জীবন অন্বেষা নিশ্চিত একটি স্বভাবজাত প্রবৃত্তি- সভ্যতা বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ের বহু পূর্ব থেকেই এই প্রবৃত্তিই জীবন অন্বেষার পথকে সময়ের ক্রমান্বয়িক ধারায় প্রবাহিত করে অব্যাহত পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে অগ্রসরমান থেকে অদ্যাবধি সচলমান এবং ভবিষ্যতেও যতদিন পৃথিবীর থাকবে, পৃথিবীতে মনুষ্যবসতি বিদ্যমান থাকবে ততদিন সুস্থ জীবন অন্বেষার প্রয়োজনীয়তা অন্তঃসলীলা প্রবাহের মত ধাবমান থাকবে নিঃসন্দেহে। মানুষের জীবন নির্মিতির প্রশ্নে যার অন্তর্লিপ্ততা অভ্রান্ত এবং অনস্বীকার্য। এবং এই জীবন অন্বেষার প্রবৃত্তি আছে বলেই মানুষের জীবন সৃষ্টির শুরু থেকে জীবন নির্বাহের পদ্ধতিতে ভাঙ্গা এবং গড়া এ দুটি বিষয়ের প্রশ্নাতীত অবন্থান একে অপরকে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে দিয়েছে যা যে কোনো বিবেচণায় চিরন্তন এবং মৌলিক সত্য। এই মৌলিকত্ব থাকবার কারণেই মানুষের চিন্তা প্রবাহে, চৈতন্যের স্রোতগামীতায়, চৈতন্যের কোষে কোষে ক্রমান্বয়িক মাত্রায় সৃষ্টি হচ্ছে শিক্ষার আগ্রহ জানবার ব্যকুলতা, পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি। জীবনের নিম্নতম অধ্যায় থেকে উচ্চতর অধ্যায়ে উত্তোরনের প্রবল আকাাক্সক্ষা। আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্যে অবিরত ভাঙ্গছে জীবন নির্মাণ পদ্ধতি, ভেঙ্গে যাওয়া ধ্বংসস্তপের ওপরই আবার গড়ে তুলছে মানুষ নবতর আঙ্গিকে এবং পদ্ধতিতে জীবনের নবতর সোপান। এভাবেই সৃষ্টির আদিকাল থেকেই চলে আসছে ভাঙ্গাগড়ার মাঝ দিয়েই মানুষের অপেক্ষাকৃত উন্নতর জীবন পদ্ধতির বিকাশ। দূরদর্শী দার্শনিক সক্রেটিসের মৃত্যু হয়েছে স্বাভাবিকভাবে নয়- তাকে মৃত্যুবরণ করে নিতে বাধ্য করা হয়েছে। একটি মাত্র কারণে যে, তিনি যে মতবাদ প্রচার করেছেন এবং মতবাদকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করেছেন -সে মতবাদ ছিল তদানিন্তন গ্রীক সম্রাটের ব্যক্তিগত স্ব-উদ্ভাবিত মত অনুযায়ী গ্রীক রাষ্ট্রের প্রচলিত বিধি বিধান, নিয়মনীতি এবং আইনের পরিপন্থি। গ্রীসের শাসক শ্রেণী নিশ্চিতভাবোই বিশ্বাস করেছিলেন সক্রেটিসের মতবাদ তাদের রাজ্যের মনুষ্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে দেবতাদের প্রচন্ড রোষানলে পড়তে হবে গ্রীক জাতিকে। আসলে এটিও ছিলো গ্রীক শাসনকর্তার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করবার লক্ষ্যে একটি অতি সু² কুটচাল। দেবতাদেরকে সন্তুষ্ট করবার জন্যেই সক্রেটিসকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করতে হবে। সক্রেটিসকে মৃত্যুদন্ড না দিলে দেবতারা গোটা গ্রীক জাতির ওপর রুষ্ট হবেন এবং গ্রীক শাসনকর্তা যেহেতু দেবতাদের প্রতিনিধিত্ব করেন সেইহেতু দেবতাদের অভিশাপে গ্রীসের শাসক শ্রেণীকে মুহুর্তেই ভয়াবহ রকম ভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে হবে। চরম সঙ্কটে নিপতিত হবে গ্রীক রাষ্ট্রের গোটা অস্তিত্ব। এবং এ কারণেই গ্রীসের জনগণকে তিনি বুঝিয়েছিলেন ‘দেবতাদের রোষানলের আতঙ্কে ভীষনভাবে ভীত হয়ে পড়েছিলেন মহাপরাক্রমশালী গ্রীসের শাসনকর্তা হয়েও তিনি নিজে।’ সেই ভীতিজনিত অস্থিরতা থেকেই গ্রীসের প্রবল পরাক্রমশালী এবং স্বৈর-শাসক বিষপানের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড প্রদান করলেন সে সময়ের একজন শ্রেষ্ঠতম এবং সর্বোচ্চ জ্ঞানী, বিচক্ষণ এবং অমূল্য দার্শনিক সক্রেটিসকে যদিও বিচার নামের একটি প্রহসনের মাধ্যমে তারই নিয়োজিত কিছু অযোগ্য বিচারকের রায়ে। আর্শ্চয্যের বিষয় এখানেই যে, যেহেতু পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকূলের কাছে তার আপন জীবনের চাইতে মূল্যবান আর প্রিয়তম অন্য কিছ্টুা নেই সেখানে সক্রেটিস তার জীবন রক্ষার জন্য এতটুকুও বিচলিত হলেন না, তার প্রাণরক্ষার আবেদন জানালেন না মহান গ্রীক শাসকের কাছে। তার চিন্তা প্রসূত মতবাদ থেকে এতটুকুও সরে দাঁড়ালেন না তিনি কোনোক্রমেই। সন্তান সন্ততিদের সামনে তিনি নিতান্তই অবিচলিতভাবেই তার জন্য নির্ধারিত এবং প্রস্তুতকৃত ‘হেমলক’- নামের বিষের পেয়ালাটিকে নিৎসংকোচে হাতে তুলে নিলেন। শেষবারেরর মতো ক্রিটোকে তিনি কিছু নির্দেশ দিলেন এবং এবং তারপর তিনি অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে তিনি পেয়ালায় রক্ষিত বিষটুকু এক চুমুকেই নিৎশেষ করলেন। অচঞ্চল দৃষ্টিতে তিনি সবার দিকে একবার তাকালেন। তারপরে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলেন । এক সময় তার পা দুটো ভারী হয়ে এলো। তিনি শুয়ে পড়লেন। স্বল্পক্ষণের মধ্যেই তার সম্পূর্ন শরীর একটু কেপে উঠে চিরদিনের মতো স্থির হয়ে এলো। তিনি কোনো প্রতিবাদ না করেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন। তিনি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হযে গেল্নে। কিন্তু তার মতবাদ থেকে গেল। পরবর্তীতে প্রমাণিত হলো তার উাচ্চারিত উদ্ভাবিত মতবাদই সত্য। তাকে স্বার্থবাদী মিথ্যার ভিতের ওপর দাড়িয়ে অতি অন্যায়ভাবে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়েছে। তিনি নির্দোষ ছিলেন। আজ তার মহান মতবাদ সারা পৃথিবী জুড়ে সৃদৃঢ় ভাবে শুধু প্রতিষ্ঠিতই নয় তার মতবাদকে পুঙ্গানুপুঙ্খ ভাবে বিশ্লেষণ তার মতবাদের ওপর গভীর গবেষণা করে মনুষ্যকূলের জন্য কল্যাণকর অনেক সত্যকেই বের করে আনছেন বর্তমানের গবেষকবৃন্দ।
সক্রেটিসের এই আত্মত্যাগ জীবন অন্বেষারই গতিশীল স্রোতধারায় একটি নবতর মাত্রা সংযোজন করলো। এই সংযোজন পরবর্তী প্রজন্মের উন্নততর জীবন নির্মানের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ উপাদান হয়ে রইলো। যার ফলে তার সমগ্র জীবনের ওপর পর্যায়ক্রমে গবেষণর পথ উন্মুক্ত হয়ে গেল এবং সে সময় থেকে অদ্যাবধি যা নিরন্তর।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল বিপুল ধ্বংস সাধন ক্ষমতা সম্পন্ন মারনাস্ত্র ( ডিনামাইট)- আবিস্কার করেছিলেন এবং পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণেই তিনি তার যে ধ্বংস ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাতে তিনি নিজেই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। তার অভ্যন্তরে তীব্র অনশোচনার সৃষ্টি হয়েছিল। তার সে অনুশোচনা এতটাই তীব্র ছিল যে, ডিনামাইট আবিস্কারের বিষয়টির জন্যে প্রতিমূহুর্তে তিনি নিজেকে মানবতার বিরুদ্ধে একজন চরম অপরাধী হিসেবে চিহ্ণত করেছিলেন। এই অপরাধকে কখনই তিনি ক্ষমা করতে পারেন নি। এবং এই অনুতাপ এবং অনুশোচণার তাড়নার কাছে নিজেকে সমর্পন করে তার জীবদ্দশাতেই তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি সুইডশ একাডেমীকে দান করে দিয়ে যান এই শর্তে যেÑ তার সম্পত্তি থেকে অর্জিত সকল আয়ের অর্থ পৃথিবীর সকল মানুষের শান্তির জন্য , কল্যাণের জন্য ব্যয় করতে হবে। আজও সেই শর্ত পালন করে সুইডিশ একাডেমী প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সমাজের অন্যান্য কল্যানমুখী কর্মকান্ডের জন্যে অগ্রগামী ব্যক্তিত্বকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে তার কর্মের প্রতি স্বীকৃতি ও উৎসাহ প্রদান করে আসছে। এখানে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আলফ্রেড নোবেলের যে আবিস্কার তা-ও জীবন অন্বেষারই একটি ফল- যদিও তা অধিকতর ধ্বংস সাধনের যোগ্য একটি মারনাস্ত্র; তার পরেও নোবেল পুরস্কার প্রবর্তিত হবার পর যেহেতু এটা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রসহ উন্নত জীবন নিমার্ণের ক্ষেত্রেও একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে; সেইহেতেু ডিনামাইট আবিস্কার একদিকে যেমন নেতিবাচক আরেক দিকে ঠিক তেমনি ইতিবাচক। এখন অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উত্থাতপিত হওয়া স্বাভাবিক যে মাত্র একটি ডিনামাইটের ধ্বংস ক্ষমতাই যেখানে বিশ্ব মানবতার জনস্য প্রচন্ড হুমকি স্বরুপ সেখানে তার চাইতেও অনেক বেশি মাত্রায় শক্তিশালী ও উন্নতমানের একং অজস্রগুণ বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন পারমানবিক বোমাসহ বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র সমূহকে কীভাবে বা কী হিসেবে মূল্যায়ুন করা যাবে? প্রশ্নািট মৌলিক এবং স্বাভাবিক- এক্ষেত্রে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু এটিকে একটি বিশেষ চিত্রকল্প হিসেবে ভাবতে হবে। কেননা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা এবং পরিপুষ্টির জরায়ু থেকে প্রসবিত ডিনামাইট থেকে পারমানবিক অস্ত্র নির্মাণের পর্যায় পর্যন্ত যে উত্তরণ তা-তো ক্রমান্বয়িকভাবে উন্নততর সৃজিনীল চিন্তাপ্রবাহরে সূত্র ধরেই উন্নততম জীবন অন্বেষারই একটি স্তর অথবা মাত্রাবিশেষ। যেহেতু বস্তুগত দিক থেকে অতি সূ² এবং অতি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, যেহেতু প্রতিটি বস্তুরই একটি নেতিবাচক এবং একটি ইতিবাচক দিক রয়েছে। সেইহেতু নেতিবাচক দিকটিকে পরিহার করে যদি আমরা ইতিবাচক দিকটিকে ব্যবহার করতে পারতাম; অর্থাৎ ডিনামাইট থেকে শুরু করে পারমানবিক শক্তিসমূহকে যদি আমরা আমাদের কল্যাণমুখী কাজে লাগাতে পারতাম তাহলে হয়ত দেখা যেত সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের ধ্বংস সাধন ক্ষমতা পুরোপুরিভাবে অবশ্যই একসময় কল্যাণকামী, সৃজনশীল কর্মের মৌলিক উপাদানে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে সমাজের সাধারণ মানুষের সৌভাগ্য নির্মণের বিষয়টিও অনেকটাই সহজে আসতো। বস্তুতঃ এখানে আমি উল্লেখিত ধ্বংসকারী শক্তিসমূহকে ব্যবহারের পদ্ধতিগত দিকটিকেই যথেষ্ট গুরুত্বসহ উল্লেখ করতে চাইছি।
প্রসঙ্গক্রমে সন্ত্রাসের বিষয়টিও এখানে আপনাআপনি এসে পড়ে। সন্ত্রাসের বিষয়টিকে যদি অমরা জীবন অন্বেষার আকর একটি স্তর অথবা অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করি তাহলে অনেকেই এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পোষণ করবেন না। বরং প্রবলভাবে বিরোধিতাই করবেন এবং প্রথম দৃষ্টিতে সেটা করাই হয়ত স্বাভাবিক হবে কিন্তু আমরা যদি বিষয়টি বিবেচনার ক্ষেত্রে গভীরতর চৈতন্যের সাহায্য নিই তাহলে কিন্তু বিরোধতার প্রশ্নটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবে। কেননা সময়ের এই পর্যায়ে সন্ত্র্সা উত্থিত হচ্ছে সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণি থেকে। এই শ্রেণিটি আবার চিরকালই বিপুল, মহৎ সৃজন কর্মের মৌলিক উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। অনিবার্যভঅবে অথ্যাৎ যারাই সন্ত্রাস নামীয় একটি বিভীষিকাময় ধ্বংসের উৎপাদন শক্তি পাশাপাশি তারাই কিন্তু সীমাহীন সৃজন ক্ষমতাশীল সৃষ্টির উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবার যোগ্য। যেহেতু তারুণ্যই হলো সকল সৃজনশলি কর্মপ্রবাহ সৃষ্টি এবং বাস্তবায়নের মৌলিক সত্ত¡া। অথচ এ সত্ত¡াই বর্তমানকালে নিয়তই অব্যাহতভাবে সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজের বিপুল আয়তনের ধ্বংস সাধন করে চলেছে। কিন্তু কেন?
এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর চাইলে আমাদেরকে আবার ফিরে যেতে হবে এ রচনাটির প্রাথমিক পর্যায়ের দিকে । ডিনামাইট এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র থেকে শুরু করে পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র পর্যন্ত নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা বিশ্বজনীন সমাজের সম্মুখে দেখা দিল কেন? নিশ্চয়ই অধিকতর ক্ষমতাসম্পন্ন একটি শক্তি দিয়ে অপেক্ষাকৃত ন্যূনতম ক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি শক্তিকে ধ্বংস করে দেবার জন্য। অথ্যার্ৎ একের ওপর অপরের শ্রেষ্ঠত্ব এবং প্রভুত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্ধিতা সৃষ্টির আয়োজনের লক্ষ্যে। এই যে প্রতিদ্ভন্ধিতা সৃষ্টির আয়োজন এটি কিন্তু যুগাদিক্রমিক। মানব ক’ল সৃষ্টির আদিকাল থেকেই এটি হয়ে আসছে। কিনুত প্রশ্ন হলো আদিকাল থেকে হয়ে আসােরও আদিকালের প্রাথামিক পর্যায় এ শিক্ষার বিষয়টি ছিল একেবারেই গৌন, শুধু গৌনই নয় শিক্ষা সংক্রান্ত কোনো বিষয়ের চিন্তা ছিল সে সময় মানুষের উপলব্ধি বহির্ভূত। শিক্ষা কী এবং কেন এবং শিক্ষার প্রয়োজন মনুষ্য জাতির কোন কল্যাণে আসতে পারে কিনা এ প্রশ্নটিই ছিল তখন তাদের কাছে অবাঞ্চিত। সে কারণে আত্মকজ্ঞানের পরিধিও ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং সীমিত। এ সব কারণে তখন সন্ত্রাসের বিষয়টি ছিল এক প্রকারের প্রথাসিদ্ধ এবং এর উল্টোটি হলেই হতো ব্যতিক্রম।
কিন্তু আজ বর্তমান সময়ের এ কাল পর্বে শিক্ষা তো মানুষের জীবন নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক শর্ত। এ শর্ত পালন করে সারা বিশ্বের মানুষ তো ক্রমান্বয়িকভাবে বিপুল জ্ঞান অর্জনের আলোকে আলোকিত করেছে তার অন্তর্লোককে । যে অন্তর্লোক জ্ঞানের আলোকে আলোকিত সেখানে সন্ত্রাস নামীয় বস্তুটির তো সমান্তরালভাবে অবস্থান করবার কথা নয়। অথচ সেই জ্ঞানপূর্ণ অর্ন্তলোক থেকেই যেন সন্ত্রাস সৃষ্টির ইন্ধন যুগিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সন্ত্রাসের মাধ্যমে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং সর্বব্যাপিতা প্রমাণের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে সর্বব্যাপী কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। আর এ জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে তরুন নামের একটি প্রজন্মকে। তাদেরকে প্রলুদ্ধ করা হচ্ছে, লোভাতুর করে তুলে তাদের সার্বিক শিক্ষাকে অবদমিত এবং অপমানিত করা হচ্ছে। শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন এবং স্বার্থসিদ্ধির জন্য। এবং এ তারুন্যও প্রলুদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসকেও মনে করছে জীবন অন্বেষার একটি অসাধারণ উপযোগ হিসেবে। যদিও এর নেপথ্যে আরও একটি অভ্রান্ত কারণ বিদ্যমান। তাহলো হতাশা আর এ হতাশাজনিত তারুণ্যের দুর্বলতাজনিত সুযোগটুকু পুরোপুরি গ্রহণ করছে আর একটি শ্রেণী। যে শ্রেণীটি তারুণ্যকে তাদের নিজ স্বার্থে ব্যবহার করছে। এবং সে হতাশা থেকে উথ্থিত একপ্রকার না পাওয়া জনিত বঞ্চনা থেকে এরকম একটি আত্মবিধ্বংসী প্রবণতার উথ্থান থেকে তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ কোনো ক্রমেই বেরিয়ে আসতে পারছে না। তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের অতল গহবরে। যা প্রচুর সম্ভাবনাময় জীবন সমূহের অকাল মৃত্যুর সাথে তুলিত হবার যোগ্য। আমাদের দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে তারুন্যের এই অকাল এবং অপমৃত্যু বড় মর্মান্তিকভাবে উপলব্ধিকে আক্রান্ত করে। অথচ করবারও কিছু থাকে না। কারণ সীমাহীন সন্ত্রাসের কাছ জিম্মি হয়ে পড়েছে গোটা সুশীল সমাজ। অধিকতর সন্ত্রাসের মাধ্যমে আর একটি সন্ত্রাসকে নির্মুল করার বিষয়টি সুশীল সমাজের চিন্তার বাইরে। সেহেতু একটি সন্ত্রাস আরও দুটি সন্ত্রাসের জন্ম দিতে পারে। আজকে সারা বাংলাদেশের চিত্রপটে সাধারণভাবেই একবার চোখ বুলিয়ে নিলে অব্যাহত সন্ত্রাসের নির্মমতা গোটা দৃষ্টিসীমাকে আচ্ছন্ন করে দেয়। আজকে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে তার নিজ জীবনটি নিয়ে সুস্থভাবে ধরে ফিরে আসবে এটুকু নিশ্চয়তাও তাদের কাছে নেই। একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে গোটা দেশ জুড়ে। আগে সন্ত্রাস ছিল শহর ভিত্তিক আর এখন তা সংক্রামক ব্যাধির মত দ্রæত থেকে দ্রæততম গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলার শান্ত øিগ্ধ নিভূত র্পলীতে পর্যন্ত। তাহলে এই সম্ভাবনাময় তারুণ্যের জীবন অণ্বেষার একমাত্র পথ হলো সন্ত্রাস, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডই তাদের জীবন অন্বেষার নিয়ামক।
এ প্রবন্ধের শুরুতে উল্লেখিত হয়েছে প্রখ্যাত গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস সম্পর্কিত কিছু কথা। পুনরায় ফিরে আসতে হলো আবার সক্রেটিস সম্পর্কিত বিষয়েই।
সক্রেটিসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি প্রহসন জাতীয় বিচারানুষ্ঠানের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়েছিল। হেমলক নামক এক প্রকার বিষ পানের মাধ্যমে। Bertrand RussellGi ‘The western philosophy’- গ্রন্থের সক্রেটিস অধ্যায়ের বিচার এবং মৃত্যুদন্ড প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে-
The main facts of the trial of Socrates are not open to doubt. The procecution was based upon the charge that Socrates is an evil doer and a curious person. Searching into king under the earth and above the heaven and making worse appear the better cause, and teaching all these to others, the real ground of hostility to him was, almost certainly that he was supposed to be connected with the aristocratic party most of his pupils belonged to this faction, and some, in position of power, haged proved themselves very pernicious. But this ground could not be made evident or account of the amnesty. He was found guilty by a meanly and it was then open to him, by Athenian law, to purpose some lesser penalty than death------------- court was annoyed and condemned him to death by a larger majority than that, which had found him guilty”
সক্রেটিসকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হলো। এই হলো বিচার নামক একটি বিষয়কে প্রহসন নামক আর একটি হাস্যকর বিষয়ের মাধ্যমে সক্রেটিসের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা। যদিও বিচারক মন্ডরীর মেজরটি অংশের সিদ্ধান্তই প্রতিফলিত হলো সক্রেটিসের বিচার প্রক্রিয়ায় তবুও প্রশ্ন রয়ে গেল পুরো বিচারক মন্ডলীর ওপর গ্রীস প্রশাসনের প্রভাব কতখানি ছিলো অথবা বিচারক মন্ডলীকে অলিখিতভাবে পর্দার অন্তরালে থেকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কি নির্দেশ দেয়া ছিল? বিষয়টি একটু বিশ্লেষণ করলেই অতি সহজেই বোঝা যায় যে, সক্রেটিসের বিষয়টি ছিল পুরোপুরি সাজানো এবং পূর্ব পরিকল্পিত, যেহেতু সক্রেটিস তার চিন্তা ভাবনা এবং মতবাদের মধ্যে তদানিন্তন গ্রীসের প্রথাবিরুদ্ধ অবস্থানে নিজেকে স্থাপিত করে ছিলেন এবং তার শিষ্য এবং অনুগামীগণের মধ্যে তিনি তার চিন্তা প্রসূত মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাদের মধ্যে প্রচার করেছিলেন। এবং যেহেতু তিনি মর্তলোকের অতলান্তে এবং স্বর্গলোকেরও উর্দ্ধালোকের বস্তুনিচয়ের অভ্যন্তরে প্রচলিত বিশ্বাসের বিপরীত ভিন্ন কোন ইশ্বরের খোঁজ পেয়েছিলেন এবং সে ইশ্বরকেই তিনি বিশ্বাস করতেনÑ যা তিনি তার শিষ্যবৃন্দের মাঝেও প্রচার করে তাদেরকে তাদের স্বমতে আনার চেষ্টা করেছিলেন। এবং এটা করে তিনি বিশেষ করে তরুন সমাজকে বিপথগামী করে ছিলেনÑ যা তদানিন্তন গ্রীস প্রশাসনের নিরঙ্কুশ মতÑ যা পূরোপুরিই অসত্য এবং গ্রীক শাসনকর্তা তথা সরকারের স্বার্থ সিদ্ধির একটি বিকলাঙ্গ অজুহাত। প্রসঙ্গতই এখানে সক্রেটিসের বিচারকার্যে নিয়োজিত বিচারকমন্ডলীর সদস্যবৃন্দের যোগ্যতা এবং চরিত্রগত দিকটি উল্লেখের দাবী রাখে।
The procecutors were anytus, a democratic politician; meletus, - ‘a tragic poet, youthful and unknown, with lanky hair and scanty beared and a hooked nose’; – and lykon,- an obscure rhetorician – They maintained that Socrates was guilty of not worshipping the gods, the state worshipped but introducing other new Divinities and further he was guilty of corrupting the young by teaching them accordingly”. (‘The western philosophy’- by Bertrand Russell)
উদ্ধৃতাংশের সারমর্ম অনুযায়ী এটা তো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সক্রেটিসের বিচারকার্যে সরকারিভাবে নিয়োজিত বিচারকমন্ডলীর কোনো যোগ্যতাই ছিল না- নিরপেক্ষভাবে তার বিচার কার্য পরিচালনা করার। অথচ সেই সব অযোগ্য, অদক্ষ ব্যক্তি বর্গ কতৃক বিচার নামীয় প্রহসনের রায়ে মৃত্যুবরণ করতে হলো বিশ্বের একজন অতি উচ্চমানের সৎ দাশনিক
সক্রেটিসকেÑ খৃষ্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে ৭০ বৎসর বয়সে এসে।
সক্রেটিসকে উদ্ধৃত করে তার সম্পর্কে এত কথা বলা হলো শুধু মাত্র এটি প্রমাণের জন্য যে সক্রেটিসকে মৃত্যুবরণ করতে হলো মূলতঃ পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে এবং এ পরোক্ষ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পেছনে যে মূল উদ্দেশ্যটি ক্রিয়াশীল ছিল তাহলো তদানিন্তন গ্রীক শাসকবর্গের স্বার্থ সিদ্ধি এবং নিজেদের ক্ষমতাকে নিস্কন্টক করণসহ অধিকতর শক্তিশালী করন। রাষ্ট্রীয় সরকার যখন তাদের স্ব-স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সন্ত্রাসকেই যথাযথ এবং অমোঘ অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয়- যে সরকার আবার গোটা জাতির একমাত্র বৈধ ঐশ্বরিক প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে দাবী করে তখন সে সন্ত্রাসকে কি বলা যাবেÑ অবশ্যই সুস্থ জীবন অন্বেষার বিপরীতে অবস্থান গ্রহণকারী আর একটি ভয়াবহ এবং ভয়ঙ্কর হিংসাশ্রয়ী রাষ্ট্রিয় নির্যাতন মূলক উপাদান ছাড়া।
যে উপাদানের ধারাবাহিকতা বর্তমান কাল পর্বে এসে আমাদের জাতীয় জীবনের স্বাভাবিক সামাজিক দেহের প্রতিটি শিরা-উপশিরা, ধমনী আর তন্ত্রীতে, তন্ত্রীতে হেমলকের মতো বিষের তীব্রতা ছড়িয়ে দিয়ে সমগ্র জাতিকে অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে, প্রতি মূহুর্তে। সরকার বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করে নিজেদের মাধ্যমে কৃত অসংখ্য কল্যাণমুখী কর্মকান্ডের সত্যতাবিহীন ফিরিস্তি প্রদান করে যাচ্ছে অব্যাহতভাবে প্রতিনিয়ত- প্রকৃত অর্থে যা মোটেই সত্য নয়। এবং যা কোনোক্রমেই এবং কোনভাবেই সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না এবং সরকারই যে নিজেদেরকে যুগ যুগ ধরে ক্ষমতায় নিরঙ্কুশভাবে টিকিয়ে রাখবার জন্যে এবং অধিকতর শক্তিধর হিসেবে সাধরণ মানুষের কাছে প্রতিপন্ন করবার লক্ষ্যকে সামনে রেখে নিজেরাই সন্ত্রাসকে উৎসাহিত করছে - যে বিষয়টি সম্পর্কে নিতান্ত সাধারণ মানুষ ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন বিশেষ শ্রেণী, গোত্র নির্বিশেষে সকল ধর্ম, বর্নের মানুষের কাছে নির্মোহভাবেই নিশ্চিত হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে আমরা ভারতে দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসনের বিষয়টি উল্লেখ করতে পারি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব সিরাজুদ্দৌলার পতনের পর ভারতে নিছক বানিজ্য করতে আসা ‘ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’র মাধ্যমে ভারতের শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ব্রিটিশ সরকার যখন ভরতের শাসনভার গ্রহন করে তখন থেকেই সে সরকার ভারতীয় জনগণের ওপর চরমতম নিবর্তন মূলক আঁচরণ শুরু করেÑ যার মাধ্যমে তারা জনগণের অন্তরে সরকারের সর্বোচ্চ শক্তিমত্তা সম্পর্কে একটি আতঙ্কের আবহ গড়ে তোলে যাতে সাধারণ মানুষ সরকারের যেকোনো কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে না পারে। কিন্তু এটি করতে গিয়ে মূলতঃ সরকার নিজেই ধীরে ধীরে জণগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং এর ফলে জনগণ ক্রমান্বয়িকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে শুরু করে। সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে সাধারণ মানুষের ওপর নিগ্রহ, নির্যাতনের মাত্রা যতই বৃদ্ধি করতে থাকে জনগণের আন্দোলনের মাত্রাও ততধিক তীব্রতা লাভ করতে থাকে। এক পর্যায়ে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হয় অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। প্রেক্ষিতঃÑ ব্রিটিশ সরকারের নিগ্রহ, নির্যাতন। তাহলে যে অজস্র ধারায় প্রবাহিত রক্তস্রোতের উপর ১৯৭১ সালে সৃজন সম্ভব হয়েছিল ‘বাংলাদেশ’- নামের অপূর্ব সুন্দর আর অসাধারণ উজ্জ্বলতম চন্দ্রালোকের আলোকে আলোকিত হয়ে এক প্রমিত সম্ভাবনাময় চন্দ্রকলার -সে চন্দ্রালোকের অভ্যন্তরেই প্রতি মূহুর্তে তিল তিল করে কি নিহত হচ্ছে না- অমূল্য রতœসাদৃশ্য অপরূপ নিষ্পাপ সেই চন্দ্রকলাটি??