিবারের সাথে সন্তানের হাসি মুখ আর নিজেদের কাজ করার শক্তি। তাই, দুঃশ্চিন্তা না করে শিশুর সামগ্রিক বিকাশে শারীরিকভাবে সুস্থ রাখার পাশাপাশি শিশুর মানসিক বিকাশের দিকেও নজর রাখতে হবে। অভিভাবক হিসেবে এ গুরু দায়িত্ব আমাদেরকেই পালন করতে হবে।