দীর্ঘ সাক্ষাৎকার - মাসুদার রহমান
দীর্ঘ সাক্ষাৎকার - মাসুদার রহমান

মাসুদার রহমান। জন্ম: সোনাপাড়া, বিনধারা, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট, ১সেপ্টেম্বর, ১৯৭০। মূলতঃ কবি,  উন্মেষকাল: নব্বই দশক। প্রকাশিত কবিতার বই ১৫টি এ ছাড়া শিশুকিশোর পাঠ্য কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে ০৩টি। এ বছর ( ২০২৫ ) বাংলা একাডেমি একুশে গ্রন্থমেলায় বেরিয়েছে 'কবিতা সংগ্রহ-১' এবং পশ্চিবঙ্গের পারস্পারিক প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছে 'নির্বাচিত কবিতা'।

উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা: বাংলা একাডেমি প্রদত্ত তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার ১৯৯৭। দ্বৈপায়ন সাহিত্য পুরস্কার ১৪২৩ বঙ্গাব্দ ( দ: পব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)। ইতিকথা সাহিত্য সম্মাননা ২০২৩ বঙ্গাব্দ (কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।কবি আনওয়ার আহমদ স্মৃতিপদক ২০১৫। লেখমালা সম্মাননা ২০২১।

মাসুদার রহমান এর সাক্ষা কার গ্রহণে সাহিত্যবার্তার সম্পাদক আরিফুল ইসলাম ।

 

 

আরিফুল: আপনি মূলত কবিতার মানুষ। আপনার কাছ থেকে কবিতার কথা জানতে চাই। কবিতা আসলে কী?

মাসুদার রহমান: একজন কবি তার কবিতা জার্নির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে যেমন রক্তচক্ষু উপেক্ষা আর অপমানমূলক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়, তেমনি সেই জার্নির ভেতর থেকেই খুঁজে পায় গভীর প্রেম ও আশ্রয়। ব্যক্তি অভিজ্ঞতা থেকেই এ কথা বলছি।

     কবিতা হল সেই ভাষাসম্পদ, যা ব্যবহারিক ভাষা থেকে সামান্য বা বিস্তর আলাদা কিন্তু প্রতিবন্ধি নয়। কবিতায় যারা প্রকট বক্তব্য ও ভাষণের দাবিদার তাদের দলে নিজেকে দেখতে আমার ভালো লাগে না। একেবারে বক্তব্য প্রধান কবিতার সমজদার আমি নই। ভাষা বা শব্দের জাগলিং, একটু কাব্যিক আড়াল এমনি কবিতা আমার ভালো লাগা এ পর্যন্ত।

 

যতদূর মনে পড়ে ছেলেবেলায় থেকেই খুব ঘন ঘন জ্বরে পড়তাম। মজার বিষয় চোখ বন্ধ করলেই কত রঙের আলো ফুটত মনের চোখে। সেই সঙ্গে খুব নিঃসঙ্গবোধ হতো। বোধের শূন্যতা তৈরি হতো। আবার একটা সময় ছিল খুব মরে যেতে চাইতাম। বলা বাহুল্য তা আর হয়ে ওঠেনি। ওই নিঃসঙ্গ দিনগুলোতে একা একটি বাড়িতে থাকতাম। বাড়িটির টানা বারান্দায় সারাদিনে দু’একটি বিড়াল শুধু নিঃশব্দে হেঁটে যেত। সামনের প্রশস্ত উঠোনে দু’এক ঝাঁক শালিক বুলবুলি অন্যান্যরা। জানালা খুলে উত্তরে তাকালে ঘন কলাবন। আরও নানা গাছপালার সবুজ। পুবের জানালা ঘেঁষে হাস্নুহেনা গাছ। তারপর ছুটেচলা ধানখেত। আর সেই সময় জেনেছি কবিতা একাকিত্বের পাশে একঝাড় হাস্নুহেনা।      

কবিতায় শব্দকে তার অর্থ দ্যোতনার বাইরে নিয়ে হাঁটাতে হয়। একজন জাদুকর যেমন করে সামন্যকে অসামান্যভাবে উপস্থাপন করেন। তেমনি সামান্যকে অসামান্য এবং অসামান্যকে সামান্যীকরণ কবির কাজ। ‘চাঁদে পানি নেই’ এই সংবাদটি আজ সাধারণ। ‘চাঁদে পানি আছে’ এমন একটি সংবাদ বা তথ্য জনসম্মুখে উঠে এলে এই মুহূর্তে তাকে জাস্ট অসাধারণ ছাড়া আর কি বলবেন? কবিতা তো অসাধারণত্বকেই ছুঁতে চেয়েছে বারবার।

 

কবিতাকে নতুন হতে হয়। পূর্বে যা লিপিত হয়নি, যেভাবে লিপিত হয়নি, সেভাবে হওয়া এবং তা স্পর্শ করাই কবিতার কাজ। কিন্তু প্রশ্ন হল, পাঠক তা মানবেন কেন?

-মানবেন। হয়তো মানবেন।

যদি না মানেন?

তার উত্তর আপনি ভালো জানেন আমার চেয়ে। তবে কবিতা লিপিত হওয়া মাত্র তার পাঠক না-ও মিলতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে অপেক্ষা করতেও হয়েছে কবিকে তার যোগ্য পাঠকের জন্য। যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত জীবনানন্দ দাশ। তাহলে কী দাঁড়ালো? নতুন এবং একাধারে যেন তা কবিতা হিসেবে গ্রাহ্যতা পায় তবেই তা কবিতা। এখনে সর্বজন গ্রাহ্যতার কথা চিন্তা করা ভুল হবে। শিল্পের সর্বজন গ্রাহ্যতা অবান্তর।

 

প্রকাশ্য কবিত্ব এক অদেখলাপনা শব্দবাক্য ধরে কবিতার অর্থ খোঁজা লোকজনের প্রসঙ্গে আদিবাসীদের বন্যপশু শিকারের একটি দৃশ্য মনে পড়ে। ধান কাটা-মাড়ায়ের পর শীতকালে যখন হাতে তেমন কাজ থাকে না; দল বেঁধে প্রতিবেশি বিধুয়া টপ্প’দা তীরধনুক বল্লম সুরকি হাতে বেরিয়ে পড়েন শিকারে।

 

সেবার গ্রামের পাশে শুকনো খালের পাড়ে ওঁদের এক অদ্ভুত শিকার কৌশল দেখেছিলাম। পাড়ের উপর থেকে নিঃশব্দে খালের তলদেশ পর্যবেক্ষণ  করে সরে এসে পজিশন নিলেন বিধুয়া টপ্প। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সতর্ক পজিশনে বিধুয়ার শিকারি দলবল। বিধুয়া ধনুকে তীর লাগিয়ে টার্গেট করলেন আকাশের দিকে। সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আমরা যারা এই শিকারপর্ব উপভোগ করতে এসেছিলাম, তারা বুঝতে চেষ্টা করলাম উড়তে থাকা কোন পাখি নিশানা করছে বিধুয়া টপ্প। তীর ছুঁড়লেন বিধুয়া। দেখছি, তীর উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে; কিন্ত্ কোথায়(?) তীর কোন কিছুকেই বিদ্ধ না করে ফিরে আসছে। তীরটি গিয়ে পড়ল খালের তলদেশে। এবার খালের নিচে একটা গোঙানির শব্দ। একটা ছটফটানি   সেদিকে দৌড় লাগাল বিধুয়া টপ্পর শিকার সহযোগীরা। দেখি, হইচই আনন্দ করে টেনে আনছে তীরবিদ্ধ একটি ধাড়ি শেয়াল।

 

তাহলে কি শেয়াল পাখা মেলেছিল আকাশে?

 

আকাশে তীর ছুঁড়ে একটি শেয়ালে বিদ্ধ করা কীভাবে?

কীভাবে?

 

কবিতার পাঠকমাত্র জানেন, কবি তো ওই বিধুয়া টপ্প!

 

 

 

মনে করে দিতে চাই, ভাষাকে যখন বিধান রচনার কাজে ব্যবহার করা হয় পরিপত্র চিঠি দলিল দস্তাবেজ লেখার কাজে প্রয়োগ করা হয় তখন নিশ্চিতভাবে ভাষার বহুগামিতকে রোধ করতে হয় ভাষার ভিতরের সকল বিষ-কাম-ক্রোধ নাশ করতে হয়। সম্ভাবনাকে গলাটিপে হত্যা করতে হয়। না হলে বিধানদাতার আসন উল্টিয়ে যেতে বাধ্য। অন্যদিকে কবিতায় প্রয়োজন ভাষার জীবন্ত জংলিরূপটি।  কবিতার ভাষায় বহুগামিতা বিষ-ক্রোধ-কাম থাকতেই হয়। কবির আসন উল্টিয়ে পড়ার ভয় থাকতে নেই। তার ভাষাভ্রমণ তো আসনগুলো উল্টিয়ে পড়া দেখতে দেখতে।

 

কবিতা-সম্ভাবনা নস্যা করে দেওয়া, তা কি এই সময়ের কবিতার একটি প্রবণতা? আমি কিন্তু এভাবে ভাবতে পারি না। একটি লেখা প্রচণ্ড সম্ভাবনাকে সামনে এনেই তাক্ষনিক তাকে নস্যা করে দিয়ে পাঠককে এক ধরণের ক্রাইসিসের সামনে রেখে কবি কী সুখ অনুভব করেন? পাঠকের জন্য কি রেখে গেলেন সেখানে? কমপক্ষে ক্রাইসিস থেকে বেরিয়ে আসার গোপন দরোজাগুলো লেখার মধ্যে থাকতেই হয় সম্ভাবনা নস্যা প্রসঙ্গটিও ফেক; কেন না তা নতুন সম্ভাবনা কে উস্কে দেয়। তাহলে কি দাঁড়ালো? যা সম্ভাবনার নস্যা বা ক্রাইসিস মনে করছি তা আসলে তা নয়। যেভাবে নাগরদোলার প্রসঙ্গটি। নাগরদোলা যেমন নাগরগণকে উপরে উঠিয়ে নিচে ফেলে দেবার ভানটি করে মাত্রএই ভান-পতনের মজাতেই নাগরগণ নাগরদোলায় পরম আনন্দে দুলে গেছেন এই দোলা অনেকের কাছে আবার হিসি উদ্রেককারিও তার তো মজা পাওয়া দূরের কথা, কাপড় নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। তাহলে পাঠকের পাঠকত্ব লাভের একটি দায় আছে। তাকেও তৈরি হয়ে আসতে হয়। তারও সাবালকত্ব পেতে হয়। কবিতার দোলা নেবার ক্ষমতা প্রাপ্ত হতে হয়। একজন পাঠক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত এসে আটকে গেলেন। সুনীল পরবর্তী পর্যায়ের কাজগুলো আর স্পর্শ করতে পারলেন না। সে ক্ষেত্রে ওই পাঠক সুনীল রেশমগুটির মধ্যে আবদ্ধ একটি শুঁয়োপোকা। এর অর্থ দাঁড়েচ্ছে একজন কবিক যেমন নিজেকে প্রতিনিয়ত ভেঙে আপডেট হয়ে আসতে হয় পাঠকেও তেমনি আপডেট হবার একটি দরকার আছে। তবে পাঠক সেক্ষেত্রে দায়বদ্ধ নাও হতে পারেন কিন্তু কবি তার কবিতা আপডেট করে নেবার দায় অস্বীকার করতে পারেন না। শিশুকে হামাগুড়ির অভিজ্ঞতা নিয়ে দাঁড়াতে হয়। বোধকরি হামাগুড়ি দিয়েই আকাশে ওঠে সূর্যপ্রত্যেক কবির কাজের ক্ষেত্রে হামাগুড়ির একটা পর্ব আছে বৈকি।

