তরুণ কবি ও সম্পাদক আরিফুল ইসলামের কবিতা সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার
অপেক্ষা রাখে না। চিরস্বপ্নচারী কবি আরিফ কখনো কখনো বিপ্লবের সঙ্গে একসুতোয়
বাঁধা পড়েন অবলীলায়। তার তীর্যক প্রতিবাদ, শ্লেষ ও হতাশার বহিঃপ্রকাশ
লক্ষ্য করা যায় ‘গুমের চিতায় স্বাধীনতা’ কাব্যগ্রন্থে।
কবির গোপন
ব্যথা কিংবা মানসকন্যা মৌমিতা সেন থেকে হালের পথকলি, নির্যাতিত বোন,
স্বদেশরক্ষাকারী অবহেলিত যোদ্ধা ও ব্যর্থ প্রেমিক কিংবা কবির প্রতিমূর্তি
প্রতিফলিত হয়েছে বইটিতে।
বইটির কবিতার মধ্যে ‘মৌমিতা সেনরা সেদিন
সংখ্যালঘু ছিল না’, ‘নিষিদ্ধ পল্লীর অনুভূতি’, ‘পৃথিবীর পথে’, ‘মাথা মোটা
বাঙালি’, ‘টোকাইয়ের স্বাধীনতা’, ‘মা আছে বলেই কবি বেঁচে থাকে’, ‘পরাজিত
স্বপ্নগুলো’, ‘শেষ লেখা’, ‘শূন্য’, ‘স্বর্গের আরেক নাম ভালোবাসা’ ও ‘সাতটি
কবিতা’ বেশ ভালো লেগেছে। পাঠককে স্মৃতিতাড়িত করবার মতো কবিতা এগুলো।
যেগুলোর নাম নিতে পারিনি, তার মানে এই নয়যে, তা পাঠযোগ্য নয় কিংবা অবহেলিত।
এ কেবল আমার দৃষ্টিভঙ্গি। অনেকেরই হয়তো অন্যান্য কবিতাও ভালো লাগবে। মূলত
কোনো কবির কোন কবিতা কোন পাঠকের ভালো লাগবে এটা কবিও জানেন না। জানেন না
পাঠক নিজেও। হয়তো পড়তে পড়তে কোনকালে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েন কবিতার কথাগুলোর
ওপর।
শেষ লেখায় কবি বলেছেন,
‘আজ অনেকদিন পর, উলঙ্গ পা-দু’টো মাটিকে স্পর্শ করেছে! একদিন হয়তো,
উলঙ্গ শরীরটাকেই স্পর্শ করবে মাটি।’
কবির
বোধ পাঠককে ভাবনার অতলে নিয়ে যায়। ফিরে এসে রয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস। কেন যে
তিনি শেষ লেখা লিখলেন তা হয়তো কবিই বলতে পারবেন। আমি কবির মধ্যে অপার
সম্ভাবনা দেখি। বেঁচে থাকার অনেক উপলক্ষ্য দেখি, যথেষ্ট কারণও দেখি।
কবি আরিফুল ইসলাম তার ‘শূন্য’ কবিতাটি উৎসর্গ করেছেন ‘বন্ধু নিলয় নীল’কে। কবির ভাষায়-
‘যদি হঠাৎ অপমৃত্যু আমায় বুকে টেনে নেয়!
ভেবে নিও বন্ধু,
কারো চোখের দৃষ্টি আমার গতিপথকে
ভালোবেসেছিলো।’
কবি
তার ছোট ছোট সাতটি কবিতাকে এক ফ্রেমে বেঁধেছেন ‘সাতটি কবিতা’ শিরোনামে।
যথা: কবি`র প্রেমে আগুন জ্বলে, ফেরিওয়ালা, বাতাস বার্তা, চুম্বন, প্রেমময়,
কবিতার সার্জারি ও মন্ত্র। এ গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতার প্রাণশক্তি আমাকে বিমোহিত
করে। আমি বারবার উচ্চারণ করি-
‘এক মানবীর গোপনে দেওয়া-
চুম্বনের কষ্ট আজো ফেরি করি।’ (ফেরিওয়ালা)
কিংবা মনে বাজে সেই কথা-
‘অর্পিতা, বাতাসের কানে ঝুলিয়ে দিলাম, মনের মৃত্যুবার্তা!
জেনে নিও, তুমি জেনে নিও।’ (বাতাস বার্তা)
নষ্টালজিক হয়ে যাই আমিও; যখন কবি বলেন-
‘ঐ ঠোটে এখন মৌমাছির ভীড়,
চুম্বনরস অমৃত হতেই পারে।’ (চুম্বন)
পৃথিবীর সব কবির পক্ষে তিনি বললেন-
‘কবি’র মৃতদেহ বুকে জড়িয়ে কাঁদছে প্রেমিকারা!
অথচ,
অনুপ্রেরণার অভাবে ছিল কবি।’
আবার ক্ষোভের সঙ্গে এও বলতে বাধ্য হন-
‘অল্পবয়সী কবির পেট থেকে পয়দা হচ্ছে সার্জারিকৃত দরকচড়া কবিতা।’
‘গুমের
চিতায় স্বাধীনতা’ গ্রন্থে ঘুরে ফিরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস,
মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রতি ঘৃণা, অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের
কথা এসেছে প্রবলভাবে। কবি বলেছেন-
‘স্বাধীনতা তুই কোথায় থাকিস?
কোন দিকে তোর আনাগোনা?’ (টোকাইয়ের স্বাধীনতা)
অথবা-
‘দিন দিন গুম হয়ে যাচ্ছি...
গুম হয়ে যাচ্ছে রক্তাক্ত স্বাধীনতা।’ (গুমের সাফ কথা)
কবি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছেন-
‘অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার।
মানচিত্রের গায়ে উঁকুনের উৎপাত।
কবিতার লাইনে দেশপ্রেমের আগুন নেই।’ (অল্প দেশপ্রেম)
সব
মিলিয়ে সবগুলো কবিতাই প্রশংসার দাবিদার। তারপরও কিছু ত্রুটি রয়েই গেলো।
হতে পারে মুদ্রণজনিত ত্রুটি। বানানের ক্ষেত্রে কবি বা প্রুফ রিডারকে আরো
সচেতন হতে হবে। ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষার যথাযথ ব্যবহার করা একান্ত
বাঞ্ছনীয়। তবে আমি বাগানের ভুলের দিকে না তাকিয়ে ফুলের সৌরভেই মোহিত হয়েছি।
কবিতার জয় হোক।
কবির চতুর্থ গ্রন্থ ‘গুমের চিতায় স্বাধীনতা’ ২০১৫
সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়েছে। চারুপিন্টুর প্রচ্ছদে চমৎকার এ
কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে আলোকবর্তিকা প্রকাশনী। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা
হয়েছে লন্ডন প্রবাসী বিশিষ্ট কবি ও গীতিকার ওয়াহিদ জালাল ও কবির ছোট ভাই
ফারুক হোসেনকে।