আরে শালা, বিজয় দিবসের কতা হুনসনাই?
হ, তা তো হুনছিই, কিন্তু এর মাহাত্ত্ব বুজিন্যা, এটটু বুজায়া কও। খালি খ্যাক্-খ্যাক্ কইর্যা উঠক্যা?
এ ধরনের কথোপকথনে দু’জন মানুষ গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটছে। একজন লাঠিতে ভর করে, নাম- ঈমান আলী, বয়স- নব্বই ছুঁই-ছুঁই, গায়ে গেঞ্জি, পরনের লুঙ্গিটা হাটু অবদি তোলা, চোখে ভারী লেন্সের চশমা, যার ডানপাশের ডাঁট না থাকায় সুতো দিয়ে কানের সাথে লাগানো। অপরজনের নাম- কিশোর। বয়স-১৪ বছর, সম্পর্কে দাদা-নাতী। দাদা-নাতীর এই মধুর খুনসুটির ছোঁয়া যেন মেঠোপথটার চারপাশের প্রকৃতিতেও লেগেছে।
গতকাল রাতে কিশোর আসার পর থেকেই দাদার কাছে বায়না ধরেছে- গঞ্জে যাবে। কারণ, সে শুনেছে যে, আজ সেখানে গান-বাজনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হবে। কিশোর ছোটবেলা থেকেই মামার বাড়িতে থাকে। ছোট মামীকেই সে ‘মা’ বলে ডাকে। মা-বাবা দু’জনেই মারা গেছেন। সাধ থাকলেও সাধ্য না থাকায় নাতীটাকে নিজের কাছে রাখতে পারে না ইমান আলী। তাই বাপ-মা মরা ছেলেটার উপর ঈমান আলীর এক ধরনের অন্যরকম ভালবাসা কাজ করে সব সময়ই। তাই তার আব্দার রক্ষা করতে ঈমান আলী নাতীকে নিয়ে যাচ্ছে গঞ্জে। নাতীর কথা শুনে ঈমান আলী বিড়বিড় করে কি যেন বলছে, কিশোর ঠিক বুঝতে পারে না -
ও দাদা, বিড়বিড় কইর্যা কি কও, কিছুইতো বুঝিন্যা।
তোর বুজার কাম নাই, আমি আমার কফালের সাতে কতা কই।
দাদার কথা শুনে কিশোর খিলখিল করে হেসে ওঠে-
তুমি যে কি কও না! কফালের সাতে কেউ কতা কয়? যেইড্যা কবার চাইল্যা হেইড্যা কও! বিজয় দিবস।
মুহুর্তেই ঈমান আলীর কন্ঠ ভিজে আসে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে-
ভাইরে, এই দিনড্যা আইলে আমার বুহের মইদ্যে কইলজ্যাডায় কেমুন কামুড় দেয়। আমি ঠিক থাকপ্যার পাইন্যারে ভাই। কত মানুষ যুদ্দ কইর্যা ফির্যা আইলো, তোর বাপ আর ফিইর্যা আইলো না। আমি এহনো আশায় বুক বাইন্দ্যা আছি ভাই।
কিশোর নির্বাক। কেনই বা দাদার কাছে বিজয় দিবসের কথা জানতে চাইলো। নিজের কাছেই যেন নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল। যেতে যেতে ওর কচি হাতটি দিয়ে দাদার পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। ঈমান আলী চোখের চশমা খুলে চোখ মুছে।
অনতিদূরে একদল ছাত্র-ছাত্রী পুষ্পমাল্য নিয়ে স্থানীয় শহীদ মিনারে যাচ্ছে দেখে কিশোর দাদাকে জিজ্ঞেস করে-
দাদা, ঐযে দেহো স্কুলের ছাত্ররা মালা নিয়্যা যাইতাছে- ওরা কই যায়?
শহীদগো বেদীতে ফুল দিব্যার যায়।
দাদা, চল আমরাও ফুল নিয়্যা যাই।
ঈমান আলী অনেকটা চাপা কষ্টের দীর্ঘশ্বাস ফেলে-
কি যামুরে ভাই, আইজ-কাইল হ¹লেই শহীদগো বেদীতে ফুল দিব্যার যায়। যারা রাজাকার-আলবদর আছিলো তারাও যায়। তাই রাগ কইর্যা মেল্লাদিন ধইর্যা আর যাই না। তয় আইজকে তোরে নিয়্যা যামু, চল।
শুনে আনন্দে কিশোরের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তার অনেক দিনের সখ- মালা হাতে শহীদ মিনারে যাবে, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। তাই দাদার সম্মতিতে মনে মনে দাদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়।
হ, চল দাদা, দাদীর হাতে লাগানো বাগান থেইক্যা ফুল তুইল্যা নিয়া আসি, চল।
বলে দাদা-নাতী দু’জনে আবারও বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা হয়।
#
অনেকটা আয়েশী ভঙ্গিতে রাস্তায় প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছেন সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সংসদ সদস্য কছির উদ্দিন তালুকদার। পরনে আলখেল্লা। বয়স ষাটোর্ধ, বেশ পরিপাটি চেহারা, মাথায় জিন্নাহ টুপি। পেছনে পেছনে তার সহযোগী ও বিশ্বস্ত চাকর ঠান্ডু মিয়া। হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে কছির উদ্দিন চারপাশের ডামাডোলের কারণ জিজ্ঞেস করতেই ঠান্ডু বলে-
হুজুর আইজ তো বিজয় দিবস। সামনে গঞ্জের দিকে যাওয়া ঠিক অইব না।
কথা শুনে বেশ জোরেসোরে একটা ধমক দেয় কছির উদ্দিন-
এই ব্যাটা, আগে মনে করাইবি না। তাহলে তো বাসা থেকেই আজ বের হতাম না, বুদ্ধু কোথাকার, চল।
বলে পেছন ফিরে হাঁটতে থাকে। সামান্য একটু এগোনোর পর দেখে বিপরীত দিক থেকে ঈমান আলী আসছে নাতীকে নিয়ে, হাতে ফুল। ঈমান আলী ওদের সামনা-সামনি আসতেই কছির উদ্দিন তাকে থামায়-
কি ব্যাপার ঈমান আলী, এই নাতীর সাথে সকাল সকাল কই যাও?
ঈমান আলী এমনিতেই চোখে কম দেখে। তাই একটু সামনে ঝুকে দেখে কছির উদ্দিন-
ও, কছির চোরা, কি কবা কও। ফুল দিব্যার যাই, শহীদগো বেদীতে ফুল দিমু। চল কিশোর, তাড়াতাড়ি চল।
বলে আবার যেতে উদ্যত হতেই কছির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়-
দাঁড়াও দাঁড়াও, এইসব ফুল-ফাল দিয়ে আর কি হবে? কতই তো দিলা। ৫২ এর পর থেকে তো দিতেই আছো। এগুলা নাফরমানি কাজ। তুমি এই বৃদ্ধ বয়সে বেদীতে ফুল দিয়া কি মালাউন হতে চাও?
মুহুর্তেই ঈমান আরী গর্জে ওঠে-
চুপ, একদম চুপ। এই শহীদগো নিয়্যা আর এডা কতাও কইবিন্যা। আমি তোরে চিনিন্যারে রাজাকারের বাচ্চা, তোগো দিন আর এহন নাই। কেবল তো খেমতা হাতছাড়া হইছে, এহন বুজবি কত ধানে কত চাইল।
কছির উদ্দিন একেবার হতভম্ব হয়ে যায়। অনাকাঙ্খিত এই পরিস্থিতি খুব কষ্টে সামলে নিয়ে-
ক্ষমতা হাতছাড়া হইছে তো কি হইছে? আমাদের ক্ষমতা জায়গামত ঠিকই আছে এবং থাকবে। আমি তোমাকে দেখে নেব।
বলে চলে যায়।
কিশোর দাদার এই হঠাৎ রেগে যাওয়া মূর্ত্তি কখনও দেখেনি। বিষ্ময়ভরা চোখে যেতে যেতে দাদাকে জিজ্ঞেস করে-
দাদা, তুমি হঠাৎ কইর্যা ঐ ভদ্রনোহের সাথে রাইগ্যা গ্যালা ক্যান? লোকটা মনে হয় মেল্লা বড়লোক। তুমি ওর সাথে ঝগড়া কইর্যা পার পাবা?
দাদা কোন কথা বলে না। কিছুক্ষণ নিরবে পথ চলে একপর্যায়ে স্বাভাবিক হলে-
মানুষটা ক্যারা শুনবি?
হ, শুনমু।
ঠিক আছে, আইজ তোরে কমু।
অদূরে একটা গাছ দেখিয়ে-
চল ঐখানে যাইয়্যা বসি, চল।
#
গ্রামের নাম ‘কিসমতজাল্লা’। এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে একটা হাইস্কুল আর একটা মাদ্রাসা আছে। মাদ্রাসা মাঠের পূর্ব-দক্ষিণ কোণায় একটা প্রকান্ড বটগাছ। প্রায় দু'শো বছরের পুরোনো। অনেক দূর থেকে দেখা যায়। তার পাশেই ছোট একটা খাল। গাছটাকে ঘিরে অনেক কল্পকাহিনী শোনা যায়। এলাকাবাসী গাছটাকে ‘মুক্তিযোদ্ধা গাছ’ নামে ডাকে। এ গাছটা হচ্ছে অত্র অঞ্চলে কালের সাক্ষী। স্বাধীনতা যুদ্ধে এদেশের অনেক সম্পদই নষ্ট হয়েছিল পশ্চিমাদের হাতে। এ এলাকার বটগাছটার শরীরও ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল হায়েনাদের বুলেটের আঘাতে। তৎকালীন এই গাছের নীচে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায়ই মিলিত হয়ে শত্র“ পক্ষকে আক্রমণ করত। টের পেয়ে একবার খালের ওপার থেকে পাক সেনারা ওদের আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা সমবেতভাবে এই গাছকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অনেক পাক সেনাকে হতাহত করেছিল। সে যুুেদ্ধই এই মুক্তিযোদ্ধা গাছটার র্প্বূ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঈমান আলী ও কিশোর হাঁটতে হাঁটতে মুক্তিযোদ্ধা গাছের নীচের আসে। হাতের লাঠিটা ঈমান আলী নিতম্বের নীচে রেখে হাফ ছেড়ে বসে। চারপাশটা ভলোভাবে দেখার চেষ্টা করে। ছায়ায় বসে গাছের ডালপালাগুলো দেখে যৌবনের অনেক স্মৃতিই মনে হয় তার। মনে হয়- স্ত্রী হনুফার সাথে ভালবাসার সময়ে কত স্মৃতিরই না সাক্ষী এই গাছটা। বৃক্ষের সাথে মানুষের একটা অদৃশ্য বন্ধন রয়েছে আবহমান কালব্যাপী। যে কোন মানুষের মনেই এক ধরনের ভাললাগা কাজ করে এসব বয়সী বৃক্ষের ছায়ায় বসলে। আনমনেই নস্টালজিক হয়।
ঈমান আলী ভাবে- এসব গাছপালা, পশুপাখী মানুষের কতই না আপনজন। এ বিজ্ঞানের যুগে মানুষ কত কিছুই না আবিষ্কার করেছে, চাঁদে পর্যন্ত গিয়েছে। অথচ জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত গাছপালা, জীবজন্তুদের ভাষা আবিষ্কার করতে পারেনি। যদি পারতো, তাহলে মানুষ নিজেরা আরো বেশি সমৃদ্ধ হত্ োইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে মনুষ্য সমাজের অমিমাংসিত অনেক প্রশ্নেরই সমাধান মিলতো।
নাতী কিশোরের ডাকে ঈমান আলীর মৌনতা ভাঙ্গে-
দাদা, ইবার কও ঐ মানুষটার কিচ্ছা।
ঈমান আলী গলাটা একটু ঝেড়ে বলতে শুরু করে-
ঐ কছির আছিলো ছিচ্কে চোর। কত মাইনষের বাড়িঘরে যে চুরি করছে। ওর জ্বালায় কেউ ঠিকমত ঘুমাবের পাইনাই। দ্যাশে যহন যুদ্ধ শুরু হইল, ঐ চুরা রাজাকার বাহিনীর মধ্যে ঢুইক্যা পাকবাহিনীগোরে সাতে খাতির ফেল্যাইয়্যা মেলা মাইনষের বাড়িঘর লুটতরাজ করলো। কত মাইনষেরে যে অত্যাচার-জুলুম করছে তার শ্যাষ নাই। লুট কইর্যা মেলা ট্যাহার মালিক হইল। যুদ্ধ শ্যাষ হইল, আমরা স্বাধীন হইলাম। বঙ্গবন্ধু এই পুঙ্গাগুলারে মাফ কইর্যা দিলো। ঐ চুরা ট্যাকা দিয়্যা ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিছিলো।
দ্যাশে নির্বাচন দিলো, এই সুযোগে এই কছির ইলেকশনে খাড়াইলো। মেলা ট্যাহা-পয়সা খরচ কইর্যা পরথমে চিয়্যারম্যান, এরপরে এই এলাকার এম.পি হইল। এই এম.পি হওনের পর ওর গিয়ার আও বাইড়্যা গেল। নিজের নামডাও পাল্টায়া রাখলো কছির উদ্দিন তালুকদার। ওর হুকুম ছাড়া গাছের এডা পাতাও নড়ে না, এরহম অবস্থা। গেরামে ঐ চুরা কছির রংমহল বানাইলো। নিত্য-নতুন যুবতী মেয়েলোক আইন্যা আনন্দ ফুর্তি করে। কেউ কতা কবার সাহস পর্যন্ত পায় না।
একদিন আমাগো ময়না বাপের বাড়ি থনে বেড়াইয়্যা আইতাছিল। রাস্তার মদ্যে এই শয়তান দেখছে। মুক্তিযোদ্ধাগোরে ভাতা দেওয়ার নাম কইর্যা ময়নারে ওর বাড়িত ডাইক্যা নিছে। সারা রাত ভইর্যা ওর উপর অত্যাচার করছে। কত হাত-পাও যে ধরছেরে দাদু, কোন কাম অয়নাই।
বলে বৃদ্ধ ঈমান আলী হু-হু করে কেঁদে ওঠে। কিশোর নির্বাক, খুব মনোযোগের সাথে দাদার কথা শুনছে। আহত মুখেই আবার বলে-
তারপর দাদা, তারপর কি হইল?
ঈমান আলী কান্না লুকিয়ে আবারও বলতে থাকে-
আমি বুইড়্যা মানুষ, এগুলা কেউই আমারে কয়নাই। আমাগোর কলের পাড়ে আমগাছ আছিল। আমি ফজরের আযানের পর অযু করবার জইন্যে কলের পাড়ে যাইয়্যা দেখি আমগাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়্যা আমাগো ময়না ঝুলতাছেরে দাদু-
বলে আবার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
কিশোর কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছেনা। মুখ থেকে শুধু একটা অস্ফুট স্বর বেরিয়ে আসে- আঃ
বৃদ্ধ ঈমান আলী কান্না থামিয়ে আবারও বলা শুরু করে-
ঐ ময়নাডা ক্যারা জানস?
না তো দাদু, কেডা?
ঐ ময়নাডাই হইল তোর মা বুলবুলি বেগম। আমি ওরে আদর কইর্যা ‘ময়না’ কইয়্যা ডাইকতাম।
কিশোর হতবাক, ওর নিষ্পাপ মুখে হঠাৎ যেন বিদ্যুতের ঝলক খেলে যায়। রাগে-ক্ষোভে ফেঁটে পড়ে। না--- বলে একটা গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে ওঠে। কচি কন্ঠের এই আওয়াজে যেন চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে-
আমি ঐ কুত্তার বাচ্চারে শ্যাষ কইর্যা ফালামু দাদা ----
বলে তীব্রবেগে বাড়ির দিকে দৌড় দেয়।
#
তালুকদার ভিলা। প্রাসাদসম অট্টালিকা। একসময় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থাকলেও এখন অনেকটাই সুনশান। এই অট্টালিকার বাসিন্দা বর্তমানে দু’জন মাত্র প্রাণী। একজন কছির উদ্দিন তালুকদার আর তার সহযোগী ঠান্ডু মিয়া। কছিরের পরিবার শহরের বাসায় থাকে।
আজ বিজয় দিবসে কছির উদ্দিন বাড়িতে ঢুকে নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া ঈমান আলীর সাথে কর্তাতর্কির রেশ কাটাতে তার বাগানে নিরবে দুইঘন্টা চুপ করে বসে থাকে। এরপর অনেকটা আয়েশী ভঙ্গিতে ঠান্ডু মিয়াকে ডাক দেয়- ঠান্ডু।
জ্বে হুজুর।
ওরা তো বিজয় দিবস পালন করতাছে। আমার এখানে কি করা যায় বলতো?
আপনার মনডা খারাপ। এতদিন ধইর্যা আপনার সাথে থাকি, কি করতে হবে তা আমার জানা আছে হুজুর। আমি ব্যবস্থা করতাছি।
বলে চলে যায়। কছির চোখ দু’টো বন্ধ করে ভাবছে- ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।
ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয় জেনেও ক্ষমতাশালীরা এই অমোঘ সত্যটি ভুলে থাকে। একদিন যখন ক্ষমতা হাতছাড়া হয়, তখন এই ক্ষমতার ‘ক্ষমতা’ তারা বুঝতে পারে। পরবর্তী সময়ে তাদের অনেকটা আফসোসের সাথেই জীবনটা পার করতে হয়। বিশেষ করে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে। মানুষ সমাজ যখন কোন কিছুতে অসহায় হয়ে পড়ে, তখন প্রকৃতিই এর সমাধান দেয়, আর এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
তার পার্টি ক্ষমতায় না থাকায় কছির উদ্দিনের বর্তমানটা অনেকটাই উদ্বেগ, উৎকন্ঠায় পার করতে হয়। অত্যাচারীরা সর্বদাই দূর্বল হয়। যে দূর্বলতায় আক্রান্ত আজ কছির উদ্দিন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠান্ডু মিয়া সূরা সমেত এসে হাজির। কছির উদ্দিন ইশারায় ঠান্ডুকে গ্লাসে ঢেলে দিতে বলে আবারও চোখ বন্ধ করলেন। মনে মনে বলতে থাকে- ৭১-এ এই শালারা কি অঘটনটাই না ঘটাইছে।
ঠান্ডু মদের গ্লাসটা সামনে দিয়ে- হুজুর, সব রেডি, চোখ খুলেন।
কছির এক ঢোকে পুরা প্যাকটুকু গলধকরণ করে-
ঠান্ডু, ঘর থেকে ‘টু-ইন-ওয়ান’টা নিয়ে আয়। নুরজাহানের গানগুলো বাজা তো।
ঠান্ডু টু-ইন-ওয়ান নিয়ে এসে গান বাজাতে থাকে। কছির উদ্দিন গভীর আনন্দে গান শুনে শুনে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করতে থাকে। আস্তে আস্তে পুরো নেশাগ্রস্ত হয়। ঠান্ডু তার মনিবকে প্রত্যাশিত আনন্দ দেয়ার আনন্দে তৃপ্তির ঢেকুর গিলে আর নিজেও হুজুরের সাথে তাল মেলাতে থাকে।
এমন সময় হঠাৎই রাম-দা হাতে তীব্রবেগে কিশোর এসে হাজির-
ঐ শুয়োরের বাচ্চা রাজাকার, বহুত খেলা দেখাইছস। আজ তোরে শ্যাষ কইর্যা আমার মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিমু, শুয়োরের বাচ্চা রাজাকার।
মুহুর্তেই ঠান্ডু উধাও। কছিরও হতচকিত হয়ে দৌড় দিতেই পড়ে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকিয়ে দেখে কিশোর রাম-দা হাতে তার বুকের উপর দন্ডায়মান। এক সময় কোপ দিতে উদ্যত হতেই ঈমান আলী এসে হাজির।
না কিশোর, না। ওদের এভাবে মারিস না। সরকার আইন করছে, ওগো বিচার এই বাংলার মাটিতেই হইবো।
বলে কিশোরের হাত থেকে দা টা কেড়ে নেয়। ততক্ষণে এলাকার অনেক লোকজনসহ পুলিশ এসে হাজির। কিশোর প্রকাশ্যে রাস্তায় রাম-দা নিয়ে দৌড়ে আসার খবর কে বা কারা থানা-পুলিশকে জানিয়েছিল। পুলিশ এসে কিশোরকে ধরে নিয়ে যায়। কিশোরের আশ্রয় হয় ‘কিশোর সংশোধনাগার’-এ।
কিশোরকে হারিয়ে দাদা যখন বাকরুদ্ধ, ঠিক তার দু’মাস পর গ্রেফতার গ্রেফতার হয় কছির উদ্দিন। পুলিশ কছির উদ্দিনের ক্ষমতা থাকাবস্থায়ই গোয়েন্দা নিয়োগ করেছিল। তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী পুলিশ তার অপরাধের প্রমাণ যোগাড় করে তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
কছির উদ্দিনের গ্রেফতারের সংবাদে এলাকায় যেন আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করে। বৃদ্ধ ঈমান আলীর চোখেও আনন্দের জল চিক্চিক্ করে ওঠে। ভুলে যায় তার লালিত কষ্টকে। হাঁটতে হাঁটতে সে এগিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা গাছটির কাছে। ঠিক তখনই দূর থেকে ভেসে আসে মাইকের আওয়াজ-
প্রিয় এলাকাবাসী, আপনাদের সকলের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে, দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আর চুপ না থেকে, আমরা যে যা জানি- নির্ভয়ে সব প্রকাশ করে কছির উদ্দিনের মত যুদ্ধাপরাধীদের ধরতে সহযোগীতা করি, গড়ে তুলি আগামী দিনের ‘সোনার বাংলা’।
আস্তে আস্তে মাইকের আওয়াজ দূর-দিগন্তে মিলিয়ে যেতে থাকে। ঈমান আলী মুক্তিযোদ্ধা গাছটার কাছে গিয়ে পরম মমতায় গাছটাকে স্পর্শ করে কি যেন বলতে চায়। এমন সময় পেছন থেকে একটা কচি হাতের স্পর্শে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে কিশোর তার পেছনে। তার সমস্ত মুখাবয়বে একটা তৃপ্তির হাসি। বৃদ্ধ ঈমান আলীর চোখদুটো অশ্র“তে ভরে ওঠে।