দাদা-নাতীর একটি সকাল - সৈয়দ মাসুদ রাজা
দাদা-নাতীর একটি সকাল - সৈয়দ মাসুদ রাজা

 

 আরে শালা, বিজয় দিবসের কতা হুনসনাই?
, তা তো হুনছিই, কিন্তু এর মাহাত্ত্ব বুজিন্যা, এটটু বুজায়া কওখালি খ্যাক্-খ্যাক্ কইর‌্যা উঠক্যা?

এ ধরনের কথোপকথনে দুজন মানুষ গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটছেএকজন লাঠিতে ভর করে, নাম- ঈমান আলী, বয়স- নব্বই ছুঁই-ছুঁই, গায়ে গেঞ্জি, পরনের লুঙ্গিটা হাটু অবদি তোলা, চোখে ভারী লেন্সের চশমা, যার ডানপাশের ডাঁট না থাকায় সুতো দিয়ে কানের সাথে লাগানোঅপরজনের নাম- কিশোরবয়স-১৪ বছর, সম্পর্কে দাদা-নাতীদাদা-নাতীর এই মধুর খুনসুটির ছোঁয়া যেন মেঠোপথটার চারপাশের প্রকৃতিতেও লেগেছে

গতকাল রাতে কিশোর আসার পর থেকেই দাদার কাছে বায়না ধরেছে- গঞ্জে যাবেকারণ, সে শুনেছে যে, আজ সেখানে গান-বাজনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হবেকিশোর ছোটবেলা থেকেই মামার বাড়িতে থাকেছোট মামীকেই সে মাবলে ডাকেমা-বাবা দুজনেই মারা গেছেনসাধ থাকলেও সাধ্য না থাকায় নাতীটাকে নিজের কাছে রাখতে পারে না ইমান আলীতাই বাপ-মা মরা ছেলেটার উপর ঈমান আলীর এক ধরনের অন্যরকম ভালবাসা কাজ করে সব সময়ইতাই তার আব্দার রক্ষা করতে ঈমান আলী নাতীকে নিয়ে যাচ্ছে গঞ্জেনাতীর কথা শুনে ঈমান আলী বিড়বিড় করে কি যেন বলছে, কিশোর ঠিক বুঝতে পারে না -

   ও দাদা, বিড়বিড় কইর‌্যা কি কও, কিছুইতো বুঝিন্যা
   তোর বুজার কাম নাই, আমি আমার কফালের সাতে কতা কই

দাদার কথা শুনে কিশোর খিলখিল করে হেসে ওঠে-

            তুমি যে কি কও না! কফালের সাতে কেউ কতা কয়? যেইড্যা কবার চাইল্যা হেইড্যা কও! বিজয় দিবস

মুহুর্তেই ঈমান আলীর কন্ঠ ভিজে আসেভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে-

            ভাইরে, এই দিনড্যা আইলে আমার বুহের মইদ্যে কইলজ্যাডায় কেমুন কামুড় দেয়আমি ঠিক থাকপ্যার পাইন্যারে ভাইকত মানুষ যুদ্দ কইর‌্যা ফির‌্যা আইলো, তোর বাপ আর ফিইর‌্যা আইলো নাআমি এহনো আশায় বুক বাইন্দ্যা আছি ভাই

কিশোর নির্বাককেনই বা দাদার কাছে বিজয় দিবসের কথা জানতে চাইলোনিজের কাছেই যেন নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগলযেতে যেতে ওর কচি হাতটি দিয়ে দাদার পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেঈমান আলী চোখের চশমা খুলে চোখ মুছে

অনতিদূরে একদল ছাত্র-ছাত্রী পুষ্পমাল্য নিয়ে স্থানীয় শহীদ মিনারে যাচ্ছে দেখে কিশোর দাদাকে জিজ্ঞেস করে-

দাদা, ঐযে দেহো স্কুলের ছাত্ররা মালা নিয়্যা যাইতাছে- ওরা কই যায়?