 

এখন কথা হল, কবিতা কারা পড়েন? জরিপ পরিচালনা করে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়োজন হয় না। একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত ভদ্রলোক ভাবেন, জগতের কত কিছুই তো তিনি জানেন। সাংসারের উন্নয়ন। ব্যাবসায়িক অগ্রগতি। অফিসিয়াল প্রজ্ঞাপন দলিল দস্তাবেজ স্টেটম্যান অধস্তনকে নিয়ন্ত্রণ ও দমিয়ে রাখার কৌশল সকল কিছুই তার জানাশোনার সীমায়কবিতা কি এমন বস্তু হল যে তা আলাদা করে বুঝতে হবে তাকে? বোঝেন না, একজন কবিতা পাঠকের পাঠতৃষ্ণা জ্বলন্ত হতে হয়।

 

অ্যালজেবরা জানি’র গর্ব কবিতা বুঝি না’র গর্বে একজন নিজেকে মহান ভাবছেন। অন্যদিকে আইনেস্টাইন চিঠি ভরা ভালোবাসার স্কয়ার কিউবগুলো; বিক্রিয়াগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছেন প্রাচাত্য হতে দূর প্রাচ্যে রবীন্দ্রনাথের কাছে এ নিশ্চয় বেড়ালের কাছে মাছ পাঠানো নয়, একজন রাষ্ট্রপতি আর একজন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেন,  বিষয়টিও ঠিক তাই!

 

 

আরিফুল : আপনার কবি হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছেন?

মাসুদার রহমান: এ নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা বলা যেতে পারে। খুব সহজ করে বলতে গেলে, অনেকটা মুদ্রাদোষে বলতে পারেন। আমার একাকীত্ব সম্ভবত এ ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছে। প্রশ্নের প্রেক্ষিতে একটি কথা মনে পড়ে, তখনমাধ্যমিকে পড়ি।   স্কুল হোস্টেলে থাকায় প্রত্যাহিক খাবারের  সবজি-মাছ-মাংস-মসলাপাতি কেনাকাটার জন্য ওই অঞ্চলের হাটবাজারে যাতায়াত করতাম। ডুগডুগিরহাট বলে একটি হাট আমাকে বেশ টানত। তা নানা কারণেই। তবে প্রশ্নের সঙ্গে প্রসঙ্গিক যে কথাটি তা হল, ওই হাটে   গেলেই একজন কবির দেখা পেতাম। কবি কফিল উদ্দিন। স্বাধীনতার আগে-পরে ‘সওগাত’ ‘মোহাম্মাদী’সহ আরও অনেক পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন তিনি।  খুব উদাসীন হাটের অলিগলি হেঁটে বেড়াতেন। দাঁড়িয়ে থাকতেন। ডুগডুগিরহাট থেকে দুই কিলোমিটার দূরেই তাঁর বাড়ি। গ্রামের নাম পালশা। তিনিই আমার প্রথম কবি দর্শন। পাতলা চেহারা, লম্বা কাঁচাপাকা চুল কাঁধ ছুঁয়ে নেমে গেছে। তফা দাঁড়িয় দেখতাম তাকে। কী এক মুগ্ধতা ছিল তাঁর প্রতি। সে সময় তার প্রথম বই প্রকাশ হয়েছিল, নাম ‘অশ্রু বাদল’। কবির বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম বই। সে অর্থে  বিলম্বিত প্রকাশ বলা যায়।   স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কাছে একদিন খবর এলো,  কবি কফিল উদ্দিনের কবিতা বই প্রেসে আছে,  প্রি-অর্ডারে কারা নিতে আগ্রহী? তালিকা করা হল। খুব আগ্রহ নিয়ে তালিকায় নাম দিলাম।   হাতে বই পেলাম। ভেবেছিলাম- বইটি বেরিয়ে গেলো, এবার দেশ জুড়ে কবির নাম ছড়াবে। তারপর আরও সময় পেরিয়ে গেল, জেলা শহরের লেটার প্রেসে ছাপা হয়ে বেরুলো তাঁর আরও কয়েকটি বই। কিন্তু তাঁকে কবি হিসেবে কেঊ চিনল না। এই অভিজ্ঞতার মধ্যে অনুপ্ররণা হয়তো ছিল এবং এক ধরণের সতর্কবারতাও ছিল।       

 

আরিফুল: কবিতা কখন অকবিতা হয়?

মাসুদার রহমান: যখন কবিতা হয়ে ওঠে না।

আরিফুল: প্রথম কোন্ কবিতা লিখে কবি জগতে প্রবেশ করেন?

মাসুদার রহমান: এভাবে বলা মুশকিল। হতে পারে কোনো একটি কবিতা হঠা অনেক পাঠকে ছুঁয়ে গেলো, তেমন নিশ্চয় হয়েছে। তবে সে কথা সামনে চাই না, ঘটনাটি রাতারাতি কবি হয়ে ওঠার মতো লাগবে হয়তো। মনে করি না কেউ রাতারাতি কবি হয়ে ওঠে। 

আরিফুল: প্রথম কবিতা ও সম্প্রতি লেখা কবিতার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান কী? একটু খুলে বলুন...

মাসুদার রহমান: পার্থক্য তো থাকেই। কেননা প্রতিনিয়ত কবিকে তার কবিতা আপডেত করে নিতে হয়। 

 

আরিফুল: আপনার মতে, আজকের দুনিয়ায় একজন কবির জন্য বিশ্বসাহিত্য জানা কতটা জরুরি?

মাসুদার রহমান: জরুরি। কিন্তু কতটা জরুরি এইটা নির্ধারণ করে দেওয়া যায় কী! কবি নিজ তাড়না থেকেই নানারকম পাঠের দিকে যান। যেতেই হয় নিজেকে ঋদ্ধ করতে।  

আরিফুল: একজন কবি সব থেকে মহ ! এতে আপনার প্রতিক্রিয়া কি ?

মাসুদার রহমান: শুধু কবি হওয়ার কারণেই কেউ মহ, এভাবে বলা যায়? তেমন কোনো গুণাবলী হয়তো আলাদা করেই প্রত্যেক্ মানুষকে অর্জন করে নিতে হয়। কবি কিংবা শিল্পীরা একটু বেশিই সংবেদনশীল বলে মানুষ এমন ভাবে। কবিদের প্রকৃতি ও জগত সম্পর্কে আলাদা এবং গভীর অবলোকন পঠন পাঠনসহ নানা মিথক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয় বলেই তার অন্যতর উজ্জলতার দেখা মিলে। লেখা ভেতরেও তার চিন্তার ভিন্নতা অনন্যতা দেয়।       

আরিফুল: আপনি কি মনে করেন, পাঠকই ‘নোংরামি’ খোঁজে, নাকি লেখকই তা তুলে ধরে?

মাসুদার রহমান: একটি লেখা লিখে ফেলার পর লেখক তার নিয়ন্ত্রণ হারান, তখন পাঠকই তার নিয়ন্ত্রক। পাঠক ভেদে তার ভিন্ন ভিন্ন অর্থদ্যোতনা আবিস্কার করেন। হয়তো একজন পাঠক একটি কবিতা পাঠের পর দীর্ঘদিন বিরতিতে সেই কবিতা পাঠ করতে গিয়ে নতুন ও ভিন্নতর অর্থময়তার মুখোমুখি হন। এখানে সাহিত্যের বহুরৈখিকতার বিষয় টের পাওয়া যায়।    

আরিফুল: তরুণ লেখকদের মধ্যে বিষয়বস্তু বাছাইয়ে আপনি কি কোনো দায়বদ্ধতার অভাব দেখেন?

মাসুদার রহমান: কবিতা শ্রেণি পরিক্ষায় শিক্ষার্থীর লেখা কোন রচনা নয়। কবিতায় বিষয় কোনো বিষয় না। কবিতা করে তুলতে পারাটাই বিষয়।

আরিফুল: আপনি কি মনে করেন কিছু লেখক শুধু আলোচনায় আসার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বিতর্কিত শব্দ বা বিষয় ব্যবহার করেন?

মাসুদার রহমান: তা তো আছেই।

আরিফুল: একটি সাহিত্যের মূল্যায়ন কেবল নৈতিক মানদণ্ডে হওয়া উচিত কি?

মাসুদার রহমান: বিষয়টি একপেশে হয়ে গেল না? কবিতা তো একটি শিল্প, তাকে শিল্পের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে হয়। তারপরে তো অন্যকথা।

আরিফুল: সাহিত্যে যৌনতা থাকলে সেটি কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অশ্লীল হয়ে যায়?

মাসুদার রহমান:‘কবিতায় যৌনতা’ পক্ষে বিপক্ষে বলবার মতো কিছু নেই। ভেবে দেখেছি, আপাত নিরীহ ‘বোতাম’ শব্দটিও যৌনতার ইঙ্গিত বহন করে। কবিতা হল সেই ভাষাসম্পদ, যা ব্যবহারিক ভাষা থেকে সামান্য বা বিস্তর আলাদা কিন্তু প্রতিবন্ধি নয়।

আরিফুল: কবি চরিত্রটি সমাজের চোখে রহস্যময়, এই রহস্যময়তার গোপন রহস্যটা আসলে কি?

মাসুদার রহমান: একজন জাদুকর কম রহস্যময়তাকে ধারণ করেন না। বাল্য বয়সে সেই জাদুকরের কথা ভাবুন, যার জাদু দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। সেই জাদুকর তো আপনার কাছে সুপারম্যান। নয় কী? দর্শক হিসেবে আপনার কাছে উতরে যেতে পেরেছিল সেই জাদুকর। কবিও পাঠকের কাছে সেভাবে উতরে যেতে পারলেই সেই রহস্যময়তা বা মুগ্ধতা জন্মে। না হলে নূন্যতম আগ্রহও থাকে বলে মনে হয় না।  

আরিফুল: আপনি একজন কবি, আর কবি হিসেবে কবিতার সংজ্ঞা কি হওয়া উচিত বলে মনে করেন ?

মাসুদার রহমান:কবিতা আকাশের মতো, তা সংগায় বেধে ফেলা মুশকিল। আকাশের যেমন ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায় রং বদলায় কবিতাও তেমনি পরিবর্তন ঘটে। জীবনের অনেকটা সময় কবিতা সঙ্গে কাটিয়ে কখনো সখনো হয়তো মনে হয় -‘কেন এই জীবনে কবিতাকে এতটা গুরুত্বের মনে করেছি’? তারপর অবাক হবার পালা, এর উত্তর একদম জানা নেই বুঝতে পেরেকবিতা কি? কেন? কীভাবে? এইসব প্রশ্নেরও কোন নির্দিষ্ট উত্তরমালা কবির হাতে নেই! তাই প্রশ্ন করা এবং উত্তর খোঁজা-ই যেন এক কবিজীবন। এক একটি দিন এক এক রকমভাবে আসে প্রশ্নগুলো। কোন দিন সমুদ্রের শান্ত সেই অঞ্চলের মতো কেবল অতলতা আলস্য বিছিয়ে রাখে। আবার কোন দিন উত্তাল এক সমুদ্র, আছড়ে পড়ে প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন কিন্তু উত্তর? উত্তর সে যাই হোক, প্রশ্ন করতে পারাটাই মূখ্য; উত্তর হয়তো গৌণ। নিজের কবিতা ভাবনা নিজেকে নিয়েই ভাবনা। নিজের কবিতা ভাবনা লিখতে গিয়ে এই মুহূর্তে নিজেকে নিয়েও ভাবনার একটা ফুরস উঁকি দিল। নতুন লিখতে আসা তরুণের কাছে এটি খুব স্বাভাবিক, তার যথেষ্ট অগ্রজ সামান্য অগ্রজ কিংবা সমসাময়িকরা পর্যন্ত তাকে শেখাতে থাকেন; কী লিখতে হবে কী লেখা উচিত। এমন কী পড়তে হবে কী পড়া উচিত তা নিয়েও বলতে থাকেন। ধারণা তৈরি করে দিতে থাকেন, কবিতা কী? অনেক ক্ষেত্রে চাপিয়ে দেবার মতো। তারপরও একজন কবির কবিতা নির্মাণ কিংবা কবিতা কেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা অন্যজন থেকে সামান্য হলেও আলাদা হবেই। বিস্তরও হতে পারে।

 

 

আরিফুল: আজকের বাংলাদেশে একজন লেখক বা শিল্পী কতটা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারেন বলে আপনি মনে করেন?

মাসুদার রহমান: কবিরা সব সময় বিপদজনক সমাজের কাছে রাষ্ট্রের কাছে।! জিহ্বায় কামড় পরেছে কখন? রক্তাক্ত হয়েছেন? তাহলে তো নিজের রক্তের স্বাদ গ্রহণ  করেছেন। কবিতা নিজ রক্তের স্বাদ গ্রহণের মতো-ই। আপনি যদি কবি হন, পরিবার আপনাকে নিয়ে কমবেশি বিপাকে আছে।

আপনার পরিপার্শ্ব; সমাজ সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে আপনাক দিকে।

আরও খানিকটা এগিয়ে দেখলে রাষ্ট্র আপনাকে বিপদজনকও ভাবতে পারেধর্মশালাগুলো অনেক আগেই আপনার নামটি শত্রু তালিকায় লিখে দিয়েছে

কেন?

সামান্য কবিতা-ই লিখতে এসেছিলেন আপনি! সেখানেও সাধারণের সন্দেহ আছে। ভয় আছে। আছে অবিশ্বাসও। এইটা আপনার চিন্তার অসাধারণত্বের কারণে। আপনার চিন্তা চেতনা ও যাপনের ভিন্নতার। কবি ও কবিতা নিয়ে  তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো আরও ভয়ংকর সন্দেহ রাখে। ত্রুটিপূরণ এইসব রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তারা চায় বশ্যতা ও আনুগত্য। শিল্পীরা সাধারণত মজ্জাগতভাবেই স্বাধীনচেতা, ফলে সংঘাত অনিবার্য। নানা কালাকানুনের ঘোরটোপে কবির কলমকে ভয় দেখাতে থাকে।    

 

 

আরিফুল: সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক কার্যক্রম ও উসবগুলো কী সাহিত্যের উন্নয়নে সহায়ক?

মাসুদার রহমান: শিল্পের জন্য সাহিত্যের জন্য গতানুগতিক কোন প্রক্রিয়াই ফলদায়ক নয়। আর এসব কার্যক্রমে যতটা না শিল্পসাহিত্যের তারচেয়ে বেশি দলের ব্যক্তির দলগত ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন। সেখানে সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা কতখানি তা ভাববার মতোই।

আরিফুল: আপনি কি মনে করেন বর্তমান সরকারের অধীনে সাহিত্যে কোনো নির্দিষ্ট ধারা বা মতাদর্শকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়?

মাসুদার রহমান: সব ক্ষেত্রে সব সময়ই দেখেছি, রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনরা মোটাদাগে একটা ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করতে চেয়েছে। তাতে সাহিত্য কতটা হয়ে উঠলো বা উঠলো না তাদের কাছে সেটা বড় কথা না। সেইটা রাষ্ট্রের চাওয়া। সাহিত্যে তীব্রভাবে এরকম কিছু আরোপিত করা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি কমে বৈ বাড়ে না। অনুসন্ধানে নামলে ভুরুভুরি উদহারণ পেয়ে যাবেন। হাঁ, খটকা তো লাগছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। এইটা বুঝি রাষ্ট্রেরই চরিত্র। কিন্তু লেখকের চরিত্রের প্রধানতম দিক হল স্বাধীনচেতা। সেখানে আরোপিত বা চাপিয়ে দেওয়া বিষয়কে, পশ্চাপদতাকে প্রকৃত লেখক আঁকড়ে বাঁচতে চাইবেন না মোটেও। তথাকথিত লেখক নামধারীদের জন্য তা স্বাভাবিক। তবে স্বযং বর্তমান সরকার সে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন কিনা তার জন্য নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখে বলা উচিত।        

 

আরিফুল: আপনি কি মনে করেন বর্তমান সরকার সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে?

মাসুদার রহমান: স্বাভাবিক প্রবাহে সকল হস্তক্ষেপ উঠিয়ে নেওয়া উচিত। লেখককে জব্দ করার জন্য যে সকল কালাকানুল হয়েছিল এবং হচ্ছে তা রদ করা উচিত।

 

আরিফুল: আপনি কি মনে করেন যে সরকারপন্থী ও সরকারবিরোধী লেখকদের আলাদা চোখে দেখা হয়?

মাসুদার রহমান: লেখকের কোন দল হয় নাকি! লেখক একটি স্বাধীন স্বত্বা।

 

আরিফুল: আপনি কোনো রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার কারণে লেখা বাদ দিয়েছেন এমন অভিজ্ঞতা আছে কি?

মাসুদার রহমান: না, আমার তেমনটি হয়নি এখনো। তবে অনেক সময় বিভিন্ন বিষয় কেন্দ্রিক লেখার অনুরোধ/আহ্বান পেয়েছি। সেভাবে লেখার প্রয়োজনবোধ করিনি। তবে অনেক অনেক দৃষ্টান্ত তৈরি হয়ে গেছে, যা লেখককে প্রতিনিয়ত ভয় দেখিয়ে যায়।  

 

আরিফুল: একজন কবি হিসেবে আপনি বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা দায়বদ্ধ বোধ করেন?

মাসুদার রহমান: করি না।

আরিফুল: আপনি কি মনে করেন বাংলা সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে যথেষ্ট সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে?

মাসুদার রহমান: বাংলা সাহিত্য মানগত দিকে থেকে বিশ্বসাহিত্যের পর্যায়ের। কিন্তু আমাদের ভালো অনুবাদ ও সংযোগ সংকটের কারণে তা বিশ্বসাহিত্যের পাঠকের কাছে সেভাবে যেতে পারেনি। 

আরিফুল: সাহিত্যিকদের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি বা রাজনৈতিক চাপ সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

মাসুদার রহমান: ইহা সাহিত্য বিকাশের অন্তরায় এবং যে যখন যেভাবেই করুন তা গর্হিতকর্ম। আর এমন সব ক্রমবর্ধমান ঘটনার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে যদি একজন লেখকের এমন উপলব্ধি হয়- ‘রাষ্ট্র সর্বাপেক্ষা স্বার্থপর প্রতিষ্ঠান’ তখন অবাক হবার কী থাকে!

 

আরিফুল: আপনি কি মনে করেন পশ্চিমা সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্যে একধরনের প্রভাব বা আধিপত্য তৈরি করেছে?

মাসুদার রহমান: নিঃসন্দেহে।

আরিফুল:  লাতিন আমেরিকান বা আফ্রিকান সাহিত্য আপনাকে কতটা আকর্ষণ করে?

মাসুদার রহমান: লাতিন সাহিত্যের জয় জয়কার আজ বিশ্বব্যাপী। আমিও লাতিন সাহিত্যের একজন অনুরক্ত ভক্ত পাঠক। আফ্রিকান সাহিত্য নিয়েও আগ্রহ রাখি। যখন যেভাবে পাই পড়তে চেষ্টা করি।

আরিফুল: সাহিত্যে উপনিবেশবাদ ও পরবর্তী-উপনিবেশবাদ বিষয়ক লেখাগুলোর সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?

মাসুদার রহমান: পড়ি এবং ঋদ্ধ হই। তবে সবক্ষেত্রে একমত হতে পারি না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়,  উপনিবেশিকতা এখন নতুন মোড়কে নতুনভাবে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।

আরিফুল: বিশ্ব সাহিত্যে নারীকণ্ঠ বা প্রান্তিক কণ্ঠের উত্থান কীভাবে দেখেন?

মাসুদার রহমান: খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখি। কখনো কখনো নারী শক্তির পূজারীমনে হয় নিজেকে। প্রান্তিকতা প্রবলভাবে মাথা তুলে দাঁড়ালে তাকে অস্বীকার করবার সাধ্য থাকে না। প্রান্তিকের সেই মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোটুকুই এক ভয়াবহ লড়াই। তাকে অসম লড়াই মনে হলেও তার ভেতর দিয়েই প্রান্তিকতার উত্থান ঘটে। প্রান্তিকতার উত্থান যেন তাই মহত্ত্বর এক বিজয় আখ্যান।     

 

 

আরিফুল: আপনি কি কোনো আন্তর্জাতিক সাহিত্য উসবে অংশ নিয়েছেন বা নিতে চান?

মাসুদার রহমান: নিইনি। সত্যি কথা বলতে, অনুষ্ঠান উসব আলো উজ্জ্বলতার বাইরে থেকে লেখালেখি করে গেছি এ পর্যন্ত। 

আরিফুল: বিশ্ব সাহিত্য পাঠ করার সময় আপনি ভাষার চেয়ে ভাব বা শৈলীকে বেশি গুরুত্ব দেন কি?

মাসুদার রহমান: দুটোই গুরুত্বের।

আরিফুল: আপনি কি মনে করেন কিছু লেখক শুধু আলোচনায় আসার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বিতর্কিত শব্দ বা বিষয় ব্যবহার করেন?

মাসুদার রহমান: তা তো দেখিই।

আরিফুল: রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পরবর্তীতে বাংলা কবিতা কোন দিকে এগিয়েছে বলে মনে করেন?

মাসুদার রহমান: রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল বাংলা সাহিত্যে সন্দেহতীতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রভাববলয় দীর্ঘদিন সক্রিয় থাকলেও সে বলয় থেকে বাংলা কবিতা ত্রিশের দশকেই বেরিয়ে এসেছে। তা এখন শাখাপল্লবিত হয়ে আরও এক মহিরুহ এবং তারও পরে আরও পরিবর্তন এসেছে বাংলা কবিতায়। বাংলা কবিতা নিবিড়ভাবে ধারাক্রমিক পাঠের ভেতর দিয়ে গেলেই তা টের পাওয়া যায়।  

আরিফুল: শিল্পের মধ্যে জীবন থাকে, জীবনে অভিজ্ঞতা থাকে- আপনার কবিতায় অভিজ্ঞতার কথা কতটুকু?

মাসুদার রহমান: কবিতা অভিজ্ঞতা আর কল্পনাকে অবলম্ব। কল্পনাও অভিজ্ঞতা থেকে উপন্নজাত।

আরিফুল: এপার বাংলার কবিতার ভাষা এবং ওপার বাংলার কবিতার ভাষার মধ্যে পার্থক্য কতটুকু ?

মাসুদার রহমান: ব্যবহারিক ভাষার যে তফা, বিশেষ করে বলার ক্ষেত্রে- দুবাংলার কবিতায় তা অল্পস্বল্প পার্থক্য এনেছে হয়তো। ভূগোলগত মানুষের যাপনগত পার্থক্যও দেখা যায় কখনো। তবে দুবাংলার ভাষাই তো বাংলা। সে ক্ষেত্রে পার্থক্য বিষয়ে আলোচনার জন্য তা অলোচনা হতে পারে এবং তা খুব স্থুল-অর্থে। যেখানে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে সংযুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষা, সেখানে একই ভাষায় দেগে দিয়ে আলাদা করার চিন্তা!

আরিফুল ইসলাম :‘কবির স্বাধীনতা’ আপনার মূল্যায়ন কী?

মাসুদার রহমান: ভীষণ প্রয়োজনীয়। পাখিদের মধ্যে মুরগি মানুষের নিকট সর্বাধিক পরিচিত। কিন্তু ৫/১০টি পাখির নাম বলতে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষ মুরগির নাম করে না। যেন মুরগি কোন পাখি নয়। কিন্তু কেন? ধরে নিতেই পারি, মুরগির গৃহপালিতের মতো বশ্যতা মেনে নেওয়া বিষয়টি। কবিদেরও তেমনি মুরগি হলে চলে না, একান্তভাবে কবি হয়ে উঠতে হয়।

 

আরিফুল ইসলাম : অনেক তরুণ কবিই গদ্য কবিতাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। গদ্য কবিতাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? গদ্য কবিতার ভবিষ্য কী?

মাসুদার রহমান: তাতে কোনো সমস্যার কারণ দেখি না। তা কবিতা হয়ে উঠতে পারলেই হল। 

আরিফুল ইসলাম : আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশের সাহিত্যে বর্তমানে অশ্লীলতা বা ‘নোংরামি’ বাড়ছে?

মাসুদার রহমান: মনে করি না।

আরিফুল ইসলাম : সাহিত্যে খোলামেলা ভাষা বা যৌনতার প্রকাশ কি ‘নোংরামি’, নাকি সাহসী সত্যউচ্চারণ?

মাসুদার রহমান: নোংরামি তো নয়ই। শিল্পিতভাবে তা যদি আসে তবেই তো তা শিল্প তথা সাহিত্য।

আরিফুল ইসলাম : একজন সাহিত্যিক কিভাবে বোঝেন কোনটি শিল্প, আর কোনটি অশ্লীলতা?

মাসুদার রহমান: অভিজ্ঞতাজাত, বোধ ও ধারণাজাত ভাবে।

আরিফুল ইসলাম : অশ্লীলতা বনাম বাস্তবতা—এই বিতর্কে আপনি কোন অবস্থানে?

মাসুদার রহমান: আলাদা হয় কীভাবে?

আরিফুল ইসলাম : আপনি কি মনে করেন, পাঠকই ‘নোংরামি’ খোঁজে, নাকি লেখকই তা তুলে ধরে?

মাসুদার রহমান: বয়ানে বটতলায় কবিতার কতরকম ব্যাখ্যা অর্থ-উদ্ধার দেখেছি, শুনেছি। তা কি সাহিত্য পাঠকের কাছে মান্যতা পেয়েছে? যার যা উদ্দেশ্য তিনি বিষয়ের মধ্যে সেভাবেই উদ্দেশ্য খুঁজে নেন। নিখাদ সাহিত্য পাঠক সাহিত্যে সাহিত্য খোঁজেন, সাহিত্য রস খোঁজেন,  জীবন ও জীবনবোধ খোঁজেন। 

আরিফুল : একজন কবি ও দার্শনিকের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায় বলে আপনি মনে করেন?

মাসুদার রহমান: একজন দার্শনিক কবি নন- দার্শনিকই, একজন কবি কখনো কখনো দার্শনিকও, বিশেষ করে যখন কবি কবিতার মধ্যে দর্শন বা দর্শনিকতা ফলান। 

আরিফুল : বাংলা সাহিত্যের কোন যুগ বা কবি আপনার লেখায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে?

মাসুদার রহমান: নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না হয়তো। তবে সকল অগ্রজ এমন কী অনুজদের লেখা থেকে নিজের লেখা প্রেরণা ও আলো খুঁজে নিই।

আরিফুল :  ইউরোপীয় সাহিত্য ও দর্শনের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সংলাপ কতটা সফল বলে মনে করেন?

মাসুদার রহমান: অনেক ক্ষেত্রেই সফল, তবে ফাঁক এবং ফাঁকিও আছে।

আরিফুল :   সামাজিক মাধ্যমে সাহিত্যের দ্রুত বিস্তার কি ‘নোংরামি’ বাড়িয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

মাসুদার রহমান:  ঠিকই বলেছেন, ফেসবুক এবং ওয়েব পোর্টাল সে কোন সময় লেখা পোস্ট দেওয়া যায়। এই মাধ্যমগুলো যেন প্রতিনিয়ত বলছে, আমাকে ব্যবহার করো। ফলে যা ঘটছে, শর্তহীনভাবে সেখানে প্রতিনিয়ত অজস্র লেখা প্রকাশ হতেই থাকছে। মানবিচার বিষয়টি এখানে নেই, কোন প্রকাশ নী/প্রকাশক সম্পাদকের শরণাপন্ন হবার বালাই আর রইলো না। ওই যে বললাম, শর্তহীনভাবে। গত শতাব্দীতে ইউরোপে যে শিল্প-বিপ্লবের ইতিহাস তা এক মস্তবড় ঘটনা। বোধ করি তারচেয়েও বড় বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে অনলাইন ভিত্তিক মানুষের নানা রকম কর্মকাণ্ড। একজন লেখক কোন সম্পাদক প্রকাশের দ্বারস্থ না হয়েই সরাসরি লেখা অনলাইনে প্রকাশ হচ্ছে, লেখকের জন্য এর চেয়ে ইতিবাচক সংবাদ আর কি হতে পারে! কিন্তু সহজলভ্যতার খারাপ দিক আছে।

 

কোথায় এবার লিখেছিলাম, শিশুকে হামাগুড়ির অভিজ্ঞতা নিয়ে দাঁড়াতে হয়। বোকরি হামাগুড়ি দিয়েই আকাশে ওঠে সূর্যপ্রত্যেক কবির কাজের ক্ষেত্রে শিক্ষানবিশ একটা পর্ব আছে বৈকি।’ কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে তাকিয়ে মনে হয়- না, কবিদের শিক্ষানবিশ পর্বটি আর নেই। অবাধ অনলাইন প্রকাশ মাধ্যম এবং তার ব্যবহারে যেমন বিপ্লব ঘটে গাছে। তেমনি সেখানে ভালো লেখার পাশাপাশি সাহিত্যের নামে নিরন্তর আবর্জনা আর জঞ্জাল সৃষ্টি অনেক অনেক বেশি করে চলছে। সেই জঞ্জালের পাহাড় থেকে প্রকৃত সাহিত্য খুঁজে পড়বার সক্ষমতা কম পাঠকেরই আছে। বেশিরভাগ মানহীন লেখা গল্প-কবিতা নামে প্রচারিত, সেখানে পাঠক রুচি উল্টো পথে হাঁটবার আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রুচিবান পাঠক সৃষ্টির সম্ভাবনা নসা হয় অধিক ক্ষেত্রেই। ভাবতে পারেন, এই মাধ্যমে ‘হিরো আলম’ অভিনেতা এবং ‘ভুবন বাদ্যকর’ উপমহাদেশ কাঁপিয়ে তোলা গায়ক।

 

আরিফুল :  প্রযুক্তির যুগে বিশ্বসাহিত্যের প্রবাহ ও প্রভাব কীভাবে বদলেছে বলে আপনি মনে করেন?

মাসুদার রহমান: সকল ভাষার সাহিত্যের সহজলভ্যতা অনলাইন প্রযুক্তির কারণেই সম্ভব হয়ে উঠছে। ইউরোপ অমেরিকান সাহিত্যের পাশাপাশি অফ্রিকান সাহিত্য পাঠের সুযোগ এসেছে। জাপানিজ চাইনিজ করিয়ান ভাষার সাহিত্যও পঠিত ও নানা ভাষায় অনুবাদের সুযোগ হচ্ছে। এই উপমহাদেশের প্রধানতম ভাষা বাংলা, নিশ্চয় বাংলাভাষাও একদিন এভাবে সমগ্র বিশ্বে পঠিত হবে আশাকরা যায়।  

আরিফুল ইসলাম : ইদানীং শোনা যাচ্ছে প্রবীণ কবিদের চেয়ে নবীন কবিরাই অনেক ভালো লিখছে। ব্যাপারটা আপনার কাছে কী মনে হয়?

মাসুদার রহমান:এভাবে উপলব্ধি করিনি, তাই মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

আরিফুল : সাহিত্যে শ্লীল- অশ্লীল কীভাবে নির্ধারিত হয়? অশ্লীলতার মাপকাঠি আদৌ কি আছে?

মাসুদার রহমান: পূর্বোক্ত প্রশ্নে এর উত্তর করেছি।

আরিফুল: কবিতার ক্ষেত্রে দশক ভিত্তিক কোন সংজ্ঞা আছে কি? যদি থাকে, আশি থেকে শ‚ন্য দশকের সংজ্ঞাগুলো কি কি বলে আপনি মনে করেন ?

মাসুদার রহমান:দশক একটি গৌণ বিষয়। আলোচনার সুবিধার্থেই এর প্রচলন হয়েছে বলে মনেকরি। এর বিভাজন প্রক্রিয়া খুব জটিল কিছু নয়। এ নিয়ে তত্ত্ব কপচানোর মতো কিছু নেই আমার কাছে। 

আরিফুল: ভবিষ্যতের বাংলাদেশের সাহিত্য ও সরকারের সম্পর্ক আপনি কীভাবে দেখতে চান?

মাসুদার রহমান: দু’য়ের সমন্বয় কখনো হয়নি। হতে পারে কিনা আমার জানা নেই। হলে ভালো, যলি নাও হয়, তাতে কোন সমস্যা নেই। শিল্প সাহিত্য বাঁধা বিঘ্নতাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাবে।  

আরিফুল: আপনি এক সময় লিটল ম্যাগ বের করতেন।  সেই সম্পর্কে জানতে চাই।

মাসুদার রহমান: অপর। মাত্র দুটি সংখ্যা, তারপর বন্ধ হয়ে গেছে। কুমার প্রণব, হেলাল আনোয়ার, মাহফুজ মিঠু এবং আমি চারজনের একটি যৌথ প্রয়াস ছিল।

আরিফুল: একজন কবির লেখালেখির পূর্ব প্রস্তুতি কি হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন ?

মাসুদার রহমান: কোন ধরা বাঁধা বিষয় নেই এ ক্ষেত্রে। তবে পঠনপাঠন জীবনবোধ আত্ন-উপলব্ধি নিজ ভাষার সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যে পাঠ ও জানাশোনা সহায়তা দেয়।

আরিফুল: নতুন যারা লিখছেন তাদের সম্পর্কে কিছু বলুন ?

মাসুদার রহমান: আমাদের পরবর্তী সময়ে অনেক উজ্জ্বল ছেলেমেয়ে লেখালেখিতে এসেছেন। নতুন ডিকশন নতুন ভাবনায় তারা কবিতার খোলনালচে পাল্টে দেবার ক্ষমতা রাখেন। প্রয়োজন সাধনা ও একগ্রতার। অনেকের মধ্যে তা আছে। সাহিত্যে শর্টকাট কোন রাস্তা নেই। সরীসৃপের মতো প্রতিইঞ্চি ভুমি বুকে স্পর্শ করেই যেন এগিয়ে যেতে হয়।

আরিফুল : অনেক ধন্যবাদ সাহিত্যবার্তাকে আপনার মহামূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য।

মাসুদার রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ। সাহিত্যবার্তার এই উদ্যোগের ফলেই অনেক অজানা কথা বলবার সুযোগ তৈরি হলো। সাহিত্যবার্তার জয় হোক।

 

   

 

 

 

 

 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান