দীর্ঘ সাক্ষাৎকার - ফারুক সুমন
দীর্ঘ সাক্ষাৎকার - ফারুক সুমন

ফারুক সুমন (কবি-প্রাবন্ধিক) 

কবিতার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ থাকলেও প্রবন্ধ-গবেষণাধর্মী মননশীল রচনার প্রতি সমান আগ্রহী। 

 

জন্ম ও শিক্ষাজীবন  

জন্ম: ১ মার্চ, ১৯৮৫। চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার অন্তর্গত শিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় দেয়ালিকায় ছড়া ও কবিতা দিয়ে লেখালেখির হাতেখড়ি। তখন শিল্পসাহিত্যে আনাড়ি এই বালকের নতুন বিস্ময় ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ এখানে এসে কিছু সৃষ্টিশীল গুণী মানুষের সংস্পর্শ তার ভাবনাবিশ্বকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন, কবি মোহাম্মদ রফিক, কবি খালেদ হোসাইন, লেখক ও গবেষক আবু দায়েন, কবি ও গল্পকার রায়হান রাইন, কবি হিমেল বরকত, কবি সুমন সাজ্জাদ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য তাঁকে শিল্পের সড়কে হাঁটতে শেখায়। ছাত্রাবস্থায় যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশ করেন সাহিত্যসংশ্লিষ্ট ছোট কাগজ ‘অক্ষৌহিণী'। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক পাঠচক্র ‘কালবোধন’ এর সংগঠক ছিলেন।

 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে যথাক্রমে স্নাতক (২০০৫), স্নাতকোত্তর (২০০৬) প্রথম শ্রেণি এবং উচ্চতর এম. ফিল. (২০১৪) ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর এম. ফিল গবেষণার শিরোনাম- 'শামসুর রাহমানের কবিতায় নগরচেতনা'। বর্তমানে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'বাংলাদেশের কবিতা: উত্তরাধিকার ও পরম্পরা' বিষয়ে পিএইচডি গবেষণায় যুক্ত আছেন। দেশে-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। 

 

কর্মজীবন

প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র’-এ ইউনিট ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও শিক্ষকতাই তার আসল ব্রত। তিনি যথাক্রমে ‘গুলশান কমার্স কলেজ’ এবং ‘কুইন মেরী কলেজ’- এ বাংলা বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন।  বর্তমানে ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ’ (রাইফেলস কলেজ, বিজিবি সদর, পিলখানা, ঢাকা)- এ বাংলা বিষয়ে অধ্যাপনায় নিয়োজিত আছেন।

 

সম্মাননা/পুরস্কার  

একাডেমিক কৃতিত্বের জন্য পেয়েছেন ‘নিপ্পন ফাউন্ডেশন অব জাপান’ (২০০৬)  শিক্ষাবৃত্তি। ২০১৯ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত 'সার্ক সাহিত্য সম্মেলন' এবং ‘নেপাল আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন’-এ যোগদান করেন। 

লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন:

১. রউফিয়ান রিদম সাহিত্য সম্মাননা-২০১৬

২. উচ্ছ্বাস প্রহর সাহিত্য সম্মাননা-২০১৯

৩. সমতটের কাগজ লেখক সম্মাননা-২০২০

৪. দোনাগাজী পদক ২০২১

 

সংগঠন ও সম্পাদনা

প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক: 

'বাংলায়ন সভা' (৪ সেপ্টেম্বর ২০২১) 

ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: 'পোয়েম ভেইন বাংলা'

যৌথ সম্পাদনা: 'অক্ষৌহিণী' ও 'বাংলায়ন বার্ষিকী'। 

 

প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ

 

কাব্যগ্রন্থ:

১. অচঞ্চল জলের ভিতর নিরাকার বসে (২০১৭)

২. আঙুলের ডগায় সূর্যোদয় (২০১৮)

৩. বিচঞ্চল বৃষ্টিবিহার (২০২০)

৪. বিরামচিহ্নের কান্না (২০২২)

৫. চোখের কোণে বালির পাহাড় (২০২৫)

 

প্রবন্ধ/ গবেষণাগ্রন্থ

১. শামসুর রাহমানের কবিতা: নগর-চেতনা ও নাগরিক অনুষঙ্গ (২০১৫)

২. শিল্পের করতালি (২০১৯)

৩. শামসুর রাহমানের কাব্যস্বর (২০২১)

৪. শিল্পের সারগাম (২০২২)

৫. দীপ্তিমান মনীষা (২০২৪)

৬. সৈয়দ আলী আহসানের প্রবন্ধে কাব্যভাবনা (২০২৫)

 

ভ্রমণগ্রন্থ

১. ভ্রমণে অবাক অবগাহন (২০২১)

 

 

 

ফারুক সুমন এর সাক্ষাকার গ্রহণে সাহিত্যবার্তার সম্পাদক আরিফুল ইসলাম ।

 

আরিফুল:আপনি মূলত কবিতার মানুষ। আপনার কাছ থেকে কবিতার কথা জানতে চাই। কবিতা আসলে কী?

