(এক)
১৯৭৪এর মধ্য ভাগ | ক' দিন পর পরই ঝড়-বাদল | সেদিন ছিল ঢাকার আকাশে ঈশান কোনে কালো মেঘের নোঙ্গর | বিকালের শেষ প্রায় | এই এখনই ঢল নামবে ভাব | জহরুল হক হল হতে লুঙ্গি পরেই চললাম | ব্রিটিশ কাউন্সিলের পাশ কেটে ভি. সি.-এর বাড়ির সামনের বয়স্ক শিরিষ গাছের আবছায়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী মোড় থেকে বাস ধরলাম | জয়দেবপুরের দিকে | প্রবীণ ভল্লুক মার্কা বাস | পথে পথে থামে | নামব খিলক্ষেত | বর্ষার পানি নামে নি তখনও | ডিঙ্গি নৌকায় উত্তর-খানের বরুয়া গ্রাম যাব | গেরস্তের বাড়ীতে রাতে বৈঠক |
শেভ করি নি হপ্তা হল | ইচ্ছে করেই | মুখে দাড়ি | মাথায় টুপী | মিলিটারিদের মত মাথার চুল ছোট ছোট | সময় কঠোর | প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু ' জরুরী অবস্থা' জারির পর আমার এ অবস্থা | সব দল নিষিদ্ধ | ‘জাসদ’-এর উপর খড়গহস্ত | দলটি গোপনে কাজ করতে হয় | সতর্ক হয়ে | কৌশল পালটে | সে অবস্থায় ডাইরেক্ট অ্যাকশন-এর ওপর জোর দেয় দলটি |
চোখ-কান খাড়া রেখে চলতে হত | সেদিন গণবাহিনীর ঢাকার উত্তরপূর্ব জোনের প্রতিনিধি সভা ছিল | তেজগাঁ -বাড্ডা -গুলশান -উত্তরখান দক্ষিনখান নিয়ে | রাতে | কিষান শ্রমিক ছাত্র প্রতিনিধিদের | শফী-মোল্লার বাড়ীতে |
খিলক্ষেত বাজারে নেমে শেষ মাথায় গিয়ে নৌকায় চরলাম, আরও ক’জনের সঙ্গে | সূর্য কমলা রঙিন হয়ে আসছিল, গোধূলিতে | তখন আমার ছায়া আমার চেয়েও অনেক লম্বা জলের উপর | বর্ষায় নৌকা ছাড়া ঢাকার পুবে যাবার আর উপায় ছিল না | বরুয়া আধা ঘণ্টার পথ | অন্যান্য লোকজন কথাবার্তা বলছে - এটা ওটা নিয়ে | প্রকাশ্য রাজনীতি চালু নেই | শহরের-গ্রামের সবাই রাজনীতি বুঝে | বুঝতে প্রচণ্ড আগ্রহী | বুঝলাম, ওরা কাওরান বাজার হতে ফিরছে | সকালে দুধ, তরি-তরকারি নিয়ে যায় | কেহ কেহ কামলা দিতে যায় | মাঝার বয়েসের প্রায় সবাই |
- " শেখ সাব একজন হিমালয়ের মত | যার নামে দেশ স্বাধীন তাঁর কী অবস্থা আজ ! "
- " সে একা কী করবে” । পাশের জন বলছে |
- " ভাল লোকদের কাছে টানলেই তো পারে - "
-"চাটার দল তাকে বন্দী করে রেখেছে | শেখ সাব তাদের সাথে পারছে না | " - দুঃখের সুরে একজন বলল |
মনে হল, গ্রামিকরা আমার চেয়েও কম বুঝে না | আমি চুপচাপ শুনছি | ওরা যাতে মনে করে না যে, আমি ওদের ফলো করছি | আমার চোখ জলময় দিগন্তে | সূর্যে আমার মাথা পিঠ রুদ্রময় | যেন অগ্নিস্নান করছি | ডান হাতে নির্মল জল ছুইছি | শাপলা ছুইছি | পানার নীল ফুল ছুইছি | জলপোকারা কলমি লতাপাতার সবুজ আঁধারে জীবনানন্দে নাচছে | বাতাসের মিছিলে মিটিমিটি ঢেউ খেলছে বিলের জলে | ঢাকা হতে দুরে গিয়ে যেন মোহময় প্রকৃতিতে নিমজ্জিত হলাম | ক্ষণিক।
নৌকায় যাত্রী ভরে গেছে | মাঝি বিড়িতে আগুন ধরিয়ে লগির ধাক্কায় নৌকা ভাসাল | ধনুকের মত বাঁকা তার পিঠ | কালো মলিন চামড়ায় ঢাকা বুকের হাড়গুলো গুনলাম | মনে মনে | জেগে উঠা চোয়ালের ওপর ডুবন্ত চোখ দু’টো হলুদ | জন্ডিস মনে হল | হয়ত ওটা মহামারি দুর্ভিক্ষের রঙ | হয়ত মানে কী (?) - নিশ্চয় |
একটু পরই মজার ব্যাপার ঘটল | মাথার ওপর উড়ন্ত ঝাঁকের এক শ্বেত বক মল ছাড়ল | পরল ঠিক আমার মাথার তালুতে | নম্র -উষ্ণতা অনুভব করলাম |
আঘাত পাই নি | জোরে একটু শব্দ করলাম, হেল্পের জন্য | বোকার মত আঙ্গুল দিয়ে চেক ও করলাম | কেউ মৃদু হাসল |
একজন বলল, "খারান বাই, ধুয়ে দেই | "
মাথা একটু বাহিরে নুইয়ে রাখলাম | এক গোয়াল দুধ বিক্রয়ের মগে উপর হতে দিয়ে জল ঢেলে পরিছন্ন করল | আন্তরিকতায় |
- " ধন্যবাদ ভাই, " বললাম |
- " কোন বিষয়ই না এটা |"
গামছা দিয়ে মাথাটা শুকিয়েও দিল | গামছায় ঘামের নাকি দুধের গন্ধ বুঝলাম না | তবে মানুষের নির্ভেজাল মমত্বের গন্ধ যেন পেলাম। ওদের নিরহংকার সরলতায় সিক্ত হলাম |
পাশের গ্রামের এক মুরুব্বী তাঁর ঘাটে অজু করছিল | নৌকা থেকে দেখলাম | মাগরিব বেশী দুরে নয় | মাগরিব ধরার জন্য প্রাণপণ বইঠা চালাল মাঝি | কিছুক্ষণ পরই বরুয়ার শফীমোল্লার ঘাটে আমাকে নামাল | বাকী দু’জনকে নিয়ে আরও পুবে ডুমনী - ইছাপুরার দিকে গেল |
শফীদের বসত ভিটা অনেক উঁচু | ঘাট থেকে কাদা ভেঙ্গে উঠানে উঠলাম | চারদিকে নানা জাতের গাছ- গাছালি | প্রথম নিঃশ্বাসে কাঁচা গোবরের গন্ধ পেলাম | সচরাচর পাই না তো এমনটা; ভাল লাগল | অনেকটা আমার প্রিয়ই বলা যায় | পাখী কিচির -মিচির করছিল আম গাছে | ডিমওলা মুরগীগুলো শোরগোল করে খুপরী ঘরে ঢুকার আগে | ওদের পুবের ভিটায় বড় ঘরের বারান্দার দু’পাশে দুটি লাস্যময়ী ডালিম গাছ | সূর্যের বিদায়ী আভায় ডালিম কলিগুলু টুকটুকে লাল | পেছনের দিকে ছোট খড়ের লাছ, গোয়াল ঘরের পাশেই |
শফীর বাবা ছাড়া বাড়ীর আর কেহ নামাজ পরে না | জানতাম | কাঠের উঁচা খড়ম পায়ে ঘাটে অজু করতে যাচ্ছিলেন তিনি | আমাকে বসতে বলেন পশ্চিমের বৈঠক খানায় | শফী আসবে একটু পরে | মা বারান্দায় জলচৌকীতে হারিকেন ও কুপি রেডী করছিলেন | মেয়েকে বললেন, সে ঘরের দরজা খুলে একটি হারিকেন পরিষ্কার করে দিতে |
শফীর একটিই বোন |পারভিন | জওয়ান | উঁচা, লম্বা, সুঠাম , পুরুষ টাইপের গড়ন | কর্মঠ | ঘরে- বাইরে গাধার মত কাজ করে | ছয় জনের পরিবার সাত বিঘা জমির ওপর কোনভাবে চলে | স্বাধীনতার পর হতেই দু 'বছর বন্যায় ফসল গেছে | তাই সুদের উপর ঋণ নিতে হয়েছে ; গ্রামের এক নব্য সুদখোর থেকে | সরকারী পার্টির জোরে কালোবাজারি করে রাতারাতি বড়লোক | মেট্রিক পাশও করে নি | চেয়ারম্যান মোজাম্মেলের চামচা |
- "পারু, শফী কোথায় ?"
-"বাই, আদা ঘণ্টার মাঝেই ফিরব | এই মাত্র মাইজপাড়ায় তেমোহনায় গেছে | মেজবান আইব | বয়েন |" স্মিত হেসে বলল |
-" বুঝলাম | একটু জল খেতে দিবে?"
-" অবশ্যই | "
এক লহমায় এলুমিনিয়ামের মাগে ঠাণ্ডা জল আনল; মাটীর কলসি হতে | ও ঘোড়ার মত চলে | শুনেছি, গ্রামের সণ্ডা-বদমাইশরা ভয়ে পারুর কাছেও ভিড়ে না | আগ্রাসীর মত চড়া গলায় কথা বলে, রাগান্বিত হলে |
আমার থেকে এক মুষ্টি লম্বা | এক কথায়, পারু একেবারে গুণ্ডির মত | গুন্ডারা ওকে একটু হিসাব করেই চলে | বেকার সণ্ডা-গুণ্ডাদের গ্রামের অন্যান্য মেয়েরা ঘরের ভেতরও নিরাপদ না | অগত্যা সন্ধ্যার পর জরুরী প্রাকৃতিক কাজে পরুষ সাথে নিয়েই ক' মিনিটের জন্য বের হতে হয় | দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা একেবারেই নেই |
সে উঠান হতেই ইশারায় ভেতরের হাতা-ভাঙ্গা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলল | অন্ধকার বৈঠক ঘর | সন্ধ্যাবাতি তখনও দেয়নি | কেরোসিনের বাজারে আগুন | মূল্য চড়া |
ব্লাউজ ছাড়াই শাড়ী পরা সে | কোন কোন পাহাড়ি মেয়েদের মত | সুতী শাড়ী | রঙ ও প্রিন্ট দেখে বুঝলাম ভারতীয় | কালোবাজারের | গরীবরা উপায় না পেয়ে ধুমসে পাগলের মত কিনছিল এ সব | সস্তা | মান নিম্ন | দেশীগুলু ভাল, দাম বেশী | কারণ পার্টীর চামচারা কাঁচামাল সব চোরাকারবার করে, ক্যাডাররা তাঁতিদের কাছে চাঁদাবাজি করে |
শাড়ীর আয়তনে পারুর শরীর কাভার হচ্ছিল না | শাড়ী তার পায়ের ঘণ্টার কয়েক আঙ্গুল উপর পর্যন্ত | ওপরে মাত্র দের প্যাচ | নজরটা সহজেই ওর মাংসল বুকের উপর গেল | উদ্যত বাম স্তন উদোম | কালো বুটাও দৃশ্যমান | তরতাজা, শানিত স্তন | ওর ওসব খেয়াল নেই | আমার সাথে পারু এমনই চলে | বছর আগে পরিচয়ের পর হতেই | ও হয়ত ভাবে, আমরা অন্য রকমের মানুষ, আদর্শগত ভাবে | কম্যুনিস্ট। গরীবের বন্ধু | বা অন্য কিছুও ওর মনে হতে পারে |
ঐ যে বললাম ঘোড়ার মত - , এক সেকেন্ডে হারিকেন নিয়ে এলো বড় ঘর হতে | দরজার পাশে মেজের উপর রাখল | ভীতরে প্রবেশ করল না |
আমি কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না | মুহূর্তের জন্য।আদর্শ, মজদুর, বিপ্লব – এ সব কথা কর্পূরের মত উবে গেল।তখন পারুই যেন আমার মগজ দখল করল | হেলুছিনেশনের মত | আমার হাবভাব দেখে পারু বুঝতে পারল |
-" আর কিছু লাগবে ?" চোখে চোখ রেখে আমাকে জিজ্ঞাস করল |
-" না, না | আজ না |" স্মিত হেসে, ওর বুকের উপর চোখ রেখেই বললাম | আমার অন্যমনস্কতা পারু বুঝতে পারল | শে স্মিত হেসে শাড়ীর আঁচল দিয়ে বুক ঢাকল | কিছুই বলল না | চলে গেল | বুঝলাম, আমার মত শে একটু পুলকিত | ওর মা কিন্তু আমাকে লাইক করে, বিশ্বাস করে - তা বুঝেছিলাম |
রান্না ঘর হতে একটু পরেই ফিরে এসে বলল, " বস , বাই আইলেই ভাত দেব |" চট করেই 'আপনি' থেকে 'তুমি' তে চলে গেল শে |
-" ভুখ নাই, সন্ধ্যায় ভাত খাই না, তুমি তো জান |"
-" আট- দশ জনের খাবার পাক করতে বলেছে | খেয়ে সবাই বাহিরে যাবে | "
-" জ্যোৎস্না রাতে আমি ভাত খাই না |" এমনিতেই বললাম | সুপ্ত দুষ্টামিতে | হয়ত বুঝল |
-" ঐ রাতে কী রোজা রাখ ?" চৌকাঠের বাহির থাকেই জিজ্ঞাস করল | দুষ্টামি করে |
-" না, শুধু তরল কিছু খাই |"
-" জল?"
"দুধ | নয়তো - জলে মধু আর লেবুর রস মিশিয়ে |"
-" ছাগলের নাকি গরুর দুধ ? "
-"বাঘিনীর" | উভয়ই হাসলাম | যে যা বুঝার বুঝলাম | ও পুবের ঘরের দিকে তাকাল | মাথা নিচু করে আমাকে ঠেলে বৈঠক ঘরে ঢুকল | জানালার পাশে দাঁড়াল | আবছায়ায় | শে বুকের শাড়ী গুছাল | আমি মুখো-মুখী দাঁড়ালাম | উভয়ই চুপচাপ | মিনিটের মত | অ আমার মুখের উপর চোখ গেঁথে রাখল | সাহসটা অ- ই আগে দেখাল | দুঃসাহস |
বুকের শাড়ী সরিয়ে দিল | হৃদকম্পন বেড়ে গেল | আমার দু' হাতের তালু হঠাৎ ঘেমে গেল | গলা শুকিয়ে গেল | কয়েক বার নিজকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে নিলাম, কোনভাবে | আমি ওর কপালে মুহূর্তের জন্য চুমু দিলাম | মনে হলে বিশ্বে ভূমিকম্প হচ্ছে | আমার জীবনে কোণ মেয়েকে প্রথম চুম্বন করলাম |
পারু আমায় আলিঙ্গন করে মাথা আমার বুকে রাখল | অনেকটুকু সাহস পেলাম তাতে | দু' হাত জড়িয়ে প্রলম্বিত আলিঙ্গন করলাম | মুখে চুমো খেলাম | কয়েকবার | কিভাবে ভাল চুমু খায়, জানতাম না | তৎক্ষণাৎ, আত্মসংযম করে নিজকে সরিয়ে নিলাম |
নিজের কাছেও আমি পরিষ্কার ছিলাম না | এ আমাদের নির্মল প্রেম নাকি অন্য কিছু ? পারুর প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল, এটা ঠিক | সে সরল মেয়ে | ভিতরে প্যাচ- গোচ কিছুই নেই | কয়েক মাস হয়, নিবিড়ে তার সাথে টুক - টাক কথা হত | কখনো মনে হয় তার শরীরই প্রধান আকর্ষণ | আমার প্রতি তার কেন বা কী আকর্ষণ - তা বুঝি না | আমি ইউনিভার্সিটি ছাত্র, শহরের, সমবয়সী - তাই ? এ অবস্থায় আমরা দুজন কী জৈবিকতায় লিপ্ত হতে পারি ? আইনের ও ধর্মের চোখে অপরাধী হব, যদি সেটা করি আমরা | তাই না ? #