শহীদগো বেদীতে ফুল দিব্যার যায়

দাদা, চল আমরাও ফুল নিয়্যা যাই

ঈমান আলী অনেকটা চাপা কষ্টের দীর্ঘশ্বাস ফেলে-

কি যামুরে ভাই, আইজ-কাইল হ¹লেই শহীদগো বেদীতে ফুল দিব্যার যায়যারা রাজাকার-আলবদর আছিলো তারাও যায়তাই রাগ কইর‌্যা মেল্লাদিন ধইর‌্যা আর যাই নাতয় আইজকে তোরে নিয়্যা যামু, চল

শুনে আনন্দে কিশোরের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠেতার অনেক দিনের সখ- মালা হাতে শহীদ মিনারে যাবে, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনিতাই দাদার সম্মতিতে মনে মনে দাদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়

            , চল দাদা, দাদীর হাতে লাগানো বাগান থেইক্যা ফুল তুইল্যা নিয়া আসি, চল

বলে দাদা-নাতী দুজনে আবারও বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা হয়


 #

 

অনেকটা আয়েশী ভঙ্গিতে রাস্তায় প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছেন সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সংসদ সদস্য কছির উদ্দিন তালুকদারপরনে আলখেল্লাবয়স ষাটোর্ধ, বেশ পরিপাটি চেহারা, মাথায় জিন্নাহ টুপিপেছনে পেছনে তার সহযোগী ও বিশ্বস্ত চাকর ঠান্ডু মিয়াহাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে কছির উদ্দিন চারপাশের ডামাডোলের কারণ জিজ্ঞেস করতেই ঠান্ডু বলে-

            হুজুর আইজ তো বিজয় দিবসসামনে গঞ্জের দিকে যাওয়া ঠিক অইব না

কথা শুনে বেশ জোরেসোরে একটা ধমক দেয় কছির উদ্দিন-

            এই ব্যাটা, আগে মনে করাইবি নাতাহলে তো বাসা থেকেই আজ বের হতাম না, বুদ্ধু কোথাকার, চল

বলে পেছন ফিরে হাঁটতে থাকেসামান্য একটু এগোনোর পর দেখে বিপরীত দিক থেকে ঈমান আলী আসছে নাতীকে নিয়ে, হাতে ফুলঈমান আলী ওদের সামনা-সামনি আসতেই কছির উদ্দিন তাকে থামায়-

            কি ব্যাপার ঈমান আলী, এই নাতীর সাথে সকাল সকাল কই যাও?

ঈমান আলী এমনিতেই চোখে কম দেখেতাই একটু সামনে ঝুকে দেখে কছির উদ্দিন-

            , কছির চোরা, কি কবা কওফুল দিব্যার যাই, শহীদগো বেদীতে ফুল দিমুচল কিশোর, তাড়াতাড়ি চল

বলে আবার যেতে উদ্যত হতেই কছির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়-

            দাঁড়াও দাঁড়াও, এইসব ফুল-ফাল দিয়ে আর কি হবে? কতই তো দিলা৫২ এর পর থেকে তো দিতেই আছোএগুলা নাফরমানি কাজতুমি এই বৃদ্ধ বয়সে বেদীতে ফুল দিয়া কি মালাউন হতে চাও?

মুহুর্তেই ঈমান আরী গর্জে ওঠে-

            চুপ, একদম চুপএই শহীদগো নিয়্যা আর এডা কতাও কইবিন্যাআমি তোরে চিনিন্যারে রাজাকারের বাচ্চা, তোগো দিন আর এহন নাইকেবল তো খেমতা হাতছাড়া হইছে, এহন বুজবি কত ধানে কত চাইল

কছির উদ্দিন একেবার হতভম্ব হয়ে যায়অনাকাঙ্খিত এই পরিস্থিতি খুব কষ্টে সামলে নিয়ে-

            ক্ষমতা হাতছাড়া হইছে তো কি হইছে? আমাদের ক্ষমতা জায়গামত ঠিকই আছে এবং থাকবেআমি তোমাকে দেখে নেব

বলে চলে যায়

কিশোর দাদার এই হঠাৎ রেগে যাওয়া মূর্ত্তি কখনও দেখেনিবিষ্ময়ভরা চোখে যেতে যেতে দাদাকে জিজ্ঞেস করে-

            দাদা, তুমি হঠাৎ কইর‌্যা ঐ ভদ্রনোহের সাথে রাইগ্যা গ্যালা ক্যান? লোকটা মনে হয় মেল্লা বড়লোকতুমি ওর সাথে ঝগড়া কইর‌্যা পার পাবা?

দাদা কোন কথা বলে নাকিছুক্ষণ নিরবে পথ চলে একপর্যায়ে স্বাভাবিক হলে-

            মানুষটা ক্যারা শুনবি?

            , শুনমু

            ঠিক আছে, আইজ তোরে কমু

অদূরে একটা গাছ দেখিয়ে-

            চল ঐখানে যাইয়্যা বসি, চল

#

            গ্রামের নাম কিসমতজাল্লাএখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে একটা হাইস্কুল আর একটা মাদ্রাসা আছেমাদ্রাসা মাঠের পূর্ব-দক্ষিণ কোণায় একটা প্রকান্ড বটগাছপ্রায় দু'শো বছরের পুরোনোঅনেক দূর থেকে দেখা যায়তার পাশেই ছোট একটা খালগাছটাকে ঘিরে অনেক কল্পকাহিনী শোনা যায়এলাকাবাসী গাছটাকে মুক্তিযোদ্ধা গাছনামে ডাকেএ গাছটা হচ্ছে অত্র অঞ্চলে কালের সাক্ষীস্বাধীনতা যুদ্ধে এদেশের অনেক সম্পদই নষ্ট হয়েছিল পশ্চিমাদের হাতেএ এলাকার বটগাছটার শরীরও ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল হায়েনাদের বুলেটের আঘাতেতৎকালীন এই গাছের নীচে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায়ই মিলিত হয়ে শত্রপক্ষকে আক্রমণ করতটের পেয়ে একবার খালের ওপার থেকে পাক সেনারা ওদের আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা সমবেতভাবে এই গাছকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অনেক পাক সেনাকে হতাহত করেছিলসে যুুেদ্ধই এই মুক্তিযোদ্ধা গাছটার র্প্বূ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়

            ঈমান আলী ও কিশোর হাঁটতে হাঁটতে মুক্তিযোদ্ধা গাছের নীচের আসেহাতের লাঠিটা ঈমান আলী নিতম্বের নীচে রেখে হাফ ছেড়ে বসেচারপাশটা ভলোভাবে দেখার চেষ্টা করেছায়ায় বসে গাছের ডালপালাগুলো দেখে যৌবনের অনেক স্মৃতিই মনে হয় তারমনে হয়- স্ত্রী হনুফার সাথে ভালবাসার সময়ে কত স্মৃতিরই না সাক্ষী এই গাছটাবৃক্ষের সাথে মানুষের একটা অদৃশ্য বন্ধন রয়েছে আবহমান কালব্যাপীযে কোন মানুষের মনেই এক ধরনের ভাললাগা কাজ করে এসব বয়সী বৃক্ষের ছায়ায় বসলেআনমনেই নস্টালজিক হয়

            ঈমান আলী ভাবে- এসব গাছপালা, পশুপাখী মানুষের কতই না আপনজনএ বিজ্ঞানের যুগে মানুষ কত কিছুই না আবিষ্কার করেছে, চাঁদে পর্যন্ত গিয়েছেঅথচ জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত গাছপালা, জীবজন্তুদের ভাষা আবিষ্কার করতে পারেনিযদি পারতো, তাহলে মানুষ নিজেরা আরো বেশি সমৃদ্ধ হত্ োইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে মনুষ্য সমাজের অমিমাংসিত অনেক প্রশ্নেরই সমাধান মিলতো

নাতী কিশোরের ডাকে ঈমান আলীর মৌনতা ভাঙ্গে-

            দাদা, ইবার কও ঐ মানুষটার কিচ্ছা

ঈমান আলী গলাটা একটু ঝেড়ে বলতে শুরু করে-

            ঐ কছির আছিলো ছিচ্কে চোরকত মাইনষের বাড়িঘরে যে চুরি করছেওর জ্বালায় কেউ ঠিকমত ঘুমাবের পাইনাইদ্যাশে যহন যুদ্ধ শুরু হইল, ঐ চুরা রাজাকার বাহিনীর মধ্যে ঢুইক্যা পাকবাহিনীগোরে সাতে খাতির ফেল্যাইয়্যা মেলা মাইনষের বাড়িঘর লুটতরাজ করলোকত মাইনষেরে যে অত্যাচার-জুলুম করছে তার শ্যাষ নাইলুট কইর‌্যা মেলা ট্যাহার মালিক হইলযুদ্ধ শ্যাষ হইল, আমরা স্বাধীন হইলামবঙ্গবন্ধু এই পুঙ্গাগুলারে মাফ কইর‌্যা দিলোঐ চুরা ট্যাকা দিয়্যা ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিছিলো

            দ্যাশে নির্বাচন দিলো, এই সুযোগে এই কছির ইলেকশনে খাড়াইলো। মেলা ট্যাহা-পয়সা খরচ কইর‌্যা পরথমে চিয়্যারম্যান, এরপরে এই এলাকার এম.পি হইল। এই এম.পি হওনের পর ওর গিয়ার আও বাইড়্যা গেল। নিজের নামডাও পাল্টায়া রাখলো কছির উদ্দিন তালুকদার। ওর হুকুম ছাড়া গাছের এডা পাতাও নড়ে না, এরহম অবস্থা। গেরামে ঐ চুরা কছির রংমহল বানাইলো। নিত্য-নতুন যুবতী মেয়েলোক আইন্যা আনন্দ ফুর্তি করে। কেউ কতা কবার সাহস পর্যন্ত পায় না

            একদিন আমাগো ময়না বাপের বাড়ি থনে বেড়াইয়্যা আইতাছিলরাস্তার মদ্যে এই শয়তান দেখছেমুক্তিযোদ্ধাগোরে ভাতা দেওয়ার নাম কইর‌্যা ময়নারে ওর বাড়িত ডাইক্যা নিছেসারা রাত ভইর‌্যা ওর উপর অত্যাচার করছেকত হাত-পাও যে ধরছেরে দাদু, কোন কাম অয়নাই

বলে বৃদ্ধ ঈমান আলী হু-হু করে কেঁদে ওঠেকিশোর নির্বাক, খুব মনোযোগের সাথে দাদার কথা শুনছেআহত মুখেই আবার বলে-

            তারপর দাদা, তারপর কি হইল?

ঈমান আলী কান্না লুকিয়ে আবারও বলতে থাকে-

            আমি বুইড়্যা মানুষ, এগুলা কেউই আমারে কয়নাইআমাগোর কলের পাড়ে আমগাছ আছিলআমি ফজরের আযানের পর অযু করবার জইন্যে কলের পাড়ে যাইয়্যা দেখি আমগাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়্যা আমাগো ময়না ঝুলতাছেরে দাদু-

বলে আবার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে

কিশোর কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছেনামুখ থেকে শুধু একটা অস্ফুট স্বর বেরিয়ে আসে- আঃ

বৃদ্ধ ঈমান আলী কান্না থামিয়ে আবারও বলা শুরু করে-

            ঐ ময়নাডা ক্যারা জানস?

            না তো দাদু, কেডা?

            ঐ ময়নাডাই হইল তোর মা বুলবুলি বেগমআমি ওরে আদর কইর‌্যা ময়নাকইয়্যা ডাইকতাম

কিশোর হতবাক, ওর নিষ্পাপ মুখে হঠাৎ যেন বিদ্যুতের ঝলক খেলে যায়রাগে-ক্ষোভে ফেঁটে পড়েনা--- বলে একটা গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে ওঠেকচি কন্ঠের এই আওয়াজে যেন চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে-

            আমি ঐ কুত্তার বাচ্চারে শ্যাষ কইর‌্যা ফালামু দাদা ----

বলে তীব্রবেগে বাড়ির দিকে দৌড় দেয়

#


            তালুকদার ভিলাপ্রাসাদসম অট্টালিকাএকসময় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থাকলেও এখন অনেকটাই সুনশানএই অট্টালিকার বাসিন্দা বর্তমানে দুজন মাত্র প্রাণীএকজন কছির উদ্দিন তালুকদার আর তার সহযোগী ঠান্ডু মিয়াকছিরের পরিবার শহরের বাসায় থাকে

            আজ বিজয় দিবসে কছির উদ্দিন বাড়িতে ঢুকে নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া ঈমান আলীর সাথে কর্তাতর্কির রেশ কাটাতে তার বাগানে নিরবে দুইঘন্টা চুপ করে বসে থাকেএরপর অনেকটা আয়েশী ভঙ্গিতে ঠান্ডু মিয়াকে ডাক দেয়-  ঠান্ডু

            জ্বে হুজুর

            ওরা তো বিজয় দিবস পালন করতাছেআমার এখানে কি করা যায় বলতো?

            আপনার মনডা খারাপএতদিন ধইর‌্যা আপনার সাথে থাকি, কি করতে হবে তা আমার জানা আছে হুজুরআমি ব্যবস্থা করতাছি

বলে চলে যায়কছির চোখ দুটো বন্ধ করে ভাবছে- ফেলে আসা দিনগুলোর কথা

ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয় জেনেও ক্ষমতাশালীরা এই অমোঘ সত্যটি ভুলে থাকেএকদিন যখন ক্ষমতা হাতছাড়া হয়, তখন এই ক্ষমতার ক্ষমতাতারা বুঝতে পারেপরবর্তী সময়ে তাদের অনেকটা আফসোসের সাথেই জীবনটা পার করতে হয়বিশেষ করে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেমানুষ সমাজ যখন কোন কিছুতে অসহায় হয়ে পড়ে, তখন প্রকৃতিই এর সমাধান দেয়, আর এটাই প্রকৃতির নিয়ম

তার পার্টি ক্ষমতায় না থাকায় কছির উদ্দিনের বর্তমানটা অনেকটাই উদ্বেগ, উৎকন্ঠায় পার করতে হয়অত্যাচারীরা সর্বদাই দূর্বল হয়যে দূর্বলতায় আক্রান্ত আজ কছির উদ্দিন

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠান্ডু মিয়া সূরা সমেত এসে হাজিরকছির উদ্দিন ইশারায় ঠান্ডুকে গ্লাসে ঢেলে দিতে বলে আবারও চোখ বন্ধ করলেনমনে মনে বলতে থাকে- ৭১-এ এই শালারা কি অঘটনটাই না ঘটাইছে

ঠান্ডু মদের গ্লাসটা সামনে দিয়ে- হুজুর, সব রেডি, চোখ খুলেন

কছির এক ঢোকে পুরা প্যাকটুকু গলধকরণ করে-  

ঠান্ডু, ঘর থেকে টু-ইন-ওয়ানটা নিয়ে আয়নুরজাহানের গানগুলো বাজা তো

ঠান্ডু টু-ইন-ওয়ান নিয়ে এসে গান বাজাতে থাকেকছির উদ্দিন গভীর আনন্দে গান শুনে শুনে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করতে থাকেআস্তে আস্তে পুরো নেশাগ্রস্ত হয়ঠান্ডু তার মনিবকে প্রত্যাশিত আনন্দ দেয়ার আনন্দে তৃপ্তির ঢেকুর গিলে আর নিজেও হুজুরের সাথে তাল মেলাতে থাকে

এমন সময় হঠাৎই রাম-দা হাতে তীব্রবেগে কিশোর এসে হাজির-

            ঐ শুয়োরের বাচ্চা রাজাকার, বহুত খেলা দেখাইছসআজ তোরে শ্যাষ কইর‌্যা আমার মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিমু, শুয়োরের বাচ্চা রাজাকার

মুহুর্তেই ঠান্ডু উধাওকছিরও হতচকিত হয়ে দৌড় দিতেই পড়ে যায়কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকিয়ে দেখে কিশোর রাম-দা হাতে তার বুকের উপর দন্ডায়মানএক সময় কোপ দিতে উদ্যত হতেই ঈমান আলী এসে হাজির

            না কিশোর, নাওদের এভাবে মারিস নাসরকার আইন করছে, ওগো বিচার এই বাংলার মাটিতেই হইবো

বলে কিশোরের হাত থেকে দা টা কেড়ে নেয়ততক্ষণে এলাকার অনেক লোকজনসহ পুলিশ এসে হাজিরকিশোর প্রকাশ্যে রাস্তায় রাম-দা নিয়ে দৌড়ে আসার খবর কে বা কারা থানা-পুলিশকে জানিয়েছিলপুলিশ এসে কিশোরকে ধরে নিয়ে যায়কিশোরের আশ্রয় হয় কিশোর সংশোধনাগার’-

কিশোরকে হারিয়ে দাদা যখন বাকরুদ্ধ, ঠিক তার দুমাস পর গ্রেফতার গ্রেফতার হয় কছির উদ্দিনপুলিশ কছির উদ্দিনের ক্ষমতা থাকাবস্থায়ই গোয়েন্দা নিয়োগ করেছিলতাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী পুলিশ তার অপরাধের প্রমাণ যোগাড় করে তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়

কছির উদ্দিনের গ্রেফতারের সংবাদে এলাকায় যেন আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করেবৃদ্ধ ঈমান আলীর চোখেও আনন্দের জল চিক্চিক্ করে ওঠেভুলে যায় তার লালিত কষ্টকেহাঁটতে হাঁটতে সে এগিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা গাছটির কাছেঠিক তখনই দূর থেকে ভেসে আসে মাইকের আওয়াজ-

            প্রিয় এলাকাবাসী, আপনাদের সকলের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে, দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছেআর চুপ না থেকে, আমরা যে যা জানি- নির্ভয়ে সব প্রকাশ করে কছির উদ্দিনের মত যুদ্ধাপরাধীদের ধরতে সহযোগীতা করি, গড়ে তুলি আগামী দিনের সোনার বাংলা 

আস্তে আস্তে মাইকের আওয়াজ দূর-দিগন্তে মিলিয়ে যেতে থাকেঈমান আলী মুক্তিযোদ্ধা গাছটার কাছে গিয়ে পরম মমতায় গাছটাকে স্পর্শ করে কি যেন বলতে চায়এমন সময় পেছন থেকে একটা কচি হাতের স্পর্শে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে কিশোর তার পেছনেতার সমস্ত মুখাবয়বে একটা তৃপ্তির হাসিবৃদ্ধ ঈমান আলীর চোখদুটো অশ্রতে ভরে ওঠে



সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান