দুটিগল্প । সাইফউদ্দিন আহমেদ বাবর
বার্মিংহামে একদিন
রেস্টুরেন্ট নিয়ে অনাকাংখিত এক জটিলতায় জড়িয়ে পড়ায়- আমরা,পার্টনাররা,সিদ্ধান্ত নিলাম-রেস্টুরেন্ট বিক্রি করে দেবো।
প্রথমে প্রস্তাব তোলা হলো,পার্টনার দের মধ্যে কেউ কিনতে চাইলে কিনতে পারবে।সেক্ষেত্রে স্পেশাল ডিসকাউন্টও বিবেচনা করা হবে।
নানাবিধ সমস্যার কারনে আমরা কেউ ই কিনতে আগ্রহী হলাম না।
আমরা বাইরের ক্রেতার সন্ধান করতে লাগলাম।পেয়েও গেলাম।সব কিছু সেট হওয়ার পর,যে দিন উভয় পক্ষ সলিসিটারের অফিসে,এগ্রিমেন্ট সাইন করার জন্য-তখন আমাদের এক পার্টনার পল্টি মারলো!
সে নিজেই ক্রয় করার প্রস্তাব দিলো।তাও তার সলিসিটারের ফ্যাক্সের মাধ্যমে।
উপস্থিত সলিসিটাররা বললেন,আইন মতে তাকে সুযোগ দিতেই হবে।পার্সোনালি তার সাথে মীমাংসা করতে পারলে -সেটি অন্য ব্যাপার।তবে আপাতত সব ডিল মুলতুবি করে দিতে হবে।
তাই করতে আমরা বাধ্য হলাম।
আমাদের রেস্টুরেন্ট ছিলো হ্যাম্পশেয়ারের উলস্টনে।
আমরা চার পার্টনারের কেউ ই তখন রেস্টুরেন্টে থাকি না।রেস্টুরেন্ট চালায় আমার ছোট ভাই।
আমি আমাদের ঘর,লন্ডনের কিলবার্ণে থাকি।আমার পার্টনার মনির থাকে কেন্টের ডার্টফর্ড।সেখানে তার বাসা বাড়ি।
সেখানে তার বড়ো ভাইয়ের একটি টেকএ্যাওয়ে আছে।সেটি সে রান করে এবং টেকএ্যাওয়ের উপরে ফ্লাটে আরো দু’জন স্টাফের সঙ্গে থাকে।
আমার আজকের গল্প আমার রেস্টুরেন্ট পার্টনার,বন্ধু এই মনিরকে ঘিরে।
সময় ১৯৯৭সাল।
মে মাস।
একদিন রাতে মনির ফোন দিয়ে বললো,
- কি রে,যাবি বার্মিংহামে?
- বার্মিংহাম কেনো যাবো!
- কাল আমি যাচ্ছি,একটা ভ্যান হায়ার করে।
- কেনো!ভ্যান কেনো?তোর গাড়ি কোথায়?
- গাড়ি তো আছে,গাড়িতে হবেনা।যাচ্ছি রকিব ভাইকে আনতে।সে তো তার বৌ বাচ্চা নিয়ে বার্মিংহাম থেকে আমাদের এখানে চলে আসছে।ঘরও রেন্ট করা হয়ে গেছে।
রকিব ভাই,মনিরের চাচাতো ভাই।তিন বছরের মতো হলো এদেশে এসেছে।আসার পরই আমাদের উল্স্টন রেস্টুরেন্টে বেশ কয়েক মাস কিচেন পোর্টারের কাজ করেছে।
সুন্দর স্বাস্থ্যের,দীর্ঘদেহী একজন লোক।খুবই বন্ধু বৎসল।খেলা ধুলায় ভীষণ আগ্রহ।
আমরা তখন প্রতি বৃহস্পতিবার আর রবিবারে,বটলী ভিলেজের মাঠে গিয়ে,অন্যান্য রেস্টুরেন্টের স্টাফদের সঙ্গে মিলে ফুটবল খেলি।প্রায়ই ফাইভ ও সাইডের টুর্নামেন্টের আয়োজন করি।
আমাদের টি মের গোল কীপার ছিলো এই রকিব ভাই।মনে আছে একটা টুর্নামেন্টই জিতেছিলাম আমরা তারই গোল কীপিং এর কৃতিত্বে।
মনিরের কথায় মনে পড়লো,কয়েকদিন ধরে সে মাঝে মাঝেই বলছিলো-রকিব ভাইয়ের বৌয়ের সাথে বনিবনা হচ্ছে না।ঝগড়া ঝাটি সারাক্ষণই লেগে আছে।আর সে সব হচ্ছে কেবল তারই শাশুড়ির চক্রান্তে।
তাই রকিব ভাই চাচ্ছে বৌকে নিয়ে বার্মিংহাম ছেড়ে,নিজের আত্মীয় স্বজনের কাছাকাছি চলে আসতে।সে তার বৌকে ক্রমাগত কান মন্ত্র দিয়ে-তাতে রাজী করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
রাজী করিয়েই ফেলেছে তাহলে!
আমি মনির কে বললাম,
- ঠি ক আছে যাবো।
- তাহলে চলে আয়।
- আমাকে লন্ডন থেকে নিয়ে যাস।
- তুই আজ রাতেই চলে আয় না।এখানে থাকলি।আর কাল দিনে ধীরে সুস্থে রওয়ানা দিলাম।
ঘরে বেকারই বসে আছি,তাই বললাম,
- ও কে,আসছি।
পরদিন আমরা সাদা একটা ভ্যানে করে,আস্টন ভিলা ফুটবল ক্লাবের ভিলা পার্ক স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে রকিব ভাইয়ের ঘরে পৌঁছলাম।
বার্মিংহামে যদিও আমার এক খালা থাকেন।খালাতো ভাই বোনেরা থাকে।তারপরও নানান সমস্যায় সময়ের অভাবে আসা হয়নি।
তবে খালা তারা বার্মিংহাম আসার আগে,একটি গল্পের বই প্রকাশের সূত্রে একবার এসেছিলাম।ডাঃ মাসুদ আহমেদের কাছে।সেটি সেই ১৯৯০ সালে।
সেটি আরো অন্য গল্প।
যাইহোক,আমাদেরকে মহা উল্লাসে রকিব ভাই অভ্যর্থনা জানালো।
বিকেল তখন পাঁচটার উপর।
অভ্যর্থনার প্রথম ধাক্কার শেষে রকিব ভাই তার ঘর আমাকে ঘুরে দেখাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো।
এই ঘর ছেড়ে সে চলে আসছে,তারপরও আমাকে উপরে নিয়ে দেখালো,একটা বড়ো আর একটা ছোট বেডরুম।নিচে তো বসেই দেখলাম,কিচেন,ড্রয়িংরুম আর বাথ রুম।
সারা ঘরই আগোছালো হয়ে আছে।জায়গায় জায়গায় নানান ধরণের ব্যাগে,বক্সে প্যাক করা জিনিষ পত্র।সিফট্ হওয়ার প্রস্তুতি।
ঘর দেখে নিচে নেমে দেখি চা দেয়া হয়েছে।
বেলা একটার সময় মনিরের ভাইয়ের টেকএ্যাওয়ে থেকে চা,আর এক পিস ব্রেড খেয়ে বেরিয়ে ছিলাম,খিদের চোটে শরীর কাঁপছে।এখানে খাবারের আয়োজন কখন হবে-বুঝতেও পারছি না।খিদে কমাতে বিস্কুটই খাচ্ছিলাম।
চা,বিস্কুটের মাঝ খানেই রকিব ভাইয়ের শাশুড়ির আগমন।সরবে!
