সময় টা এখন করোনার। করোনা যে আমাদের পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্রাচারে অনেক অভ্যাস বদলে দিয়েছে এটা অস্বীকার করার কোন যো নেই। করোনার সংক্রমন রোধে সীমিত আকারে ব্যাংকিং, রোস্টারিং ডিউটি এসব কারনে ব্যাংকার হয়েও দিনের অনেকটা সময় ঘরেই থাকা থাকছি। পরিবারের সাথে আড্ডা আর টিভি দেখেই বেশিরভাগ সময় পার করছি। টেলিভিশন নামক বোকা বাক্সটার সাথে জড়িয়ে আছে আমার অনেক অতীত স্মৃতি।
টিভি দেখার ঝোঁকটা আমার সেই ছোটবেলা থেকেই। আমাদের গ্রামে তখন কোন টিভি ছিলনা। এমনও হত শুধু টিভি দেখার জন্যই নানু বাড়িতে দিনের পর দিন পরে থাকতাম। পরে অবশ্য নানু বাড়িটাই আমার এক রকম স্থায়ী ঠিকানায় পরিনত হয় যখন নানুবাড়ির কাছেই একটা স্কুলে ভর্তি হই।আমার শৈশব-কৈশোরের অধিকাংশ সময় কাটে ওখানেই।নানুদের ঘরেও কোন টিভি ছিলনা তখন।আসলে ঐ সময়ে গ্রামে হাতে গুনা দু একটা টিভি পাওয়া দুষ্কর ছিল। উঁচু বাঁশের মাথায় অ্যান্টেনা দেখেই অনুমান করা যেত কার বাড়িতে টেলিভিশন আছে।সে সময়ে নানুদের মোল্লা বাড়ির দুটা ঘরে টিভি ছিল। একটা সুবর্নাদের ঘরে অন্যটা ছিল কবির মামার। দুটোই সাদাকালো। এনালগ। চ্যানেল পাল্টানোর জন্য কোন রিমোট সিস্টেম ছিলনা। সে সময়ে টিভির একটা কমন রোগ ছিল প্রায়শই ‘ঝিরঝির’করা। বেশ লম্বাসম্বা একটা বাঁশের মাথায় লাগানো অ্যান্টেনা টা নেড়ে-চেড়ে ঠিক করতে করতে হাত আর কাধ ব্যথা হয়ে যেত। অ্যান্টেনা টা সহজে ঘোরানর সুবিধার্থে বাঁশের নিচের মাটির অংশ ফাঁকা রাখা হত। কেনো জানি প্রিয় কোন অনুষ্টানের প্রিয় মুহূর্তে সেই ঝিরঝির টা হঠাৎ করেই বেড়ে যেত। তবে এতটা বিরক্তি লাগত না তখন! দু একজন পাক্কা লোক থাকতই যারা কিনা অ্যান্টেনা নাড়াতে ওস্তাদ। আমার এক মামাত ভাই আলামিন এ ব্যাপারে খুব দক্ষ আর আগ্রহী ছিল। কবির মামার নিক্কন ব্র্যান্ডের টিভিটার চ্যানেল পাল্টানোর টিউনার টা ভাংগা ছিল বিধায় হাত দিয়ে ঘুরিয়ে চ্যানেল পালটানো টা সহজ ছিলনা। আলামিন ভাই বুদ্ধি করে একটা পদ্দতি বের করে ফেলল আর তা হল টিউনার টা হাত প্লাস দিয়ে ধরে সহজেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চ্যানেল পাল্টানো।যাই হোক,সেই সময় টিভির চ্যানেল বলতে বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)আর দুটা ভারতীয় চ্যানেল।
সংশপ্তক,কোথাও কেউ নেই,রূপনগর,বহুব্রীহি,আজ রবিবার,চোরএরকম বহু ধারাবাহিক ও সাপ্তাহিক নাটকের কথা এখনও খুব মনে পড়ে। তৌকির-বিপাশার “শেষ পর্যন্ত তুমাকে চাই” নাটকে তৌকির আহমেদের মৃত্যু খুব কষ্ট দিয়েছিল আমায়।বিশেষভাবে "অস্থির পাখিরা'ধারাবাহিক নাটকে ঘুমের মধ্যে বখাটেরা কি যে লুহমর্ষকভাবে মাহফুজ আহমদের দুচোখে আঘাত করে তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল, সেটা মনে হলে এখনও খুব ভয় লাগে।পাড়ার মাদকাসক্ত একদল বখাটে ছেলেরা পাড়ার পরিবেশটা কে বিষাক্ত করে তুলে। মাহফুজ মৃত্যু ঝুঁকি নিয়েও এদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়। কী অসাধারণ অভিনয়ই না করেছিলেন তখনকার তরুন অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ ।বিটিভির নাটক আমাদের জীবনকে তখন এতটাই দখল করেছিল যে,পরদিন স্কুলে গিয়ে কোন ধারাবাহিক নাটকের আগামী পর্বে কী হবে তা নিয়ে বন্ধুদের মাঝেও খুব আলোচনা হত।
তখন বিনোদনধর্মী ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান বলতে এক ও একচ্ছত্র হানিফ সংকেত ও তাঁর 'ইত্যাদি'। পরবর্তীকালে 'শুভেচ্ছা'র মতো আরও অনেক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান এলেও 'ইত্যাদি'র মতো আমাদের আপ্লুত করতে পারেনি। ইত্যাদি এর বিদেশ ভ্রমণ অংশ টা আমার বেশি ভাল লাগত। দীর্ঘ রমজান শেষে কাজী নজরুলের “রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” গান দিয়েই শুরু হত আমাদের ঈদ আনন্দ। তখনকার ঈদ আরও আনন্দময় হতো,কারণ ঈদ মানেই নতুন নতুন ঈদ নাটক, নতুন 'ইত্যাদি'। আমাদের শিশু-কিশোরদের অনুষ্ঠান মানে ছিল 'নতুন কুঁড়ি'কিংবা জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক অনুষ্ঠান। শিশু-কিশোরদের অনুষ্টান হলেও আসলে তখন কার টিভির অনুষ্টান গুলো এমন ছিল যে পরিবারের সব বয়সের সকলে একসাথে বসে খুব মজা করে দেখত।
একুশে
ফেব্রুয়ারিতে টিভিতে নিয়ম করে প্রচার করা হতো জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’আর ষোল
ডিসেম্বর বা ছাব্বিশে মার্চে হয়তো 'কলমীলতা','অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী','ওরা ১১ জন'। মহররমের সময় টিভিতে চলতো শোকাবহ চলচ্চিত্র 'মেসেঞ্জার'। তবে শৈশব-কৈশোরজুড়ে আমাদের মনের মঞ্চে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সিনেমা ‘বেদের মেয়ে জোসনা’,‘কেয়ামত থেকে
কেয়ামত’। বাংলা ও হিন্দি সিনেমার সূত্রে আমাদের প্রিয় ও পরিচিত মুখ ছিল রাজ্জাক,শাবানা,ববিতা,আলমগীর,প্
সিনেমার নায়করা আমাদের কাছে ছিল প্রায় দোষশূন্য। সিনেমাতে মারপিটের সময় আমরা সকলে মিলে নায়কের পক্ষ নিতাম। তাই ত দোষী সাব্যস্ত হয়েফাসির আসামী সালমান শাহের কারাগারে ‘চিঠি এলো জেলখানাতে...’গান দেখে কারো চোখে পানি যেন থামছেই না। ছোটবেলায় আমাদের জন্য সিনেমা মানে ছিল 'বই'। আর সিনেমায় গান শুরু হলে আমাদের প্রতি নির্দেশ আসতো আবার কাহিনী শুরু হলে দেখতে আসার। হয়তো তখন গানের রোমান্টিক দৃশ্য বাচ্চাদের চরিত্র নষ্টের ব্যাপারে প্রেরণা জোগাতে পারে বলে অভিভাবকদের বিশ্বাস ছিল।
সে সময়ে প্রচারিত বিদেশি সিরিয়াল ‘রোবোকপ’খুবপ্রিয়ছিল আমার। আর একেবারে মনপ্রাণ-কাড়া সিরিয়াল বলতে গেলে 'আলীবাবা চল্লিশ চোর,'আলিফ লায়লা ','সিন্দবাদ'। আলীবাবার-কাশেম, মর্জিনাআরআলিফ লায়লার-মালিকা হামিরা,ডাকু কেহেরমান এইসব চরিত্র আমাদের মনকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে বাস্তব জীবনে ও আমরা তখন অনেক কে এসব নাম ধরে ডেকে ভেংচি কাটতে দেখতাম।‘সিন্দবাদ'এর জাহাজ আমাকে ডাঙার বাস্তবতা থেকো তাড়িয়ে নিয়ে যেত দূরের সমুদ্রে,তখন ভাবতাম বড় হয়ে বাবার মত নাবিক হব।আমার বাবা চাকরির সুবাদে জীবনের বেশিভাগ সময় নদী আর সমুদ্রেই কাটিয়েছেন।
চন্দ্রকান্তা'নামে একটি পৌরাণিক সিরিয়ালেও বুঁদ হয়েছিলাম বহুদিন। 'চন্দ্রকান্তা কি কাহানি...'গানটিও ছিল সম্মোহক। দাস বিদ্রোহ নিয়ে নির্মিত 'দ্য কুইন',শেরউডের জঙ্গলের গরিববন্ধু ডাকুর গল্প 'রবিনহুড'কিংবা সমুদ্র-রোমাঞ্চকর 'মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড'এর কথা ফিরে ফিরে মনে পড়ে। আর বিশেষ করে মনে পড়ে 'আকবর দ্য গ্রেট'এর কথা। এর আবহবাণীটি আমার প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল 'সূর্য ওঠে আবার অস্তমিত হয় ওই দিগন্তের পানে তবু ধরণীর বুকে তার চিহ্ন রেখে চলে’। 'আকবর'দেখা শেষ হলে মন ভার হয়ে থাকতো এই কারণে যে আমাদের বয়সে আকবর শাহী সালাম পাচ্ছে,ফূর্তি করছে আর আমাদের কিনা সারাক্ষণ স্কুলের পড়া নিয়েই থাকতে হচ্ছে।
অন্যের বাড়িতে গিয়ে কখনো দাঁড়িয়ে,কখনো মুড়ায় বসে,কখনো বা মেঝেতে বসে টিভি দেখার অবসান ঘটল যখন আমার বড় মামা বিদেশ থেকে ১৪ ইঞ্চির সনি ব্র্যান্ডের একটা টিভি নিয়ে বাড়ি আসলো। তারপর থেকে নানুর বাসায় খাটে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখতাম।এমনকি স্কুলের টিফিন আওয়ারে এসেও টিভি দেখতে দেখতেই টিফিন টা সাড়তাম। তখনকার খুব কাছের সঙ্গী ছিল আমার এক চাচাত মামা। বয়সে কিছুটা ছোট হলেও বন্ধুর মতই ছিলাম আমরা। নাম তার বাক্কি। সে এতটাই সালমান শাহ ভক্ত আর সালমান শাহের অনুকরন প্রিয় ছিল যে শেষমেশ পাড়ায় তাকে ছোট সালমান শাহ বলেই অনেকে ডাকত। সেদিনের বাক্কি আজ অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। এখন সে সরকারের বড় কর্মকর্তা।টিভিদেখারআরেকসঙ্গীআমারমেজোমামাহাবিজ।কিশোরবয়সেফুটবলখেলতেগিয়েপায়েছুটলেগেদুপাইঅচলতার।অত্যন্তবিনয়ীআরবিচক্ষনএইমানুষটার জীবনে সমাজের আর দশ টা মানুষের মত স্বাভাবিকভাবে চলতে ফিরতে না পারার দরুনহয়তঅনেককষ্ট।এতসবপ্রতিকূলতারমাঝেওসদাহাসোজ্জ্বলতারমুখখানাদেখেকেউবুঝতেইপারবেনাযেসকল বাঁধা কে পেছনে ফেলে জীবনযুদ্ধে সেস্বীয়মর্যাদারসাথেটিকেআছে।তাকে দেখে দেখে শিখেছি জীবনে টিকে থাকার জন্য চেষ্টা আর অফুরন্ত ইচ্ছাশক্তিটা খুব দরকার।
“নানু প্রায় ই বলতেন এভাবে খালি টিভি দেখলেই হবে? টিভিতে শিক্ষার কত কিছু আছে সেগুলো নিজে কিছু শিখ”। সেই থেকে বিতর্ক আর কুইজ কুইজের প্রতি মনোযোগ দেয়া শুরু।কোন একটা বিতর্কে মডারেটর নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে বলেছিলেন কিশোর বয়সে তার লেখালেখির অভ্যাসটা তার বর্তমান জীবনের জন্য খুব কাজে দিয়েছিল।আমার কিশোর মনে উনার কথা টা খুব দাগ কেটে ছিল সেদিন। আর আমার লেখালেখির হাতে খড়ি সেখান থেকেই। সে সময়ে ভৈরব থেকে প্রকাশিত “নিরপেক্ষ অরুনিমা” নামের একটা সাপ্তাহিক পত্রিকার পাক্ষিক আয়োজন “চাঁদের হাসি” তেই আমার প্রথম লেখা ছেপেছিল।তার কিছুদিন পর “নিরপেক্ষ অরুনিমা” পত্রিকাটির পক্ষ থেকে ‘মাদকাসক্তি ও এর প্রতিকার’ শিরোনামে একটা রচনা প্রতিযোগিতার জন্য লেখার আহ্বান করা হলে পারুল নামের আমার এক খালা তাতে লেখা পাঠায়। রচনা টা লেখার ব্যাপারে পারুল খালাকে আমি উদ্বুদ্ধ করেছিলাম। ওই রচনা টা সেবারের প্রতিযোগিতায় প্রথম পুস্কারের জন্য মনোনিত হয়েছিল। পারুল খালামনি আজ উন্নত বিশ্বের বাসিন্দা; স্বামী সন্তানসহ সহ কানাডার মন্ট্রিলে থাকে।
টেলিভিশনে দেখতে পাওয়া রঙিন মানুষদের কাছ থেকে কেবল হাসি আর আনন্দের খোরাকই পেতাম তা কিন্তু না,তাদের ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ কষ্টও গ্রাস করতো আমাকে তাইতো প্রিয় নায়ক সালমান শাহের অকাল মৃত্যতে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম,কিছুদিন টিভির সামনে যাওয়াটা ও বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ক্যাবল টিভি, ইন্টারনেট টিভির এই যুগে বাঁশের মাথায় এমন অ্যান্টেনার যেমন দেখা মেলেনা তেমনি সাদাকালো এনালগ টেলিভিশনও কারো ঘরে আর দেখা যায়না। তবে যাই হোক, সেইদিনের সাদাকালো বোকা বাক্সটাই ঘোটা সাম্রাজ্য বিস্তার করে রেখেছিল আমার মত অনেকের শৈশব-কৈশোরে!
অচিরেই করোনার প্রভাব কাটিয়ে সারা পৃথিবীর সুখ-ছন্দ হারানো মানুষগুলোর জীবনে ভর করুক শৈশব-কৈশোরের সেই নির্মল আনন্দ আর সীমাহীন খুশি।