 

ফারুক সুমন: কবিতা সম্পর্কে দীর্ঘ সময় নিয়ে কথা বলা যায়। কবিতা কী ও কেন, কবিতার রূপ-রস-গন্ধ, কবিতার সৃজনপ্রক্রিয়া, কবিতার নির্মাণকলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। আমার লেখা 'শিল্পের সারগাম' গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে সবিস্তারে বলবার চেষ্টা করেছি।  তবে সংক্ষেপে, আমার কাছে কবিতা এক অন্তহীন জিজ্ঞাসার নাম। ব্যক্তির রুচিভেদে কবিতার সংজ্ঞায়নও আলাদা হয়। কবিতা যেহেতু আবেগ ও অনুভূতির গভীরতম অঞ্চলস্পর্শী শিল্প, সেহেতু এর সৃষ্টিপ্রক্রিয়া জটিল ও রহস্যময়। কবির মনোভূমিতে কখন কোন পরিপ্রেক্ষিতে কবিতার বীজ উপ্ত হয়, সেটা নিয়েও সন্তোষজনক কোনো উত্তর নেই। এই ব্যাপারে নানা কবি নানাভাবে বলবার চেষ্টা করেছেন। আমার মনে হয়, কবিতা   আবেগের এমন এক অত্যাশ্চর্য ফুল, যার রূপ-রস-গন্ধ অতুলনীয়। কাব্যফুলের সুবাস ব্যক্তিঅনুভূতির নানাস্তরে অনুরণন তৈরি করে। কাব্যপাঠে অনির্বচনীয় আনন্দ-বেদনায় আমাদের মন উদ্বেল হয়ে ওঠে। কখনো কখনো কবিতা হয়ে উঠে দাবি আদায় কিংবা প্রতিবাদের অনিবার্য হাতিয়ার।

 

আরিফুল :আপনার কবি হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছেন?

 

ফারুক সুমন: এমন প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি। তাই তো, কীভাবে কবিতা লেখার প্রতি আগ্রহী হয়েছিলাম? মনে পড়ে, যখন বয়সে কিশোর তখনই কবিতার মতো কিছু লেখবার চেষ্টা করেছি। ছোট্টবেলার ডায়েরিগুলোয় এরকম অনেক লেখা অগ্রন্থিত পড়ে আছে। এখন সেসব কাচা হাতে লেখা পদ্য পড়ে নিজেই অবাক হই। এগুলোর সাহিত্যমূল্য সেভাবে না থাকলেও শৈশবকৈশোরের চেষ্টাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। তখন কোনো ব্যক্তি কিংবা বিষয় নিয়ে ছড়ার ঢঙে অন্ত্যমিল যুক্ত পদ্য লিখতাম। খুব সুনির্দিষ্ট করে যদি বলতে হয় তবে বলব, প্রকৃতির বিচিত্র বিস্ময় ও সৃষ্টিরহস্য আমাকে ভাবুক করে তোলে। সাধারণের চোখে যা কিছু স্বাভাবিক, আমার কাছে সেগুলোই বিস্ময়ের জন্ম দেয়। এই বিস্ময়বোধ থেকেই কবিতা লেখায় অনুপ্রাণিত হয়েছি। পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন শিশুতোষ কবিতা পড়ে প্রথম অনুপ্রাণিত হয়েছি। সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দিন, কুসুম কুমারী দাশ, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, সত্যজি রায়সহ আরও অনেকের লেখা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। অবশ্য দেশি-বিদেশি অনেক রূপকথার গল্প আমাকে স্বাপ্নিক করে তুলেছে। আমার মা বানিয়ে বানিয়ে গল্প শোনাতেন। এগুলো খুব ছোটবেলা থেকেই আমার কল্পনার জগতকে প্রসারিত করেছে। অবশ্য বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবিতায় বাস্তবজীবনের ছায়াপাত ঘটতে থাকে। ব্যক্তিগত সংকট তো ছিলই, একইসঙ্গে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা সংকট কবিতায় স্থান পায়। এভাবেই বোধহয় কবিতার পথে হেঁটে যাচ্ছি। বর্তমানে আমার কবিতা বিষয় ও প্রকরণে ক্রমশ পরিবর্তনশীলতার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করি।

 

আরিফুল:কবিতা কখন অকবিতা হয়?

 

ফারুক সুমন: কবিতার আলোচনায় এটা খুবই বিতর্কিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। কবিতা ও অকবিতা  নির্ণয়ের জন্য অলঙ্কার শাস্ত্রের আশ্রয় নিতে হয়। কবিতা হতে গেলে কিছু মৌলিক শর্ত পূরণ করতে হবে বৈকি। উপমা, রূপক, ছন্দ, চিত্রকল্প, প্রতীক, রহস্যময়তাসহ বিশেষ কিছু আলঙ্কারিক ব্যাপার কবিতা হয়ে ওঠার জন্য অপরিহার্য মনে করি। তবে এই সময়ের কবিতার ভাব ও বিষয় বহুমাত্রিকতাকে ধারণ করেছে। ফলে ট্র‍্যাডিশনাল কবিতার বাইরে কবিতার নতুন সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে। দার্শনিকতাপূর্ণ ভাবনির্ভর কিছু পঙক্তি কবিতার নতুন সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছে। একটি কবিতা সবার কাছে সমানভাবে সমাদৃত না-ও হতে পারে। যে কবিতা আপনার কাছে অসাধারণ, সেটা আবার পাঠরুচির বিবেচনায় আমার কাছে অকবিতা মনে হওয়াটাও দোষের কিছু নয়।

 

 

আরিফুল:প্রথম কোন্ কবিতা লিখে কবি জগতে প্রবেশ করেন?

