জীবন পরম্পরা । আবু সাঈদ তুলু
জীবন পরম্পরা । আবু সাঈদ তুলু

 

বাবার বলে যাওয়া গোপন কথাটি বারবার কানে বাজে সিদামের। সিদাম কী পারবে কথা রাখতে। সিদামের ইচ্ছা ছিল এমন এক জীবন; যেখানে চারদিক ঘিরে থাকে আনন্দের দোল। অবারিত স্বপ্ন যেখানে হাতের মুঠোয়। অথ আর উচ্ছাস ভেসে বেড়াবে প্রাণের রাতের গভীর থেকে গভীরে। খাবারের অনাবিল হাসি যখন সামনে দন্ডায়মান। কিন্তু বাস্তবে তার শক্তি যেন শূন্য। যুগ যুগ ধরে যে জীবনচক্রে সিদাম আটকে আছে পারবে কী তা থেকে মুক্তি পেতে। সিদাম ফিরে তাকায় চা বাগানের গাঢ় নীল অন্ধকারের সীমানায়। সে অন্ধকার যেন ঘিরে রেখেছে বাস্তবতার পরিবেশ। সিদাম সন্ধ্যায় ঘণায়মান অন্ধকারে চা বাগানের সবুজের গভীরতায় দাঁড়িয়ে থাকে। সূয তখনও অস্ত যায়নি। সিদামের বারবার মনে পড়ে বাবার বলে যাওয়া সেই বীজমন্ত্রটি।   

 

জীবনছড়া চা বাগানে সিদাম কাজ করে। কাজ করে বলতে সিদাম একজন চা শ্রমিক। বয়স অল্প ১৩/১৪ বছর হবে। বংশ পরম্পরায় এই বাগানেই তার বসতি। চা বাগানের উপর দিয়ে সূয অস্ত যাওয়ার দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগে সিদামের। কেন ভালো লাগে তা জানে না। নাকি সিদাম সূযাস্তের প্রতীকে নিজের জীবনকেই খুঁজে পায়। প্রতিদিনের মতো আজও সিদাম দিগন্ত বিস্তৃত চা বাগানে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ তখনো লাল গোধূলি রক্তিম। অন্ধকারে ঘিরে আসা শান্ত প্রকৃতি। সিদাম সন্ধ্যালগ্নের নীরবতাকে উপেক্ষা করে বৃক্ষের মতো শক্ত ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। উদ্ভাসিত সিদামের মুখমণ্ডল। আজ চা বাগানের অপার সবুজ দিগন্ত বিস্তৃত সৌন্দর্যরাশি তাকে মুগ্ধ করে না। সীমাহীন আকাশ তাকে উদ্বেলিত করে না। কিংবা দিগন্তের গভীরতাও তাকে হারিয়ে দেয় না। তাহলে কী সূর্যের মতো ঢলে পড়ার অভিলাষ সিদামের! ধূমকেতু বা আতশবাজির মতো ঔজ্জ্বল্যে জ্বলে অনিমেষ হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর! না, সিদাম চায় জীবনের সন্ধান। চারদিক তখন রক্তিম আভায় উদ্ভাসিত।

 

সিদাম একবার তাকায় নিজের দেহের দিকে। দেহের ভিতরে হাড্ডিগুলো ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে। কাঁদতে থাকে হাড়ের সাথে লেগে থাকা অপুষ্ট অস্থিমাংসগুলো। কঙ্কালসার দেহের ভাঁজে যে অভুক্ততার ছাপ ফুটে উঠেছে তা টের পায়। কিন্তু স্বপ্নের অবারিত দূর হাতছানি কেমন নিজের শরীর-মনকে ব্যাঙ্গ করতে থাকে।

 

অন্ধকার ঘনিয়ে এলে সিদাম ফিরে যায় তার ডেরায়। ঘরে তার মা তখন বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। পরিশ্রম আর বয়সের ভারে ক্ষয় হয়ে যাওয়া শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। প্রতিটি সন্ধ্যার পর ব্যথার যন্ত্রণায় তাকে কাতরাতে হয়। কী যে অসুখ তা বুঝবে কীভাবে, ডাক্তার তো দেখাতে পারে নাই। ম্যানেজার বাবু বলেছিল শহর থেকে ডাক্তার আসবে। কিন্তু কই ডাক্তার আর এলো কোথায়। শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখাবে সে সামথ নাই। সিদামের মা আজ সন্ধ্যার আগেই গাছপাতা ভতা করেছে। ঘরে কোনো বাজার নেই। সিদামের বাবা মারা গেছে অনেক দিন হলো। সারাজীবন চা বাগানে চাকুরি করেছে। শেষে এমন এক মরণক্ষয় হলো। শুকিয়ে শুকিয়ে মারা গেল। সপ্তাহান্তে যে কয়টা টাকা পাওয়া যেতো তা প্রতিদিনের তিনবেলা খাবারই জুটতো না। আবার ডাক্তার দেখাবে কীভাবে। এখনো যে তাদের আথিক উন্নতি হয়েছে তা নয়। ভাগ্য ভালো চা বাগানের মালিক শ্রমিকদের থাকার জায়গা দিয়েছে। নইলে যে কী হতো কে জানে। বাগানের মালিক অনেক ভালো। সিদামের নয়/দশ বছরের ছোট এক ভাই আছে। ছোট ভাইটি খুব বেয়াড়া। সিদামের ইচ্ছা ছিল পড়াশুনা করে শিক্ষিত হয়ে নতুন জীবনে যাবে। তা কী সম্ভব!

 

ঘরে ঢুকেই সিদাম মাকে জিজ্ঞাস করে

অসীম কোথায়।

কিন্তু অসীম কোথায় মা তা জানবে কীভাবে।

অসীম কী আমার কথা শুনে।

এই বাচ্চা বয়সেই অসীম পাকনা হয়ে গেছে। নিয়মিত মদ খায়। আগে খেতো সন্ধ্যার পর। এখন প্রায় সময়ই মদে মাতাল হয়ে থাকে। বাগানের ম্যানেজার-দারোয়ান-পিয়নের সঙ্গে তার অনেক খাতির। ওরাই অসীমকে মদের ব্যবস্থা করে দেয়।

 

অসীমকে ঘরে না পেয়ে সিদাম মোড়ের দোকানের দিকে যেতে থাকে। মাঝপথেই দেখা হয় অসীমের সাথে। অসীম তখন মাতাল। সিদাম অসীমকে নিয়ে ঘরে ফিরে। সিদামদের থাকার ঘরটি বাঁশ-কাঠ-লতা-পাতার এক ডেরা বা ছাউনি। বাগানের মালিকের জমিতে ছাপড়া করে তারা থাকে। সিদামের বাবা মারা যাবার পর পুরো পরিবার খুব অসহায় হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বাগানের মালিকের মহত্বে এখানে একটি ছাউনি করে তাদের থাকার অনুমতি দিয়েছে।

 তোকে কতবার বলেছি মদ খাবি না।

 মদ খেতে তো টাকা লাগে না দাদা

 টাকা লাগুক আর না লাগুক। তুই মদ খাবি না

মদ না খেলে আমাকে যে বেমানান লাগে। ম্যানেজার কাকু তো তাই বলে।

বলতে বলতে ঢুলে পড়ে অসীম। সিদাম তার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয়। মনে মনে বলতে থাকে ম্যানেজার কাকু কেন তোকে মদ খাওয়ায় তা কী তুই বুঝিস। এই বাগানের প্রতিটি শ্রমিককে মদ খাইয়ে কেন মাতাল বানিয়ে রাখে? আমরা কেন বাগান থেকে বেরিয়ে নতুন জায়গায় নতুন ঘর বাঁধতে পারি না? আমরা সবাই কেন ম্যানেজার-মালিকের প্রশংসা করি তা কী বুঝতে পারিস? কোনো উত্তর আসে না সিদামের কাছে। অসীম বুঝবে কীভাবে সে তো এখন মাতাল।

 

ততক্ষণে অসীম ঘুমিয়ে পড়েছে। সিদাম খেয়াল করে পাশের বিছানায় মাও ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতের খাবার হয়ত কারো দরকারই নেই। অথবা রাতের খাবার ঘরেই নেই।

 

সিদাম ভাবে এই চা শ্রমিকেরা বাগানে কতদিন। বাবার কাছে শুনেছে ব্রিটিশরা তাদেরকে মধ্যভারত থেকে এখানে নিয়ে এসেছিল নানা সুবিধা দিবে বলে। তারপর শত শত বছর। ব্রিটিশ গেল; পাকিস্তান গেলো। বাংলাদেশ চললো কিন্তু বাগানের অবয়ব যেমন খুব পরিবতন হয় নাই তেমনি চা শ্রমিকদের জীবনের সংস্থান হয় নাই। যুগের পর যুগ শতাব্দির পর শতাব্দি জীবনের ঘানি টেনে যেতে হচ্ছে। কয়েকশত বছরের ইতিহাসে চা-বাগানের কোনো শ্রমিক এখান থেকে মুক্তি পায় নাই। মুক্ত পৃথিবীর আলো বাতাসে বাস করতে পারে নাই। প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেটে ভাতে বেঁচে থাকছে আর জীবনের ঘানি টানছে।  

     

তখন চারদিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন। সিদামের ভেতরে কেমন যেন একটি আবেগ-উত্তেজনা কাজ করছে। মনে হচ্ছে সবুজ চা গাছের উপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে হালকা বাতাস। বাতাসকে কখনো বেগুনি কখনো বা চা পাতার রঙের ঢেউ মনে হচ্ছে। সিদাম যেন বারবার নিজের দেহকে দেখতে পাচ্ছে। নিজের দেহের অভ্যন্তরে তখন অট্টহাসি। অনুভব করে হাসি তার বাবা বা হাড্ডিসার অভুক্ত মায়ের। চায়ের বাগানে অনাহারে অভুক্ত থেকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। নিজের অস্থিমজ্জায় যেন সেই বাবার অট্টহাসিই শুনতে পায়। তখন আকাশ লাল কী না তা টের পাওয়া যায় না। অন্ধকারের চাদরে ঢাকা পড়েছে সমস্ত প্রকৃতি। সিদাম দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে দাঁড়ায় ঠিক সেই স্থানটায়; যেখান থেকে প্রতি সূযাস্তে জীবনের অন্ধকারকে অবলোকন করে। ধীরে ধীরে আত্মউপলব্ধির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে থাকে। যেদিন ট্রাকের মধ্যে গরুর মতো রশি ধরে দাঁড় করিয়ে তার বাবা-মাকে বাগানের মালিক বাগান থেকে অন্য বাগানে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সিদামের কানে কানে বাবা একটা গোপন কথা বলেছিল। সে কথা জীবনে কখনো ভুলেনি সিদাম। নিয়তির পরিহাস থেকে মুক্তির কোনো উপায় কী নেই। একদিন সিদামও হাড্ডি-কঙ্কালসার হবে; ধীরে ধীরে নুয়ে পড়বে দেহ। হয়ত সেদিনের বাবা-মার মতো সিদামও তার সন্তানদের কানে কানেও বলবে সেই একই বীজমন্ত্র। হঠাৎ সিদামের চৈতন্য ফিরে আসে। সিদাম সামনে একটি চা গাছের পাতা নড়তে চড়তে দেখে তাকায়। চারদিকে সব চা গাছ তখন অনেকটা স্থির। একটি পাতার নড়াচড়া সিদামকে মনোযোগী করে তুলে। অন্য ভাবনাগুলো থেকে মন বাস্তবতায় ফিরে আসে। সিদাম এগিয়ে যায় সামনের দিকে। আলো-আঁধারী পরিবেশে সিদাম টের পায় চা গাছের পাতায় একটি সাপ খেলা করছে। একটু এগিয়ে স্থির দাঁড়ায় সিদাম। মনটা যেন সামনে যেতে নিষেধ করে। মাথাটা নিচু করে একটুখানি কী জানি ভাবে সিদাম। তারপর ঘুরে দাঁড়ায় নিজের ঝুপড়ির ঘরে ফেরার জন্য। মনে বাজে সেই বীজমন্ত্র। কিন্তু পালাবার শক্তি যে নাই। আজ খেয়াল করে পালাবার ইচ্ছাটাও নাই। অন্ধকারের চাদর তখন গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরছে প্রকৃতি। ঘরে ফিরতে ফিরতে সিদাম পুনরায় অনুভব করতে থাকে তার অস্থিমজ্জার গভীরে বাজছে বাবা-মায়ের অনাহারের অট্টহাসি।



সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান