“অসময়ে ধরলাম পারি
আকাশেতে বেলা নাই
অকুল নদীর ঢেউ দেখে ডরাই।”
দূর থেকে গানের সুর ভেসে আসছে।রাত্রি নিশাকাল।ঝড় বৃষ্টির মৌসুম।থেকে থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে।
এমন সময় ঘরে বসে ভাবের গান শোনার চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কিছু নাই।যে শোনছে,সে মহা ভাগ্যবান।
বিলাল অন্ধকারে নিঃশব্দে হাঁটছিলো।গানের সুরে হাঁটা বন্ধ করে আন্দাজ করার চেষ্টা করলো-কোন দিক থেকে গানের সুর ভেসে আসছে।
মেম্বারের বাড়ির দিক থেকেই কি?
সেরকমই মনে হলো বিলালের।সে কান আরো খাড়া করে শোনলো।নিশ্চিত হলো।গ্রামের একেবারে দক্ষিন প্রান্তের মেম্বারের বাড়ি থেকেই গানটা ভেসে আসছে।
বিলাল সে দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
যতোই সে মেম্বারের বাড়ির কাছাকাছি হতে লাগলো-গানের কথা,সুর আরো স্পষ্ট করে শোনতে পারলো।
কী দরাজ গলা ! আহা।কে গাইছে?
খাদিম পুরের সুবল বাউল না তো?এ অঞ্চলে এক মাত্র সেইতো এতো সুন্দর গান গাইতে পারে।দূর দূরান্তের গ্রামে,গন্জে বায়না নিয়ে গান গাইতে যায়।হাজার হাজার মানুষ রাত জেগে তার গান শোনে।
সে হঠাৎ মেম্বারের বাড়িতে গাইতে এলো কেমন করে?
সুবল বাউল কোথাও গাইতে গেলে-চারিদিকে খবর হয়ে যায়।লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়।তাহলে?
দ্বিধান্বিত বিলাল,মেম্বারের বাড়িতে প্রবেশ করলো।
সে তাজ্জব হয়ে দেখলো সত্যি সত্যিই সুবল বাউল গাইছে।
আসর বসেছে মেম্বারের বাংলা ঘরে।তিন চারজন বাদ্য যন্ত্রী নিয়ে সুবল গাইছে।জানালার কাছেই দাঁড়ালো বিলাল।মেম্বারের চোখে সে পড়তে চায়না।মেম্বার তাকে দু চোখে দেখতে পারেনা।অবশ্যি বিলাল দেখার মতো লোকওনা।সেটা তার চেহারা সম্পর্কিত না।পেশা সম্পর্কিত।
বিলাল খুব সাবধানে নিজেকে মেম্বারের চোখের আড়ালে রেখে গান শোনতে লাগলো।আহা,হা,কী গলা।কী সুর।
গানের টানে মনটা উদাস হয়ে,কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো।
যেমন গলা তেমন নূরানী চেহারাও সুবল বাউলের।এক মাথা কুকড়ানো ঝাকড়া চুল ঝাকিয়ে কী সুন্দরইনা গাইছে!
এখন গাইছে-
“ভবের জনম বিফল গেলো
মিটলোনা প্রেম পিপাসা
ভালো মন্দের ধার ধারিনা
লোকে বলে কূলনাশা।”
কী গান!অন্তর ছুঁয়ে যায়।লোকে বলে কূলনাশা!
লোকে বলেইতো।
বিলাল বংশ পরম্পরায় দরিদ্র মানুষ।তার বংশে কেউ কোনদিন তিন বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারেনি।তার কোন পূর্বসূরীদেরই কোন জায়গা জমি ছিলোনা।তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনের কোন চেষ্টাই করেনি।তারা এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষ,একটি মাত্র কাজটাকেই ধরে রেখেছে।সে কাজ ছাড়া আর কিছু ভাবা তাদের জন্য অধর্মের বলে ভেবে এসেছে।
জিবীকা নির্বাহে তাদের পেশাটাকে-লোকজন ঘৃণা করে,তাদের কূলনাশা বলে।
তারপরও বিলালরা তাদের পেশা থেকে সরে আসেনি।শত লাঞ্চনা সহ্য করেও তারা তাদের পরম্পরাটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
একটার পর একটা গান গেয়ে যাচ্ছে সুবল বাউল।ঘর ভর্তি হয়ে গেছে লোকে।সবাই মুগ্ধ হয়ে শোনছে।মগ্ন হয়ে শোনছে।কারো কোন দিকে কোন খেয়াল আছে বলে মনে হচ্ছেনা।বিলালের বহুদিনের ইচ্ছা ছিলো কাছে থেকে সুবল বাউলের গান শোনে।আজ সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে।এরচেয়ে আরো বেশি কাছ থেকে সুবল বাউলের গান শোনা তার জন্য অসম্ভব ব্যাপার।
বিলাল তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
সুবল বাউল এখন ধরেছে-
“সয়ালের দয়াল বন্ধুরে
সয়ালের দয়ালরে বন্ধু
সর্ব ঘটে আছো
জীবের জীবন নাম ধরিয়া
স্বরুপে মিশেছোরে”
কী গান।কী গান।বুকের ভেতরটা মুচড় দিয়ে উঠলো।দু চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো।বিলাল গামছা দিয়ে চোখ মুছে গানের তালে তালে মাথা দোলাতে লাগলো।
রাত গভীর হলো।
তীব্র বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টি নামলো।গান তবু থামলোনা।ভোরের আগে থামবে বলে মনেও হয়না।তা চলুক,গান চলুক।
বিলাল সন্তর্পনে মেম্বারের গরুর ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
কাজটা সহজেই হয়ে গেলো।
মেম্বারের বড়ো ষাঁড়টা দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যেতে বিলালের কোন বেগ পেতে হলোনা।
মেম্বারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে,ষাঁড়ের পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে বিলাল তৃপ্তির হাসি হাসলো।
একটি মাত্র রাতে,আজ তার জীবনের বড়ো দুটি স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেলো।কয়েক ঘন্টা আগ পর্যন্ত সে এসব কল্পনায়ও ভাবেনি।
কাছ থেকে সুবল বাউলের গান শোনার স্বপ্ন তার অনেক দিনের।
আর মেম্বারের বাড়িতে এরকম একটি কাজ করার স্বপ্ন তার সারাজীবনের।
আনন্দে বিলাল নৃত্যের ভঙ্গিমায় হাঁটতে হাঁটতে,গুন গুন করে গান ধরলো-
“রাখো কিবা মারো এই দয়া করো
থাকিনা যেনো তোমারে ভুলিয়া
দয়াল,থাকিনা যেনো”—-
--
স্কীকারোক্তিঃ গল্পে ব্যবহৃত গানের চরণ গুলো বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম সাহেবের গান থেকে নেয়া।