 

ফারুক সুমন: প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় চাঁদপুরের একটি স্থানীয় দেয়ালপত্রিকায়। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি বোধহয়। শাহরাস্তি উপজেলায় মামার বাড়িতে যাওয়ার পথে চিতোষী রেলস্টেশনে একটা দেয়ালপত্রিকা চোখে পড়ে। সেখানে আমার প্রথম পদ্যকবিতা প্রকাশ পায়। এটাকে ছড়া বলাই ভালো। ছড়াটি ছিল এমন– ‘আমার নাম হাদা/ বাবা বলেন গাধা/ অংক করি ভুল/ মা ধরেন চুল/ শিক্ষক ধরেন কান/ জোরে দেন টান।’ সেই ছড়া প্রকাশের পর কী পরিমাণ আনন্দ পেয়েছি সেটা বর্ণনাতীত। দুয়েকদিন পর পর আমি গিয়ে অন্য সবার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের কবিতা পড়তাম। স্টেশনের যাত্রীরা ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা অবসর সময়টুকু এই দেয়ালপত্রিকা পড়তো। আমি আড়চোখে পাঠকের চোখের দিকে তাকাতাম। দেখতাম, বোঝার চেষ্টা করতাম তিনি আমার ছড়াটি পড়ছেন কিনা। আসলে প্রথম লেখা প্রকাশের আনন্দ কেমন এটা যারা লেখক তারাই কেবল অনুভব করতে পারবেন।

 

আরিফুল:প্রথম কবিতা ও সম্প্রতি লেখা কবিতার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান কী? একটু খুলে বলুন...

 

ফারুক সুমন: অবশ্যই পার্থক্য আছে।  সেইসময়ে লেখা কবিতা কিংবা ছড়াগুলোর গাঁথুনি কিছুটা দুর্বল। বিভিন্ন কবির লেখার অনুসরণ করে মিলিয়ে মিলিয়ে লেখার চেষ্টামাত্র। তবে লেখক হিসেবে সেগুলোকে আমি অস্বীকার করতে পারি না। বর্তমানে আমার লেখার ভাষা ও বিষয়ে পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করি। বিভিন্ন সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যবোধের আলোকে কবিতার নির্মিতিতে নতুনত্ব এসেছে। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করি বলে লেখায় সেটা প্রতিফলিত হয়।

 

আরিফুল:আপনার মতে, আজকের দুনিয়ায় একজন কবির জন্য বিশ্বসাহিত্য জানা কতটা জরুরি?

 

ফারুক সুমন: বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে অবগত থাকা ভালো। তবে জানতেই হবে এমনটি মনে করি না। শিল্প মূলত ব্যক্তিমানুষের অনুভূতির উকৃষ্ট প্রতিফলন। সেটা পৃথিবীর নানাপ্রান্তে বিভিন্ন ভাষার কবিদের কবিতায় প্রতিভাত হয়। সেসব লেখায় প্রতিটি দেশ কিংবা ভূখণ্ডের নিজস্ব লড়াই-সংগ্রামের বৃত্তান্ত উপস্থাপিত হয়। যিনি কালজয়ী লেখক, তিনি দেশকাল ও সীমানার বেড়া অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক লেখক হয়ে ওঠেন। তখন তাঁর লেখা বিশ্বমানবের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। তাঁরা ধ্রুপদী লেখক। তাঁদের লেখা সম্পর্কে আমাদের খোঁজখবর রাখা জরুরি মনে করি।

 

আরিফুল:একজন কবি সব থেকে মহ ! এতে আপনার প্রতিক্তিয়া কি ?

 

ফারুক সুমন: ‘একজন কবি সব থেকে মহ’ এমন সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। কবি নিশ্চয় চিন্তার দিক থেকে অগ্রসর হতে পারেন। সত্য ও সুন্দরের প্রচারক হতে পারেন। যে কোনো অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে পারেন। তাই বলে সব থেকে মহ ও নিষ্কলুষ হওয়ার দৃষ্টান্ত দেওয়া খুব কঠিন।

 

আরিফুল:কবি চরিত্রটি সমাজের চোখে রহস্যময়, এই রহস্যময়তার গোপন রহস্যটা আসলে কি?

 

ফারুক সুমন:পৃথিবীতে হাজারও ভাষা আছে। সকল ভাষাতেই কবিতা রচিত হয়। কিন্তু ভাষা স্বতন্ত্র হলেও কবিদের জীবনযাপন ও জীবনদর্শন প্রায় নিকটবর্তী। পৃথিবীর মানচিত্রে যে অংশেই কবি অবস্থান করুন, অনুভব ও উপলব্ধির অঙ্গীকারে কবিরা যেন একই কান্নাহাসি সাঙ্গ করে বেঁচে আছেন। কবি মানেই ভিন্ন ভাবনার কেউ। কবি মানেই প্রবাহিত স্রোতের বিপরীতে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাতাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কবি জানতে চান বাতাসের গতিপ্রকৃতি। মত ও পথের প্রাগ্রসর ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন বলেই সমকালে কবির ভাগ্যে জোটে উন্মাদের অভিযোগ। মহ কবি এসবের তোয়াক্কা করেন না। কারণ তিনি হয়ত অনুমান করতে পারেন পৃথিবীতে উদয়াস্তের সংজ্ঞা কি। হ্যাঁ, এটা এই অর্থে হয়তো উন্মাদনা। একধরনের রহস্যময়তার চাদর মুড়ি দিয়ে তিনি বেঁচে থাকেন। কবি প্রসঙ্গে আমার লেখা ‘কাটা ডাবের হাহাকার’ কবিতাটি এই মুহূর্তে মনে এলো–

 

কবিজীবন এত মসৃণ হয় না হে

দিশেহারা সময়ের অলাতচক্রে

উত্তপ্ত লৌহখণ্ড, ভেতরে বাউল

কবি এক থেঁতলে যাওয়া আঙুল।

    

কবিমন যেন রক্তাক্ত রণক্ষেত্র

কবি ভোগে অলৌকিক অসুখে

অন্তঃপুরে থাকে সন্তের অধিবাস 

কবি এক অধরা ফুলের নির্যাস।

 

কবি মানে কাটা ডাবের হাহাকার

দুঃসময়ের পরিত্যক্ত কাদাজলে

লুপ্ত হয়েও সুপ্ত কোনো বীজপুরুষ

এইতো কবি, কবিতার মহাকাল।’

 

আরিফুল:আজকের বাংলাদেশে একজন লেখক বা শিল্পী কতটা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারেন বলে আপনি মনে করেন?

 

ফারুক সুমন: স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করা কঠিন। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তখন সে সরকার তার নিজের মতো বলয় তৈরি করে। আমি মনে করি, এদেশে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করার মতো পথ এখনো তৈরি হয়নি। অবশ্য এজন্য সুবিধাভোগী লেখকগোষ্ঠিও কম  দায়ি নয়। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে গিয়ে তাদের লেখককণ্ঠ আর উউচ্চকিত হতে পারে না। তাদের প্রতিবাদী সত্তার মৃত্যু ঘটে। তারা যশখ্যাতি ও অর্থের কাছে নতি স্বীকার করেন।

 

আরিফুল:সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক কার্যক্রম ও উসবগুলো কী সাহিত্যের উন্নয়নে সহায়ক?

 

ফারুক সুমন: এধরনের সরকারি উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। সংস্কৃতিকেন্দ্রিক উসবগুলো একটা জাতির নিজস্ব জীবনধারার পরিচয় বহন করে। আমাদের শিল্পসাহিত্যে এই আয়োজনগুলোর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। তবে এই আয়োজনগুলো আরও ব্যাপকভাবে হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। সরকারি আয়োজন যেন বিশেষ দলের আয়োজন হিসেবে প্রচার না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 

আরিফুল:আপনি কি মনে করেন বর্তমান সরকারের অধীনে সাহিত্যে কোনো নির্দিষ্ট ধারা বা মতাদর্শকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়?

 

ফারুক সুমন: বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তো স্থায়ী কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা রাখে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মূলত বিশেষ কিছু সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য দায়বদ্ধ। ফলে এই সময়ের সাহিত্যচর্চায় নতুন কিছু লেখককে সক্রিয় হতে দেখা গেলেও এরা সাহিত্যের মৌলিক উকর্ষ সাধনে ততটা যোগ্য নয়। মঞ্চ কাঁপিয়ে চাতুর্যময় বক্তব্য দেওয়া আর উকৃষ্ট সাহিত্য রচনা কখনো এক হতে পারে না। তারাও মূলত সময়ের সৃষ্ট সুবিধাপ্রত্যাশী একটা শ্রেণিমাত্র।

 

আরিফুল:আপনি কি মনে করেন বর্তমান সরকার সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে?

 

ফারুক সুমন: এটা আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হয়। ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু স্বাধীনতাপরবর্তীকালে যারাই সরকার গঠন করেছে তারাই নিজদের দলীয় স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। কেউ ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার বানিয়েছে। আবার কেউ সংস্কৃতির ধারকবাহক হয়ে নিজদের ব্যক্তি স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে।

 

আরিফুল:আপনি কি মনে করেন যে সরকারপন্থী ও সরকারবিরোধী লেখকদের আলাদা চোখে দেখা হয়?

 

ফারুক সুমন: অবশ্যই। আমাদের সাহিত্যসমাজ ৩ ভাগে বিভক্ত। সরকারপন্থী, সরকার বিরোধী ও নিরপেক্ষ-নির্লিপ্ত শ্রেণি। সরকারপন্থী বরাবরই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত। তারা সরকারি-বেসরকারি নানাপুরস্কারে ভূষিত হন। অবশ্য তাদের এই পুরস্কার জনমনে গ্রহণযোগ্য করে তোলার লক্ষে দুয়েকজন যোগ্য লেখকও পুরস্কার পেয়ে থাকেন। সরকার বিরোধীরাও বিশেষ কোনো দলের এজেন্ডা নিয়ে মাঠে থাকেন। যারা নিরপেক্ষ ও নির্লিপ্ত শ্রেণি তারা এই দুপক্ষকে এড়িয়ে চলেন। তারা মনে করেন সাহিত্যের জন্য উভয়পক্ষই ক্ষতিকর।

 

আরিফুল:আপনি কোনো রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার কারণে লেখা বাদ দিয়েছেন এমন অভিজ্ঞতা আছে কি?

 

ফারুক সুমন: রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছি কিন্তু লেখা বাদ দিইনি। মনে পড়ে, ‘রামপাল বিদ্যুকেন্দ্র’ স্থাপনের প্রতিবাদে ‘বনে ঢালব ঘি’ শিরোনামে একটা কবিতা লিখে তকালীন সরকারের রোষানলে পড়েছিলাম। বিভিন্ন ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সাময়িকভাবে হতাশ হয়েছি সত্য, তবে লেখা বন্ধ থাকেনি।

 

আরিফুল:একজন কবি হিসেবে আপনি বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা দায়বদ্ধতআ বোধ করেন?

 

ফারুক সুমন: শুধু কবিই নয়, বিবেকবান মানুষ হিসেবে অবশ্যই দায়বদ্ধতা অনুভব করি। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে আমার অবস্থান। আমিও নিশ্চয় মনে মনে বিশেষ কোনো দলের সমর্থন করি। কিন্তু সেই সমর্থন কিছুতেই অন্ধ সমর্থন নয়। একজন কবি সমাজের অগ্রসর ব্যক্তি বিধায় বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকাটা জরুরি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে এদেশের নতুনপ্রজন্মের মনে রাজনৈতিক যে দর্শন প্রোথিত হয়েছে তা আগামী ১০০ বছরের রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে। আমাদের বড় দলগুলো ইতোপূর্বে ঘুরেফিরে পালাক্রমে দেশশাসন করেছে। কিন্তু তারা প্রতিহিংসার রাজনীতি বেছে নিয়েছিল বিধায় পরস্পরকে নিঃশেষ করে দিতে উদ্যোগী হয়েছে। এটা মোটেও ভালো কিছু নয়। এতে প্রিয় স্বদেশ বিবেকবান মানুষদের পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রাজনীতি থেকে সুশিক্ষিত মানুষেরা ক্রমশ দূরে সরে গেছেন।  একজন কবি হিসেবে আমিও এমন হতাশার মধ্যে আছি। অবশ্য জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরেও আমার মনের সেই হতাশা দূর হয়নি। আসলে জাতি হিসেবে আমরা লোভী ও অকৃতজ্ঞ। তা না হলে বার বার শহিদের রক্ত বৃথা যাবে কেন? ১৯৫২ সাল, ১৯৭১ সাল, ২০২৪ সাল থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছি কি? জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরেও  আমার মনে হচ্ছে প্রাণপণে কুয়শার পর্দা ছিঁড়ে এগুতে চাইছি। কিন্তু পারছি না।

 

আরিফুল:আপনি কি মনে করেন বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে যথেষ্ট সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে?

 

ফারুক সুমন: বাংলা ভাষায় বিশ্বমানের সাহিত্য রচনা হলেও বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে আমাদের সংযোগ সেভাবে ঘটেনি। কেবল ইংরেজি, ফরাসি ও আফ্রিকান সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের যসামান্য যোগাযোগ আছে। অথচ পৃথিবীতে আরও বহু ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ লেখক রয়েছেন যাদের কাছে আমাদের সাহিত্য একেবারেই অচেনা রয়ে গেছে। আমাদের ভাষা ও সাহিত্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের দূতাবাস আছে। তারা চাইলে আমাদের শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশে উদ্যোগী হতে পারতেন। কিন্তু হচ্ছে না।

 

আরিফুল:সাহিত্যিকদের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি বা রাজনৈতিক চাপ সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

 

ফারুক সুমন: আমি মনে করি এটা চিরকালীন একটা সমস্যা। সাহিত্যিকদের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও বা রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে  দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু মহ ও মৌলিক কবি যুগে যুগে এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তারা অবশ্যই সত্যের প্রশ্নে আপোষহীন।   ক্ষমতাবানরা বরাবরই মহ কবিদের ভয় করেন। তারা ক্ষমতাকাঠামোকে প্রশ্ন করেন বিধায় তাদের প্রতি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়।

 

আরিফুল:আপনি কি মনে করেন কিছু লেখক শুধু আলোচনায় আসার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বিতর্কিত শব্দ বা বিষয় ব্যবহার করেন?

 

ফারুক সুমন: কারো কারো কবিতা পড়ে আমারও এমনটি মনে হয়। কবিতার পঙক্তি কিংবা স্তবক জুড়ে পড়ে থাকে অন্তসারশূন্য শব্দের কঙ্কাল। শব্দের ভেতর কাব্যিক দ্যোতনা কিংবা অর্থগত ব্যঞ্জনা নেই। মনে হয় তারা অভিধান ঘেঁটে অপরিচিত ও দুর্বোধ্য কিছু শব্দের স্তুপ সাজিয়েছে। অবশ্য সেসব কবিরা আবার নিজদেরকে ‘নিরীক্ষাধর্মী কবি’ হিসেবে দাবি করেন।

 

আরিফুল:রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পরবর্তীতে বাংলা কবিতা কোন দিকে এগিয়েছে বলে মনে করেন?

 

ফারুক সুমন: রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দুজনেই বাংলা ভাষার কিংবদন্তি লেখক ও পথপ্রদর্শক। তারও আগে মধুসূদনের কথাও স্মরণে আনতে চাই। এঁদের সঙ্গে জীবনানন্দের কথা ভুলি কি করে। মূলত এই চারজনই কবিতার ভাবসম্পদের বিবেচনায় বাংলা কবিতাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাঁদের উত্তরকালে আরও অনেক কবি বাংলা কবিতায় নতুন নতুন পালক যুক্ত করেছেন। ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাংলা কবিতা বিষয় ও প্রকরণে আধুনিক কবিতার নানা তত্ত্বকে ধারণ করেছে। বিশ্বময় বিভিন্ন সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে বাংলা কবিতাও যুক্ত হয়েছে। তবে জীবনানন্দপরবর্তী বাংলা কবিতায় চেষ্টা থাকলেও বাঁকবদল বা টেকনিক বদলের মতো বিশেষ কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন এখনো ঘটেনি বলে আমি ধারণা করি।

 

আরিফুল:শিল্পের মধ্যে জীবন থাকে, জীবনের অভিজ্ঞতা থাকে- আপনার কবিতায় অভিজ্ঞতার কথা কতটুকু ?

 

ফারুক সুমন: শিল্পে জীবনাভিজ্ঞতাকে অনিবার্য একটি ব্যাপার বলে মনে করি। যে শিল্পে জীবনের গল্প ও অভিজ্ঞতার রসদ নেই সেই শিল্প আদতে মৃত। মানুষের কাছে শিল্পের যে আবেদন, সেটা জীবনের সঙ্গে মিলিয়েই পঠিত হয়। ভিক্টোরিয়ান যুগের কবি ম্যাথিউ আর্নল্ড সাহিত্যকে ‘criticism of life’ তথা জীবনের সমালোচনা বলে অভিহিত করেছেন।

 

আরিফুল:এপার বাংলার কবিতার ভাষা এবং ওপার বাংলার কবিতার ভাষার মধ্যে পার্থক্য কতটুকু ?   

 

ফারুক সুমন: বলতে দ্বিধা নেই, একসময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রাজধানী ছিল কলকাতা। কিন্তু বর্তমানে সেই গন্তব্যে পরিবর্তন এসেছে। এখন ক্রমশ ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চা প্রধান হয়ে উঠেছে। এখানে বাংলা ভাষার বহুমাত্রিক চর্চা হচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, স্বায়ত্তশাসিত পৃথক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধিতে প্রচুর পরিমাণে  গবেষণা করছে। বাংলাদেশ এখন স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র। ফলে ওপার বাংলার তুলনায় এপার বাংলায় ভাষা ও সাহিত্য চর্চা বেশি হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সক্রিয় প্রচেষ্টার ফলে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পৌঁছে গেছে। এই ব্যাপারে ওপার বাংলার লেখকবন্ধুরা হয়তো আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। তবে এটাই এখন বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া ভালো।

 

কবিতার ভাষায় এপার ও ওপার বাংলার কবিদের মধ্যে যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, সেটা ওপার বাংলার শক্তি ও শঙ্খ আর এপার বাংলার শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের কবিতা পাশাপাশি রেখে পাঠ করলে কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যাবে।

 

আরিফুল ইসলাম :‘কবির স্বাধীনতা’ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

 

ফারুক সুমন: আসলে স্বাধীনতা শব্দটি নানাভাবে ব্যবহার হতে পারে। আপনার প্রশ্নে ‘কবির স্বাধীনতা’ বলতে আমি লেখার স্বাধীনতাকেই ধরে নিচ্ছি। কবি স্বাধীনভাবে ব্যক্তিক কিংবা নৈর্ব্যক্তিক নানা বিষয়ে লিখবেন। তবে স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারী হওয়া যাবে না। লেখার মাধ্যমে কারো অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া থেকে বিরত থাকা ভালো। শত মত ও শত পথের মানুষের বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করতে হবে। রাজনৈতিক অনাচার, ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। কবির স্বাধীনতা মূলত সত্যপ্রকাশের স্বাধীনতা।

 

আরিফুল ইসলাম :অনেক তরুণ কবিই গদ্যকবিতাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। গদ্যকবিতাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? গদ্যকবিতার ভবিষ্য কী?

 

ফারুক সুমন: কবিতাকে কবিতা হিসেবেই বিবেচনা করা শ্রেয় মনে করি। গদ্যকবিতা গদ্যের ছাঁদে বিন্যস্ত হলেও এখানে কবিতার স্বাদ কতটা অটুট আছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। এইসময়ে গদ্যকবিতার ব্যাপক চর্চা দেখা যায়। একসময় প্রচলিত প্রধান ৩টি ছন্দে কবিতার আঙ্গিক বিন্যস্ত ছিল। বর্তমানে কবিরা সেই ছন্দকাঠামো থেকে কবিতাকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। দেখতে গদ্যের মতো হলেও ভাব ও অলঙ্কারে সমৃদ্ধ হয়ে গদ্যকবিতা রচিত হয়। এখানে উপমা, রূপক, চিত্রকল্প, প্রতীকসহ বিভিন্ন অলঙ্কারের নান্দনিক প্রকাশ ঘটে। ফলে গদ্যকবিতা আধুনিক কবিতার সম্ভাবনাকে বহুমুখী করে তুলেছে। অনেকের ধারণা, গদ্যকবিতায় ছন্দ নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু আগেই গদ্যকবিতায় ‘অন্ত্যছন্দস্রোত’-এর কথা বলে গেছেন। এটাকে কেউ কেউ ‘ছন্দপ্রবাহ’’ বলেছেন। এটা নিয়ে আরও দীর্ঘ আলাপে যাওয়া যায়। আমি মনে করি গদ্যকে কবিতাময় করে তোলা সহজ নয়। উকৃষ্ট গদ্যকবিতা আগামীতেও টিকে থাকবে বলে বিশ্বাস করি।

 

আরিফুল :একজন কবি ও দার্শনিকের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায় বলে আপনি মনে করেন?

 

ফারুক সুমন: একজন কবি একইসঙ্গে দার্শনিকও বটে। তবে একজন দার্শনিক কবি নাও হতে পারেন। কবিতার নির্দিষ্ট  কিছু রীতিপদ্ধতি আছে। বিষয় ও প্রকরণ পরিচর্যায় কবিকে সচেতন হতে হয়। পক্ষান্তরে যিনি দার্শনিক, তিনি সুনির্দিষ্ট কোনো মতবাদ সম্পর্কে অভিব্যক্তি দিয়ে থাকেন। দর্শনশাস্ত্রে কাব্যময়তা অপরিহার্য কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু কবিতায় দর্শনসত্যের বাইরে কাব্যময় অভিব্যক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই কবি ও দার্শনিকের মধ্যকার তফা আছে বলে মনে হয়।

 

আরিফুল :বাংলা সাহিত্যের কোন যুগ বা কবি আপনার লেখায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে?

 

ফারুক সুমন: এটা সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। আঙ্গিকের ক্ষেত্রে আমি আধুনিক যুগের সাহিত্যকে প্রাধান্য দিয়েছি। তবে ভাবের দিক থেকে প্রাচীন ও মধ্যযুগের অনেক কবির লেখা আমাকে প্রাণিত করেছে। তন্মধ্যে সহজিয়া, বৈষ্ণবসাহিত্য, গীতিকবিতা ও মর্সিয়া সাহিত্য আমার ভালো লাগে। আধুনিক যুগে এসে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, জসীমউদ্দিন, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের কথা স্মরণ করতে পারি।

 

আরিফুল ইসলাম :ইদানীং শোনা যাচ্ছে প্রবীণ কবিদের চেয়ে নবীন কবিরাই অনেক ভালো লিখছে। ব্যাপারটা আপনার কাছে কী মনে হয়?

 

ফারুক সুমন: আসলে নবীন-প্রবীণের মধ্যে তুলনা করার এই পদ্ধতি সঠিক নয়। সকল প্রবীণ লেখকের মধ্যে যেমন মুষ্টিমেয় কজন ভালো লেখেন, তেমনি নবীনদের মধ্যেও হাতে গোনা দুয়েকজন লেখক পাঠকপ্রিয়তা পেয়ে থাকেন। লেখার ক্ষেত্রে বয়স মুখ্য ব্যাপার নয় বরং লেখাটাই মুখ্য। অনেক প্রবীণ সারাজীবন ধরে লিখেও লেখক হিসেবে নিজেকে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে পারেননি। আবার কোনো কোনো নবীন লেখক সেটা পেরেছেন।

 

আরিফুল :সাহিত্যে শ্লীল- অশ্লীল কীভাবে নির্ধারিত হয়? অশ্লীলতার মাপকাঠি আদৌ কি আছে ?

 

ফারুক সুমন: অশ্লীলতার অভিযোগে এ যাব নামকরা অনেক শিল্পকর্মই বিতর্কিত হয়েছে। মূলত এই বিভেদ ব্যক্তির পাঠপ্রস্তুতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে শিল্প একজনের কাছে অশ্লীল কিংবা প্রাপ্তমনস্কদের সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত, ঠিক অন্য কারো কাছে সেটা অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ হওয়ার দৃষ্টান্তও কম নেই। ডি এইচ লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ উপন্যাসটি ১৯২৯ সালে ব্রিটেনের আদালতের নির্দেশে ত্রিশ বছরের অধিককাল নিষিদ্ধ ছিল। অশ্লীলতার অভিযোগ এনে বইয়ের কপি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ উত্তরকালে এই গ্রন্থ বেশ সমাদৃত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে কালিদাসের ‘মেঘদূত’, রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’, তারাশঙ্করের ‘কবি’, বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভরে বৃষ্টি’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘জলেশ্বরী গল্প’, হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’, সৈয়দ আলী আহসানের ‘জিন্দাবাহারের গলি’-সহ অসংখ্য গ্রন্থের দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে—যেখানে যৌনতার খোলামেলা বর্ণনা পাওয়া যায়।

 

শিল্প তো মানব জীবনের উত্তম রূপায়ণ। যদি তা-ই হয়, তবে মানব-মানবীর যৌনজীবন শিল্প-সাহিত্যে উপেক্ষিত হতে পারে কি? নিঃসন্দেহে পারে না। শুদ্ধতাবাদী শিল্প-তাত্ত্বিকেরা হয়তো বলবেন, যৌনতার প্রকাশ শিল্পে শৈল্পিক হওয়াই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সাহিত্যে যাঁরা বাস্তব জীবনের রূঢ় সত্যকে উপস্থাপনে উসাহী, যাঁরা মানব জীবনের অনালোকিত অধ্যায়কে কোনোরকম ভণিতা ছাড়া শিল্পরূপ দিতে চান, তাঁদের সঙ্গে শুদ্ধতাবাদী শিল্পপ্রেমিদের মতবিরোধ থাকা অস্বাভাবিক নয়।

 

বস্তুত জীবন ও জগক যাঁরা সাহিত্যের ক্যানভাসে আঁকতে চান, জীবনের বহুবর্ণিল রূপকে যাঁরা শিল্প-সাহিত্যের বিস্তৃত অবয়বে চিত্রিত করতে চান, তারা এ যুক্তি মানতে নারাজ যে, আমাদের জীবনের যে দিকগুলো স্পর্শকাতর ও রহস্যময়, সেগুলো সৌজন্য হেতু কিংবা নৈতিকতার প্রশ্নে গোপন থাকুক। তাঁরা ভালো-মন্দ নামক মুদ্রার উভয়পিঠ খতিয়ে দেখতে কৌতূহলী।

 

আরিফুল:কবিতার ক্ষেত্রে দশক ভিত্তিক কোন সংজ্ঞা আছে কি? যদি থাকে, আশি থেকে শূন্য দশকের সংজ্ঞাগুলো কি কি বলে আপনি মনে করেন?

 

ফারুক সুমন: ‘দশকধারণা’ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। আধুনিক বাংলা কাব্যালোচনায় কবি ও কবিতাকে সুচিহ্নিত করার প্রয়াসে ‘দশকধারণা’র উদ্ভব ঘটে। দশকওয়ারী কাব্যালোচনার এই রেওয়াজ সম্ভবত বিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকে চালু হয়। তাই বলে ত্রিশের দশকের পূর্বে কি দশক ছিল না? ছিল। কিন্তু মূলত বাংলা কাব্যালোচনার এধারণাটি কবি ও সমালোচক মহলে বেশি মুখরিত হয় ত্রিশের দশককে কেন্দ্র করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যবলয়কে পাশ কাটিয়ে আধুনিক বাংলা কবিতার নতুন সরণী আবিষ্কারের প্রয়াসে ত্রিশের দশকের পাঁচ প্রধান কবির (জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং বিষ্ণু দে) স্বকীয়তা কিংবা অবদানকে শনাক্ত করতে গিয়ে তাঁদের উত্তরকালের কবি সমালোচকগণ এই ‘দশকধারণা’কে আলোচিত ও আলোকিত করে তোলেন।

 

চল্লি­শের দশকের কবি আবুল হোসেন, পঞ্চাশের দশকের সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ প্রমুখ কবি যখন তাঁদের কবিতা নিয়ে শূন্য দশকে প্রকাশিত ছোট কাগজ বা বড় কাগজের পাতায় উপস্থিত থাকেন, হয়ে ওঠেন একজন তরুণ কবিরও প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন ‘দশক-বিভাজন’ বিতর্কের বিষয়কে আরও বেশি প্রকট করে তোলে। তবে হ্যাঁ, (দশক-বিভাজনের ক্ষেত্রে) আমার মনে হয়, দশকওয়ারী কাব্যালোচনার গুরুত্ব এইখানে যে, কেবল ঐ দশকের সময়সীমায় যে একঝাঁক তরুণ কবির আবির্ভাব ঘটে, তাদের কবিতার বিষয় ও প্রকরণে বিশেষ কোনো প্রবণতার উন্মেষ ঘটেছে কি-না কিংবা তাঁদের ভাবনায় বিশেষ কোনো দর্শন প্রযুক্ত হয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখার প্রয়াসে ‘দশকবিভাজন’ গুরুত্বপূর্ণ। আশি, নব্বই কিংবা শূন্য দশকের বাংলা কবিতায় সমকালীন নানা ঘটনার উত্তাপ স্থান পেয়েছে। এছাড়া রোমান্টিক ও গীতিকবিতার চর্চা বেশি দেখা যায়। কবিদের মধ্যে দশকের কবি হিসেবে খ্যাতিমান হওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। দশকের বৃত্তে আবদ্ধ থেকেই কেউ কেউ কবিতা লেখায় ইতি টেনেছেন।

 

আরিফুল:আপনি এক সময় লিটল ম্যাগ বের করতেন।  সেই সম্পর্কে জানতে চাই।

 

ফারুক সুমন: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন কবিবন্ধু আহমেদ বাসারের সঙ্গে যৌথভাবে ‘অক্ষৌহিণী’ সম্পাদনা করেছি। তবে সম্পাদনায় দীর্ঘসময় থাকা সম্ভব হয়নি। আসলে পত্রিকা সম্পাদনায় যে একাগ্রতা ও ধৈর্যের প্রয়োজন সেটা আমার মধ্যে ছিল না। যদিও পরবর্তীসময়ে ‘বাংলায়ন সভা’র বার্ষিকীসহ আরও দুয়েকটি সাহিত্যপ্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।

 

আরিফুল:একজন কবির লেখালেখির পূর্ব প্রস্তুতি কি হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন ?

 

ফারুক সুমন: কবির জন্য কোনো উপদেশ কিংবা পরামর্শ দেওয়াকে আমি ব্যক্তিগতভাবে ভালো মনে করি না। যিনি কবি, তিনিই ভেঙেচুরে নিজেকে কবিতার দুর্গম পথের জন্য তৈরি করে নিবেন। কেউ চাইলেই কবি তৈরি করতে পারেন না। কবি এমন এক শৈল্পিক সত্তা, যিনি নিজের প্রতিভার ঔজ্জ্বল্য নিয়ে অবধারিতভাবেই আত্মপ্রকাশ করবেন। কবিতা লিখতে গেলে প্রচলিত পড়াশোনার পাশাপাশি জীবন ও জগ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখা প্রয়োজন মনে করি। কবিকে যুগপ দ্রষ্টা ও ধ্যানী হতে হয়। ভাষাকে কাব্যভাষায় রূপ দানের জন্য প্রয়োজনীয় শব্দসম্ভার সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে বৈকি। ধর্ম-দর্শন ও ইতিহাস-বিজ্ঞানসহ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিচারণ করতে হবে।

 

 

 

 

 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান