নিশ্বাসের সবকটি দরোজার কপাট লেগে যায়; তুমিহীন
।
তবে এই কবিতাটি আমার শেষ কবিতা হবে ।
বুকের এখনকার ব্যথাটি শেষ ব্যথা;
প্রবলভাবে তোমাকে পাইনি এ আক্ষেপটি শেষ যাতনা;
এ মুহুর্তের অভিমানটি শেষ মায়া;
আজ মরে গেলে এই আঙুলগুলো আগামীতে বৃক্ষ হবে ।
( চিরন্তন )
কবিতাটি পড়ে আমি থমকে গেছি; এ কবিতা কার? বর্তমান সময়ে কে লিখতে পারেন অমন মানবিক সাহসে! কবির নাম হাসান হামিদ । বয়সে একেবারেই তরুণ । এরপর তাঁর বেশ কিছু কবিতা আমি পড়েছি । কলকাতার বাংলা কবিতা নামের সাইটে তাঁর কবিতা পড়ে আমি একরকম ভক্তই হয়েছি । ভাষার মহিমা, সাথে সহজ শব্দের সবল বুনন; এমন প্রাণোচ্ছল ধারা এখনকার যারা কবি, আর কারও লেখায় আমার চোখে পড়েনি অতোটা । আমার কাছে তাঁর কবিতা পাঠে মনে হয়েছে, সরলতার সাথে আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য মনে বাজে; সেটি কেন্দ্রিকতা । হাসান হামিদ তাঁর কবিতা যেখানটায় শুরু করেন, নানা পথ ঘুরে, জীবনের বিচিত্র চড়াই উতরাই শেষে ঠিক শুরুর জায়গায় শেষ করেন । আপাত দৃষ্টিতে কবিতাগুলো সহজ মনে হলেও তার সমস্ত শরীরজুড়ে যে মোহময় গাঁথুনি রয়েছে তা টের পান অগ্রগামী পাঠক ।
একটি কবিতা উল্লেখ করছি,
সাঁতার না জানা শরীর
তবু সমুদ্দুর পাড়ি দিতে চায়,
আলগোছে চুনোপুঁটি ধরে, একা একা সারা রাত বান
ডাকে,
বালিশের ওড় ভিজে বালিকার প্রেমের স্রোতে,
স্যাঁতস্যাঁতে বিছানায় শুয়ে থাকে দুর্গন্ধ নির্যাস;
অনাঘ্রাতা হৃদয় পড়ে থাকে শিথানের কাছে।
মাঝরাতে একাকী বালিকার মনে পড়ে ঈশ্বর !
( নিঃসঙ্গ বালিকার মধ্যরাত )
কবি বুঝেন কবিতার রস, কবিতার বিদ্রোহ- বিরহ – অমরত্ব । সেই সাথে বিমূর্ত মায়া, সৌন্দর্যবোধ, বেদনাবৃত নিসর্গ দিনপঞ্জি । হাসান হামিদের পরিমিতিবোধ দারুণ; আর তাঁর পাঠকপ্রিয় হওয়ার কারণ এটাই । আরেকটি বিষয়, তাঁর প্রতিটা কবিতায় আমরা দেখতে পাই জীবনের উন্নত অবাদ বিকাশ । কবির দেশাত্ববোধ, দেশপ্রেম নানাভাবে ওঠে আসে রচিত বাক্যের হাত ধরে । যেমন-
এই বসন্তে শান্ত জলে হাত ধুয়ে চলে গেছে
খুনী হৃদয়,
বড়ো বেশি বেহায়া বেয়ারা সময়, ভালো নেই
স্বপ্ন-স্বদেশ,
শত নাবালিকার দীপ্তিমান দর্পনে সে এখন বিমর্ষ মলিন,
অথচ একদিন তার
সুন্দরের ভাষা ছিল না;
অথচ তার শ্যামল ঘাসের বিছানাতেই
রোদ বিছিয়ে রাখতো মাংসল সোনালী শরীর।
বসন্ত কই; আমি তারে আজ কোথাও দেখি না!
(এই বসন্তে )
কবি বঙ্গবন্ধু নামের এক কবিতায় লিখলেন,
এ শব্দটি কানে এলে প্রতিবারই-
আন্দিজ পর্বত থেকে কেঁদে নামে আরও একটি নদী,
মাঝরাতে ঘুম ভাঙার মতো, স্বপ্ন-বাটি উল্টে পড়ার মতো,
মর্মর তুলে ঘেমে আমি নেয়ে যাই; এ শব্দ শুনলে
নিমেষে সুখী হই; স্বস্তির জায়নামাজে জীবন নামাই ।
...এ শব্দ কানে এলে মনে হয়
নিজের লাশ বয়ে বেড়াচ্ছি আপনার কাঁধে,
ভীষণ পুড়ে যাচ্ছে পাজরের ঘর-বাড়ি ।
( বঙ্গবন্ধু )
কতো গভীর বোধ জমা হলে বুকে, এমন করে সাজানো যায় শব্দ । কতো যাতনার সমাহারে এমন প্রতিচ্ছবি আঁকা যায়, তা দেখিয়েছেন কবি হাসান হামিদ । এখানেই তিনি সার্থক; সহজ অথচ কতো মোহময়, সরল অথচ কী বিন্ময় লুকানো তাঁর সৃষ্টিতে ।
হাসান হামিদের কবিতার আরেকটি দিক হলো নাটকীয়তা । এখানেও সহজ অথচ সুন্দর এবং গভীর ভাবে তিনি লিখেছেন, পাঠক তা পড়ে অন্য কোথাও চলে যায় যেন, কিছু সময়ের জন্য আর ফিরে না, মন্ত্রমুগ্ধ হয় –
যেমন আছি তেমন রবো; বদলাবো না, দ্যাখো-
তোমার হাত ছাড়বো না যে- খাতায় লিখে রাখো ।
(প্রতিশ্রুতি)
তাঁর কবিতা পাঠে যাতনা সেরে যায়, মনে আরাম অনুভুত হয় । কটমটে কঠিন এখন যারা নিজেকে জাহির করেন, হাসান হামিদ তাদের উল্টো। সহজ পথে যদি পৌঁছুনো যায় পাঠকের ঘরে, তবে ত্যাড়া পথ কেন মাড়ানো? হাসান হামিদের কবিতা তাই একবার পড়লে আবারো পড়তে ইচ্ছে করে। গভীর থেকে একটা টান টের পাওয়া যায়। দেশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কারপ্রাপ্ত অমর একুশে বইমেলা ২০১৯ এ তাঁর প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থটি পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম অন্য দশজন পাঠকের মতো ।