এমন সময় তাঁর আগমনে খাওয়াতে আমার ব্যাঘাত ঘটলো।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস একটা গোপন করে বসে রইলাম।
রকিব ভাই তার শাশুড়ির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলো।
আমি অনুমান করলাম,হাল্কা গড়নের ফর্সা ঐ মহিলার বয়স খুব বেশি হলে পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে।লক্ষ্য করলাম,চশমার পেছনে তাঁর চোখ জোড়ায় ধূর্ততার আভাস।তবে গলার স্বরে তাঁর অতিরিক্ত একটা মোলায়েম ভাব!
আমার বন্ধু মনিরের সব চেয়ে বড়ো গুন হলো-সে যে কোনো পরিবেশে,যে কোনো মানুষের সঙ্গে,অতি সহজ ভাবে গল্প জমাতে পারে।
তা ছোট বড়ো,নারী,পুরুষ,যে ই হোকনা কেনো!
সে রকিব ভাইয়ের শাশুড়ির সঙ্গে এমন ভাবে গল্প করতে লাগলো যেনো তিনি তার কতো কালের চেনা!
আমি তার পাশে বসে শোনতে লাগলাম তাদের আলাপ।
সে তখন বলছে,
- মাওয়ইজী,গেলেন না তো আমাদের একদিন দেখতে?
- কি ভাবে যাবো বাবা!এখানে আমার কতো কিছু সামাল দিয়ে রাখতে হয়।তোমার তালুইয়ের মৃত্যুর পর থেকে রেস্টুরেন্টের ব্যাবসাটাও আমাকে দেখতে হয়।
- তা জানি।তারপরও তো সময় করে একবার আমাদের ওদিকে ঘুরে আসতে পারতেন।আপনার রেস্টও হতো।
- তা হতো।রকিবও অনেক বার তার কাছের আত্মীয়দের দেখাতে নিয়ে যেতে বলেছে।কিন্তু আমার কি যাওয়ার জো আছে বাবা?আমার দুই মেয়ের সংসার,ছেলে গুলোর সংসার,সবি তো আমি ছাড়া অচল।
মনির কিছু বলতে যাচ্ছিলো,সে মুহুর্তে আরো কিছু লোকের আবির্ভাব হলো।তারা ঘরের ভেতর পা দিয়েই চেঁচিয়ে কথা বলতে লাগলো।
রকিব ভাইয়ের মেয়েকে কোলে নিয়ে,একজন প্রচন্ড শব্দে,উম্মা,উম্মা করে আদর করতে লাগলেন।
কথা বার্তায় বুঝলাম-তিনি রকিব ভাইয়ের শালী।
আর রকিব ভাইয়ের ভায়রার সঙ্গে রকিব ভাই ই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলো।
শ্যামলা রংয়ের এই মানুষটার বয়স ত্রিশের মধ্যেই হবে।সুন্দর শার্ট,প্যান্ট আর জ্যাকেট পরা,মোটামুটি স্মার্ট এক যুবক।চোখে চশমা।
তিনি আমাদের কাছাকাছি একটা সোফায় বসতে না বসতে-তার শাশুড়ি,আমাদের মাওয়ই তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
- ও মৃদুল,শেফ কি আর কিছু বললো?
- না আম্মা,আর কিছু বলতে শোনিনি।
- আমি বলেছি তাকে,সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে কাজ করতে না পারলে কাজ ছেড়ে চলে যেতে।আমি অন্য শেফ আনবো।তার থেকেও ভালো।প্রায়ই কারো না কারো সাথে সে ঝগড়া করে।পেয়েছে কি সে?
- জ্বী আম্মা।অনেকদিন ধরে কাজ করছে তো,তাই সে ধরেই নিয়েছে তার কথা মতো সবাই কাজ করবে।
- রেস্টুরেন্ট কি তার না কি যে,সবাই তার হুকুমে চলবে?
আলোচনার এই পর্যায়ে রকিব ভাই এসে ইশারায় আমাকে ডাকতে লাগলো।মজার আলোচনা ছেড়ে আমাকে উঠে যেতেই হলো।
রকিব ভাই,আমাকে তাদের ব্যাক ইয়ার্ডে নিয়ে গিয়ে একটা সিগারেটে ধরিয়ে বললো,
- ঐ যে,আমার ভায়রা,এটা বড়ো ধুরন্ধর বাবর ভাই।ডেন্জারেস মানুষ।
সন্ধ্যা হয়েছে অনেক আগে।তাদের ছোট্ট এই গার্ডেনে লাইটও নাই।
অন্ধকারে আমি পরিস্কার রকিব ভাইয়ের মুখ দেখতে পেলাম না।
বললাম,
- তারপরও নিজের ভায়রা রকিব ভাই।
- তা ঠিক।
- বউয়ের আত্মীয় স্বজন নিয়েইতো চলতে হয়।
- হুম,আমাকে আর পাবে কোথায়?চলে যাচ্ছি না?
সাতটার দিকে আরো কিছু লোকের আবির্ভাব হলে শুরু হলো জিনিষ পত্র ভ্যানে তোলা।হাত লাগাবো না লাগাবো না,করেও চক্ষু লজ্জায় হাত লাগাতে হলো।তবে হাল্কা দেখে দেখে,ধীরে ধীরে নিচ্ছিলাম।
একটা সতেরো ইঞ্চির টিভি দেখে ভাবলাম ঐটা নিয়ে কম হলেও পনেরো মিনিট সময় নষ্ট করবো।সে মতোই টিভি নিয়ে ভ্যানের পাশে ফুটপাথে রাখছিলাম।একটু আনমনাও ছিলাম।ঠাস করে টিভি উল্টে পড়লো।সর্বনাশ।
সোজা করে দেখি,স্ক্রীন ফেঁটে গেছে!
আমি এদিক ওদিক তাকালাম।মনির কাছেই ছিলো।
বললো,
- ভাঙ্গলো?
- হ্যাঁ।
সে হাসলো।
ভ্যানের একটা জায়গা দেখিয়ে বললো,
- ঐ খানে রাখ।এ নিয়ে কিছু বলিস না।
আমরা দু’জনেই হাসলাম।
প্রায় দু’ঘন্টা ধরে জিনিষ পত্র তোলা চললো।ভ্যানের জায়গা শেষ হয়ে গেলো।কিন্তু জিনিষ শেষ হলোনা।এই সময় রকিব ভাইয়ের স্ত্রী এসে ভ্যানের দিকে তাকিয়ে ইংলিশ এক্সেন্টে বাংলায় বললেন,
- আঢ় জ্যাগা নাই?
তারপর মনির কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
- ভাট ডেয়া হয়েছে...খেঠে ছলো।
ঘরের ভেতর গিয়ে আমি একটা সোফায় বসে পড়লাম।ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।ঘড়িতে প্রায় নয়টা বাজে,সারাদিনে ভাত খাওয়া হয়নি।
ডাইনিং টেবিলে দেখলাম খাবার সাজানো।কিন্তু কেউ খেতে বসছে না।ফলে খেতে বসতেও পারছিনা!
এদিকে রকিক ভাই ভ্যানে জিনিষ নিয়ে যাচ্ছে আর আসছে।সে জিন্সের উপরে যে শার্ট পরেছিলো-জিনিষ পত্র টানাটানিতে,গরমে ঘামে ভিজে যাওয়ার সেটা কখন যে খুলে ফেলেছে!
তার এখন খালি গা।
তা দেখে তার শাশুড়ি বললেন,
- ও রকিব,এ কি অবস্থা তোমার?গা খালি কেনো?গেন্জী টেন্জী একটা পরো।
রকিব ভাই হাসলো।
কিছু পরার লক্ষণ তার মাঝে দেখা গেলোনা।
বেশ কিছুক্ষণ পর,রকিব ভাইয়ের শাশুড়ি আমার পাশে বসে থাকা,রকিব ভাইয়ের ভায়রাকে বললেন,
- ও মৃদুল কেউ দেখি খেতে বসছে না।এক কাজ করো,তুমি বসে যাও দেখবে আস্তে আস্তে সবাই বসে পড়বে।
হলোও তাই।
মৃদুল সাহেব আমাকে নিয়ে খেতে বসতেই একে একে অন্যরাও এসে বসে পড়লো!
তবে আমি তেমন খেতে পারলাম না।ভাত তরকারী ঠান্ডা হয়ে জমে গেছে।খিদা নিয়েই উঠে পড়লাম।
ঘরের বাইরে দরোজার সামনের এক পাশে দাঁড়িয়ে,ভ্যানে কি করে আরো জিনিষ পত্র তোলা যায়-মনির আর রকিব ভাইয়ের সেই কসরত দেখছি।এমন সময় মৃদুল সাহেব আমার কাছে এসে জীজ্ঞাসা করলেন,
- আপনিও নিশ্চয় রেস্টুরেন্টে কাজ করেন?
- জ্বী।
- কি যে এমন মানুষ এদেশের!সবাই রেস্টুরেন্টে কাজ করে।আর একত্রিত হলে সবাই শুধু রেস্টুরেন্ট নিয়েই কথা বলে।
- আপনিও তো শোনলাম রেস্টুরেন্টে কাজ করেন।
তিনি একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন,
- দুর্ভাগ্য তো আমার এখানেই।দেশে থাকতে কী সুন্দর লাইফ ছিলো।বন্ধুরা মিলে রেস্টুরেন্টে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতাম।সেই আমি এখন রেস্টুরেন্টে বয়ের কাজ করি!দেশে থাকতে প্রায়ই বিকেল বেলা একটা রিক্সা নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়তাম।এখন একটু দম ফেলারও সময় পাই না।
- এদেশে এসে ভুল করেছেন ভাই।
- হুম।তবে রেস্টুরেন্টে বেশিদিন আর কাজ করতে হবেনা।আমার ওয়াইফ শাড়ির শপ করছেন।ডেকোরেশনের কাজ শেষ।আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে মাল তোলা হয়ে যাবে।
- ভেরী গুড ভাই।গুড লাক।
- থ্যাংকয়ূ ভাই।
রাত একটার দিকে আমরা ফেরার জন্য প্রস্তুত হলাম।
ভ্যানে সব জিনিষের জায়গা হয়নি।
সিদ্ধান্ত হলো,দু’সপ্তাহ পর রকিব ভাইয়ের স্ত্রী যখন যাবেন তখন বাকি জিনিষও যাবে।
যাবার প্রাক্কালে মনির তার মাওয়ইকে বললো,
- এতোদিন তো আমাদের ওদিকে যান নি মাওয়ইজী।এবার দেখবো আপনার নাতনীকে দেখতে যান কি না।
- তোমার ভাতিজি আমার জানের টুকরা,তার কাছে না গিয়ে পারবো?
- তখন ভাতিজি যদি আপনাকে আসতে না দেয়?
তিনি হাসতে হাসতে বললেন,
- বার্মিংহামের মতো আরাম আমাকে আর কোনো শহর দিতে পারবে?
আমরাও হেসে বিদায় নিলাম।
ভ্যানে উঠে ঘটলো বিপত্তি।
রকিক ভাইয়ের খাটটা দামী কাঠের।সেটি খুলে ভ্যানে ভরা হয়েছে।খাটের ফ্রেমের লম্বা লম্বা কাঠ গুলো এমন ভাবে রাখতে হয়েছে যে,ওগুলো সামনের প্যাসেন্জারের সীটের মাথার উপর দিয়ে অনেকখানি বেরিয়ে এসেছে।
এখন আমাদের বসতে হলে সামনের দিকে ঝুকে বসতে হবে।অথবা মাথা নিচু করে বসতে হবে।এতো লম্বা পথ এভাবে বসে আসা সম্ভব?
মনির এতে মজা পায়।হাসে।ফাজিল।
রকিব ভাই বলে,
- আমার জন্য না হয় সামান্য কষ্ট করলেই বাবর ভাই।
তা কষ্ট আমি করলাম বটে।
জিনিষ পত্র নামানো তে আর যাতে কষ্ট করতে না হয়-তাই মনির কে বললাম,
- আমাকে কিলবার্ণে আমার ঘরে ড্রপ করে দিয়ে যা মনির।
সে হাসে।বলে।
- আজ না,কাল এনে দিবো।
আমি বলি,
- যদি আজ আমাকে নামিয়ে না দিস তবে তোর সাথে আজই আমার বন্ধুত্ব শেষ।
সে কিছু না বলে হাসে।আমিও আর কিছু বলি না।তবে খেয়াল করলাম সে লন্ডনের পথেই ড্রাইভ করছে।
আমার ঘরের কাছাকাছি আসতেই রকিব ভাই বলে,
- ব্যস্ততার জন্য খেতে পারিনি।এখন খিদায় মরে যাচ্ছি।
আমি কিছু বললাম না।আমিওতো খেতে পারিনি।খিদেয় আমিও তো মরে যাচ্ছি।
রকিব ভাই আবারো কথাটা রিপিট করলো।
এর মানে হলো,সে চাচ্ছে আমি বলি-আসো আমার ঘরে,খেয়ে যাও।
এই ভোর পাঁচ টার সময় আমি সে কথা বলি কি করে?
আমি খোদা হাফেজ বলে ভ্যান থেকে নেমে গেলাম।
রেস্টুরেন্টের ভেতরের গল্প
- ভাতিজা,আইবায় নি ব্যাটা আমার রুমো একবার?
- জ্বী অয় চাচা আইমু।কাপড়টা বদলাইলাই।
- আইচ্ছা রে বাবা।কাপড় বদলাইয়া অউ আও।
আমি কাপড় পাল্টাতে লাগলাম।কাজের।
কাজ শেষ করে,খেয়ে দেয়ে সবে মাত্র থাকার জায়গা-রেস্টুরেন্টের উপরের ফ্লাটে ফিরেছি।সময়,রাত প্রায় সাড়ে বারোটা।
সবাই মিলে ভিডিওতে হিন্দি ছবি দেখবো।নতুন ছবি আনা হয়েছে।’ইলজাম’।শত্রুঘ্ন সিনহা আর গোবিন্দ নায়ক।গোবিন্দের প্রথম ছবি।সঙ্গে নায়িকা নীলম।পোস্টার আর ট্রেইলার দেখে মনে হয়েছে-দারূন একটা ছবি হবে।
আমাদের মাঝে চরম উত্তেজনা।
এরই মাঝে চাচা এসে তাঁর রুমে যাওয়ার জন্য ডাকলেন।আমি ভীষণ বিরক্ত হলাম।কিন্তু প্রকাশ করলাম না।কখনো করিনা।
চাচা বয়স্ক লোক।
বয়স্ক লোকের সাথে যে কোনো পরিস্থিতিতে অসৌজন্য মূলক আচরণ আমার শিক্ষার পরিপন্থী।
কাজেই আমার ছবি দেখায় ব্যাঘাত ঘটলেও,চাচার রুমে আমি যাবো।জানি,দেশ থেকে আজ চাচার চিঠি এসেছে।সে চিঠি তাঁকে পড়ে শোনিয়ে,চিঠির উত্তর একটা লিখে দিয়ে আসতে হবে।
বরাবর আমাকে তা করতে হয়।
এ রেস্টুরেন্টে কাজে আসার পর থেকেই আমি তা করে আসছি।শুধু কি চাচার চিঠি পড়ি আর লিখি?
আরো অনেকেরও চিঠি পড়তে হয়,লিখে দিতে হয়।এ সাহায্যটুকু করতেই হয়।ডে অফের দিন,ঘরে গেলেও অনেকে আসেন-চিঠি লেখাতে!
তারা অনেকে বলেন,
- সকলরে তো আর বিশ্বাস করা যায়না।সব কথা খুইল্লা কওয়া ও যায়না।
চাচা বলেন,
- তুমি রে বাবা,নিরাই ছিরাই মানুষ।সাব্যস্তর মানুষ।তোমার গেছ থাকি কুনু কথা বার অইতোনায়।আর তোমারে যে কুনু কথা একবার কইলিলে খাটাইয়া কুটাইয়া সুন্দর করি লেইখ্খা দিলাও।বড়ো ভালা লাগেরে ফুত।
এমন প্রসংশা পেতে কার না ভালো লাগে!
সুতরাং নিজের সাধ আহ্লাদ জলান্জলি দিয়ে হলেও,নিজস্ব সময়ের অনেকটা আমি তাঁদের সেবায় ব্যয় করি।
আমার মন্দ লাগেনা।
চিঠি নিয়ে আসলে,চিঠির লেখা যতোই দুর্বোধ্য হোক-আমি পাঠ উদ্ধার করে,সুন্দর করে পড়ে শোনাই।
সে সময় চিঠি পত্রের স্বর্নালী সময় ছিলো।
বলা যায় একমাত্র সহজ যোগাযোগের মাধ্যম ছিলো।বেশির ভাগ চিঠিই লেখা হতো এয়ার লেটারে।লেখার বিষয় বস্তু বেশি হলে এয়ার লেটারে স্থান সংকুলান হতোনা।তখন এয়ার লেটারের চারপাশের সামান্য ফাঁকা জায়গায়ও লেখা হতো।সে লেখার আগা মাথা বের করতে বেশ বেগ পেতে হতো।
তাছাড়া হাতের একেকটা লেখা দেখলে,কষ্টে কান্নারও উপক্রম হতো!কি লেখার ছিরি! বাবারে বাবা।
তবে রুলটানা কাগজে,এনভেলপের মাঝে-হঠাৎ হঠাৎ কোনো চিঠি আসলে কিঞ্চিত স্বস্তি পাওয়া যেতো।
আমার কাপড় পাল্টানো হয়ে গেলে,গেলাম চাচার রূমে।
চাচা তাঁর বেডের একপাশ পরিস্কার করতে করতে ব্যস্ত ভাবে বললেন,
- বও,ওখানো বওরে বাবা।
আমি বসলাম।
- চাচার উপরে বিরক্ত অওনি ব্যাটা?
- বিরক্ত অইতাম কেনে চাচা?
তিনি হাসলেন।
- চাচায় যে খালি চিঠি লইয়া তোমারে বিরক্ত করি।
- কিতা যে কইন চাচা!
- হে হে হে,তোমার মতো ভালা,সাব্যস্তর ফুয়া,অউ রেস্টুরেন্টো আর আছে না কিতা?
কথা বলতে বলতে চাচা বালিশের নিচ থেকে চিঠি বের করে দিয়ে বললেন,
- পড়োরে বাবা।
আমি এয়ার লেটারের চিঠি নিয়ে খুব সাবধানে খুলতে লাগলাম।বাংলাদেশের এয়ার লেটার খোলাটাও বিরাট এক ঝামেলার ব্যাপার।তিন পাশ দিয়ে অল্প অল্প করে খুলতে হয়।একটু অসাবধান হলে শেষ!চিঠির অনেকখানি লেখা ছিঁড়ে যাবে।
আমাকে চিঠি দিয়ে চাচা বসলেন তাঁর ট্যাবাকো নিয়ে।বিড়ি বানাবেন।প্রতিদিন রাতে কাজ থেকে ফিরে তিনি বিড়ি বানিয়ে একটা টিনে র চার কুণো কৌটায় রাখেন।পরের দিন একটু পর পর পান করেন।
আমি অনেক্ষণ নিয়ে চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলাম।
চিঠির উপরে লেখা-এলাহী ভরসা।পাশে তারিখ।
‘প্রিয় স্বামী প্রথমে আমার শত কুটি সালাম ও কদমবুসি গ্রহন করিবেন।আশা করি ভাল আছেন।এদিকে আমিও আল্লাহর রহমতে আপনার দোয়ায় সকলকে নিয়ে একপ্রকার আলো আছি।
পর সমাচার এইযে,একটা দুঃখের সংবাদ আপনাকে দিতেছি’
এতোটুকু পড়ে আমি চাচার দিকে তাকালাম।চাচা একটা বিড়ি ধরিয়ে মন দিয়ে শোনছেন।
আমি আবার শুরু করলাম,
‘জানিনা আপনার সহ্য হবে কি না।দুঃখের সংবাদ হইলো আমাদের মেজো মেয়ে সুফিয়া রতনের সহিত পালাইয়া ময়মনসিংহ চলে গেছে’
চিঠি পড়া বন্ধ করে আমি চাচার দিকে আবারো তাকালাম।
তাঁর ফর্সা চেহারা কী রকম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।তিনি বিড়িতে টান দেয়া ভুলে চোখ বড়ো বড়ো করে চিঠির দিকে তাকিয়ে আছেন।যেনো এটি চিঠি না-ভয়ংকর কিছু!
দেশ থেকে চিঠি এলে,সে সময়ের আমরা প্রবাসীরা আনন্দিত হয়ে,পরম মমতায় চিঠিকে নাড়া চাড়া করতাম।পরিবারের আপনজন এসেছে ভেবে,চিঠিকে দেখতাম।
চাচার মতো মুরুব্বিরা তো আরো বেশি মমতার দৃষ্টিতে দেখতেন।
আজ চাচা আমার পড়া শোনে কী রকম হতাশ চোখে চেয়ে রইলেন।
তারপরও আমি পুরো চিঠিটা পড়ে শেষ করলাম।চাচী তাঁর মেয়ের পালিয়ে যাবার বিষয়টা বিশদ ভাবে বর্ণনা করে লিখিয়েছেন।
আমি পড়া শেষ করে চিঠিটা চাচার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।তিনি কিঞ্চিত চমকে উঠে চিঠিটা অনিচ্ছার সাথে হাতে নিলেন।
আমি বললাম,
- এয়ার লেটার দেউখ্খা।
চাচা ভীষণ আনমনা হয়ে আছেন।
বললেন,
- এয়ার লেটার কেনে?
- উত্তর লেখা লাগতো নায়নি?
- উহু,আইজ না ভাতিজা।আইজ না।তুমি অখন যাওগিরে বাবা।আর ইতা কেউর লগে মাইত্ত না।
- কিতা যে কইন চাচা!আমি কেনে মাততাম?
-জানি তুমি মাততায় নায়।
আমি উঠতে উঠতে জানতে চাইলাম,
- কুন্তা মনো করবা না চাচা,এই রতনটা কে?
চাচা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
- আমার বাড়ির চাকররে বাবা।চাকর।
আমি চমকে চাচার দিকে তাকালাম।দেখি তাঁর দু’গাল বেয়ে পানি পড়ছে।বুঝা ই যাচ্ছে-চাচা ভেঙ্গে পড়েছেন।পড়ারই কথা।এই বুড়ো বয়সে যে বাচ্চাদের সুখ শান্তির জন্য প্রবাসে থেকে,প্রচন্ড বিজি এই রেস্টুরেন্টে কিচেন পোর্টারের কাজ করছেন,সেই বাচ্চারা যদি তাঁকে কষ্ট দেয় তা সইবেন কেমন করে?
আমি চাচাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় রেখে এসে’ইলজাম’ছবি দেখায় যোগ দিলাম।কিন্তু মনোনিবেশ করতে পারলামনা।বারবার চাচার কথাই ভাবতে লাগলাম।
এতো বড়ো কষ্টের ধাক্কা এ বয়সে সহ্য করতে পারবেন তো?
না,সহ্য করতে না পেরে,হার্টফেল করে বসবেন?